কুরবানী

  • 14 April, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 433 view(s)
  • লিখেছেন : নার্গিস পারভিন
পরের দিন খুব ভোরে, সবাই তখনো ঘুমাচ্ছে, শিউলি ছুটে গেলো, তাদের ছোট্ট ডোবাটার উত্তর পাড়ে। সঙ্গে একটা কোদাল এনেছিলো সে। আন্দাজে জায়গাটা চিনে নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলো। অল্প আয়াসেই উপরের মাটি সরে একটা বড় গর্ত বেরিয়ে পড়লো। গর্তের মাটি অল্প সরাতেই প্লাস্টিকের একটা বেশ বড়  প্যাকেট। সে প্ল্যাস্টিক ব্যাগের মুখটা কেটে ভিতর থেকে বের করে আনলো তার একাদশ শ্রেণীর বইগুলো! 
 

 - হ্যালো বড়ভাই, তুমি কেমন আছো?

-আমি ভালো আছিরে, তোরা ভালো আছিস? আব্বা, মা, রিজু?

- আমরা সবাই ভালো আছি। তবে ক'দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে তো, সেটাই একটা অসুবিধা। ঘরের চালের অবস্থা তো তুমি জানো, শুনেছ মা'র মুখে। খড়গুলো সব পচে গেছে। জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি পড়লেই  ঘরের মেঝে ভিজে কাদা কাদা হয়ে যাচ্ছে। বাটি, মগ, গামলা পেতে রেখে কাজ চালাচ্ছি। তবে তুমি চিন্তা করোনা আমরা ম্যানেজ করে নিচ্ছি। 

-চিন্তা করবোনা! তা কিভাবে ম্যানেজ করছিস? এই সর্বক্ষণের  বৃষ্টি! খাওয়া শোওয়ার তো খুব অসুবিধা হচ্ছে! 

-না না তেমন কিছু নয়। বৃষ্টি কি দিনে চব্বিশ ঘণ্টাই হয় নাকি? আমরা ঠিক বৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে সময় করে খেয়ে নিই, ঘুমিয়ে নিই। এইতো পরশু দিন, এতো বৃষ্টি হল যে ঘরের মেঝে, বারান্দার মেঝে ভিজে কাদা কাদা। খাটিয়া থেকে নেমে, সবাই যে রান্নাঘরে খেতে যাব, সে উপায় নেই! তখন আবার পা ধুয়ে আসতে হবে ডোবা থেকে। মা তো কেঁদে ঘরের কাদা কিছুটা আরও বাড়ালো। অবশ্য আব্বার চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘরের তাপমাত্রা বেশ গরম। শেষমেশ কিভাবে ম্যানেজ দিলাম জানো? 

-কিভাবে?

- আরে, সেবার তুমি আমাদের জন্য জুতো কিনে এনেছিলে না? তার খালি বক্সগুলো খাটিয়ার তলায় ছিল তো! শুকনোই ছিল তখনো।  ব্যাস, মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো! সেই বক্সগুলো ছিঁড়ে এক একটা ইঁটের মত সাজিয়ে দিলাম। তারপর সেই কাগজের ইঁটে পা দিয়ে দিয়ে আমরা সবাই রান্নাঘরে গেলাম। আচ্ছা বড়ভাই, এরপর দিন এমন হলে, কি দিয়ে ম্যানেজ দেব গো? 

- আরে, তুই ঘাবড়ে গেলে কিভাবে হবে? আমি যতদিন না বাড়ি গিয়ে পৌঁচ্ছাচ্ছি, তোকেই তো সাহস আর বুদ্ধি ধরতে হবে। 

-হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। 

-আচ্ছা তোর বইগুলোর খবর কি? ভিজে যাচ্ছে না তো? রেখেছিস ঠিক করে?

- সেসব কেজি দরে বেচে দিয়েছি। তোমরা সবাই মিলে তো আমার পড়াটা বন্ধ করে দিলে! 

- সেকিরে, তোর বিয়ে দিচ্ছি তুই খুশি হোসনি? কত ভালো পাত্র!

- আমি কিসে খুশি হই, তা তুমি খুব ভালো করে জানো বড়ভাই। এবারের কুরবানীতে তুমি তো আমার সেই খুশিটাই কুরবানী দিতে চলেছো!

-কি বোকা বোকা কথা বলছিস! মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাব দেকি! এমন ছেলে সব সময় পাওয়া যাবে না। 

-পাচ্ছ কোথায়? কিনছ তো! তোমার রক্ত জল করা টাকায়!

-কি সব বলছিস? আমার টাকা তোর জন্য খরচ হলে আমার ভালো লাগবে। তোর বড়ভাই কে তুই কম ভালবাসিস! আমাকে কিছু করতে দে তোর জন্য! 

 - তাই যদি চাও, তবে ঐ টাকাটা আমার পড়াশোনাতে খরচ করোনা বড়ভাই! জানি তুমি পারবে না। আব্বা- মায়ের অমতে সেটা তুমি করতেই পারবে না!  

-দেখ এতগুলো বছর আমি তো তোর কথাতেই সায় দিয়েছি, বুঝিয়েছি ওদের। এখন একটা ভালো ছেলে পাওয়া গেছে। মায়ের কথাটাও তুই ভাব। আমাদের মত মানুষদের সব ইচ্ছা কি পূর্ণ হয়! আর কতটাই বা তোকে পড়াতে পারব বল? 

-আমার যে অনেক পড়ার ইচ্ছা ছিল বড়ভাই! মাধ্যমিক পাশটা করিয়েই হাঁপিয়ে গেলে? 

-আমি বলেছিলাম তোর হবু বরকে সেকথা। ওরা যাতে তোকে বিয়ের পর উচ্চমাধ্যমিকটা পাশ করতে দেয়। ওরা শুনলো না রে!

-ওদের কথা ছাড়ো বড়ভাই, তোমারাও তো শুনছো না! 

-ধুর পাগল, অত ভাবিস না। সব ভালো হবে দেখিস। দে মাকে ফোনটা দে।

-হুম

- ভালো আছিস তো বাপ? এই বর্ষা-বাদলে তোর থাকা, খাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না তো? কাজে যেতে আসতে ভিজে যাস না তো? 

-না মা, আমি ভালো আছি। তুমি চিন্তা করোনা। আমি কুরবানীর দুদিন আগেই বাড়ি চলে যাব। একজনের কাছ থেকে আরও কিছু টাকা পাব। না হলে আগেই যেতাম। টাকাটা নিয়ে, তোমাদের জন্য জামাকাপড় কিনে, আমি ঠিক সময়মত বাড়ি চলে যাব। বিয়ের বাকি ব্যবস্থা সব ঠিকঠাক চলছে তো? আব্বাকে দাও একবার কথা বলি।

-চলছে একরকম ধার-দেনা করে। তোর আব্বা সেই কাজেই বাইরে গেছে একটু। তোর ওপরই সব ভরসা বাপ। মেয়েটাকে বিদেয় করতে হবে তো! 

-চিন্তা কোরোনা মা, আমি আছি তো। ধীরে ধীরে সব শোধ দেব। এধারওধার করে প্রায় এক লাখ মত জোগাড় হয়েছে। সেসব নিয়েই  বাড়ি যাচ্ছি। কুরবানী হয়ে গেলে পণের টাকাটা দিয়ে আসা যাবে। বিয়ের তারিখটা কুরবানীর কাছে কাছেই রেখো। আমাকে তো আবার কাজে ফিরতে হবে। বেশি ছুটি তো পাব না। 

-সেইরকমই করা হবে বাপ। তুই বাড়ি আয়। কতদিন তোকে দেখিনি।

-যাব মা যাব। তুমি একদম ভেবোনা।

-আচ্ছা মা এখন রাখি। কালো মেঘ দেখা দিয়েছে আকাশে।

-রাখবি? আচ্ছা শোন, আমাদের জন্য এখন জামা কাপড় কিনতে হবে না। যা আছে ঐ দিয়েই চলে যাবে। মেয়েটা পরের বাড়ি যাবে ওর জন্যে দুটো একটা নিস। আর ঋজুর জন্যে একটা। এখন সামনে বড় কাজ, পয়সা নষ্ট করিস না। তাছাড়া ঘরের চালটাও ছাইতে হবে। তিন বছর হল নতুন খড় ওঠেনি চালে। তারও তো একটা খরচ আছে। সবই করতে হবে বিয়ের আগে। বুঝে চলিস বাপ।

- আচ্ছা মা, ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না। সব হয়ে যাবে। এখন রাখি। এখানে খুব জোরে বৃষ্টি নামছে। আমি রাস্তায় আছি, ছাতা নেই সঙ্গে, ভিজে যাব।

-ঐ দেখেছো! ঠিক আছে রাখ। তাড়াতাড়ি ফিরে যা।

 

-'দশ দিন হয়ে গেলো, ছেলেটা ফোন করলে না! এক সপ্তাহ পেরোতে দেয়না! শিউলি তুই আর একবার ফোনটা কর না মা!' 

 

- তুমি ভাবছ আমি করছি না? সারাদিন চেষ্টা করে যাচ্ছি মা। চিন্তা করোনা, হয়তো বাড়ি আসবে বলে, বেশি বেশি কাজ করে নিচ্ছে ওভারটাইমে।

 

 দুশিন্তায় কাঁটা হয়ে আছে শিউলি নিজেও। মাকে যতই প্রবোধ দিক, সে জানে বন্যা কবলিত কেরালার অবস্থা। খবরের কাগজে সব পড়েছে। ক্রমাগত বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে কেরালা। হাজার হাজার মানুষ জলবন্দী, হাজার হাজার মানুষ ঘর-বাড়ি হারা! রিলিফ এবং ক্যাম্পের ভরসায় দিনাতিপাত করছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। একশো বছরের মধ্যে নাকি এমন বন্যা হয়নি কেরালাতে। এমনকি জঙ্গলের পশুরাও বন্যার কবলে পড়ে দুর্দশার শিকার। গতকালই খবরের কাগজে পড়েছে শিউলি এইসব। সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। মাকে বলতেও পারছে না। তাদের বাড়িতে টিভি নেই বলেই খবরটা এখনো মায়ের কানে যায়নি। কিন্তু তাদের গ্রামের আশেপাশের আরও দু-তিনটে ছেলে কেরালাতে থাকে। বৃষ্টির জন্যে সবাই একটু কম বেরোচ্ছে  এই যা, তবুও খবর ঠিক ছড়াবে। তার আগেই  একবার বড়ভাই এর ফোন এসে গেলে মঙ্গল! শিউলি ঠিক যা ভাবছিল তাই হল। দুপুরে শিউলির আব্বা  কাজ থেকে খেতে এলো কেরালার বন্যার খবর সঙ্গে নিয়ে। মায়ের খাওয়া-ঘুম মাথায় উঠলো! একদিকে ছেলের জন্য দুশিন্তা- ঐ অত দুর্যোগে, বিদেশ-বিভুঁয়ে সে যে কেমন আছে, কোথায় থাকছে, কি খাচ্ছে!  আবার অন্যদিকে একটা অতবড় কাজ বাড়িতে! সব তার ওপরই ভর করে! মা বিছানা নিয়ে ফেললো! আব্বাও আর কাজে যেতে পারলো না। থম মেরে গেছে একেবারে। শিউলি সারাদিন ফোনে বড়ভাই এর নম্বরে ফোন করে যাচ্ছে! বার বার সুইচ অফই বলছে। বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে আছে। দুটো দিন পার হয়ে গেছে, ইমতিয়াজ এর ফোন আসেনি তখনও। দুদিন হাঁড়ি চড়েনি উনুনে। মুড়ি ভিজিয়ে খেয়ে খেয়ে দিন কাটছে ঋজুর। একটাই অপেক্ষা কখন ফোন বাজবে! কখন ইমতিয়াজ ফোন করে বলবে; সে ভালো আছে, নগদ এক লাখ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে ঈদের দুদিন আগে। সেই দুদিন ও পেরিয়ে গেলো! রাত পেরলেই ঈদ। সকালে উঠেই ঈদের নামাজ শেষে কুরবানী শুরু হবে। গ্রামের ধনী ব্যক্তিরা রেষারেষি করে বেশি টাকা দিয়ে গরু, খাসি কি এনেছে; সেসব কুরবানী দেওয়া হবে। কার গরু আগে জবাই হবে সেসব নিয়েও চলে রেষারেষি। গাঁয়ের গরীব মানুষগুলো বড়লোকদের সেই সুখে তাল মিলিয়ে হাসবে, কর্তার বাড়তি নজর আকর্ষণের প্রয়োজনে; দানে যদি কিছুটা বেশি গোস পাওয়া যায়! 

 তখন সাঁঝবেলা। ইমতিয়াজের বাপ মাথায় হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে আছে, যেন পাথরের মূর্তি! শিউলির হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ের আগে নগদ টাকা না দিলে বিয়ে হবেনা! ঘটক এসে সেই কথাই জানিয়ে গেছে একটু আগে। আকাশে তখন নিকষ কালো মেঘ। চারিদিক থমথমে। ঝড়বৃষ্টির আগের মুহূর্ত। সাইকেলের ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে শশব্যস্ত হয়ে বাড়ির উঠোনে এলো পড়শি জুনেদ ভাই। হাতে একটা খাম! বললো 'ইমতিয়াজের চিঠি'। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো শিউলি। জুনেদ ভায়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো খামটা। মোবাইল এর অল্প আলোর নিচে মেলে ধরলো  চিঠিখানা। শিউলির বাপ নড়েচড়ে বসেছে। মা ঘরের ভিতরেই বিছানার ওপর উঠে বসেছে, কান খাড়া। মাকে উদ্দেশ্য করেই ইমতিয়াজের তাড়াহুড়ো করে লেখা চিঠি। "কেরালায় খুব বড় বান এসেছে মা। মানুষজনের খুব বড় বিপদ। কত মানুষ ঘরবাড়ি হারা হয়েছে! কত মানুষ যে ভেসে গেলো মা! আমার থাকার জায়গাটাও বানে ভেসে গেছে। হাত- পা নিয়ে অনেকের মতন আমিও একটা রিলিফ ক্যাম্পে এসে উঠেছি। মানুষজনের এখানে না খেতে পেয়ে মরার অবস্থা মা। ছোট ছোট বাচ্চা, মেয়েমানুষ, বুড়ো মানুষদের যে কি কষ্ট! তাদের কষ্ট দেখে আমি আর নিজেকে দূরে রাখতে পারিনি মা! আমার সব দিয়ে ফেলেছি। আমাকে মাফ কোরো মা। তুমি, আব্বা আর শিউলির কাছে আমি আর মুখ দেখাতে পারব না মা। তাই এবারের কুরবানীতে আমি আর বাড়ি যাচ্ছিনা মা। সামনের বছর টাকা জোগাড় করে তবে বাড়ি যাব। এখন আমি বানভাসি মানুষদের সাহায্য করার কাজ করছি। সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে আবার কাজে ফিরবো মা। ছেলের বাপকে বোলো, বিয়েটা যেন না ভাঙে; টাকার জন্য না ভাবে। আমি ঠিক শোধ করবো ওদের পণের টাকা।" চিঠি শেষ হতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো মা! তার ছেলে বেঁচে আছে! বানের তোড়ে ভেসে যায়নি! এটুকু খবর শোনার জন্যই কান পেতে রেখেছিলো মা। এ চিঠি অন্যকারোর লেখা দুঃসংবাদের চিঠি নয়, তার ইমতিয়াজ নিজে লিখেছে। আর কি চায় মা! ছেলে তার যেখানেই থাকুক বেঁচে আছে। ঠিক তখনই কালো মেঘে ভারী আকাশও তার বুক খালি করতে শুরু করলো।  

 

 পরের দিন খুব ভোরে, সবাই তখনো ঘুমাচ্ছে, শিউলি ছুটে গেলো, তাদের ছোট্ট ডোবাটার উত্তর পাড়ে। এসে দাঁড়ালো বাবলা গাছটার পাশে। সঙ্গে একটা কোদাল এনেছিলো সে। আন্দাজে জায়গাটা চিনে নিয়ে খুঁড়তে শুরু করলো সে। বৃষ্টির প্রকোপে মাটি এমনিতেই নরম, অল্প আয়াসেই উপরের মাটি সরে একটা বড় গর্ত বেরিয়ে পড়লো। গর্তের মাটি অল্প সরাতেই প্লাস্টিকের একটা বেশ বড়  প্যাকেট। শিউলি ডোবার পানিতে প্যাকেটের গায়ে লেগে থাকা কাদামাটি ধুয়ে বাড়ি নিয়ে এলো প্যাকেটটা। কাঁচি দিয়ে সে প্ল্যাস্টিক ব্যাগের মুখটা কেটে ভিতর থেকে বের করে আনলো তার একাদশ শ্রেণীর বইগুলো! 

সৌজন্য সিউ পত্রিকা

পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২৬ আগস্ট ২০২২ 

লেখক : ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক 

ছবি : সংগৃহীত

 

 

0 Comments

Post Comment