- 15 January, 2023
- 0 Comment(s)
- 477 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
মতি তাদের ফেরেনি, কেবল ‘জুতো মেরে গরুদান’ বা একটু ভুল হলো বোধহয় – ‘গরু মেরে জুতো দান’এর ঢঙে তারা নির্দেশনামায় কিঞ্চিৎ বদল এনেছে মাত্র। সেই খবরটুকুও জানানো জরুরি । তারই সঙ্গে এও জানানো জরুরি, এই নির্দেশনামা বদলের পিছনে ঠিক কোন ধরণের অর্থনীতি অথবা রাজনীতির কারবার আদতে কলকাঠি নাড়তে পেরেছে। আদতে যে বৃহৎ পৃথিবীতে বিন্দু থেকে সিন্ধু অবধি প্রত্যেকেরই অস্তিত্ব ছাপানো ব্যাঙ্কনোট অথবা আধুনিক যুগের বৈদ্যূতিন কড়ি-ব্যবস্থার নাগপাশে আবদ্ধ, তা আর নতুন করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই কড়ি-ব্যবস্থার কল্যাণে আমাদের নাগরিক, মানবিক, সামাজিক আন্দোলনগুলিও কেমন ভাবে দিশাহীন মরুভূমিতে গণ্ডূষমাত্র জলের সমতুল হয়ে দাঁড়ায়, তা ভাবলে পরেও দুঃখবোধ হয়। কেবল বিশ্বাস রেখে চলি, অনেক মানুষের মিলিত কলস্বরেই ক্রমশ আমরা সুদিনের পথে এগোব। এগোব আলোকিত পথেই।
আফগানভূমের তালিবান প্রশাসকেরা বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, এখন থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি অবধি মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। এর জন্য অবশ্যই ছাত্রীদেরকে উপযোগী ‘ইসলামি’ পোশাক পরে স্কুলে আসতে হবে এবং স্কুলগুলিতেও সাচ্চা ইসলামি আচার-আচরণের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। কাজেই এর ফলে কতখানি যে শিক্ষালাভ হবে আর কতখানিই বা বোরখা-লাভ হবে তা খোদায় মালুম। সৌভাগ্য আলীসাহেবের যে তিনি রানী সুরাইয়ার আফগানিস্তান দেখেছিলেন। তালিবান-শাসিত পাঘমান তাঁকে দেখতে হয়নি। কিন্তু হঠাৎ তালিবানেরই বা এমন ভাবে মতি ফিরল (?) কেন সেই বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করা প্রয়োজন। ডিসেম্বর, ২০২২এ তালিবান প্রশাসন প্রথমেই নির্দেশনামা জারি করে দেশজুড়ে মেয়েদের শিক্ষালাভের সমস্ত অধিকার কেড়ে নেয়। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই আবারও নতুন নির্দেশনামা জারি করে প্রায় সমস্ত প্রকাশ্য স্থানে মেয়েদের চলাফেরার অনুমতি ফিরিয়ে নেওয়া হয়। প্রায় সমস্ত পেশাগত ক্ষেত্র, যেমন কি না সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মতো সমস্ত জায়গায় মেয়েদের কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে এই ঘটনা নিয়ে হইচই শুরু হয়। আন্তর্জাতিক মহলে তালিবান প্রশাসন তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। তাতে অবশ্য মোল্লা-প্রতিভূদের বিশেষ কিছুই হারানোর ছিল না। এমনতরো গা-জ্বালানি সমালোচনা সয়ে যাওয়াটা তাঁদের জন্মগত অভ্যাস। আলোচনা-সমালোচনা দিয়ে তো আর হাঁড়ি চড়ে না কারোর। কাজেই সাহেব অথবা মোসাহেবেরা কোন দেশ অথবা কোন রাজধানীর মঞ্চে দাঁড়িয়ে কিই বা বিবৃতি দিলেন কাবুলী হোমরাচোমরাদের তাতে থোড়াই কেয়ার। অথচ এই মাত্র এক দিন আগেই সেই মোল্লারাই বিবৃতি দিয়ে অন্ততপক্ষে ষষ্ঠ শ্রেণি অবধি মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। কারণটা সামাজিক বা রাজনৈতিক মোটেও নয়, পুরোপুরিই অর্থনৈতিক। সামান্য কিছু হিসেব দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মার্কিন প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তালিবানের হাতে আফগানিস্তানের পতনের পর, অর্থাৎ কি না আগস্ট ২০২১এ সেই দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যে ঘটনা, সেই সময় থেকে আজ অবধি প্রতি সপ্তাহে মানবিক সাহায্য বাবদ যে অর্থ আমেরিকার তরফে আফগানিস্তানের তালিবান প্রশাসনের এ্যাকাউন্টে পাঠানো হচ্ছিল, সেই অর্থ সাহায্য তারা বন্ধ করবে। তালিবানকে প্রতি সপ্তাহে পাঠানো মার্কিনি অর্থসাহায্য? ঠিকই শুনেছেন, আগস্ট ২০২১ থেকে এই সাহায্য পাঠানো হচ্ছে – এবং প্রতি সপ্তাহে এই সাহায্যের পরিমাণ ৪ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় আনুমানিক ৩২০ কোটি টাকা, প্রতি সপ্তাহে! মার্কিন প্রশাসনের তরফেই জানানো হয়েছে আগস্ট ২০২১ থেকে আজ অবধি তালিবান-শাসিত আফগানিস্তানে পাঠানো মার্কিনি সাহায্যের পরিমাণ আনুমানিক ১১০ কোটি মার্কিন ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় আনুমানিক ৮৮০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮১ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য এসেছে ইউএসএইডের মাধ্যমে, ৩২ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য পাঠিয়েছে মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তর। তালিবানকে সহায়তার এই হলো মার্কিনি খতিয়ান। এই টাকাতে টান পড়ার আশঙ্কা শুরু হতেই মোল্লা-নেতাদের নরম হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যদি এমনই দেওয়া-নেওয়ার হিসেব জারি থাকে, সেক্ষেত্রে মানুষের আন্দোলনেরই বা ভবিষ্যৎ কোথায়? অসহায় বোধ করি তখন।
মার্কিন প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে আফগানিস্তানে বসবাসকারী ৪ কোটি সাধারণ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ২.৫ কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই ন্যূনতম মানবিক সাহায্যের অপেক্ষায় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিনি সাহায্য ভিন্ন তাদের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। কিন্তু এর বিপরীতে রাজনৈতিক ভাবেও যে তালিবানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা ও ধীরে চলার যে মনোভাব আমেরিকা তথা পাশ্চাত্যের দেশগুলি নিয়েছে, তাতেও কি সন্দেহ জাগবে না? আগস্ট ২০২২এ তালিবানের হাতে আফগানিস্তান পুনর্দখলের মাত্র দিনকয়েক আগেই খাস কাবুল শহরতলিতে ড্রোণ হামলার মাধ্যমে আল কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যা, তার প্রতিবাদে কিন্তু তালিবান প্রশাসনের তরফেও বিবৃতি ভিন্ন তেমন কোনও কড়া পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বাইডেন প্রশাসনের তরফে এও জানানো হয়েছে এই মুহূর্তে তালিবান-বিরোধী কোনও সংগঠনকে অস্ত্র বা অর্থ সাহায্যের বিষয়ে আমেরিকা ভাবনাচিন্তা করছে না। ইতিপূর্বে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার এমন একেকটি ছায়াযুদ্ধের কারণেই কিন্তু আজ তালিবান বা আল-কায়েদার মতো সংগঠন বিশ্বের ত্রাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওয়াকিবহাল সকলেই সেই বিষয়ে অবগত আছেন। এই মুহূর্তে আমেরিকা বরং কৌশলগত ভাবে আল-কায়েদা বা হক্কানি নেটওয়ার্কের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সময়ে সময়ে যে একেকটি সন্ত্রাস-বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে আদতে মূল তালিবানেরই পায়ের তলাকার মাটি শক্ত হচ্ছে। তালিবানের সঙ্গে দোহা চুক্তির পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোন রাজনীতি, আপোষনীতি অথবা অর্থনীতির ভুলভুলাইয়াতে পথ হারিয়ে বসেছে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে তার ধারণা করা অসম্ভব। এর পাশাপাশিই রয়েছে বিশ্বব্যাপী মন্দার আশঙ্কা, ইউরোপের যুদ্ধ তদুপরি সারা পৃথিবী জুড়েই অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাধারণ নাগরিকের অধিকার, সাধারণ মানুষের অধিকার, মেয়েদের অধিকার এই বিষয়ক আন্দোলন কোন পথে চালিত হবে তা ঠিক করে দেবে সেই অনেক টাকার মালিক হয়ে বসে থাকা মানুষেরাই, অথবা রাজনৈতিক ভাবে উপরতলাকার কিছু দেশের প্রতিনিধি। তাঁদের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে, বিভিন্ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন যেমনটা হলে পরে সুবিধা হতে পারে, অঙ্গুলিহেলনে আজ বিশ্বের রাজনীতি চলবে সেই পথেই।
এই কথাগুলো জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল কারণ, শত্রুকে চেনা যেমন প্রয়োজন – তেমনই প্রয়োজন ছায়ান্তরালের এই কলকাঠিগুলি সম্পর্কে অবহিত থাকা। প্রত্যেক লড়াই যে আসলে নিজেদের, এবং নিজেদেরই কেবল, এই বোধ প্রথম প্রথমে রূঢ় অথবা কঠিন বলে মনে হতে পারে – কিন্তু এই বোধের সঙ্গে একটিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে, সংগ্রামের জন্য মানসিক দৃঢ়তা আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যায়। কারো উপরে নির্ভরশীল না হয়েই যে লড়াই, তার সাফল্য দেরিতে এলে পরেও তা হয় দীর্ঘস্থায়ী ও মজবুত। অন্ধকার কাটেনি, কিন্তু অন্ধকার যদি নিজে থেকেই কাটানো যায় সেই আলোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে প্রত্যেক মানুষই নতজানু হতে বাধ্য থাকবে। মেয়েদের অধিকার মেয়েরাই অর্জন করুক। আমরা কেবল সমর্থন জানাতে পারি।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment