- 28 November, 2021
- 0 Comment(s)
- 547 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
(দ্বিতীয় কিস্তি)
[৩]
আমি অন্ধ লোভে পড়েছি : রিমা
রুমমেট রুমে নেই। আপাত বাঁচা গেল। বসন্তের নির্জন দুপুরের শান্ত পরিবেশ চিরকালই রিমার কাছে অন্যরকম উপভোগ্য। এ সময় সবাই ঘুমালেও জেগে থাকে রিমা। পাখির ডাক শুনে, দুপুরের রোদস্নাত বাতাস শরীরে মাদকতা ডেকে আনে। স্মৃতিকাতর হয় মন ও শরীর। নিজের শৈশব মেলে ধরে নিজের সামনে। কত রকমের ঘুমন্ত-জাগ্রত স্মৃতি যে জিউল মাছের মতো উজিয়ে ওঠে মনে। দুই গ্রাম দূরের চড়কমেলার স্মৃতি মনে পড়ে। মেলা থেকে চাকু কেনার স্মৃতি মনে পড়ে। বিচিত্র রকমের চাকু। কাস্তের মতো বাঁকানো বড় মানুষের আঙুলের সমান চাকু দিয়ে আম ছোলা সহজ। ছোট্ট মানুষের হাত কতোটুকু আর। রিমার ডান হাতের আঙুলগুলো গুটিয়ে আসে, যেন হাতের মুঠোয় গুটি আম। জোবেদা-আসমা-হাসিনা হৈহল্লোড় করে ছোটে আসে। ওদের একজনের হাতে বাটি, একজনের কাঁচা মরিচ, আরেকজনের হাতে লবণ। রিমার জিভ লালায়িত হয়। নিকটে কোথাও ঘুঘু ডাকছে। দুপুরের প্রখর সূর্যটাকে মাথায় নিয়ে বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়ানোর দাপটে রঙিন দিনগুলো কোথায় হারালো! জোরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে স্মৃতির ফাঁদ ছেড়ে।
পেছনে ফিরে তাকালে ভয় হয় এমন কোন স্মৃতি নেই রিমার। গভীর কোন সংকটে পড়েনি। একেবারে ছকেবাঁধা আঁটসাঁট জীবন। প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, সরকারি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পা ফেলা পর্যন্ত রিমার নারী জীবনে স্মরণীয় কোন দুর্ঘটনা নেই। অস্পর্শ মন, অস্পর্শ শরীর। সাদা ধবধবে মনে বিন্দু পরিমাণ আঁচড়ও লাগেনি।
হোক নিছক দুর্ঘটনা, তবু তো পুরুষ স্পর্শ নিয়েছি, পুরুষের একেবারে বুকের উপরে পর্যন্ত হাত রেখেছি, স্ফিত বক্ষদেশ প্রদর্শন করেছি, এই ভেবে রিমা জিভ কামড়ে ধরে নিজের অলক্ষ্যে। এ কী সর্বনাশ! এ কী লজ্জা! এখন ছেলেটির সামনে যাই কী করে! এ মুখ-ই দেখাব কী করে! চৌধুরীর স্যারের আড্ডায় না হয় না গেলাম, তবুও দেখা তো হবেই। এতো তো গ্রাম শহর বা একটি দেশ নয়, আবার এক দু’দিনের ব্যাপারও নয়, বছর বছর একই ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। এদিকে চৌধুরী স্যার কী ভাবলেন কে জানে? সুযোগ পেয়ে যুবকের বুকের উপরে হামলে পড়েছি, বুকের ওড়না ছাড়া ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি স্ফীত বক্ষ নিয়ে—বাঙালি মেয়ের এ কী স্পর্ধা! নিজের শরীর এভাবে নিজের লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াবে, প্রতিপক্ষ হবে, শত্রু হবে, এ কথা কোনোদিনই ভাবেনি রিমা। বাংলা সিনেমাতেও এতটা হয় না।
ছেলেটির নিশ্বাস, শরীরের গন্ধ, দেহের উষ্ণতা শরীরের ঘামের মতো সঙ্গে নিয়ে রুমে ফিরেছে রিমা। দুপুরের ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়ে দু’দণ্ডও শান্ত রাখতে পারে না মন। গোঁয়ার ষাড়ের মতো গুঁতো মেরে ছিঁড়ে ফেলে যুক্তির জাল। একদিকে শান্ত হলে তিনদিকে ঝড় ওঠে। রিমা নিজেই আবিষ্কার করে, আমি আর একা নেই রুমে। এসবই মন আর শরীরের যূথবদ্ধ ষড়যন্ত্র। মন ভুললে শরীর বেঁকে বসছে, শরীর ভুললে মন। বসন্তের বিকেল। শহরে না হয় নদীর পাড় ধরে একা হাঁটা যায়। এই জাঁদরেল ভূত শরীর-মন থেকে তাড়াতে হবে। এখনি বাইরে বের হতে হবে। বিকল্প নেই।
হল গেটের বাইরে এক পা ফেলেছে মাত্র। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে রিমার সর্বশরীর, আপনি?
সুমনের মুখে ভূবনজয়ী হাসি। সরি, ডিস্টার্ব করে ফেললাম বোধ হয়। আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি সেই দুপুর হতে। কী করি বলুন, ছিনতাই যখন আমি করেছি, ছিনতাইয়ের মালটা ফেরত দেবার দায়টাও আমার উপরেই বর্তায়, কি বলেন?। এমনভাবে ছুটে বেরিয়ে এলেন তখন, আমি কিছুতেই নাগাল পাইনি। অ্যাথলেটিক্স ছিলেন নাকি? পেছন থেকে এতো ডাকলাম, শুনলেন কিনা জানি না, ফিরে তাকালেন না। আপনার ঘড়ি হাত থেকে খুলে পড়েছিল ফ্লোরে। সম্ভবত আপনি টের পাননি?
প্রলোভনের হাসি ফুটে ওঠে রিমার ঠোঁটে, শুধুই কি ঘড়ি ছিনতাই হয়েছে? নাকি অন্য কিছু..
না, আর কিছুই তো পড়ে থাকতে দেখিনি। আপনার কি আরও কিছু খোয়া গিয়েছে? কাল তাহলে স্যারের রুম সার্চ করে দেখব—সরল মনে কথাটি বলে হাঁটা ধরে সুমন।
ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে রক্ত বের করে ফেলে রিমা। ছি! এ কী ফাজলামি!
রিমার বাইরে বের হওয়ার ইচ্ছেটাই হত্যা করে গেল ছেলেটা। ঘড়িটা হাতে নিয়ে ফিরে গেল রুমে। লাইট জ্বালানোর ইচ্ছে হয় না। অন্ধকার বরং নিরাপদ। দুপুরের উত্তাপে বিছানা এখনো তপ্ত। দুপুরের দ্বিগুণ অস্থিতরতা এখন রিমার মনে। দুপুর থেকে আমার হাতে ঘড়ি নেই, আমি টেরই পেলাম না! হাতের ঘড়ি পর্যন্ত খুলে গেল! তার মানে, ধস্তাধস্তি বেশ জোড়ালোই ছিল। যতো দূর ভাবছি তার চেয়ে বেশি ছিল।
রিমার দুই মনের মধ্যে সংলাপ শুরু হয়; সঙ্গে শত্রু শত্রু খেলাও শুরু হয়ে গেল। এক মন বলে—স্রেফ দুর্ঘটনা। অন্ধকারের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রিমা নিজের সঙ্গে সংলাপে বসে। চয়নিকাকে দেখেছি, সাথীকে দেখেছি, নির্মলাকে দেখেছি, কত দেখছি, পুরুষ মানুষের সঙ্গ-লোভে ফাঁদে পা ফেলে জীবনটাই বরবাদ করেছে। কলেপড়া ইঁদুরের মতো শেষে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। মধ্যপথে লেখাপড়া খতম, ক্যাম্পাস ছেড়েছে। অন্ধ লোভ! লোভে ধরেছে তোকে! নির্লজ্জের মতো বললি, শুধুই কি ঘড়ি ছিনতাই হয়েছে? লোভে পা ফেলিস না রিমা, জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে ছোট্ট একটি জীবন। একবার পা হড়কে গেলে সোজা গর্তে।
রিমার অন্যমনে নিঃশব্দে প্রবেশ করে দুপুরের দুর্ঘটনাটি; যেন রাতের কুয়াশা ভেদ করে সবুজ ঘাসের ভেতরে সকালের সূর্যের রশ্মি নিঃশব্দে প্রবেশ করেছে। সন্ধ্যার কথা ভাবে রিমা। ছেলেটার এভাবে চলে যাওয়া কি দম্ভের প্রকাশ? পাত্তা না দেওয়ার চিহ্ন। নাকি নির্লিপ্ততাই ওর স্বভাব। কিছুটা ক্রোধ, কিছু জেদ, কিছু নেশা, কিছুটা লোভ, কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা ভয়ের সংমিশ্রণের ভেতর দিয়ে সুমনকে ঘিরে জীবন রসায়নের নতুন সমীকরণ-সূত্র আবিষ্কারের নেশার ফাঁদে পা ফেলে রিমা।
বন্ধুরা দু-একজন দরজা ঠেলে উঁকি দিল। পড়ুয়া মেয়ে পড়ছে ভেবে কেউ ডিস্টার্ব করেনি। রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না। দশ টাকা প্যাকেটের শুকনো গোল্ডমেরি বিস্কুট কিনেছিল সপ্তাহখানেক আগে। তাই রাতের খাবার। শুয়েও সুখ নেই, বসে তো নেই-ই। একবার শোয়, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে, আবার উঠে বসে, আবার শোয়। শুয়ে-বসে-পাঁয়চারি করে দুপুরের ঘটনাটাকে ভোলার চেষ্টা করে। স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। এ ঘটনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, ছেলেটির প্রতি আমার কোন দুর্বলতা নেই। এছাড়া থাকার প্রশ্নও ওঠে না। মুখস্থ কবিতা আবৃতি করার মতো কথাগুলো নিজেকে শোনায় রিমা। অতঃপর টান হয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে। চোখের পাতা জোটবদ্ধ হলেই কে যেন নাটকের মতো মেলে ধরে দুপুরের ঘটনা। আর তখনি লাফিয়ে ওঠে রিমা, যাদু-টোনা করল নাকি ছেলেটা! এভাবে শুয়ে-বসে-উঠে-শুয়ে রজনীর শেষার্ধে ঘুম নামে রিমার ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত চোখে।
ঘুমেই কী শান্তি! স্বপ্ন দেখে রিমা—বৈশাখের দুপুরের কাঠফাটা রোদ মাথায় দৌড়ে বেড়াচ্ছে ওদের আমতলির মাঠে। জোবেদা, আসমা, হাসিনা ওরা সবাই কোথায় যেন লুকিয়ে আছে। কিন্তু ফসল কাটা ন্যাড়া মাঠে লুকাল কোথায়? ওরা আছে আশেপাশে। ওদের ফিসফিসানি, হাসাহাসি, ঠেলাঠেলি সবই শুনতে পায় রিমা। ওরা কি অশরীরী হয়ে গেল? জ্বিন-ভূত হয়ে গেল! হঠাৎ দেখা গেল ওরা তিনজন বাতাসের আগে আগে হাঁটছে, নিচ থেকে ধীরে ধীরে ওদের শরীর সাপ হয়ে যাচ্ছে! ক্রমশ ওরা পরিপূর্ণ সাপ হয়ে গেল। রিমা ভয়ানক ভয় পায়। ওরা কী আর মানুষ হবে না! ওরা এখন থেকে সাপ হয়েই পৃথিবীতে বাঁচবে! কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখে, তিনটি সাপ বাতাসে উড়ে আসছে, ওদের লক্ষ্য রিমা।
রিমা মরণ-চিৎকার দিয়ে ওঠে, তোরা আমাকে ছোবল দিস না, দোহাই, আমাকে বাঁচতে দে, আমি মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই, আমার কতো স্বপ্ন। তোরা আমার স্কুলের সহপাঠী, তোরা আমার খেলার বন্ধু, তোরা আমাকে মানুষ হয়ে বাঁচতে দে।
ক্রমাগত চিৎকারে ধীরে ধীরে নিথর হয়ে আসে রিমার শরীর। ঘুম ভাঙার পরেও শরীরের নিথরতা যায়নি। কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকে।
বিশ্রী-বীভৎস একটি রাত গেল। এমন রাত যেন শত্রুর জীবনেও না আসে। সাড়ে নয়টায় ক্লাস। বাজে ৯টা। ত্বড়িৎবেগে বিছানা ছাড়ে রিমা। বাথরুমের কার্যক্রম শেষে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিছুদূর হেঁটে রিক্শায় উঠে। ক্লাসে পৌঁছে দেখে, বন্ধুরা মাস্তি করছে। এত সকালে স্যারের ঘুম ভাঙেনি, তাই আসেননি। পেটের ক্ষুধা নিয়ে আর কতক্ষণ? বাইরে থেকে লিলিকে ইশারায় ডাকলে লিলি উঠে আসে। ক্ষিধেয় পেট পুড়ছে। চল ক্যান্টিনে যাই। কিছু খেয়ে আসি। লিলি বলে, পাগল হয়েছিস। আমি উঠলে ওরা তিনজনও উঠবে। এত জনের বিল দিতে পারবি? তার চেয়ে বরং তুই একা যা, চুপ করে খেয়ে আয়।
ক্ষিধের পেট। কোনোদিকে না তাকিয়ে আলুভর্তা দিয়ে ঠাণ্ডা খিচুরি গোগ্রাসে গিলছে রিমা। খাওয়া শেষ, শেষ নলা হাতে, মুখ হা করেছে, এ মুহূর্তে জলজ্যান্ত সুমন হাজির। রিমার হা-মুখ হা হয়েই আছে। হাতের নলা হাতেই। বিকল যন্ত্রের মতো রিমা স্থির। পাশের চেয়ারে বসে পড়ল সুমন।
ভুল সময়ে এসে গেলাম। যেভাবে খাচ্ছিলেন, গলায় যদি আটকায়, যদি ডাক্তার ডাকতে হয়, এ ভেবে এলাম। অন্তত জলটা তো হাতে ধরিয়ে দিতে পারব। হাতের নলা থালায় রেখে হাত ধোয়ার জন্য উঠতে গেলে রিমার হাত ধরে ফেলল সুমন। আমার অপরাধ হলে শাস্তি দিন, কিন্তু এভাবে মুখের আহার ফেলে যাবেন না, অনুরোধ। ঘোর অকল্যাণ। এছাড়া জানেন তো, এ একমুঠো খাবারের অভাবে এই মুহূর্তে কতজন মানুষ মারা যাচ্ছে পৃথিবীতে?
ঘরে-বাইরে আর কোথাও শান্তি নেই। রাগে কাঁপছে রিমা। হাত টান দিয়ে ছাড়িয়ে নেবার ফাঁকে বলে, আপনার মার্কসবাদী কথাবার্তা আপনার কাছেই রাখেন, আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না।
বেসিনে হাত ধুয়ে, টেবিল থেকে ব্যাগ নিয়ে হাঁটা ধরে রিমা। সুমন বসেই আছে। হাঁটতে হাঁটতে রিমা জিজ্ঞেস করে নিজেকে—একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল কিনা? যার বুকের উপরে হামলে পড়তে পারি, সে সামান্য হাতটাই তো ধরেছে, এ তো ভয়ানক অকৃতজ্ঞতা! এতটা অকৃতজ্ঞ তুই কবে হলি রিমা! ফিরে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলে কেমন হয়? অন্য ছেলে হলে হনুমানের লেজের মতো পেছনে পেছনে হাঁটত মান ভাঙানোর জন্যে। এ ছেলে তো আলাদা ধাতুর তৈরি। আসবে না। নিশ্চয় আসবে না। আর একবার দেখা হোক, দেখি কী প্রতিক্রিয়া দেখায়। পরে না হয় ক্ষমা চেয়ে নেব।
ক্লাস শেষ হয় ১২ টায়, দুপুর ২টা পর্যন্ত রিমা একা ক্যাম্পাসে এলোপাতাড়ি হেঁটে বেড়ায়। কখনো ক্যান্টিনে, কখনো সিনেট ভবনের চারপাশে, কখনো আমচত্বরের চায়ের দোকানগুলোর সামনে। সুমনের থাকার সম্ভাব্য স্থানগুলোতে তিনবার চারবার করে চক্কর মারে। সুমনকে না পেয়ে হতাশ হয়ে রুমে ফেরে। কোথায় আমার অভিমান হবে, তোয়াজ করে অভিমান ভাঙাবে, কিন্তু দেখো, আমিই হন্যে হয়ে খুঁজছি ছেলেটাকে! কী এক নারীজন্ম নিয়ে এলাম পৃথিবীতে! ছেলেটা অভিমান করে কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে কে বলবে।
বিকেলে বেরুবার সময় অকারণেই আয়নার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে রিমা। নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেই অবাক! শ্যামলবর্ণ শরীরে এ কিসের আলামত! গালের মাংসগুলো ফুলে উঠেছে। আর দেখো, কেমন লাল হয়ে উঠেছে। বুকের ধুকপুকানি তো আছেই। সারাক্ষণ ঠোঁট কাঁপে কার ঠোঁটের স্পর্শের লোভে! সুমনের? ছি ছি ছি! পাপে ধরেছে। রিমা তোকে পাপে ধরেছে। আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমার কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার নেই। আমি কী এমন বলেছি! ক্যান্টিনে মানুষের ভিড়ের মধ্যে যুবতী মেয়ের হাত ধরবে, এ তো অসভ্যতা!
আয়নায় প্রতিফলিত রিমার ছায়া এবার কথা বলে, সুমন ধরেছে তোর হাত, আর তুই?—সুমনের বুকের ওপরে শুয়েছিস, দুই হাতে বুকটা অধিকারে নিয়ে তবেই না উঠে দাঁড়িয়েছিস।
দুর্ঘটনা, স্রেফ দুর্ঘটনা। এজন্য আমার কোন দায় নেই। রিমার শরীর কেঁপে ওঠে, দ্বিগুণ কেঁপে নিজের ছায়া।
তোর মনে লোভ ছিল না? ছিল তো? ছায়াটির ঠোঁটে হাসি।
অপরাধীর মতো ঘাড় নিচু করে রিমা।
[৪]
আমি কি পথ হারিয়ে ফেলছি : রিমা
নিজের ছায়া-ই এখন রিমার শত্রু। শেষ পর্যন্ত হল থেকে বেরুতেই হয়। সূর্যটি দৌড়াচ্ছে আত্মাহুতি দেবার জন্যে। অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ করে রিমা ভাবে, কে দেয় না আত্মাহুতি? এত শক্তি আর তেজ যার বুকে, তারও দিন শেষে আত্মসমর্পণ আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা নামবে, দ্রুত পা ফেলে হাঁটে রিমা। বিজ্ঞান ভবন-২ এর কাছাকাছি পৌঁছেই দেখে, পা দিয়ে বাতাসে লাথি মারতে মারতে এদিকেই আসছে সুমন। রিমা বুকে থু-ফু দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। রিমার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ বাঁক নিয়ে দক্ষিণে হাঁটা ধরে সুমন। দক্ষিণে পথ নেই, খেলার মাঠ। বেশিদূর যায়নি সুমন। একটা টুকরো কাগজ কুড়িয়ে বসে পড়ল ঘাসের চাদরে।
আমি কি ওর বড়শি গাঁথা মাছ? এভাবে খেলিয়ে খেলিয়ে ডাঙ্গায় তুলবে। আমি যাব না ওর কাছে। কিন্তু এক মিনিটও পণ রক্ষা করতে পারল না। নিজের পা দুটি-ই ঘরের শত্রু বিভীষণ। রিমার পণকে তোয়াক্কা না করে মন্ত্রপড়া বাটির মতো ছুটছে।
সূর্যের মুখোমুখি বসে আছে সুমন। সুমনের মুখোমুখি বসে রিমা। কথা বলে না কেউ কারো সাথে। কথা বলার ভাষা যেন ওরা এখনো শেখেনি। সূর্যটার আত্মাহুতি প্রায় সম্পূর্ণ। সন্ধ্যার অন্ধকার ধেয়ে আসছে। নির্জন মাঠ। ধীরে ধীরে দুজনের মুখের অভিব্যক্তিগুলোকে ঢেকে দিচ্ছে অন্ধকারের ছায়া। হঠাৎ সুমন দু-হাত জোড় করে, ক্ষমা চাইছি, সকালে এভাবে হাত ধরা ভুল ছিল।
রিমার দুই হাত গিয়ে পড়ে সুমনের দুই হাতের উপরে, সরি, আমি খুব সরি।
অন্ধকারে রিমার কোনো ছায়া নেই। কেউ দেখছে না রিমাকে। রিমা তখন নিজেকে মেলে ধরে সুমনের কাছে। বলে, ঘুমাতে পারি না আমি, একদম ঘুমাতে পারি না। ঘুমালেই সাপের মতন কেউ প্যাঁচিয়ে ধরে আমার বুক, আমার কোমার, আমার সমগ্র অস্তিত্ব! আমি তখন নড়তে পারি না, ভীষণ ভয় পেয়ে জেগে ওঠি। রিমা আবিষ্কার করে, ওর সমগ্র শরীর চলে গিয়েছে সুমনের বাহুতলে। সুমন কানের কাছে মুখ নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণের মতো করে বলে, ভয় নেই সোনা, ভয় নেই, আমি আছি, তোমার কোনো ভয় নেই।
মর্ত্যরে সব অন্ধকার এসে ঢুকে পড়েছে রিমার মধ্যে। সুমনের মধ্যে। মানুষের সুপ্রাচীন বাসনা ও আদিম লোভ প্রকাণ্ডরূপ ধারণ করেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে দৌড় দিল রিমা। রিমার মনে হলো, সুমনও দৌড় দিল।
নির্জন মাঠে পথ হারিয়ে ফেলা বালিকার মতো ভয়ে-আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে অন্ধকারে এলোমেলো দৌড়ায় রিমা। কিন্তু অন্ধকার মাঠ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পায় না।
আমি কি পথ হারিয়ে ফেলছি? আমি কি পথ হারিয়ে ফেললাম?
এ সময় মাঠের মধ্য দিয়ে শর্টকার্ট পথে বাসায় ফিরছিলেন প্রফেসর চৌধুরী। অন্ধকারে একটি ছায়া দৌড়াচ্ছে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন, কে? কে এভাবে দৌড়াচ্ছো অন্ধকারে?
সুতা কাটা ঘুড়ির মতো গুত্তা খেয়ে প্রফেসর চৌধুরীর পায়ের কাছে পড়ল রিমা। দুই হাতে রিমাকে তুলে ধরলেন প্রফেসর চৌধুরী। ওহ! তুমি? সুমনকে দেখলাম ওদিকে যেতে।
আমি কি পথ হারিয়ে ফেলেছি স্যার? এতক্ষণ ধরে দৌড়াচ্ছি, কিন্তু মাঠ থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছি না!
পথ তো তোমার, আমি কী করে বলি, তুমি পথ হারিয়ে ফেলছো কিনা? তুমি কোন পথে যাবে, কোথায় পৌঁছাবে, সে তো একান্ত তোমার ব্যাপার? আমি শুধু জানি, এই পথে আমি ঘরে ফিরছি। কিন্তু আমি আর তুমি তো এক মানুষ না। আমরা আলাদা মানুষ, আলাদা আমাদের ঠিকানা। আমার পেছনে হাঁটো, রাস্তায় উঠে যাবে, আলো পাবে। পথ কিন্তু তোমাকেই খুঁজে নিতে হবে। তোমার পায়ে হেঁটেই তোমার গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে।
প্রফেসর চৌধুরী হাঁটতে শুরু করলেন। পেছনে পেছনে হাঁটে রিমা। রাস্তায় পৌঁছার পরে প্রফেসরর চৌধুরী উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করলে রিমা হলের অভিমুখে দক্ষিণ দিকে হাঁটে।
[৫]
মা, মাগো, বাঁচাও তুমি : রিমা
হলের গেট দিয়ে ঢুকে ঝড়ের বেগে রুমে পৌঁছেই দরজা আটকে দিল রিমা। আলো জ্বালিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আঁতকে উঠে এক পা পেছনে ফেরে রিমা, এ কাকে দেখছি আমি? এ কী রিমা! এ কী আমি! মাথার চুল, কান-গলার ভাঁজে, হাতে, পায়ের পাতা পর্যন্ত কি শরীর কি কাপড় মরা দূর্বাঘাসে ভর্তি। এমন বিধ্বস্ত চেহারায় কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ!
ক্ষিপ্রতার সাথে পরনের পোশাক ছেড়ে কোমর বরাবর গামছা প্যাঁচিয়ে বাথরুমে ঢোকে রিমা। মাথা বাদে বাকি শরীরে পানি ঢালে অনেকক্ষণ।
রাতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে রিমার। জ্বরের ঘোরের মধ্যেই ভাবনাগুলো আসে। আমি কি তাহলে সুমনের প্রেমে পড়েছি? এরই নাম কি প্রেম? এখান থেকে ফেরার পথ নেই? এরপর কী? বিয়ে? সর্বনাশ! কোন সর্বনাশা পথে হাঁটছি আমি!
সুস্থ সবল শক্তিশালী পুরুষকে ভালোবাসা, বিয়ে, তারপর দুটা- একটা সন্তান, সংসার—এ তো নারীজন্মের সুখ-স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্ন একইসঙ্গে রিমার সামনে এখন মোহনীয়, ছলনা, আর নিষ্পত্তিহীন ভয় নিয়ে হাজির। হিংস্র ছোবলের অনিবার্য নিয়তি এড়াবে কী করে? সামান্য এক মেয়ে। বাঙালি মেয়ে। লড়াই করার এত পুঁজি কোথায়? জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গেল কিনা, অস্পষ্ট স্বরে মাকে ডাকে রিমা, মা, মাগো, তোমার মেয়ে দেখো সর্বনাশা প্রেমে পড়েছে? তুমিই পারো বাঁচাতে। [চলবে...]
২০১০-এ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত। ২য় সং ২০১৭।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।)
0 Comments
Post Comment