- 19 May, 2024
- 0 Comment(s)
- 1029 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“... অর্যমা নির্নিমেষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভবিষ্যদবাণী করে – দেখে রাখো ভগ, কাল চাঁদ পূর্ণ হবে, ধন্যা ফুলে উঠবে। চাঁদ পূর্ণ কিংবা অদৃশ্য হলেই ধন্যার মধ্যে এরকম পরিবর্তন আসে।
... একটি শিশু যেদিন জল ফুলবে বুঝতে না পেরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলা করছিল এবং জলের তোড়ে ভেসে গেল, সেই দিনই অর্যমা তার আবিষ্কার জানাল। - ‘চাঁদ গোল হলে কিংবা অদর্শন হলে, ধন্যা ফুলবে। সাবধান!’ সবাই সাবধান হয়ে গেল। সবাই অবাক। পূর্ণ চাঁদের দিন ধন্যার তীরে সব সারসার দাঁড়িয়ে আছে, দেখবে।
মধুরা বলল – জাদু! জাদু! অর্যমা জাদু করতে পারে, চাঁদকে ওই বশ করেছে।
ভগ বিরক্ত হয়ে বলল – বাজে বোকো না। জাদু যদি কেউ করে থাকে সে স্বয়ং চাঁদ। চাঁদের সঙ্গে নদীর খেলা। অর্যমা সেটিকে লক্ষ করেছে মাত্র। ...”
[‘খনামিহিরের ঢিপি’, বাণী বসু]
পর্যবেক্ষণ। প্রশ্ন, সমস্যা-বিভাজন, পর্যবেক্ষণ। বিজ্ঞানের তিন সোপান। তিনটি প্রধান পদক্ষেপ। যে মানুষ সর্বপ্রথম গাছে গাছে ঘষা লেগে আগুন জ্বলতে দেখেছিল, যে মানুষ সর্বপ্রথম সেই পর্যবেক্ষণকে পুনর্বার স্বহস্তে যাচাই করে দেখতে গিয়ে সহসা অগ্নিকে করায়ত্ত করেছিল – সেই মানুষই যে পৃথিবীর প্রথম বৈজ্ঞানিক। আদিতম গবেষক, আমাদের সকলের পূর্বপুরুষ। নমস্য, শ্রদ্ধেয় - বিজ্ঞানবিৎ। সামান্য দেখাকে যিনি ‘পর্যবেক্ষণ’-এ রূপায়িত করতে পারেন, তিনিই তো বৈজ্ঞানিক, তিনিই আবিষ্কারক। তিনিই নববিধানের সার্থক প্রবর্তক। এখন সেই আগুন আবিষ্কারের অনেক শতাব্দী পেরিয়ে অনেক সহস্রাব্দ পেরিয়ে, এক বাঙালিনি লিখলেন আবার,
“শ্রাবণ ভাদ্রে বহে ঈশান,
কাঁধে কোদাল, নাচে কৃষাণ”
অথবা,
“আষাঢ়ের পানি, তলে দিয়া গেলে সার,
উপরে দিয়া গেলে ক্ষার”
এ তো কৃষিবিজ্ঞানের কথা। তিনি কি আদতে বাঙালিনি, নাকি সিংহলী ? সহস্র কিংবদন্তীতে তিনি লীন হয়ে আছেন। কত গল্প, কত ছড়া, কত ইতিহাস – তাঁর বচনেও কি আমরা বারেবারে ব্যবহারিক বিজ্ঞানকে খুঁজে পাচ্ছি না ? মহাকালের গর্ভে জটিল হয়ে আছে সেই সমস্ত সূত্রসমূহ, আর আজ – ‘খনা’র পরিচয় কে দেবে এখন ?
একেকজন বলেন তিনি বরাহের পুত্রবধূ। তাঁর জন্ম হয়েছিল বারাসাতের কাছে দেউলি গ্রামে, এক সম্পন্ন পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল অটনাচার্য। বাংলার চন্দ্রকেতুগড়ের রাজা ধর্মকেতুর রাজত্বকালে খনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। উজ্জয়িনীতে রাজা বিক্রমাদিত্যের সভায় নবরত্নের অন্যতম রত্ন জ্যোতির্বিদ বরাহ, তাঁর পুত্র মিহিরের বিবাহ দিয়েছিলেন এই খনার সঙ্গে। আজও বারাসাতের অদূরে সেই চন্দ্রকেতুগড়ের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। সেখানে খনার সমাধি বলে একটি ঢিপিকে চিহ্নিত করে, স্থানীয়েরা নাকি তাকে খনামিহিরের ঢিপি বলে নির্দেশ করে থাকেন। আবার অন্য কয়েকটি সূত্র থেকে জানা যায়, এই খনা নাকি সিংহলের রাজকন্যা। রাজরত্ন বরাহের কুলবধূ হয়েই তাঁর এদেশে আগমন। শোনা যায়, বরাহ নাকি মিহিরের জন্মের সময় গণনা করে দেখেছিলেন তাঁর পুত্রের জীবন গভীর সংকটে। তাই তিনি পুত্রকে ভেলায় চাপিয়ে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ভেলাই ক্রমশ সিংহলে গিয়ে পৌঁছলে পরে সেখানকার রাজা মিহিরকে প্রতিপালন করেন এবং বয়স হলে নিজ কন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন। সেই বিবাহিত বধূকে সঙ্গে নিয়েই বরাহ-পুত্র মিহির আবার নিজভূমে প্রত্যাবর্তন করেন। কারো কারো জবানিতে গণিতবিদ ভাস্করাচার্যের কন্যা লীলাবতীই আসলে খনা, আর সেই লীলাবতীকে বীজগণিতের পাঠ দিতে দিতেই ভাস্করাচার্য তাঁর বিখ্যাত অঙ্কের বইটি রচনা করেন এবং তখন সেই বইটিরও নাম হয় ‘লীলাবতী’। যদিও এই শেষোক্ত কিংবদন্তীটির সপক্ষে যুক্তি কম। আবার হয়ত সবকটির পক্ষেই সে কথা কমবেশি বলা চলে। আজ খনার সত্যপরিচয়কে উদঘাটন করতে গেলে, সে অনেক জটিলতায় গিয়ে পড়তে হবে। এমনকি খনা কি কেবল একজনই ? এই নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন খনার আনুমানিক সময়কাল ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ। সেক্ষেত্রে বরাহ বা মিহিরের সঙ্গে খনার সম্পর্ক নিয়ে বিরোধ তৈরী হয়। কারণ, ঐতিহাসিকেরা বলছেন বরাহের জীবৎকাল ৫০৫ থেকে ৫৮৭ খ্রিস্টাব্দ। কাজেই, তিনশো বছরের ব্যবধানে কোনও দুইজনের মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক থাকাটা কার্যত অসম্ভব। অন্যদিক থেকে দেখলে খনার বচনগুলির যে ভাষাবৈশিষ্ট্য, যে গঠনরীতি পণ্ডিতেরা পর্যালোচনা করেছেন, তাতে করে মনে হচ্ছে যে এই বচনগুলির বয়স ৪০০ থেকে ৫০০ বছরের চেয়ে অধিক প্রাচীন হবে না। সেই অনুযায়ী খনার কার্যকাল তখন ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দ না হয়ে, আরও আধুনিকতর সময়ে এগিয়ে আসবে। অথবা এও সত্যি হতে পারে যে, এই বচনগুলি শুরুতে অন্য কোনও রূপে বা ভাষাতে লিখিত হয়েছিল – যা ক্রমশ বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মৌখিক ভাবে পালটাতে পালটাতে আজকের চেহারাতে এসে দাঁড়িয়েছে। খনার বচনগুলি, গঠনগত ভাবে দুটি বা চারটি ছোট ছোট পংক্তিতে পদ্যাকারে রচিত। ভাস্করাচার্যের ‘লীলাবতী’ গ্রন্থে আবার, অনেকটা সেই একই পদ্ধতিতে ছোট ছোট পদ্যের সাহায্যে বীজগাণিতিক সূত্রগুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই কারণেই অনেকে খনার সঙ্গে ভাস্করের কন্যা লীলাবতীর সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন। আবার এও নিশ্চয়ই সত্যি যে, কালের নিয়মে খনার মূল বচনগুলির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন বচনও যুক্ত হয়েছে বা সেগুলি প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। খনার বচনগুলিকে আরও খানিকটা বিশ্লেষণ করতে চাইলে এও দেখা যায় যে, সেই সময়ে ভারতবর্ষে কৃষি অনেকটাই প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। বচনগুলিতে গরু, কুকুর, ছাগল, এমনকি বচনবিশেষে ভেড়া অথবা হাতির উল্লেখ থাকলেও, মোরগ বা মহিষের উল্লেখ নেই। কাজেই এটা ভাবা যেতে পারে যে, রচনার সময়ে শেষোক্ত দুটি প্রাণী গৃহপালিত পশুপক্ষীদের মধ্যে তখনও ঠাঁই করে উঠতে পারেনি। সেভাবে দেখলে খনার কার্যকাল আরও অনেকটাই পিছিয়ে গিয়ে এমনকি সপ্তম শতাব্দীতেও গিয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন হয়ত বরাহের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটিকেও আর কষ্টকল্পনা বলে মনে করতে হয় না। যদিও এই সবকিছুকে মেনে নিয়েও আজ, খনার সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু বলাটা অসম্ভব।
তা বলে কি খনার বচন অথবা তাঁর অবদানকেও অস্বীকার করতে হবে ? খনা বা, বচনগুলি যদি একাধিক কবি/ছড়া-বা-লিপিকার দ্বারাও লিখিত হয়ে থাকে, তাহলেও – এই বচনগুলির কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে আমাদের নজর করা উচিত। প্রাচীন ভারতবর্ষ অনেকটাই ধর্ম-ও-শাস্ত্রের নিগড়ে আবদ্ধ থাকলেও, আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় যে খনার বচনগুলিতে দুএকটি ছাড়া (যেগুলি প্রক্ষিপ্ত অথবা পরবর্তীতে পরিমার্জিতও হয়ে থাকতে পারে) ঈশ্বর বা ধর্মের উল্লেখ প্রায় নেই বললেই চলে। আধ্যাত্মিকতা, পরকালের গল্প, স্বর্গ বা নরকের উপাখ্যান – এসব কোনকিছুই ঠাঁই পায়নি খনার বচনগুলিতে। একেকটি বচনে কুসংস্কারের সামান্য উল্লেখ থাকলেও, অধিকাংশ বচনই সেই দোষের হাত থেকে মুক্ত। বরং খনার বচনে যা আছে, তা হল স্বাস্থ্য, কৃষি এমনকি আবহাওয়া সম্পর্কে পূর্বাভাস বা বক্তব্য। যেগুলি রীতিমত ‘বৈজ্ঞানিক’ পর্যবেক্ষণ ভিন্ন অতখানি সহজে কারো পক্ষে সেই সময়ে উপস্থাপন করাটা বিস্ময়ের। আজও, দুই-বাংলার কৃষক সম্প্রদায় খনার বচনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সেগুলির বাস্তবধর্মীতাকে স্মরণ করে চলেছেন। খনা বলেছিলেন,
“শুনরে ব্যাটা চাষার পো,
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে হলুদ রো,
আষাঢ় শাওনে নিড়িয়ে মাটি,
ভাদরে নিড়িয়ে করবি খাঁটি,
হলুদ রোলে অপর কালে,
সব চেষ্টা যায় বিফলে”
এক্ষেত্রে এটাও বলা উচিত যে, খনার বচনে কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে নারীনিন্দা অথবা পুরুষশ্রেষ্ঠতা অনুপস্থিত। সেকালের হিসেবে এর থেকেই কিন্তু খনার নারীত্ব সম্পর্কেও অনেকটা নিশ্চিত হওয়া চলে। সে যা হোক, খনা আরও বলেছিলেন,
“শুনরে বাপু চাষার বেটা,
মাটির মধ্যে বেলে যেটা,
তাতে যদি বুনিস পটল,
তাতে তোর আশার সফল”
এখন কাব্যগুণের আলোচনায় যাব না। ভাষার নবীনত্ব বা প্রাচীনত্ব নিয়ে তর্কে বসব না। কারণ সে বিদ্যে আমার নেই। কেবল লক্ষ্য করব, বচনগুলির বিশেষত্ব, বিষয় এবং একমুখী বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের প্রত্যেকটি উদাহরণ। আজ মহাকালের গর্ভে খনার ইতিহাস যদি এতখানি বিনষ্ট হয়ে না যেত, হয়ত আমরা আরও কিছু পেতাম, আরও খানিকটা বিজ্ঞান, কৃষি, আবহাওয়ার সার্থক লিপিকৃত সংবাদ, কোনও এক বাঙালিনি’র কলমে।
বরাহ ছিলেন ভারতশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ। তাঁর পুত্র মিহিরও সেই জ্ঞান লাভ করেছিলেন। অপরপক্ষে খনার পরিচয়ও নেহাত সামান্য ছিল না। সিংহল-রাজদুহিতা বা দেউলি গ্রামের অটনাচার্যের কন্যা – খনার পরিচয় যাইই হোক না কেন লোকশ্রুতি বলে, কোনও একবার মহারাজ বিক্রমাদিত্য কর্তৃক প্রদত্ত একটি সমস্যার সমাধানে বরাহ, ও তস্য পুত্র মিহির উভয়েই ব্যর্থ হলে পরে খনা একলাই সেই সমস্যার সমাধান করেন। এরপর, ক্রোধান্বিত পিতা ও পুত্র – খনার জিহ্বাচ্ছেদ করেন। অন্য লোকশ্রুতি অনুযায়ী অবশ্য খনা নিজেই নাকি স্বামী ও শ্বশুরের চেয়ে অধিকতর বিদ্বান প্রমাণিত হওয়াতে আত্মলজ্জায় নিজের জিভ নিজেই কেটে ফেলেন, আর সেই থেকেই স্বরবিকৃতির কারণবশত তিনি ‘খোনা’ বা খনা বলে বিখ্যাত হন। বাংলা ও উড়িষ্যার একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত এমন কিছু কাহিনী বা লোকশ্রুতিই আজ খনার বিষয়ে জনমুখে শতাব্দীর পরে শতাব্দী ধরে চলে এসেছে। এই যে বাকস্বাধীনতার অধিকার - বড় বিশ্রী অধিকার, সকলকে কি আর সত্যি সত্যিই বলতে দেওয়া যায় ? বলতে দিয়েছে কেউ ?
খনা লিখেছিলেন,
“সকাল শোয় সকাল ওঠে,
তাঁর কড়ি না বৈদ্যে লোটে”
আমরা ইংরেজীতে পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে মুখস্থ করে আসব, “Early to bed, early to rise; makes a man healthy, wealthy and wise” – কখনও ভেবে দেখব না, হাজার বছর আগেকার কোন এক অখ্যাত বাঙালিনি’র কলমেই বুঝি বা তা লেখা হয়েছিল। অখ্যাত কারণ – তিনি বচন লিখে থাকতে পারেন। কিন্তু, তিনি স্বীকৃত অধিকারপ্রাপ্তা নন। তাঁর নামে কোনও বিজ্ঞানকেন্দ্রের শিলান্যাস করেনি কেউ। কৃষিকেন্দ্রেরও স্থাপনা ঘটেনি কোথাও। কেবল আজও তিনি ঘরে ঘরে গ্রামবাংলার অখ্যাত হেটো-হাটুরেদের মুখে-মুখে থাকেন। শহর ও গ্রামের দুস্তর ব্যবধানকে, ঘোচানো যে অসম্ভব।
সূত্রঃ
১) ‘খনামিহিরের ঢিপি’, বাণী বসু, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ
২) ‘কিংবদন্তীর খনা ও খনার বচন’, পূরবী বসু, অন্যপ্রকাশ, বাংলাদেশ
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১৬ নভেম্বর ২০২০
ছবি : প্রতীকী
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment