উত্তরা চক্রবর্তী : আলোকিত মানুষ

  • 09 January, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 630 view(s)
  • লিখেছেন : রেজিনা বেগম
কয়েকদিন আগে খবর এলো দিদি (উত্তরা চক্রবর্তী) আর নেই। মনে হলো চারপাশের আলো কিছু কমে গেল। এমন মানুষগুলি আছেন এমন ভাবনাই অনেক শক্তি যোগায়, নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলেও। মনে মনে জানতাম দিদি আছেন, যে কোনও প্রয়োজনে আবারও যদি তাঁর আশ্রয় নিই তিনি ফেরাবেন না, সাথে থাকবেন, পরামর্শ দেবেন, হাত ধরে রাস্তাও চেনাবেন। সবার চলে যাওয়া প্রস্থান হয় না।

সময়টা সম্ভবত ২০০৯-এর শেষদিক, রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ সামনে রেখে চলছিল নানা আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে এক সেমিনারে খুব আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলাম। আগ্রহের পেছনে ছিলেন মূলবক্তা কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক উত্তরা চক্রবর্তী। শুনেছিলাম তাঁর মাসি ছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের সহপাঠী। সিনেট ভবনের নওয়াব আলী মিলনায়তনে সামনের সারিতে ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দসহ বিশিষ্টজনেরা। বেশ পেছনের দিকে বসে বক্তৃতায় মন দিলাম। এক পর্যায়ে চমকে উঠে নড়চড়ে বসলাম, রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে অকাট্য প্রমাণ দিয়ে বক্তা বলছেন যে, ব্যক্তি জীবনে  নারী বিষয়ক চিন্তাধারায় রবীন্দ্রনাথ সনাতনী ধারণার ছিলেন। আমি দূরে বসেই মাথা উপর-নীচ করে সমর্থন করেছিলাম তাঁর বক্তব্য। সেমিনার শেষে মালেকা আপার (নারীনেত্রী ও নারী বিষয়ক  গবেষক মালেকা বেগম) কাছে গিয়ে বললাম আমি একটু বক্তার সাথে কথা বলতে চাই। আপা দিদির কাছে নিয়ে গেলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন। উত্তরাদিকে বললাম, রবীন্দ্রনাথের বিশ্লেষণে আপনি যে উপলব্ধির কথা বলেছেন সেটি আমারও হয়েছে অনেক সময়ে। আমার মনে হতো আমি ভুল বুঝছি। কাউকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাইনি। দিদি সস্নেহে বলেছিলেন, আমি লক্ষ্য  করছিলাম যে, তুমি আমার কথায় সহমত জানাচ্ছিলে, শোন, গবেষণা করতে গেলে যে সত্যিটা তুমি পাবে, সেটা বলবে, সংকোচ করবে না। তাঁর কাছ থেকে এভাবেই গবেষণা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠটি পেয়েছিলাম। আন্তরিক, অমায়িক, মিষ্টিহাসির এই মানুষটির জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় সেদিন পেয়েছিলাম।

এরপরে গবেষণা কাজে যখন কলকাতা যাই, দিদির সাথে আবারও যোগাযোগা হয়। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে দিদি আমাকে ডেকে নিলেন। অনেক দীর্ঘ সময় নিয়ে আমাকে নানান পরামর্শ দিলেন। কোন কোন বই পড়তে হবে, কার কার ইন্টারভিউ নিতে হবে সব কিছু আলোচনা করলেন। কারো কারো ফোন নাম্বার এবং ঠিকানা দিলেন। অনেক সহজ করে দিলেন আমার কাজ। গ্রন্থতালিকা নিয়ে কলেজস্ট্রিটে বই কিনতে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই বিপ্লবী বীনা দাসের আত্মজীবনী খুঁজে পাচ্ছি না। আবারও স্মরণাপন্ন হলাম দিদির। সঙ্গে সঙ্গে দিদি বললেন, আগামীকাল আমার ক্লাস শেষ হলে চলে এসো প্রেসিডেন্সিতে। পরের দিন সময়মতো পৌঁছে গেলাম প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভেবে নিয়েছিলাম দিদি হয়তো সঙ্গে কাউকে দিয়ে দেবেন। হয়তো ওনার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে কাউকে। আমাকে বিস্মিত করে দিদি নিজেই আমাকে নিয়ে গেলেন কলেজস্ট্রিট। খুঁজে বের করলেন সেই প্রকাশকের অফিস। বেশ গলির মধ্যে, ছোট্ট একটা দোকান মতো, অনেকটা হাঁটতে হয়েছিলো। একজন খ্যাতিমান অধ্যাপক বিন্দুমাত্র বিরক্ত হননি সেদিন, মাত্র দু’চারদিনের চেনা এক শিক্ষার্থীর জন্য এই পরিশ্রম করতে। সত্যিকারের দায়িত্বশীল শিক্ষককে দেখেছিলাম সেদিন। আমার সঙ্গে কাউকে সহযোগিতা করার জন্য দিয়েই নিজ দায়িত্ব শেষ করতে পারতেন কিন্তু তা করেননি।

গবেষণার কাজ শেষ হলে প্রয়োজন হয় দুইজন পরীক্ষকের। আমার তত্ত্বাবধায়ক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বললেন, একজন দেশের বাইরের হতে হবে। সবদিক বিবেচনায় যাঁর নাম আসলো তিনি আর কেউ নন, উত্তরা চক্রবর্তী, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রশ্ন হলো তিনি অনেক ব্যস্ত থাকেন, এই সময় দিতে পারবেন কি না? আবারো যোগাযোগ করলাম। এবারও নিরাশ করলেন না, সম্মতি দিলেন আমার পিএইচডি গবেষণার পরীক্ষক হতে। আমার ভয় অনেক বেড়ে গেল। দু’জন পরীক্ষকই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, আমার কাজের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করবেন। উত্তরা দিদি পরামর্শ দিলেন, একদম তাড়াহুড়ো করবে না, ছোটখাটো কোনও ভুলের জন্য যেন তোমার কাজ বাতিল করতে না হয়। পরামর্শটি আমাকে সাহায্য করেছিল সচেতনভাবে কাজ করতে এবং দিদির সততায় আবারও শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছি তাঁর প্রতি। কাজের ক্ষেত্রে এতটাই নিষ্ঠাবান ছিলেন যে ব্যক্তিগত পরিচয়ের কোনও সুযোগ ছিল না। একদিকে তাঁর স্নেহ যেমন পেয়েছি তেমনি দায়িত্ব এবং কর্তব্যে অটল থাকা শিক্ষাটিও দিয়েছেন। শত ব্যস্ততার মাঝে আমার পরীক্ষকের দায়িত্ব সময়মতো পালন করেছিলেন। তারপরে যখন দিদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী অধ্যায়ন বিভাগে এসেছেন বক্তব্য দিতে, তখন দিদির সান্নিধ্য আবার পেয়েছি। মাঝে মাঝে ফোনে যোগাযোগা হতো। দিদি মাঝে মাঝে প্রবাসী ছেলেদের কাছে থাকতেন। একসময় মালেকা আপার কাছে শুনলাম দিদির কিডনি সমস্যা, ডায়ালেসিস চলছে। আমার মা-ও তখন কিডনি রোগে শয্যাশায়ী, শেষদিকে আর যোগাযোগ হতো না। কয়েকদিন আগে খবর এলো দিদি আর নেই। মনে হলো চারপাশের আলো কিছু কমে গেল। এমন মানুষগুলি আছেন এমন ভাবনাই অনেক শক্তি যোগায়, নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলেও। মনে মনে জানতাম দিদি আছেন, যে কোনও প্রয়োজনে আবারও যদি তাঁর আশ্রয় নিই তিনি ফেরাবেন না, সাথে থাকবেন, পরামর্শ দেবেন, হাত ধরে রাস্তাও চেনাবেন। সবার চলে যাওয়া প্রস্থান হয় না। দিদি হয়তো আর সাথে করে নিয়ে পথ চেনাবেন না কিন্তু দিদির পরামর্শ আজীবন সাথে থাকবে। বাংলাদেশ থেকে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা দিদির জন্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

ছবি: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা হলে সোসাইটি ফর এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন-এর একটি সভায় উত্তরা চক্রবর্তী (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়)

0 Comments

Post Comment