বোকা দিবসের জয় হোক!

  • 09 April, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 467 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
মানুষের সৃজন ক্ষমতা ও মগজ মিটার এতটাই উর্বর যে, তারা যেকোনও সাধারণ দিনকে অসাধারণ দিবস উদযাপনের নাম দিতে পারে । মা দিবস, বাবা দিসব, শ্রমিক দিবস , প্রেম দিবসের মতো বোকা দিবসও এই সুপার এক্টিভ মগজের নমুনা ।

মানুষের সৃজন ক্ষমতা ও মগজ মিটার এতটাই উর্বর যে, তারা যেকোনও সাধারণ দিনকে অসাধারণ দিবস উদযাপনের নাম দিতে পারে।  মা দিবস, বাবা দিসব, শ্রমিক দিবস, প্রেম দিবসের মতো বোকা দিবসও এই সুপার এক্টিভ মগজের নমুনা। এই দিনের পেছনে অনেকগুলো প্রচলিত কাহিনীর মধ্যে ফ্রান্সের কাহিনীই সবচেয়ে বিখ্যাত –

‘১৫৬৪ সালে ফ্রান্স তাদের ক্যালেন্ডার বদল করে। এর আগে বছর শুরু হত মার্চের শেষ থেকে। কিন্তু ওই বছর সেটি বদল করে নতুন বছর শুরু করা হয় ১ জানুয়ারি থেকে। এই পরিবর্তন অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন বছরের সূচনা পালন করতে থাকেন। যাঁরা পরিবর্তনটি মেনে নেন, তাঁদের বোকাও বানাতে থাকেন। তাঁদের পিঠে কাগজের তৈরি মাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। নতুন ক্যালেন্ডারের পক্ষে যাঁরা, তাঁদের ডাকা হত ‘এপ্রিল ফিশ’ বলে। সেই থেকেই এপ্রিল ফুলের গল্প শুরু হয়। 

তা  বোকা হওয়া বা বোকা বানানো দুই রকমের হয়।  একটি ভালোমানুষ নিরামিষ গোছের, যা নিছক মজার, অন্যকে কোনওভাবেই আঘাত করে না এবং অন্যটি প্রতারণা যা একেবারেই মজার নয় । ‘ঠকানো’ জিনিসটা অন্যান্য ভালো মন্দের মতোই আপেক্ষিক, এর কোনও মানদণ্ড নেই । আর সেটা না থাকার জন্যই মজা আর প্রতারণার মধ্যের সূক্ষ্মতম পার্থক্যটা গুলিয়ে যায় বারবার । মঞ্চে জাদুকরের ম্যাজিক বা লোক ঠকানো ভ্রান্তিবিলাস ততক্ষণই মজার যতক্ষণ তাতে হারানো বা ক্ষয়প্রাপ্ত অথবা ‘গায়েব’ হওয়া জিনিস ফিরে আসে । পায়রা উড়তে উড়তে ফুল হয়ে ঝরে পড়ল, তরুণীর কাটা মাথা কথা বলল, বাচ্চামেয়ের শরীর দু’টুকরো হয়ে গেল – এগুলো যে দৃষ্টিভ্রম এবং পাতি বিজ্ঞান – তা দর্শক জানে বলেই মজা নিতে টিকিট কাটে।  কিন্তু ধরুন যদি সত্যি মেয়েটির মাথা কাটা গেল, শরীর দু ভাগ হয়ে গেল ধারালো তরবারিতে, রক্তে ভেসে গেল মঞ্চ – তখন কি সেটা নিছক মজার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়! দাঁড়ায় না, কারণ সেক্ষেত্রে ওই মেয়েদেরকে জাদুকর কোনওভাবেই ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। এই দাম দিয়ে ঠকতে আসা অনুষ্ঠান আর জীবনের দাম দিয়ে দিল্লি থেকে দিনাজপুরে মহিলাদের দেহ ৩২ টুকরো থেকে ৭২ টুকরো হওয়ার মধ্যে কি ঠকবাজীর প্রতিযোগিতা চলতে পারে? অবশ্য সেসব গম্ভীর ব্যাপার নিয়ে ভাবলে মজারুদের বোকামির উদযাপন ব্যহত হতে পারে। 

‘বোকার মরণ’ কথাটা কেবল প্রবাদেই নয় আমাদের অস্থি-শিরা-মজ্জায় ঢুকে আছে বলেই আমরা ঠকতে ভালোবাসি। তা যখন জীবনমুখী গানে ডাক্তার রোগীদের ঠকাচ্ছে, ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ বাবা-মাকে ঠকাচ্ছে  - এসব অসততার গল্প শুনি তখন আলাদা করে নিজের জীবনের সাথে তা ভাবতে বসি না, কারণ ‘ও তো ফিকশান, আমার সাথে ওইরকম কিছু হবে না’ মার্কা একটা ঠগী পর্দা বুদ্ধির গোড়ায় ঝুলিয়ে রেখে ইশপের গল্পের গর্তে মুখ গুঁজে থাকা নিরাপদ খরগোশ সাজি। আমাদের মনে প্রশ্ন ওঠে না, কেন ম্যাজিক মঞ্চে দু’টুকরো হওয়া মানুষটি কেবল মেয়েমানুষই হবে? 

অথবা কেন একটা দেশের ক্রিকেট লীগের নাম পুরুষের জন্য হবে ‘ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগ’ আর মহিলাদের জন্য হবে ‘উইমেন্স প্রিমিয়ার লীগ’? মেয়েদের খেলা কি ভারতের নয়?  নাকি স্মৃতি মান্ধানারা দেশের বাইরের কোনও জীব! মগজে ঠগী পর্দা আবারও প্রশ্ন তুলতে বাধা দেয় যে, এ কি বাঁ হাতে পুজো দেওয়ার মত আড়ম্বরের আড়ালে মেয়ে ঠকানো ব্যাপার নয় ?

যেন ভারতীয় ক্রীড়া সমাজে - যেখানে যা কিছু পুরুষালি তাই ‘সাচ্চা’ ভারতীয় বলে মান্যতা পাওয়ার হকদার - সেখানে মহিলাদের খেলাটা যে দর্শক, স্পনসর ও বোর্ডের স্বীকৃতি পাচ্ছে সেটাই একমাত্র বিচার্য, তাই ‘উইমেন্স ‘ শব্দটি রেডমার্ক করে প্রচলিত হোক। এক্ষেত্রে  লিঙ্গবৈষম্যের দগদগে ঘায়ে ন্যাকড়া বেঁধে তাকে আড়ালে রাখাটাই নিয়ম । এরকম ইমোশানাল ফুলের মতো প্রশ্নের জন্য পাছে বাকিদের এন্টারটেইনমেন্টে ব্যাঘাত ঘটে, তাই দেশের উচ্চকোটির নারীবাদীরাও হেসে পাশ কাটান!

আজকাল ফ্লাইটে আকছার মহিলাদের গায়ে মদ্যপ পুরুষের প্রস্রাব করার খবর আসে। কথা নেই বার্তা নেই হঠাত করেই একজন পুরুষ প্রকাশ্যে বিনা শরমে জিপার খুলে পাশের সিটের মহিলার পোষাক ভিজিয়ে দেয়।  লক্ষণীয় ভুলের টার্গেট কোনও পুং সহযাত্রী হন না।  অবচেতনেও মহিলাদের রমন করা, তাদের দলিত মথিত ও অপমানিত করে আনন্দ পাওয়ার দুরভিসন্ধি কাজ করে না? এতে সাময়িক হৈ-চৈ হয়, খবরওয়ালাদের খোরাক জোটে, কিন্তু দোষী ব্যক্তির ততটা কঠোর শাস্তি হয় না। মহিলাটিও পুলিশে খবর দেয় না ‘মদ্যপ’ দোষীর একটি ‘স্যরি’তে ভরসা রেখে।  বুঝতেই পারেন না শুধুমাত্র মদ্যপ বা প্রকৃতিস্থ নয় বলেই যে লোকটিকে ছাড় দেওয়া হল এতে নিজেকে ঠকানো ছাড়া আদপে আর কিছু মিলল না, উলটে জল-সার দেওয়া হল অন্যান্য নারীবিদ্বেষের চারাগাছকে ।

যে মানুষ ভোগবাদী দুনিয়ার প্রতি নাক সিঁটকে চলেন তার ফাটা চপ্পল –বাসে বাদুড়ঝোলা ভিড়- মলিন জামা- উস্কোখুস্কো চুলের ভাঁজে খেটে-খাওয়া শ্রেণীর আদর্শকে আঁকড়ে ধরে তিনিও যেমন ঠকছেন, আবার যে স্বচ্ছ্বল আবেগপ্রবণ মানুষটি বিপদে, প্রয়োজনে অন্য মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন নিজের সামর্থ্যের জোরে - তাঁকেও ঠকানো হচ্ছে ‘ইমোশানাল ফুল’ বানিয়ে । সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগী, বাজারু এই যুগে এখন কেউই ভোক্তা নয় সবাই পণ্য। ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ হয়ে গেছে ‘ভোগ্যতমের উদ্বর্তন’।

অর্থনীতির সূত্র বলে যে, জোগান যেমন চাহিদা তৈরি করে,  তেমনি চাহিদা তার জোগান ঠিকই জুটিয়ে ফেলে । কিন্তু সেই সূত্রটি জীবনে ঠিক খাপে খাপে বসে না । আমরা শ্রমজীবী , বুদ্ধিজীবী, পরজীবী  হয়ে আজকাল ডেটাজীবী  হয়ে জীবন কাটাই। আজকের ব্যস্ততার দিনে সম্পর্কগুলো সবই মোবাইল কেন্দ্রিক। যতক্ষণ ফ্রি ডেটা ততক্ষণ ‘সুপ্রভাত ডার্লিং’ থেকে ‘শুভরাত্রি  ডিয়ার’ – এর মধ্যে খাওয়া, স্বপ্নদেখা, কাজ, ঘুম ও যৌনতা সব কিছুই ঘটে যাচ্ছে, একটা আস্ত প্রেমজীবন টিকে আছে ডেটার উপরে।  সেখানে বুদ্ধি, বিবেক বা মস্তিষ্ক প্রক্ষালণের কোনও অবকাশই নেই।  মেমোরি কার্ডের উপর বোকার মত নির্ভরশীলতা আমাদের মুখস্থবিদ্যাকে মেরে ফেলেছে । মোবাইল বন্ধ বা হারানো মানেই যাবতীয় কেজো, অকেজো ,পারিবারিক বা সামাজিক সব সম্পর্কই ‘ভ্যানিশ’ ! কেউ কারো সাকিন জানে না, কারণ ভোগবাদ আমাদের শিখিয়েছে - স্মার্ট লোকেরা মুখস্থ করে না, কিছু মনেও রাখে না। বোকারা রাখে। 

অন্যের চোখে নিজেকে শাহজাদী দেখার লোভে, অন্যের আয়নায় নিজের সেরা প্রতিবিম্বটি ফুটিয়ে তোলার লোভে বহুজাতিক সংস্থা ওরফে বোকার পাঠশালাগুলি বহুদিন ধরেই মেয়েদের ভেতর ‘সুন্দর মানে ফর্সা’, ‘আকর্ষণীয় মানে রোগা’  ইত্যাদি সংজ্ঞা গেঁথে দিয়েছে যা সদ্য স্কুলে যাওয়া মেয়েটিকেও উঁচু জ’লাইন, দৃশ্যমান কলার বোন ইত্যাদিকে রূপের হাতিয়ার হিসেবে চেনাচ্ছে । সেই পাঠশালা থেকেই ডায়েটের হরেক পসরা , মাত্র তিন দিনে তিন কিলো ওজন ঝরানোর বিধান থেকে মিথ্যাচারের হরেক খবর সব আমাদের হাতের মুঠোয় আসে টিভি-পরবর্তী বোকাবাক্সের পর্দায়।  হৃদয়ের খোরাক হয়ে এভাবেই বোকামির গোলাম হচ্ছে গোটা প্রজন্ম। 

প্রায়শই খবরে আসে – ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায় এড়ানো’, ‘দীর্ঘদিনের সম্পর্ক - সহবাসজনিত সন্তানের দায় এড়ানো’ যার পরিণতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ভাবেও নির্যাতিতার জীবন নরকতুল্য হয়ে ওঠে।  তদুপরি ভবিষ্যতের কোনওরকমের নিশ্চয়তা দাবি না করেও বহুজন কেবল হৃদয়ের কাছে বোকা হয়েই সম্পর্কে ঢোকেন, আবেগ-অর্থ-এনার্জি-সময় সবকিছুই অনিশ্চয়তার পায়ে সঁপে নিজেকে ঠকিয়েই চলেন ।

রবীন্দ্রনাথ এক সময় বলেছিলেন – ‘মানুষ ঠকিতেই চায়, ঠকিতেই ভালোবাসে । অথচ পাছে কেহ নির্বোধ মনে করে সে ভয়টুকুও ষোলো আনা আছে । এইজন্য প্রাণপণে সেয়ানা হইবার চেষ্টা করে। তাহার ফল হয় এই যে, শেষকালটা ঠকে কিন্তু বিস্তর আড়ম্বর করিয়া ঠকে’ – উক্তিটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় ভোট এলে।  আমরা দিনের পর দিন ‘লেসার ইভিল’ বাছতে গিয়ে ‘গ্রেটার গুড’ –কে ভুলেই গেছি । ভোটের চেয়ে আড়ম্বর কিসেই বা বেশি! প্রতিটা সাধারণ ভোটার গণতন্ত্রের নাটকে আইডি কার্ড নিয়ে যায়,  হাতে কালি, মুখে কালি ও মগজে কালি মেখে ক্লাউন সেজে বাড়ি ফেরে।  তারা জানে অবস্থা উন্নতির দিকে পাল্টাবে না তবু লোকঠকানো নেতাদের সভায় ভিড় জমায়।

রবি ঠাকুরের উক্তিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। মেয়ে খুব অবচেতনে আশঙ্কার দোলায় অবিরাম টাল খেতে খেতে বুঝতে পারে ঠকে যাচ্ছে সে, তবু ভার্চুয়াল প্রেমে দেশান্তরী হয়, চাতকের অপেক্ষায় দিন গোনে, প্রেমে আফিমে আচ্ছন্ন থেকে যৌনতা করে ভবিষ্যৎ না ভেবে, এবং পার্টনারের মতিগতি চালচুলো না জেনেই বোকার কাজলে সেজে স্বপ্ন দেখে অনাগত সুখী দাম্পত্যের । পুরুষের লিখিত ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে থাকা, পুরুষের চোখে ‘জাতে ওঠার লোভে’ নিজেকে নিত্যদিন ঠকানো হিজাবি  মহিলার মতোই প্রিয়তমের কাছে শো-কেস বেবি সাজার লোভেই হয়ত বা এইসব আধুনিকারা কণ্ঠ ছাড়ে ‘ ইটস মাই চয়েস’ !

কারণ এই প্লাস্টিক হাসির যুগে আমাদের ভোটে ‘গণতন্ত্র’, নোটে ‘ধনতন্ত্র’ এবং ঠোঁটে ‘পছন্দ-তন্ত্র’ । বস্তুতই এখন স্মার্ট লোকজন ‘চয়েস’ নামের অলীক এক গড্ডালিকা প্রবাহে ‘এমনি এমনি ভেসে যায়’। ঠকে যাচ্ছি বুঝতে পেরেও নিজেকে প্রবোধ দিই ‘এটা তো একরকমের চয়েস, ব্রো ! চাপ নিস না।’ এভাবেই লিঙ্গবৈষম্যের মতো আদিম সমস্যা হোক, নারীবিদ্বেষের মতো রোগ হোক বা মানসিক টানাপোড়েন – বোকাদের বিপ্লব ওই সোশাল মিডিয়া অবধিই। যেখানে অবিরাম আপলোড, ডাউনলোড, লাইক আর সাবক্রাইবের বন্যায় নিজেকে ‘অলওয়েস চাপলেস’ দেখানোর ছায়াযুদ্ধ চলে আর চে’গেভারাকে হাতের উল্কি আর জামার গ্রাফিক ডিজাইনের মধ্যে এঁকে বিপ্লবীসত্তাকে সহজেই বেঁধে ফেলা যায় ।

দায়দায়িত্বহীন, বোধহীন আদায়ের দুনিয়ায় সার্কাসের ক্লাউন সেজে অজান্তেই আমরা গেয়ে চলি – ‘আমরা সবাই বোকা, মজারুদের বোকার দাসত্বে …’ 

কাজেই একটা মাত্র দিনে বোকামি উদযাপনের মধ্যে অগৌরবের কিছু নেই বোধহয়, কারণ ব্যাঙ্গের কষাঘাতে আত্মশ্লাঘা পেতে আমাদের মোটেও খারাপ লাগে না।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment