মাহসা আমিনি

  • 19 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 872 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
এই মূহুর্তে  আপনার সামনে যে মশাটা ভনভন করছে কিংবা ক্ষুদ্র একটি লাল পিপীলিকা  যাতায়াত করছে, তাকে যেমন অবলীলায়, হেলাফেলায় চপেটাঘাতে বিনাশ করা যায়, ঠিক তেমন করেই হিজাবের একাংশ একটু বেঁকে গেলেই, একটা চুল বেরিয়ে থাকলে, কপালের একটা দিক একটু বেশি বেরিয়ে গেলেই, নিমেষেই নারীদের 'ঘ্যাচাং ফু' করে দেওয়া যায়। এই সকলের মূলে কে আছে তা আমাদের অজানা নয়, পর্দা, হিজাব, নেকাব, অশালীনতা, শালীনতা প্রোগ্যামিং করে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা জানি, নারী-পুরুষ সমান নহে। হাজার চেষ্টা করলেও সমানে সমান হওয়া যাবে না। কারণ, শারীরিক হাজার একটা পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু 'অধিকার'? সেই অধিকারের ক্ষেত্রে আমাদের মহামান্য পিতারা, কী সুন্দর চৌকস চাল চেলে, নারীদের মাথায় ধর্মীয় ঘোল ঢেলে, জুজু দেখিয়ে, না তোমার জানু, বুক, খাঁজ, ভাজ, চুল, রেখা, ব্রায়ের স্ট্র্যাপ, স্যানিটারি ন্যাপকিন প্যাকেট সব কিছু নিয়ে ফিসফাস, চুপচাপ, রাখ ঢাক; ঐসব প্রসঙ্গ দূরে থাক! কিন্তু ক্যানরে ব্যাটা ষ্টুপিড? আপনি যখন গামছা পরে, পশ্চাতদেশ চুলকাতে চুলকাতে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ান, খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে  মূত্র বিসর্জন করেন তখন এই রাখ ঢাক কোথায় থাকে? খালি গায়ে বগলের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আপনি পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে, টাইম কলের জলে স্নান করতে করতে মেয়েদের নিয়ে রসিকতা করেন, তারবেলা! আপনারা কতখানি শালীন? অশালীন পোশাক কী কেবল নারীরা পরেন?

ইরানের মাহসা আমিনির কথা আমাদের কারও অজানা নেই। বিশ্ব জুড়ে মাহসার মৃত্যু নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ চলছে। বাইশ বছরের একটি ছোট মেয়ে ঠিক ভাবে হিজাব না পরার কারণে, নীতি পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন। গত ৫ জুলাই মেয়েদের জন্য নতুন পোশাক বিধি জারি করেছেন ইরানের  রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসি। সেখানে মহিলারা কী কী পোশাক, কীভাবে পরবেন সেই তালিকা দেওয়া হয়েছে৷ এরপর থেকেই পোশাক বিধির অন্যথা হলেই তীব্র তিরস্কার, জরিমানা বা গ্রেপ্তারের সম্মুখীন হতে হয়েছে ইরানের  মেয়েদের। ((তথ্যসূত্র: সংবাদ প্রতিদিন, ১৭ সেপ্টেম্বর)  প্রসঙ্গত, সাত বছর বয়স থেকেই ইরানিয়ান মহিলাদের মাথা ঢাকতে হয়। যদি  এই নিয়মের অবাধ্য কেউ হন, তাহলে স্কুলে কিংবা কর্মস্থলে প্রবল সমস্যার মুখে পড়তে হয়। মাহসার ভাই কিয়ারাশ আমিনি সেদেশের সংবাদমাধ্যম ‘ইরানওয়্যার’কে জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। তাঁর সামনেই মাহসাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর তিনি থানার সামনে পৌঁছলে, ঘণ্টাখানেক সেখানে একটি অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে ছিল। তাঁর কথায়, ”ভিতর থেকে বাকি মহিলাদের বেরিয়ে আসতে দেখলাম। আমি সকলকে বলতে শুনি একজনকে ভিতরে মেরে ফেলা হয়েছে। তখন আমি আমার দিদির ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারি মাহসাকে  ওরা চোখের সামনে লুটিয়ে পড়তে দেখেছেন।” তাঁর দাবি, প্রথমে পুলিশের তরফে বলা হয় এক পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামনে আসে আসল সত্যি। জানা যায়, মাহসাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন। পরে চিকিৎসকরা ঘোষণা করেন, তাঁর মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে।  (তথ্যসূত্র -সংবাদ প্রতিদিন, ১৭ সেপ্টেম্বর)

মাহসাকে খুন করার খবর প্রকাশ্যে আসতেই ইরান জুড়ে প্রতিবাদ শুরু করেন মহিলারা। হাজার হাজার নারীরা রাজধানী তেহরানের রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁরা নারী অধিকারের দাবি তোলেন। স্লোগান দেন ‘অত্যাচারীর মৃত্যু হোক’, ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’।  প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার ভিডিও ইরানের সাংবাদিক ও সমাজকর্মীরা টুইট করেছেন। কিছু ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা কর্মীরা কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করছেন। মাহসার মৃত্যুর প্রতিবাদে বহু তরুণী চুল কেটে, হিজাব পুড়িয়ে প্রতিবাদে শামিল হন। তাঁরা চুল কাটা ও হিজাব পোড়ানোর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেন।

এতক্ষণ একটা ফিরিস্তি পেশ করা হল। এর থেকে মালুম পাওয়া যায়, এই মূহুর্তে  আপনার সামনে যে মশাটা ভনভন করছে কিংবা ক্ষুদ্র একটি লাল পিপীলিকা  যাতায়াত করছে, তাকে যেমন অবলীলায়, হেলাফেলায় চপেটাঘাতে বিনাশ করা যায়, ঠিক তেমন করেই হিজাবের একাংশ একটু বেঁকে গেলেই, একটা চুল বেরিয়ে থাকলে, কপালের একটা দিক একটু বেশি বেরিয়ে গেলেই, নিমেষেই নারীদের 'ঘ্যাচাং ফু' করে দেওয়া যায়। এই সকলের মূলে কে আছে তা আমাদের অজানা নয়, পর্দা, হিজাব, নেকাব, অশালীনতা, শালীনতা প্রোগ্যামিং করে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিতারা নারী-পুরুষের ভেদাভেদ বরাবর করে আসছেন। এইসকল বিধান আরোপ করে তাঁরা নারীদের দাবিয়ে রেখেছেন। সকাল-বিকাল-দিন-রাত আমাদের বোঝানো হয়, তোমরা ভোগ্যপণ্য। ঢেকেঢুকে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাক। 

সত্যিই জানি না, কোরান-হাদিসের কোথায়, কোন খানে লেখা আছে ঠিক ভাবে হিজাব না পরলে একজন নারীকে হত্যা করে ফেলতে হবে। এই ফোঁপরদালালি কত হাজার বছর চলবে?

একজন নারীর জীবন এতই ঠুনকো? কোন অপরাধে মাহসা মারা গেল? ঠিক ভাবে মাথা না ঢাকার জন্য! আপনাদের বলছি, কথায় কথায়- হাজিরে হুজুর, জি জাহাঁপনা বলাটা এবার বন্ধ করে, তলিয়ে ভাবার চেষ্টা করুণ। পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন রাঁধতে রাঁধতে, জাঙ্গিয়া কাঁচতে কাঁচতে ভাবতে থাকুন। ডিগ্রিধারি প্রতিষ্ঠিত মহিলাদের কেউ বা নিজের নিরাপত্তা খুঁজছেন পিতৃতন্ত্রে আশ্রয় নিয়ে। আজকে মিনমিন করে প্রতিটা অন্যায় কথায় সায় দিচ্ছেন, ভাবুন সেটা কালকে আপনার কতখানি ক্ষতি করবে! পিতৃতন্ত্রের ধারক, বাহক না হয়ে অন্তত আমাদের কন্যাদের জন্য একটি সুস্থ, সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখুন।  

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment