গর্ভ যন্ত্রণা 

  • 04 December, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 599 view(s)
  • লিখেছেন : মীরা কাজী
আহ! জিরে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে মুগডাল রান্নার গন্ধ পাচ্ছে সুভদ্রা। ডাল মেখে দুটো ভাত খেতে ইচ্ছে করছে তার। মুখের ভিতর লালা জমে উঠছে। অমন ডাল মেখে গরম ভাত কতকাল খাওয়া হয়নি। ঠাণ্ডা ভাতের দলা মুখে রোচে না। কিন্তু সে টুকুও আজ কেউ তাকে খাইয়ে দিতে আসছেনা। তাকে কি সবাই ভুলে গেল? এক বৃদ্ধ মায়ের শেষ জীবনের পরিণতি ফুটেছে এই গল্পে।

 (১)

শরতের আকাশটায় “কুড়ুলে কোদালে” মেঘ জমা হয়েছে। বোধ হয় বৃষ্টি আর হবেনা। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মেঘের গড়ন দেখে বৃষ্টির আনাগোনা প্রায় নির্ভুল ভাবে বলে দিতে পারত সুভদ্রা। এখন পারেনা। পারার কথাও নয়। বয়সের সাথে সাথে শরীরটার মত তার চিন্তাশক্তিও কুঁকড়ে মুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেছে। মনের গতিবিধিও এখন তার আয়ত্তে থাকেনা। ঝাপসা হয়ে আসা টুকরো টুকরো স্মৃতি শরতের মেঘটার মত তার মনের আকাশে যখন তখন ভেসে ওঠে।

 উঠোনে তার নিজের হাতে পোঁতা পেয়ারা গাছের তলায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সুভদ্রা। কিছুক্ষণ আগেও পেয়ারা গাছের ছায়াটা তার শরীরে জড়িয়ে ছিল। এখন সেটা সরে গেছে। আশ্বিনের রোদের তাত সরাসরি এসে তার গায়ে লাগছে। পিঠটা জ্বালা জ্বালা করছে। অন্যদিন এই সময়টায় কেউ না কেউ এসে তাকে তার ঘরে তুলে দেয়। আজ কেউ আসছে না।

কেউ একজন আসছে। উৎকর্ণ হয়ে ওঠে সুভদ্রা। এবার নিশ্চয় তাকে তার ঘরে তুলে দেবে। নিজের বিছানাটির জন্য আকুল হয়ে ওঠে সে। সুভদ্রাকে নিরাশ করে পায়ের শব্দটি মিলিয়ে যায়। খুব জলতেষ্টা পেয়েছে তার। আগে আগে মাটির কুঁজোয় জল ভরে রাখত সুভদ্রা। রান্নাঘরে মাটির মেঝেয় গোল গোল গর্তে ভিজে বালির ওপর বসানো থাকত জলভরা কুঁজোগুলো। আহ্ কি মিষ্টি সে জল! তেমন এক ঘটি জলের জন্য প্রাণটা হাহাকার করতে থাকে।

 সুভদ্রা ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে বোঝার উপায় নাই। কোটোরাগত চোখদুটি টিপে বন্ধ করা। চোখ মেলে দেখার সাধ বুঝি তার ফুরিয়েছে। এখন যা কিছু দেখাশোনা সব ভেতরে ভেতরে। নিচ্ছিদ্র ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে না সে। চেষ্টা করেও পারে না। দিনের বেশির ভাগ সময়ে তন্দ্রা আর জাগরণের মধ্যে অবস্থান করে। অবশ্য তন্দ্রার মধ্যে থাকতেই পছন্দ করে সে। তন্দ্রা কেটে গেলে অস্থির অস্থির লাগে। সেই সময় বাড়ির মানুষের কথাবার্তা হাঁটাচলা থেকে কিছু কিছু টের পায় সে। যেমন এই মাত্র সে টের পেলতার মেজছেলে দীপুর মেয়ে মানি তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেল।

 বাড়ির প্রত্যেকের পায়ের শব্দ সুভদ্রার চেনা। তার বড়ছেলে শুভো পা ঘষটে ঘষটে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে গলা খাঁকারি দেওয়া তার অভ্যাস। আবার মেজছেলের পায়ের আওয়াজ খুব ভারি। হাঁটলে দুম দুম আওয়াজ হয়। ছোটজন অর্থাৎ তীর্থ হাঁটে হেলে দুলে। তার পা পড়ে এলোমেলো ভাবে।

 তীর্থর ছোটছেলেটা হামাগুড়ি দিয়ে সুভদ্রার কাছে চলে আসে। গায়ে থাপ্পড় দেয়। সুভদ্রার বেশ লাগে। এটাকে সে কোলে পিঠে করতে পারেনি। বাকি নাতি নাতনিরা সবাই তার কোলে কাঁখে বড় হয়েছে। আজ সেও আসছেনা। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে।

 আহ! জিরে তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে মুগডাল রান্নার গন্ধ পাচ্ছে সুভদ্রা। ডাল মেখে দুটো ভাত খেতে ইচ্ছে করছে তার। মুখের ভিতর লালা জমে উঠছে। অমন ডাল মেখে গরম ভাত কতকাল খাওয়া হয়নি। ঠাণ্ডা ভাতের দলা মুখে রোচে না। কিন্তু সে টুকুও আজ কেউ তাকে খাইয়ে দিতে আসছেনা। তাকে কি সবাই ভুলে গেল?

 উঠোনের রোদে তেতে ওঠা শরীরটা জুড়োতে যে ঘর, যে বিছানাটির জন্য লালায়িত হচ্ছে সুভদ্রা, সেই ঘরটিতে এখন ঝাড় পোঁছ চলছে। তার তিন বৌ কোমরে কাপড় জড়িয়ে কাজে নেমেছে। হাতে সময় বেশি নাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাড়াটেরা এসে পড়বে।

ওই তো অতটুকুনি একটা মানুষ! বিছানার একটেরে পড়ে থাকে। তার জন্য অত বড় একটা ঘর ফেলে রাখা যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছেনা তাদের কাছে। বরং ভাড়াটে বসালে দু পয়সা আয় হবে। তাছাড়া  আজ বাদে কাল শ্রাদ্ধ শান্তির জন্য গুচ্ছের টাকা বার করতে হবে। ভাড়ার টাকাটা জমিয়ে রাখলে সে সময় কিছুটা কাজ দেবে।

তীর্থর বৌ নমিতার মাথায় যুক্তিটা প্রথম আসে। অন্য জাদের বললে তারা তার বুদ্ধির তারিফ না করে পারে না। সুভদ্রার ছেলেরা প্রথমে এই প্রস্তাবে  রাজি হয় না। “তা কি করে হবে? মা চিরটাকাল এই ঘরে থেকেছে। কটাদিনই বা বাঁচবে? মারা গেলে তখন না হয় ভাবা যাবে”। কিন্তু নিজেদের মতামত বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না তারা। তিন বউ এর যুক্তির তোড়ে তাদের মিনমিনে যুক্তি খড় কুটোর মত ভেসে যায়।। শেষমেশ তিন ভাই একজোট হয়ে ভাড়াটে খুঁজতে শুরু করে।

বড়দা! মাকে তাহলে আপনার ঘরেই তুলে দি? প্রথম দশদিন আপনার ঘরেই থাকুক। তারপর মেজদার পালা, শেষে আমাদের। আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তীর্থর বউ নমিতা বলে।

আমার ঘরে? না মানে, হয়েছে কি, মেয়ে দুটো বরাবর তো মায়ের ঘরেই শুতো। এখন মা বিছানা নোংরা করে ফেলে। তাই কিছুদিন থেকে আমদের ঘরে মেঝেয় বিছানা করে শুচ্ছে। তাই ভাবছি, মা শোবে কোথায়? শুভো আমতা আমতা করে।

এ আর কি এমন সমস্যা! বুলি,টুলিকে খাটে আপনাদের  কাছে নেবেন। আপনাদের খাটটাতো বেশ বড়ো। মা থাকবেন মেঝেয়। মাসে দশটা দিনের পালা। যেমন করে চালিয়ে তো নিতেই হবে। নমিতা স্পষ্ট করে বলে।

তা তো বটেই, কিন্তু আমার ঘরটা তো ছোট। এই গরমে ঠেসাঠেসি করে শোওয়া! তাই বলি কি,এখন তোদের দিকেই ব্যবস্থা কর। ঠাণ্ডা পড়লে তখন নাহয়----। ছোট দুই ভাই এর দিকে মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তাকায় শুভো।

শুভো ভুল কিছু বলেনি। তার ঘরখানা সত্যিই ছোট। দক্ষিণমুখো তিনখানা ঘরের দু পাশের দুটো ঘরে দীপু আর তীর্থ থাকে। আর মাঝখানের বড় ঘরটায় এখন সুভদ্রা একাই থাকে। এই ঘরটা বাড়তি যত্ন নিয়ে বানিয়েছিল ওদের বাবা শংকর। ইচ্ছে ছিল বড় ছেলেকে দেবেন। গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান শেষ হলে দেখা গেল, তিন ছেলেই মনে মনে মাঝের ঘরখানাকেই নিজেদের জন্য পছন্দ করে রেখেছে। শেষে কি ঘর নিয়ে ছেলেদের মধ্যে বিবাদ হবে? তখন ওদের বাবা শংকর নিজেদের জিনিসপত্র মাঝের ঘরে রেখে দিলেন। মেজ আর ছোট দুপাশের দুটি ঘর দখল করল। বড়র ভাগে পড়ল এককোণের ঘরখানা। পশ্চিমমুখো হওয়ার কারনে অন্য ঘরগুলোর তুলনায় ওই ঘর খানায় গরম একটু বেশি। কিন্তু সুভদ্রার তাতে কি কিছু এসে যেত? বরং একঘরে সবার সাথে শুতে পারলে তার ভালই লাগত। কিন্তু এখানে তার চাওয়া পাওয়ার মুল্য আছে কি? যেখানে তার উপস্থিতিটাই বাড়ির লোকের কাছে বিড়ম্বনা স্বরূপ! এই উপস্থিতিটা ছেঁটে দিতে পারলেই এখন তারা বেঁচে যায়।

 (২)

এই সংসারে যখন এসেছিল সুভদ্রা, তখন কতই বা বয়স তার? বড় জোর পনেরো। বিয়ের দু বছরের মাথায় তার কোলে এল শুভো। শুভোকে তার ঠাকুমাই সামলাতেন। কেবল ঘুমোনোর সময়টুকু থাকত সুভদ্রার কাছে। সেটুকুতেই তার নাকানি চোবানি অবস্থা! ছেলে কিছুতেই ঘুমোয় না। কেবলই হাত,পা ছুড়ে কাঁদে।শাশুড়ি ধমকে ওঠেন, “ছেলে কি করে ঘুম পাড়াতে হয় তাও কি তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিতে হবে? ছড়া বল, গান কর। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে ছেলে ঘুমোয় কখনও?”

   শাশুড়ির কাছে ধমক খেয়ে কাতর হয়ে পড়ে সুভদ্রা। সেই মুহূর্তে কোন গান, কোন ছড়া তার মনে আসছে না। কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তোলা ছেলের পিঠে থাপ্পড় দিতে দিতে নিজেই কাঁদতে শুরু করে সে। হঠাৎ বাবার মুখে শোনা একটি ছড়া তার মনের কোনে গুনগুনিয়ে ওঠে। সুভদ্রার বাবাদের কালে পাটিগনিত অংক শেখার জন্য একটি সুত্র মনে রাখতে হত। যেটিকে বলা হত শুভঙ্করী আর্য্যা বা শুভঙ্করী সূত্র। বালিকা সুভদ্রাকে তার বাবা সেই সূত্রটি সুর করে গেয়ে শোনাতেন। সেটিকেই বাবার মত করে গাইতে শুরু করে সে “কুড়োবা কুড়োবা কুড়োবা  লিজ্জে/ কাঠায় কুড়োবা কাঠায় লিজ্জে/ কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমান/বিশ ধুলে হয় কাঠার প্রমান/ধূল বাকি থাকে যদি কাঠা নিলে পরে/ষোলো দিয়ে পুরে তারে এক গণ্ডা ধরে”। সুভদ্রার খোকার কান্না থামে। সে ঘুমিয়ে পড়ে। সুভদ্রা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এবার থেকে এই ছড়াটি সুর করে গেয়ে খোকাকে ঘুম পাড়ায় সে। আর খোকাও হয়েছে তেমনি? এই ছড়াটি গাইলেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। মা ছেলের কাণ্ড দেখে শংকর মজাপায়।

হ্যাঁগো! খোকার যে এখনও নাম ঠিক হলনা? খোকাকে বিছানায় শুইয়ে শঙ্করকে শুধোয় সুভদ্রা।

 ওর নাম তো ঠিক হয়েই আছে? মুচকি হেসে শঙ্কর বলে।

 কি নাম? কৌতূহলী চোখতুলে স্বামীর দিকে তাকায় সুভদ্রা।

 শুভঙ্কর।

 শুভঙ্কর!

যে ছেলে শুভঙ্করী ছড়া না শুনলে ঘুমোয়না তার নাম শুভঙ্কর ছাড়া আর  কি হতে পারে? কেন নামটা তোমার পছন্দ হয়নি?

লাজুক হাসে সুভদ্রা।

 খোকার নাম হল শুভঙ্কর। ছোট করে শুভো। কয়েক বছরের মধ্যে সুভদ্রার কোলে পর পর আরো দুজন এল। বড়র সঙ্গে মিলিয়ে তাদের নাম রাখা হল দীপঙ্কর আর তীর্থঙ্কর। ছোট করে দীপু আর তীর্থ।

আচ্ছা! দুপুর কি গড়িয়ে গেল? পিঠের জ্বালা ভাবটা আর নাই। ক্ষিদেটাও মরে গেছে। কেবল গলাটা শুকিয়ে উঠেছে। আজ সারাদিন সে কি কিছু খেয়েছে? মনে করতে পারেনা সুভদ্রা। শরীরের কোনখানে একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। পাশ ফিরতে চেষ্টা করে বিফল হয় সুভদ্রা। শক্ত মাটিতে তার হাতটা ঘষটে যায়। বিছানাটা কোথায় গেল? নিজের বিছানাটি  খুঁজে না পেয়ে  খুবই কাতর হয়ে পড়ে সুভদ্রা। সে তার ছেলেদের ডাকতে থাকে। তার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বের হতে থাকে।

  সুভদ্রা যখন তার ছেলেদের আকুল হয়ে ডাকাডাকি করছে, তখন তার ছেলেরা পেয়ারাতলায় সুভদ্রার জন্য ঘর তৈরির তদারকি করছে। দুজন লোক সুভদ্রাকে  মাঝখানে রেখেই দড়িদড়া বাঁশ খোঁশ নিয়ে বাঁধাবাঁধি করছে। সবাই মিলে আলোচনা করে সুভদ্রার জন্য এই ব্যবস্থাই স্থির করেছে। কি দরকার! আধমড়া মনুষটাকে নিয়ে এঘর ওঘর টানাটানি করার? যে কটা দিন বাঁচে এক ঠাঁইএ থাকুক।

 দেখিস? ঘরটা যেন একটু বড়সড় হয়। কাউকে না কাউকে এক আধবার ঢুকতে তো হবে?

 ত্রিপলটা আঁট করে বাঁধিস। বৃষ্টির ছাঁট যেন না আসে।

 চটপট হাত চালা সন্ধ্যে যে হয়ে এল?

ঠিকমত হুঁস থাকলে সুভদ্রা বুঝতে পারত, তার সুবিধে অসুবিধে নিয়ে তার ছেলেরা কতটা চিন্তিত।

   রাতে সুভদ্রার ছেলেরা যে যার ঘরে শুতে চলে যায়। উঠোনে নতুন তৈরি চালা ঘরে আছন্নের মত পড়ে থাকে সুভদ্রা। তার চতুর্দিকে কেবল ধোঁয়া আর ধোঁয়া। এত ধোঁয়া এল কোত্থেকে বুঝে উঠতে পারেনা সুভদ্রা। কুন্ডলীকৃত সেই সব ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ছবি তৈরি হতে থাকে। একটা ছবি স্পষ্ট হতে না হতেই ধোঁয়ার স্রোত এসে সেটিকে ভেঙ্গে দেয়। তখন আবার অন্য ছবি আদল পেতে শুরু করে। কষ্ট করে সেই সব ছবি দেখতে থাকে সুভদ্রা।

 একটি বউ পিঠে চাবির গোছা ঝুলিয়ে, নিজের সংসারে ব্যস্ত। তিনটি নাবালক শিশু তার পায়ে পায়ে ঘুরছে। বউটি কি সুভদ্রার চেনাকেউ? হবে হয়ত? এক বাটি দুধ হাতে সে একটা ঘরে ঢুকল। সেখানে এক জন বৃদ্ধা শুয়ে আছে। “মা! দুধটুকু খেয়ে নিন তো?  খাবনা বললে শুনব না। লক্ষী মেয়ের মত হাঁ করুন দেখি?” বৃদ্ধার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বউটি। ছবিটা মিলিয়ে যায়।

ওই মাঝবয়সী মহিলাটি কে? পরনে সাদা থান। একথালা ভাত হাতে নিয়ে কাকে যেন সাধাসাধি করছে? “বড় বৌমা! ওঠ দিকিনি বাছা! অমন মুখ গুঁজে পড়ে থাকলে পেটেরটা যে শুকিয়ে যাবে? নেবুর জারক মেখে ভাত এনেছি। দুটো মুখে দাও। এক মাথা চুলের কি ছিরি করেছ? ওঠ, চুল কটা বেঁধে দিই”। ছবিগুলো ক্রমশঃ অস্পষ্ট হতে হতে এক সময় সুভদ্রার চোখে আর ধরা পড়ে না। তখন কেবলই ধোঁয়া।

রাত তখন কটা হবে কে জানে? আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। নতুন ভাড়া করা ঘরে কিছুতেই ঘুম আসছেনা সুপর্নার। “হ্যাঁগো! বুড়ো মানুষটা ভিজে যাচ্ছেনা তো?” স্বামী অলোককে ডাকে সে।

 ভিজতেও পারে। অলোকেরও ঘুম আসেনি। সে জেগেই ছিল।

 ছেলেদের ধরন ধারন দেখ? বুড়ো মাকে উঠোনে ফেলে রেখে নিজেরা ঘরে খিল এঁটে ঘুমুচ্ছে?

 পাষণ্ড! কিন্তু তুমি আমি কি করতে পারি বল? ঘুমিয়ে পড়। অলস ভঙ্গিতে বলে অলোক।

যার ঘর সে পড়ে থাকল উঠোনে,আমরা তার ঘর দখল করে নিশ্চিন্তে ঘুমুই কি করে বলতো?

দখল করলাম কোথায়? ভাড়া নিয়েছি। ওনার ছেলেদের হাতে টাকা গুনে দিয়েছি।বিরক্তির স্বরে বলে অলোক।

সে যাকগে। এখন এক কাজ করলে হয়না?

কি কাজ?

ওনাকে এই ঘরে তুলে আনি।

তা কি করে হবে? ওনার ছেলেরা কিছু ভাবতে পারে।

উঠোনে পড়ে পড়ে ভিজছে, তাতে যাদের হুঁস নাই? তাদের আবার ভাবা ভাবি? সারাজীবন মানুষটা এই ঘরে কাটিয়েছে। শেষ সময়ে সে উঠোনে ভিজে মরবে, আর আমরা তার ঘরে আরাম করে ঘুমুবো? এতে আমাদের অকল্যাণ হবে না?

 সুপর্না ও অলোক দুজনে মিলে সুভদ্রাকে তুলে এনে নিজেদের বিছানায় শুইয়ে দেয়। সুভদ্রার গা তখন বরফের মত ঠাণ্ডা। মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে। ভিজে কাপড়চোপড় থেকে মুক্ত করে, নিজের শাড়ি দিয়ে তাকে ঢেকে দেয় সুপর্না।তারপর সুভদ্রার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে বলে, “ কষ্ট হচ্ছে? জল খাবে? ”বলা বা শোনার মত অবস্থায় নেই সুভদ্রা। তার তখন গর্ভ যন্ত্রণা উঠেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। কে যেন বলছে, “আর একটু সহ্য কর। তোমার কোলে সন্তান আসছে যে”। “আর পারছিনা- আ-আ!”ককিয়ে ওঠে সুভদ্রা। সুভদ্রার মুখের কাছে কানটা নামিয়ে আনে সুপর্না।মানুষটা বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। শোনার চেষ্টা করে সে।

 চাপ চাপ কষ্টের ডেলাটা ক্রমশ গলে যাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে সুভদ্রার। কিন্তু সে এখন ঘুমোয় কি করে? তার খোকা যে ঘুমুচ্ছেনা? কি যেন সেই ছড়াটা? কিছুতেই মনে আসছে না। অস্থির হয়ে ওঠে সুভদ্রা।

 

লেখক : গল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

                             

                                     

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment