- 02 November, 2025
 - 0 Comment(s)
 - 68 view(s)
 - লিখেছেন : মীরা কাজী
 
“তুঁহুঁ মম”
মায়ের শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছেনা। ফোন করে বার বার জানতে চায় – আমি কবে বাড়ি যাব। সারা সপ্তাহ নিজের কলেজের কাজ, শনি-রবিবারটা ওপেন ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো। বাড়তি ছুটি-ছাটা পেলে মায়ের কাছে যাই। তবে তাতে যেন মায়ের ঠিক মন ভরেনা। বাবা চলে যাবার পর মা আর দুই বোন আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। বুঝতে পারছি এবার ওপেন ইউনিভার্সিটির কাজটা ছাড়তে হবে।
আমার পরের বোন মধুবন্তীর বিয়ের চেষ্টা করছি। সে পঁচিশ পেরিয়ে ছাব্বিশে পড়েছে। ছোট দময়ন্তীও দেখতে দেখতে কুড়িতে পড়ল। একটা ছেলের সন্ধান পেয়েছি, ছেলেটি ভালো। নিজেদের পৈত্রিক ব্যবসা দেখাশোনা করে। আমার এক বান্ধবীর পরিচিত। আজকাল একেবারে অচেনা কোনও পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার কথা ভাবতে সাহসে কুলোয় না। মধুর বিয়ের কথা মাকে বলতেই মা হাঁ হাঁ করে উঠল- তোর আগে মধুর বিয়ে! হতেই পারে না।”
মাকে কী করে বোঝাই, সংসার করা আমার দ্বারা হবেনা। ও ভারী জটিল জায়গা। যেন চক্রব্যূহ- যেখানে প্রবেশ করাটা সহজ, বের হওয়ার কৌশল জানা নেই। আমার মত দুর্বল চিত্তের মানুষের ওই সমরাঙ্গনে প্রবেশ করা সমীচীন হবে না। কিন্তু মা কেঁদে-কেটে একশা করছে। অগত্যা চুপ করে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমার ওই চুপ করে থাকাটাকেই যে মা আমার সম্মতি ভেবেছেন সেটা জানা গেল পরের মাসে বাড়ি গিয়ে।
বাড়ি ঢুকে একটু অবাক হলাম- সব কেমন যেন ঝক ঝক করছে। বিছানায় নতুন চাদর, বালিশের ওয়াড়, টেবিলে নতুন টেবিল ক্লথ পাতা। কলতলার শাওলা-ট্যাওলা সব উধাও। শো-কেসটা বেশ গোছানো। আদুর দিকে তাকাতে সে ফিক করে হেসে সরে গেল। দময়ন্তীকে আমরা ছোট করে আদু ডাকি। সে নিয়ে তার অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু এত কালের অভ্যাস,কি আর বদলানো যায়? সে আমাদের কাছে আদুই থেকে গেছে। সে যা হোক, যা বলছিলাম, মাকে জিজ্ঞেস করবার আগে মধু আগবাড়িয়ে বলল, “দিদি, কাল তোকে একজায়গা থেকে দেখতে আসবে।”
“দেখতে আসবে! মানে?”
“আরে বাবা, তোর বিয়ের জন্য পাত্রপক্ষ আমাদের বাড়িতে আসবে। এবার বুঝিলি তো?”
“বোঝা গেল। তবে আমি তো এসবের কিছু জানি না!”
“তোকে জানালে তুই কি বাড়ি আসতিস? ছুটি পাচ্ছিনা বলে ঠিক এড়িয়ে যেতিস।”
“ও, তাই চুপি চুপি এই ব্যবস্থা?”
“তোর বিয়ে নিয়ে মা খুব চিন্তায় থাকে। দিদি তুই রাজি হয়ে যা! সমন্ধটা খুব ভালো”।
“ তাই বুঝি?”
“তুই তাহলে রাজি তো?” উছলে ওঠা হাসি সামলে মধু বলল।
“মায়ের কাছে নিশ্চয় ওদের ফোন নম্বরটা আছে?”
“আছে তো?”
“ সেটা আমাকে দে তো? তবে মাকে বলবি না।”
“কী করবি সেটা নিয়ে?”
“কিছুই না, একটু বাজিয়ে দেখব- আমাকে বিয়ে করতে চায়, না আমার চকরিটাকে।”
“এই দিদি! তুই সব ভেস্তে দিবি না তো? মা জানতে পারলে খুব কষ্ট পাবে।” মধু চিন্তিত স্বরে বলল, সে তার দিদিকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না।
তবে সে দিদির কথা ফেলতেও পারল না। মায়ের অজান্তে তার ডাইরি থেকে পাত্রপক্ষের ফোন নম্বরটা আমাকে এনে দিল। কাল দুপুরের দিকে পাত্রপক্ষ আসবে। তার আগেই তাদের সাথে কথা বলে নিতে হবে। মাকে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে। হাঁটুর ব্যথা অগ্রাহ্য করে এটা- সেটা করেই যাচ্ছে। বারণ করলেও শুনছে না। আমি তার মুখের উপর কিছু বলতে গিয়েও পারছি না। রাতে ফোনে ধরলাম। ওদিক থেকে একজন রাশ ভারী গলায় আমার পরিচয় জানতে চাইল। আমি নিজেকে মেয়ের মাসি বলে পরিচয় দিয়ে বললাম, “বিশেষ প্রয়োজনে আমি একটু ছেলের সাথে কথা বলতে চাই।”
মিনিট খানেক পর যে ফোনটা ধরল, তার গলাটা আমার ভীষণ চেনা মনে হল।
“আপনিই তো কাল পাত্রী দেখতে বীরপুরে আসছেন?”
“হ্যাঁ! কিন্তু আপনি ?”
“আমি মেয়ের মাসি”।
“আপনার গলাটা এত চেনা! আপনার নামটা যদি বলেন?”
“আমার ও আপনার গলাটা চেনা লাগছে। আপনি, মানে——!"
“ দেবোত্তম চৌধুরী”।
“দেবু!”
“আর তুই ইরা,ইরাবতী। ঠিক বললাম তো?”
“ঠিক!”
“কত দিন পর! কেমন আছিস?”
“ ভালো। একটা বিশেষ দরকারে তোকে ফোন করেছি।”
“সেটা না বললেও বুঝেছি। বল কী দরকার?”
“দেবু, তুই আমকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার কর! আমি এই বিয়ে করতে পারব না”।
“কী বলছিস? বুঝতে পারছিনা।”
“তোরা কাল যাকে দেখতে আসছিস, সে আর কেউ নয়, আমি।”
“ও হো! কী অদ্ভুত যোগাযোগ? এখন আমার অমত রইল না। তুই পাত্রী হলে আমি রাজি।” খানিক হেসে দেবোত্তম বলল।
“বাজে কথা ছাড়। আমি এ বিয়ে করতে পারব না।”
“আমি পাত্র হিসাবে খুব একটা খারাপ নই! একটা ভালো কোম্পানীতে কাজ করি। মাইনেও ভালো।”
“আমাকে না জানিয়ে মা এ সমস্ত করেছে । এখন তুই ভরসা।”
“আমি এখন কী ভাবে তোকে সাহায্য করব?”
“তুই শ্রেফ ‘না’ করে দে।”
“আমি ভাবলাম এবার একটু থিতু হব। কী রকম ভাগ্য দেখ, পাত্রী নিজেই বাগড়া দিচ্ছে।”
“থিতু হবার জন্য আমি ঠিক উপযুক্ত নই। অন্য যে কেউ তোকে লুফে নেবে। তুই রাজি হলে আমার পরের বোন মধুমন্তীকে বিয়ে করতে পারিস। খুব ভালো মেয়ে।”
“সেটা সিনেমার মত হয়ে যাবে না? যাকে দেখতে গেলাম, তার বোনকে পছন্দ করে চলে এলাম।”
“সে না হয় না কর, তবে আমাকে ‘না’ করে দে!”
“আমাকে একটা চান্স দিয়ে দেখতে পারতিস? আশা করি ঠকতিস না।”
“বাজে বকিস না। আমি বিয়ে করব না ঠিক করেছি । যদি কখনও মত বদলাই তাহলে তোর কথা আগে ভাবব।”
“কথা দিলি কিন্তু?”
“ দিলাম।”
“তুই তো সেই থেকে নিজের কথাই বলে গেলি। আমার কথা এবার একটু শোন।”
“যা বলবি চটপট বল। এখনি বোনেরা এসে পড়বে।”
“আমার অবস্থাও ঠিক তোর মত। মা জোর- জার করে পাত্রী দেখতে নিয়ে চলেছে। কত আর ‘না’, ‘না’ করব, এবার তাই ভাবলাম যাই একটু ঘুরে ফিরে আসি। তারপর বলব- মেয়ে আমার পছন্দ নয়। ব্যাস ফুরিয়ে গেল।”
পরদিন যথা সময়ে পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এল। আমি আগেই মাকে বলে দিয়েছিলাম, আমি যেমন আছি তেমনই থাকব, সাজতে গুজতে পারব না। তাতে কারও পছন্দ হলে হবে, না হলে না হবে। মা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মুখের উপর কিছু বলার সাহস পেল না। আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি তাতেই সে কৃতার্থ হয়ে গেছে।
ঘণ্টা দুই থেকে ওরা চলে গেল। দেবুর সাথে আমার আগে থেকে পরিচয় আছে সেটা কেউ জানল না। দেবু ও আমি দুজনেই নিখুঁত অভিনয় করে গেলাম। দেবুদের বাড়ির সবাই আমাদের আপ্যায়নে খুব খুশি। ওরা তাদের পছন্দের কথাটি জানিয়ে যেতে চাইছিল। দেবু সেটা হতে দিল না। বলল, বাড়ি গিয়ে ফোনে জানিয়ে দেবে। এতে আমার মা একটু আশাহত হল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম- যাক দেবু কথা রেখেছে। পরদিন আমি সোনামুখী চলে গেলাম। দিন দুই পর দেবু আমাকে ফোন করে জানাল- তাদের বাড়ির সবার নাকি আমাকে, আমাদের বাড়ির সবাইকে খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দেবুর মনে হয়েছে, মেয়েটি খুব অহংকারী। একে কলেজে পড়ায় তায় আবার সুন্দরী। ও মেয়ে শ্বশুর বাড়ির কাউকে পাত্তা দেবে না।
সব কথা শেষ করে দেবু মজা করে বলল, “বিয়েটা আপাতত কেঁচে গেলেও আমি অপেক্ষা করে থাকব, তোর সুমতি হলে জানাস। আমি টোপোর পরে যথাস্থানে হাজির হয়ে যাব।”
তবে মায়ের সব আয়োজন একেবারে বৃথা গেল না। দেবুর এক মামি ও মামাতো ভাই সঙ্গে এসেছিল। মধুকে তাদের ভারি পছন্দ হয়েছে। তারা মায়ের কাছে মধুর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। মা আমাকে জানালে আমি দেবুর সাথে কথা বলে জানলাম, ছেলেটি ভাল চাকরি করে। স্বভাব-চরিত্রও ভাল। দাবি-দাওয়া নেই। মধুর সাথে কথা বলে বুঝলাম, তারও আপত্তি নেই। মধুর বিয়ে হয়ে গেল।
মা কী বুঝেছিল কে জানে, এরপর থেকে মা আমার বিয়ের কথা আর তোলেনি ।
এবার দেবুর কথা একটু বলি। দেবু মানে দেবোত্তম আমার কলজের বন্ধু। সবার সঙ্গে হাসি মজা করাটা ওর স্বভাবগত। কলেজ ছাড়ার পর দু-একবার কোনও বন্ধুর বিয়েতে টিয়েতে দেখা হয়েছে। তারপর আর দেখা হয়নি। ফোনেও যোগাযোগ হয়নি। তারপর হঠাৎ করে এই যোগাযোগ।
এই ঘটনার পর থেকে দেবুর সাথে আমার নতুন করে যোগাযোগ তৈরি হল। দেবুই ফোন টোন করত বেশি, খবরাখবর নিত। দেখা করার কথা ভাবলেও দেখা করা হয়ে ওঠেনি। দেবুর ফোন পেলে আমার ভালো লাগত। খুশির একটা আমেজ, একটা ভালো লাগা আমাকে জড়িয়ে থাকত বহুক্ষণ। তবে কি আমি দেবুকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছি? মনকে প্রশ্ন করে উত্তর পেতাম না। দেবুর কাছে কি কোনও উত্তর আছে? জিঙ্গেস করার অবকাশ হয়নি। মধুর বিয়ের প্রায় বছর দুই পরে মোটর বাইক এক্সিডেন্টে দেবু মারা যায়।
দেবু চলে যাবার পর কিছুদিন খুব একা লাগত। কিছুই ভালো লাগত না। তারপর সময়ের নিয়মে আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। আদু নিজের পছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করল। অনুষ্ঠান করেই বিয়ে হল। দুই বোনের বিয়ের পর মা বড় একা হয়ে পড়ল। ভাবলাম এবার মাকে নিজের কাছে এনে রাখব। কিন্তু মা কিছতেই রাজি হল না। অগত্যা বাড়ির কাজের লোকের ভরসাতেই মাকে ছাড়তে হল। আদুটা কাছাকাছি থাকে। সেই মাঝে মাঝে এসে মায়ের দেখা শোনা করে। তবুও একটা দুশ্চিন্তা থেকেই যায়। তবে বেশিদিন এই দুশ্চিন্তা ভোগ করতে হল না। কিছুদিন রোগ ভোগের পর মা চলে গেল। মায়ের জন্য কষ্ট হল ঠিক কথা,তবে দিন রাত যে দুশ্চিন্তা আমাকে তাড়া করত সেটা দূর হল।
ওপেন ইউনিভার্সিটির কাজটা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। জয়িতাদের সাথে যোগাযোগটা থেকে গেছে। ওরা আমার কাছে আসে,গল্প-আড্ডায় মাতিয়ে রাখে। আমিও যাই সময় সুযোগ মত।
রিটায়ার্ড করার পর বাঁকুড়া শহরে একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। একজন কেয়ার- টেকার গোছে লোক রেখেছি, সেই সব দেখা শোনা করে। শুভলক্ষীর বিয়ে হয়ে গেছে। বেশ সুখেই আছে। বিয়ের পরেও সে আমার কাছে থেকে যেতে চেয়েছিল। তার বর বারিনেরও আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমি রাজি হইনি। অনেক ভেসে বেড়িয়েছে মেয়েটা এবার সে থিতু হোক। আমার সহোদর বোনেরা আমাকে তাদের কাছে গিয়ে থাকতে বলার সাহস পায় না। তারা তাদের দিদিকে চেনে। বেশ কিছুটা দূরে চলে আসার জন্য জয়িতাদের সাথে এখন নিয়মিত দেখা হয় না। ফোনে প্রতিদিনই কথা হয়।
এখন বয়সকালীন একটা উপসর্গ দেখা দিয়েছে- কিছু মনে রাখতে পারিনা । জরুরি কথাগুলি লিখে রাখতে হয়। ইদানীং একটা ব্যপার হচ্ছে- কিছুক্ষণ একা থাকলে কার যেন পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। খুব সন্তর্পনে, নীরব চরণ ফেলে কেউ যেন আসছে। সে যে-ই হোক আমি তার অপেক্ষায় আছি। “দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি—।"
( চলবে)
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ছবি : সংগৃহীত
								
										
										
										
0 Comments
Post Comment