বিলকিস যেন এ লেখা না পড়ে!

  • 28 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 394 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
কবিত্ব এখানে শ্মশানযাত্রী হয়েছে। সাহিত্যকে চুল্লিতে পাঠাও। এক অবাক বধিরতায় ডুবেছে দেশ। এক অপার নীরবতায় আমরা নিমজ্জিত হয়েছি। সেই নীরবতা প্রতিবাদের সমার্থক নয়। সেই নীরবতা আমাদের পরাজয়ের বার্তাকেই বহন করে এনেছে। সেই নীরবতা অবসানের নীরবতা, শূন্যের নীরবতা। সেই নীরবতা থেকে আর কোনও কিছুরই জন্ম হবে না কোনওদিন।

‘আইন—সে একটা তামাসা মাত্র—বড় মানুষেই খরচ করিয়া সে তামাসা দেখিয়া থাকে’ – একথা বলেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে। সেই সময় পেরিয়ে আমরা অনেক বছর কাটিয়ে এসেছি। একশো বছরেরও বেশি সময় বোধহয়। কিন্তু সেই উক্তির সত্যতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। চিরন্তন হয়ে সে থেকেছে, আজও, এখনও – আমাদেরকে লজ্জিত করেই সেই উক্তি চিরসত্যের রূপ ধারণ করেছে।

 

হ্যাঁ, বিলকিসের কথাই বলব। লজ্জা আমারও যে, ঘটনার প্রায় ১০দিনেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছে। আজাদির অমৃত মহোৎসবের পুণ্য(?) মুহূর্তে যে ন্যক্কারজনক ঘটনার সূত্রপাত, তার প্রতিক্রিয়াতে লিখতে গিয়ে পরে সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছে। দেশজুড়ে মৃদুস্বর অথবা জোরালোতে হলেও, অল্পবিস্তরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ শুরু হতে পেরেছে। বিবেক কি জেগেছে তাহলে? ৭৫ বছরের ন্যুব্জতাকে কাটিয়ে আমরা কি অবশেষে ৭৫এর যৌবনকেও ফিরে পেতে চেষ্টা করেছি? এককথায় করিনি। পারিওনি কখনও। বিশেষ কিছু মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী বা সংগঠনের বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ! এইটুকুই কি প্রাপ্য ছিল বিলকিসের?

 

সবচেয়ে বড় কথা ব্যক্তি বিলকিসের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির চেয়েও আরও বড় কিছু এই ঘটনার আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে। বিলকিস যে নৃশংসতার স্বীকার হয়েছিল, সেই ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তির কোনও প্রয়োজন দেখছি না। সে খবর আপনারা সকলেই কাগজের পাতায় অথবা মোবাইলের পর্দাতে অনেক-অনেকবার স্ক্রল করে করেই হোক অথবা উলটিয়ে পালটিয়ে যে করেই হোক দেখে নিতে পেরেছেন। প্রশ্ন হলো, গুজরাত হোক বা হিমাচল, হিন্দু হোক অথবা মুসলমান –একজন গর্ভবতী নারীকে গণধর্ষণের মতো হীন কাজে অভিযুক্ত যে মানুষ, বা যে দল বা যে সকল – তাদেরকে কেবল যে আইনের মাধ্যমে খালাস করে দেওয়া হলো তাই নয়, আইনপ্রণেতারা একেকজন তাদেরকে সংস্কারী বললেন, মালা পরালেন, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলেন। উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন যেগুলি তাদের পুরনো সঙ্গীদের ফুলমিষ্টি-সহযোগে বরণ করে নিলে, তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেও রুচিতে আটকে যায়। তাদের প্রসঙ্গে শব্দব্যয় করাটাও অপচয় বলে মনে হয় আমার। কিন্তু যে আইনপ্রণেতারা এমন একেকজনের সপক্ষে তাদের ‘ক্যারেকটার সার্টিফিকেট’ দিলেন, যে বিচারক তাদের খালাসের হুকুমনামাতে সই দাখিল করলেন, যে আইনপ্রণেতা সংবাদমাধ্যমের সামনে বয়ান দিয়ে পরে জানালেন, “ব্রাক্ষ্মণ তারা, একাজ তারা করতেই পারে না (নাকি বলতে চাইলেন একাজ করলে পরেও তাদের ‘দোষ লাগে না’)” সেই সব মানুষদের উদ্দেশ্যেও তো অন্তত শব্দব্যয় করা প্রয়োজন। খাতায় কলমে, সরকারি ভাবে তাঁরা আমাদের সংবিধানের রক্ষক ও বাহক। স্বাধীনতা দিবসের ৭৫তম বছরে, ঠিক সেই দিনটিতেই, এমন মহোত্তর একটি উপহারকে দেশবাসীর হাতে তুলে দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা যে অন্তত ভাবতে পেরেছেন, এতটুকু বুঝতে গেলে পরেও শিহরিত হতে হয়। এই লজ্জা কোথায় লুকোব?

 

হাথরাস, কাঠুয়া, উন্নাও – অথবা নির্ভয়ার ইতিহাস, এদেশে নারীর ইজ্জত লুণ্ঠনের ইতিহাস পুরনো। কিন্তু যে প্রসঙ্গে আলোচনার অবকাশ রয়েছে, নির্ভয়ার জন্য যেখানে লাখো মানুষের মোমবাতি মিছিল সম্ভব হয়েছিল, নতুন ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে সেই উদ্দীপনাতেই কেমন যেন একটা ঘাটতি, একটা ক্লান্তি ভাব, আমাদের চোখে পড়ছে না তো? আমরা যেন সমস্ত ঘটনাকেই রাজনৈতিক (অথবা ‘ধর্মীয়’) একটা চশমার মধ্যে দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছি। আমরা এখন পরিণত হয়ে, ভেবেচিন্তে, ধীরেসুস্থে, চা-পপকর্ন সহযোগে, মার্জিত রুচিতে, পরিশীলিত প্রতিক্রিয়ার উপরেই বিশ্বাস রাখতে চেষ্টা করে চলেছি। আসলে বয়সটাও তো কম হলো না আমাদের, সেই ৭৫ – কম বয়স নাকি!

 

আমাদের শিরদাঁড়ার জোর কমেছে। যে কারণে ওই একই সময়ে, সামান্য একটু আগেপরেই যখন আরেক ৭৫বছর বয়সী প্রবীণ নাগরিক সলমন রুশদির উপর মৌলবাদীদের আক্রমণ নেমে এল, আমরা তখনও ধীরেসুস্থে প্রতিক্রিয়া দিতে চেয়েছি। ব্যস্ততা অথবা ক্লান্তির অজুহাতে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে চেয়েছি। ঠিক তেমনই আজাদির উল্লাসের গর্জনেই চাপা পড়ে গিয়েছে বিলকিসের আর্তনাদ। আমরা গণধর্ষকদের মুক্তির উল্লাসকেই আজাদির উল্লাস বলে ভাবতে চেয়েছি। সংবিধানকেও মিথ্যে বলে মনে করতে ইচ্ছে হয়েছে তখন। এই আমাদের নয়া ভারত। এই ধর্ষকদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না!

 

এই ধর্ষকদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না!

 

শুনছে কেউ? কেউ বা পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে? কবিত্ব এখানে শ্মশানযাত্রী হয়েছে। সাহিত্যকে চুল্লিতে পাঠাও। বিলকিস, গুজরাত, ইসলাম, অথবা হিন্দু – এই সমস্ত কিছুকে বিস্মৃত হয়েও, এখন কেবল চিৎকারের সময়। নিষ্ফল চিৎকারের সময়। যেমন ভাবে আমরা চিৎকার ভিন্ন আর কোনও কিছুই করতে পারিনা। অতীতে তবু আমাদের চিৎকারের জোর ছিল। আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকারে শামিল হওয়ার প্রয়োজনেও আরও কিছু মানুষ ছিল। মুখ ছিল। এখন ক্রমশ বধিরতা আমাদেরকে গ্রাস করে নিয়েছে। আমরা চারপাশে তাকাই, দেখতে পাই না কোনও কিছুই। শুনতে পাই না কোনও কিছুই। কেবল এক অবাক বধিরতায় ডুবেছে দেশ। এক অপার নীরবতায় আমরা নিমজ্জিত হয়েছি। সেই নীরবতা প্রতিবাদের সমার্থক নয়। সেই নীরবতা আমাদের পরাজয়ের বার্তাকেই বহন করে এনেছে। সেই নীরবতা অবসানের নীরবতা, শূন্যের নীরবতা। সেই নীরবতা থেকে আর কোনও কিছুরই জন্ম হবে না কোনওদিন।

 

ব্যবহারিক ক্ষেত্র থেকে বলি, আমরা ছোটবেলা থেকে পড়ে আসতে চেষ্টা করেছি ‘ঐক্যই বল’, ‘একতাই সম্পদ’ ইত্যাদির মূলমন্ত্রকে। আমাদের দেশকে ফাসিস্তদের হাত থেকে বাঁচানোর প্রয়োজনে যে বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক বিরোধীগোষ্ঠীগুলির উপর আমরা মধ্যে মধ্যে নির্ভর করতে চেষ্টা করি, তাঁরাও বোধহয় ইস্কুলজীবনে গতানুগতিক ফাঁকিবাজ, অশিক্ষিত আর পাঁচজন রাজনীতিকদের মতোই এই মন্ত্রগুলিকে পড়ে আসতে বা শিখে আসতে পারেননি। তাই বিলকিসের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে এই ঘৃণ্য, চরমতম ভাবে বিতর্কিত রায়কে পুনর্বিবেচনার জন্য যখন আর্জি পেশ করা হয় – তখনও দেখা যায় একেকটি দল একেকটি করে পিটিশন ফাইল করতে চলেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মঞ্চতেও একতাকে দেখা যায় না, সীমানা দেখা যায়। বিলকিসের আন্দোলনও কখন যেন ‘আমার বিলকিস – তোমার বিলকিস’এ বিভক্ত হয়ে যায়। প্রতিবাদ বিলকিসকে নিয়ে হয় না, প্রতিবাদে কোন দল কত বেশি করে বিলকিসের পাশে থেকেছে, তুল্যমূল্য ভাবে কেবল তারই প্রচারের ব্যবস্থা হতে থাকে। এই তো আমাদের দেশ। একতা ভিন্ন ফাসিস্তদের পরাজয় অসম্ভব, অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কবেই বা আর সেই বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারব!

 

বিলকিস, তুমি কখনও আমার এই লেখা পোড়ো না। আমাদের এই অসহায়তার চেয়ে, এই কুড়ি বছর ধরে সবকিছুকে সহ্য করে আসা – তোমার শরীর ও মন আমার বা আমাদের এই তুচ্ছ অক্ষরগুলির চেয়ে, অনেক অনেকগুণে বেশি সহনশীল, বেশি শক্তিশালী, বেশি ঋজু, ও সরকারের সুমুখে দাঁড়িয়ে অনেক অনেক বেশি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের ঈশ্বর তোমাকে সেই শক্তিই দিন বরং। আর সুশীল, ভদ্র, রাজনৈতিক, চিন্তাবিদ যাঁরা রয়েছেন, যাঁরা এখনও তত্ত্বের হাউইতে নিজেদের বিশ্বাস রাখেন, তাঁদেরকে বলতে চাইব – মানুষের হাতেই একদিন, এমন ফাসিস্তদের পরাজয় ঘটবে। তখন আবার না হয় আপনারা উত্তরীয়-বস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে কান্না বর্ষণ করতে বেরুবেন। ততদিন অবধি কেবল প্রচ্ছন্ন ও প্রকট শান্তির কোমলতর, কোমলতম উপাধানেই আপনারা নিঃশঙ্ক চিত্তে শয়ন করুন। ওই আপনাদের সৃষ্টির একমাত্র ‘উপাদান’ যে এখন! আর কিছুই বলতে নেই - অলমিতি বিস্তারেণ; [ব্যক্তিত্ব ক্রোধোক্তিগুলির নিমিত্তে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে নিলাম]। 

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment