বিবাহিত নারী (ষষ্ঠদশ পর্ব)

  • 29 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 422 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
একটি ছোট্ট মেয়ে আনন্দ পায় রুপোর পাত্রকে ঘষে-মেজে চকচক করিয়ে, দরজার হাতল পালিশ করে। কিন্তু এই সব কাজের মধ্যে ইতিবাচক সন্তুষ্টি একজন মহিলাকে পেতে হলে তাঁকে অভ্যন্তরের যত্ন নেওয়ার জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে হবে যা তাঁর গর্বের বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের’ মধ্যে বেশ কয়েক মাস বসবাসকারী একজন মার্কিন প্রতিবেদক এই মহিলাদের মধ্যে একজনের করুণ ভাগ্য বর্ণনা করেছেন যিনি তাঁর বস্তি-ঘরকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নিরর্থক প্রভূত পরিশ্রম করে চলেছেন।

অনেক মহিলা লেখক সদ্য ইস্ত্রি করা জামাকাপড়, সাবান জলের নীলাভ আভা, বিছানার সাদা চাদর, চকচকে তামা সম্পর্কে বেশ ভালোবাসা নিয়েই কথা বলেন। বাড়ির গৃহিণী যখন আসবাবপত্র পরিষ্কার এবং পালিশ করেন, তখন “গর্ভধারণের স্বপ্ন গৃহিণীর হাতের মোলায়েম ধৈর্যকে সমর্থন করে, যে-হাত দিয়ে মোম-পালিশের মাধ্যমে গৃহিণী কাঠকে সৌন্দর্য দান করেন”, বলেছেন বাশলার। কাজ সম্পন্ন করার পরই গৃহিণী প্রশান্তি লাভ করেন। আসবাবপত্রের উত্তম মানের পরিচয় যাতে প্রকাশ পায়, যেমন : টেবিলের পালিশ, মোমদানির চকচকে অবস্থা, জামাকাপড়ের মাড় এবং শীতল শুভ্রতা, সেক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু নেতিবাচক পদক্ষেপ থাকতে হবে; প্রত্যেকটি মন্দ নীতিকে অবশ্যই বাতিল করতে হবে। বাশলার লেখেন, এটি হল একটি অপরিহার্য আকাঙ্ক্ষা যার কাছে গৃহিণী আত্মসমর্পণ করেন: অর্থাৎ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দ্বারা অপরিচ্ছন্নতাকে জয় করা। তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন :

মনে হয়, পরিচ্ছন্নতার জন্য লড়াই করার কল্পনার জন্য একটা চ্যালেঞ্জের প্রয়োজন। মারাত্মক রাগ থেকে এই কল্পনার উদ্দীপিত হওয়া প্রয়োজন। কী বাজে হাসি দিয়েই না একজন বেসিনের তামার কল-কে পালিশ করার তরল রং দিয়ে ঢেকে দেন। পুরোনো চ্যাটচ্যাটে নোংরা কাপড়ে ত্রিপোলি পেস্ট দিয়ে ভরে দেওয়া হয়। কর্মীর হৃদয়ে জড়ো হয় তিক্ততা ও শত্রুতা। কেন এমন অশ্লীল কাজ? যদিও, এরপরেই এসে পড়ে শুকনো কাপড়ের মুহূর্ত, তারপর প্রফুল্ল দুষ্টতা, জোরালো দুষ্টতা এবং কথাবার্তা: বেসিনের কল, তুমি একটি আয়না হবে; কড়াই, তুমি হবে সূর্য! অবশেষে তামা যখন চকচক করে এবং একটি ভালো ছেলের কর্কশতা বা রুক্ষতা নিয়ে হাসে, তখন শান্তি তৈরি হয়। গৃহবধূ তখন তাঁর উজ্জ্বল বিজয়ের কথা ভাবেন।

এই দ্বান্দ্বিকতা গৃহকর্মকে একটি খেলার আকর্ষণ দিতে পারে। একটি ছোট্ট মেয়ে আনন্দ পায় রুপোর পাত্রকে ঘষে-মেজে চকচক করিয়ে, দরজার হাতল পালিশ করে। কিন্তু এই সব কাজের মধ্যে ইতিবাচক সন্তুষ্টি একজন মহিলাকে পেতে হলে তাঁকে অভ্যন্তরের যত্ন নেওয়ার জন্য নিজেকে নিবেদিত করতে হবে যা তাঁর গর্বের বিষয়। অন্যথায় তিনি কখনোই প্রশান্তির আনন্দ জানতে পারবেন না, যে-আনন্দ তাঁর প্রচেষ্টার প্রতিদান দিতে সক্ষম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দরিদ্র শ্বেতাঙ্গদের’ মধ্যে বেশ কয়েক মাস বসবাসকারী একজন মার্কিন প্রতিবেদক এই মহিলাদের মধ্যে একজনের করুণ ভাগ্য বর্ণনা করেছেন যিনি তাঁর বস্তি-ঘরকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য নিরর্থক প্রভূত পরিশ্রম করে চলেছেন।  স্বামী আর সাত সন্তানের সঙ্গে তিনি একটি কাঠের কুঁড়েঘরে থাকতেন। ঘরের দেওয়াল ছিল কালিমাখা। দেওয়ালে আরশোলা ঘোরাঘুরি করতো। তিনি চেষ্টা করেছিলেন ‘সুন্দর ঘর নির্মাণের’। প্রধান ঘরটির চিমনি ঢাকা ছিল নীলাভ প্লাস্টার দিয়ে। এ ছাড়াও ঘরে ছিল একটি টেবিল এবং দেওয়ালে আটকানো কয়েকটি ছবি,যা মনে করিয়ে দিত বেদির কথা। এত কিছু সত্ত্বেও সেই বস্তিঘর কিন্তু বস্তিঘরই থেকে যায়। জলভরা চোখে শ্রীমতী জ বলেছিলেন : “আহ্‌ ! আমি এক বাড়িটিকে ভীষণ ঘৃণা করি! মনে হয় এমন কোনো জিনিসই পৃথিবীতে নেই যা দিয়ে এই বাড়ি সুন্দর করা যায়!” নারীবাহিনী এভাবেই ভাগ করে নেন অশেষ ক্লান্তি, যার শুরু এমন এক যুদ্ধে যে-যুদ্ধে তাঁরা কখনোই জয়ী হন না। এমনকি আরও সুবিধাভোগীদের ক্ষেত্রেও এই বিজয় কখনোই চূড়ান্ত নয়। গৃহবধূদের তুলনায় সিসিফাসের যন্ত্রণার সঙ্গে কয়েকটি কাজের বেশ মিল রয়েছে। দিনের পর দিন তাঁদের থালাবাসন ধুতে হয়, আসবাবপত্রের ধুলো মুছতে হয়, জামাকাপড় রিফু করতে হয় যা আবার পরের দিন নোংরা, ধুলোময় হবে। ছিঁড়েও যাবে। ঘটনাস্থলেই গৃহবধূ পদদলিত, ক্লান্ত। বর্তমান-মুহূর্তের কাজ করে চলা ব্যতীত আর কিছুই তিনি করেন না। ইতিবাচক শুভকে জয় করার কোনো ছাপ তাঁর মধ্যে নেই। বরং আছে অশুভ-র বিরুদ্ধে অনির্দিষ্টকাল ধরে সংগ্রামের পরিচয়। এই সংগ্রামই প্রত্যেক দিন নতুন রূপে চলতে থাকে। আমরা এইরকম এক গৃহভৃত্যের গল্প জানি যিনি তাঁর প্রভুর জুতো পালিশ করতে অস্বীকার করেছিলেন। “কী লাভ?” তিনি বলেছিলেন, “আগামীকাল তো আবার তা করতে হবে”। যে-সব অল্পবয়সি মেয়েরা এখনও নিজেদেরকে সম্পূর্ণ সমর্পিত করতে পারেননি, তাঁরা নিজেদের মধ্যে এই হতাশা ভাগ করে নেন। আমার মনে আছে ষোল বছর বয়সী এক ছাত্রের প্রবন্ধ যা মোটামুটি এই শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছিল, “আজ ঘর পরিষ্কারের দিন। মা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যাওয়ার সময় ভ্যাকিউম ক্লিনারের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি পালিয়ে যেতে চাই। নিজের কাছে শপথ করেছি যে, যখন বড়ো হব, তখন আমার বাড়িতে ঘর পরিষ্কার করার এইরকম বড়ো দিন কখনোই আসবে না”। শিশুটি ভবিষ্যতকে কোনো একটি অজ্ঞাত চূড়ার অভিমুখে একটি অনির্দিষ্ট আরোহণ হিসাবে ভাবে। হঠাৎ করে, রান্নাঘরে যেখানে মা থালা বাসন ধুচ্ছেন, ছোট্ট শিশু মেয়েটি বুঝতে পারে যে বছরের পর বছর ধরে, প্রতি বিকেলে, একই সময়ে, তার মায়ের হাত থালাবাসন ধোয়ার জলে ডুবে রয়েছে, কোনো রুক্ষ কাপড় দিয়ে তিনি চিনামাটির বাসন মুছছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এইসব আচার-অনুষ্ঠানের অধীনে থাকবেন। খাওয়া, ঘুমানো, পরিষ্কা-পরিচ্ছন্ন করা ... বছরগুলি আর আনন্দে কাটে না, একইরকম ধূসর রঙের টেবিলে পাতা কাপড়ের মতো কেটে যায়। প্রতিটি দিনই আগের দিনের অনুকরণ। এই শাশ্বত বর্তমান অকেজো, আশাহীন। ‘ধুলো’ নামের ছোট গল্পে, কোলেট অড্রি সূক্ষ্মভাবে এমন একটি কার্যকলাপের দুঃখজনক অসারতা বর্ণনা করেছেন যা সময়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।

লেখক: অধ্যাপক ও সমাজকর্মী

ছবি: সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment