বিধবা মবিনা খাতুন সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত

  • 08 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 116 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
 এই বছরের ৩০ মে মবিনা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত) স্বামী ইরফান ইসলাম মারা যান। মবিনা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। তাঁর পিতৃস্থানও মুর্শিদাবাদেই। শ্বশুর বেঁচে আছেন তাই স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরের বসত বাড়ি, কৃষিজমিতে মবিনা আর তাঁর ছেলে কোন হক পেলেন না। মবিনা বললেন, ‘ওরা একমাসও আমাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। আমাদের ছেলে তো ওই বংশের। তার কথা  ভেবে কত  হাতেপায়ে ধরলাম। তাও শুনলো না। শ্বশুর, দেওর মিলে তাড়িয়ে দিল।'

 এই বছরের ৩০ মে মবিনা খাতুনের (নাম পরিবর্তিত) স্বামী ইরফান ইসলাম (নাম পরিবর্তিত) মারা যান। মবিনা খাতুনের বিয়ে হয়েছিল মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। তাঁর পিতৃস্থানও মুর্শিদাবাদেই। পড়াশোনা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত। মবিনা খাতুনের বয়স এখন পঁচিশ বছর। ছেলে আট বছরের। শ্বশুর বেঁচে আছেন তাই স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরের বসত বাড়ি, কৃষিজমিতে মবিনা আর তাঁর ছেলে কোন হক পেলেন না। মবিনা বললেন, ‘ওরা একমাসও আমাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। আমাদের ছেলে তো ওই বংশের। তার কথা  ভেবে কত  হাতেপায়ে ধরলাম। তাও শুনলো না। শ্বশুর, দেওর মিলে তাড়িয়ে দিল। ওরা বলল, ধর্মে যা লেখা আছে তাই মানতে হবে। বাপ- ভাইয়ের সংসারে থাকতে হচ্ছে এখন। আমার ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাবো কেমন করে সেই দুশ্চিন্তায় ভুগছি।’

 

মবিনার স্বামী নিজেও কিছু সঞ্চয় করেছিলেন। মবিনার কথা অনুযায়ী, বিয়ের সময়  ওরা মবিনার বাবার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়েছেন। তাই মবিনার দাবি, তাঁর স্বামী যতটুকু অংশ নিজে করেছে এবং ব্যাংকের সঞ্চয় তাঁকে দিতেই হবে।  তবে সেই সব সম্পত্তিতে জীবিত বাবার হক আছে। তাই মবিনার শ্বশুর ছেলের নামের সম্পত্তি ও টাকা থেকে অংশ পাবেন। শ্বশুরের হকের ভাগ ছেড়ে দিয়ে যেটুকু পাবেন সেটা মবিনা উদ্ধার করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু  শ্বশুরবাড়ির গতিবিধি দেখে তিনি ভয় পান। তাই স্বামীর নামের সম্পত্তির দলিলসমেত  স্বামী, ছেলে আর নিজের সব ডকুমেন্টস সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যান। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের তাতে আপত্তি ছিল। সেই বাড়ির মৃত ছেলের সম্পত্তির নিয়ন্ত্রক তাঁরাই হতে চান। মবিনা খাতুন শ্বশুরবাড়ির গ্রামের মানুষকেও নাকি তাঁর পক্ষে পাননি। কী করে মা-ছেলের দিন যাপন হবে সেই সমাধান কেউ দেননি। শুধু ধর্মবিধি  এবং মৃত সন্তানের জীবিত অভিভাবকের অধিকার দেখিয়ে মবিনাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মবিনা তাঁর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ডকুমেন্টস রক্ষা করতে পারেননি। শ্বশুর, মামাশ্বশুর, দেওর সকলের কৌশলের ফাঁদে পড়েন তিনি। তাঁকে সমবেদনার গলায় সমস্ত ডকুমেন্টসসহ ডেকে নিয়ে আসা হয়। মবিনা বললেন- ' ওরা আমাকে বললেন, আমার স্বামীর একাউন্টে কৃষক বন্ধু খাতের দুলক্ষটাকা জমা আছে। ওই টাকা তুলে আমার অংশটা আমাকে দিয়ে দিতে চান। তাই খুব সকাল সকাল অফিসের সামনে চলে যেতে বলেন। আমি গিয়ে দেখি ওখানে শ্বশুরবাড়ির কেউ আসেনি। ওদের ফোন করলাম। বলল, এখনো অফিস খুলতে দেরি আছে। তুমি বাড়ি চলে এসো। আমি ওদের বিশ্বাস করে শ্বশুরবাড়ি গেলাম অনেক আশা নিয়ে। বাড়িতে পৌঁছতেই মামাশ্বশুর এবং দেওর আমাকে মারধর করে আমাদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ডেবিট কার্ড, দলিল, ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট সব কেড়ে নিল। এমনকি আমার ব্যাগে দশ হাজার টাকা ছিল তাও কেড়ে নিল। আমি দিতে চাইছিলাম না বলে আমার গলা টিপে ধরে মেরে ফেলার মতো করেছিল। ওরা হয়ত আমাকে বন্দি করেই রাখতে চেয়েছিল। কোনওরকমে আমার ভাইকে ফোন করতে পেরেছিলাম। ভাই দলবল নিয়ে গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে। আমি সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করি।' 

 

মবিনা খাতুনের ভাই বললেন, থানার ওপর ভরসা করে আছি এখন। তাছাড়া কোথায় যাব বলুন তো? মবিনা খাতুন মার খাওয়ার সময় হাতের মোবাইলের অডিওটা অন করে দিয়েছিলেন। সেই অডিও শুনিয়ে ঘটনার ভয়াবহতা বোঝাতে চাইছেন। শরিয়ত আইন অনুযায়ী শ্বশুর বেঁচেথাকাকালীন স্বামীর মৃত্যু হলে শ্বশুরের সম্পত্তি তাঁরা পাবেন না তা মবিনা জানেন। তবু তাঁদের কাছ থেকে মানবিকতা প্রত্যাশা করেছিলেন ছেলের জন্য। সেটুকুও তাঁরা দিলেন না। উপরন্তু  স্বামীর সম্পত্তি, টাকাও কেন কেড়ে নেবেন, এই প্রশ্ন কুরে খাচ্ছে মবিনাকে। দেশের আইনেও কোন নিরাপত্তা খুঁজে পাচ্ছেন না। মবিনার শ্বশুরবাড়ি মনে করছে মবিনার চারিত্রিক ত্রুটির জন্যই তাঁদের ছেলে আত্মহত্যা করেছে। মবিনার বয়ানে কিন্তু অন্য ভাষ্য উঠে এসেছে। তাঁর স্বামী কেরলে কাজ করতেন। ওখানেই এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। তাঁর সঙ্গে গণ্ডগোলের কারণেই কেরলে আত্মহত্যা করেন। স্বামীর আর একটি সম্পর্কের সব প্রমাণ নাকি মবিনা শ্বশুরবাড়িকে দেখিয়েছেন। তবু তাঁদের ছেলের মৃত্যুর জন্য মবিনাকে অত্যাচার করে স্বামীর সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করছেন তাঁরা। মবিনা এখন কাজের খোঁজ করছেন। ছেলেকে ওর বাপের বাড়ির লোক রাস্তার ভিখিরি করতে চাইছে। তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে একমাত্র ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে যাবেন। আর এই বঞ্চনা ও  শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইও করবেন।  

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্মী 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment