সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিতৃচোখে মেয়েরা (পর্ব- ৩)

  • 02 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 373 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
 একজন আত্মহত্যা করেছেন, তিনি কেন আত্মহত্যা করেছেন সেই বিষয়ে তলিয়ে ভেবে দেখার আমাদের সময় নেই। সামাজিক মাধ্যমে নীতিপুলিশদের দাপাদাপিতে আমরা কী দেখলুম, সেই মেয়েটা অভিনয় করতেন, লিভ ইন করতেন তাই খুউব বাজে মেয়ে!  চরিত্রের ঠিক নেই। উপরিউক্ত মন্তব্যগুলির আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, পল্লবীর চরিত্র নিয়ে বেশি টানা হেঁচড়া চলছে। আত্মহত্যার মত সংবেদনশীল বিষয় ‘চরিত্রের মাপকাঠির’ কাছে ঠুনকো হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

কখন খুন, কখন আত্মহত্যা, কখন হাতকাটা, কখন ধর্ষণ করে খুন এইসব খবরের বাড়বাড়ন্ত আমাদের মতন আলুনিময় জীবনে যেন বিনোদন সরবরাহ করে! এইসব খবর দেখে পানু কাকু, দিনু বাবু, মুন্নি কাকি, হাসি মাসি, ঝিংকু দিদি, পিংকু দাদা লাফিয়ে পড়েন কোন এক সামাজিক মাধ্যমে! ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্সট্রাগ্রামে মহামন্ত্র জপ করিতে থাকে। মন্তব্য বাক্স ফুলে-ফেঁপে-কেঁপে ওঠে। খুন হয়েছেন, বেশ হয়েছে। চরিত্র ঠিক নেই! আত্মহত্যা করেছে, খুব ভালো! বারোয়ারি মেয়ে, বাঁচা গেছে। কুকথায় চারিদিক ছেয়ে যায়। কিছুদিন আগে একজন টেলিভিশন অভিনেত্রী আত্মহত্যা করেন। গড়ফার একটি আবাসনের ঘর থেকে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল টলিউড অভিনেত্রীর। তাঁর নাম পল্লবী দে। তিনি 'আমি সিরাজের বেগম’ ধারাবাহিকে সিরাজের স্ত্রী লুৎফা-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্রের জন্য তিনি জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। তার আগে ‘রেশম ঝাঁপি’ ধারাবাহিকেও তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে দেখা গিয়েছিল। টলিউডে পল্লবীর যাত্রা খুব বেশি দিন হয়নি। ‘কুঞ্জছায়া’ নামে একটি ধারাবাহিকেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। গড়ফার ফ্ল্যাট থেকে পল্লবীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করেন তাঁর সঙ্গী। তিনিই পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ অভিনেত্রীর দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার অনলাইন, ১৫ মে,২০২২)

 

পল্লবীর মৃত্যুর খবর চাউর হইতে না হইতে, হারে রে রে রে রে, আমায় রাখবে ধ'রে কে রে- বলে সামাজিক মাধ্যমে কর্তাব্যক্তিরা ধেয়ে আসেন। আত্মহত্যার খবর প্রচারের সময় আমাদের অতিউৎসাহী মিডিয়া হেডমাস্টারমশাই সুলভ ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন, পল্লবী লিভ ইন করতেন। ব্যাস, আর যাবে কোথা বাছা!  প্রসঙ্গত- "কয়েক বছর আগেই একটি মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, প্রাপ্তবয়স্ক যে কোনও যুগলের ‘লিভ টুগেদার’ করার অধিকার রয়েছে। সেই মামলায় একই সঙ্গে এটাও বলা হয় যে, ২১ বছর বয়স হওয়ার আগে পুরুষের বিয়ে আইনত বৈধ নয়। কিন্তু সেই তরুণ যদি লিভ-ইন সম্পর্কে থাকে তবে তা বৈধ।" (তথ্যসূত্র:আনন্দবাজার অনলাইন, ১৬ মে ২০২২)

পল্লবীর নিজস্ব ইনস্টাগ্রাম আইডি, অনলাইন ফেসবুক  নিউজ পোর্টাল, ইউটিউব থেকে আমরা  কিছু মন্তব্য দেখে নেব।

 

পল্লবীর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের মন্তব্য-

বেশি মডার্ণ মেয়েদের এই হয়... লিভ ইন করে হয়েছে... (পুরুষের মন্তব্য)

 

বাঁচা গেছে এরকম জানোয়ার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। (পুরুষের মন্তব্য)

 

প্রস্টিটিউট একটা। (নারীর মন্তব্য)

 

টিভিতেই একটু মুখ দেখালেই একদম হাইফাই হয়ে যায় না, মডার্ণ বেশি ভাবলে এমন হয়।(পুরুষের মন্তব্য)

 

ফেসবুক

" মা বাবার বাঁচার জন্য শুধু টাকার দরকার যেটার জন্য বান্ধবীর বরের সাথে মেয়েকে নিজেরাই গড়ফায় রেখেছিলো. মেয়ের হাতে আর কাজ নেই, কিন্তু দামি গয়না, ফ্ল্যাট, আসবাব এইসব EMI দিতে হবে তখন সে সুইসাইড করল. আসলে সাগ্নিকের বাবা প্রোমোটার, আগেও তাদের গাড়ি ছিল যেগুলো হাতাবে বলেই মেয়েকে পরকীয়া করতে শিখিয়েছিল. এখন মেয়ে নেই তাই ছেলেটাকে ফাঁসিয়ে তাদের ফ্ল্যাট গাড়ি নিতে চাইছে পল্লবীর বাবা মা। (তথ্যসূত্র:  হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা) নারীর মন্তব্য।

 

"তার এই অবস্থার জন্য তার বাবা মা কি দায়ি নয়। সন্তান কী করছে কার সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব দেখা কী তাদের দায়িত্ব ছিলো না? বেশি কথা বলবো না। মেয়েটি কোনো ভালো মেয়ে ছিলো না। তার এ অবস্থার জন্য সে নিজেও দায়ি। সে বড় হয়েছে তার বুদ্ধি হয়েছে। নিজের মতো স্বাধীন ভাবে চলতে হলে মানুষ চিনতে হয়। কার সাথে চললে ভালো হবে, কার সাথে থাকলে খারাপ কিছু হবে। এ-সব কিছু বোঝার ক্ষমতা না থাকলে তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না।  (তথ্যসূত্র:  হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা) পুরুষের মন্তব্য।

 

আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি কোনো সময়  মেযেদের একা থাকতে দিতে নেই যতক্ষণ না সে মা হচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে। ছেড়ে  দেওযার  ফল দেখতেই হচ্ছে । ডিপরেশন আর কিছুই  না।। (তথ্যসূত্র:  হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা) নারীর মন্তব্য।

 

মেয়েটার দোষ, সঙ্গে মা বাবার। (তথ্যসূত্র:  হিন্দুস্থান টাইমস বাংলা) নারীর মন্তব্য।

 

 

ইউটিউব

লিভ ইন... বলার থেকে না বলাই ভাল। (নারীর মন্তব্য)

 

 

আপনি কি সুবিধাবাদী, বিনা পয়সায় ফুর্তি। (পুরুষের মন্তব্য)

 

 

আপনি ঠিক বলেছেন, লিভইনআইনের চোখে অবৈধ নয়, কিন্তু সামাজিক ও নীতিগত ভাবে কেমন যেন লাগে, এরা অধিকাংশ উচ্ছৃঙ্খল ও সুবিধাবাদী হয়। (পুরুষের মন্তব্য)

 

একজন আত্মহত্যা করেছেন, তিনি কেন আত্মহত্যা করেছেন সেই বিষয়ে তলিয়ে ভেবে দেখার আমাদের সময় নেই। সামাজিক মাধ্যমে নীতিপুলিশদের দাপাদাপিতে আমরা কী দেখলুম, সেই মেয়েটা অভিনয় করতেন, লিভ ইন করতেন তাই খুউব বাজে মেয়ে!  চরিত্রের ঠিক নেই। উপরিউক্ত মন্তব্যগুলির আধেয় বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, পল্লবীর চরিত্র নিয়ে বেশি টানা হেঁচড়া চলছে। আত্মহত্যার মত সংবেদনশীল বিষয় ‘চরিত্রের মাপকাঠির’ কাছে ঠুনকো হয়ে পড়েছে। বিগত কয়েক বছরে আত্মহত্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। খারাপ চরিত্র যাঁদের, তাঁরাই আত্মহত্যা করেছেন, বিষয়টা কিন্তু একেবারে তেমন নয়। ভাল চরিত্রের অনেকেই কিন্তু আত্মহত্যা করেন। কেন আত্মহত্যা করেন? এর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে? আত্মহত্যা প্রসঙ্গে কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সাইকিয়ট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা: শর্মিলা সরকার জানান- “আত্মহত্যার আশঙ্কা এখন বাড়ছে। বিশেষত, ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে বেড়েছে আত্মহত্যা। তাই প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই এই নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।”

তিনি আরও জানান- “আত্মহত্যাকে কোন একটা কারণ দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না। এর পিছনে অনেক জটিল প্রক্রিয়া থাকে। এই অবস্থায় আত্মহত্যার পিছনে থাকে-

১. পারিবারিক আশান্তি

২. প্রেমজনিত সমস্যা

৩. চাকরি চলে যাওয়া

৪. অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাওয়া

৫. ব্যবসার ক্ষতি

৬. পড়াশোনায় অসফল

৭. মানসিক অসুখ যেমন ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিপ্রেশন,সিজোফ্রেনিয়া

৮. মদ্যপান বা অন্য কোনও নেশা ইত্যাদি।”  (তথ্যসূত্র :এইসময়, ১৭ মে,২০২২)

 

নারীদের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে কত জরুরি বিষয় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে! আমরা একবার তলিয়ে ভেবে দেখছি না, আদতে কী চলছে। অনেকেই মনের অজান্তে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যে সমর্থন করছেন! নিজেদের হতাশা, হাহাকার, নৈতিক অবক্ষয়, বিকৃতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করছেন। সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্যগুলি দেখে মনে হয়, এই মাধ্যমগুলি পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারার প্রকাশের, নারীবিদ্বেষ প্রচারের, নারীবিদ্বেষ সমর্থনের খুল্লাম খুল্লা পীঠস্থান!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment