- 24 August, 2022
- 0 Comment(s)
- 314 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮৮ সালে দেওয়া খোমেইনির ফতোয়ার চব্বিশ বছর পর অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ছুরিকাহত হলেন সলমন। সলমন রুশদির আঘাত যত না গুরুতর এখন তার চেয়েও গুরুত্বের বিষয়টি হলো, এই ঘটনার পরেপরেই ইরান এবং খোমেইনির বিষয়ে বাড়তি নিউজপ্রিন্ট খরচা হতে শুরু করল। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, ইরানের রক্ষণশীলতা – ইত্যাদিকে নিয়ে পৃথিবীর মানুষ আবারও সচেতন হয়ে উঠলেন। কিন্তু ইরানের পরিচয় কি কেবল খোমেইনিতেই সীমাবদ্ধ? আমরা কি জাফর পানাহি অথবা আব্বাস কিয়ারোস্তামির ইরানকেও সমান ভাবে মনে রাখিনি? ইরানের শিল্প, ইরানের সঙ্গীত, ইরানের সিনেমা, ইরানের মানুষ – খোমেইনি তাদের বিপরীতে কেবল এক তুচ্ছ, সংকীর্ণ অন্ধকার মাত্র। খোমেইনির ইসলামিক বিপ্লবের অনেক আগে থাকতেই ইরানের মানুষ, সর্বোপরি ইরানের মহিলারাও প্রগতির পথে হেঁটেছিলেন। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের নামে ইরানে যে অন্ধকার নেমে এসেছিল তার বিপরীতে ইরানের প্রগতির যে ইতিহাস, আজ তেমনই একজন মানুষের কথা বলব। ইরানীয় তথা ফারসি কবিতার ইতিহাসে এক অবাক দিনবদলের সূত্রপাত ঘটেছিল, পঁয়ত্রিশ না পেরনো সেই ফারো ফারুখজাদের হাত ধরেই।
“আমার জীবনটা যখন
দেওয়ালের সেই ঠাকুর্দাঘড়ির মতোই,
নিয়মিত টিকটিকানির একঘেয়েমিতে গিয়ে দাঁড়াল,
বুঝলাম তখনই,
এবারে আমায় ভালোবাসতে হবে ...
পাগলের মতোই ভালোবাসতে হবে আমায়।।” (ফারো ফারুখজাদ, স্বকৃত অনুবাদঃ লেখক)
ফারো ফারুখজাদ নিজেকে উজাড় করে মেয়েদের কথা বলেছিলেন। মেয়েদের চাওয়াপাওয়া, বাসনা, ইচ্ছের কথা বলেছিলেন। কোনও রাখঢাক না করেই বলেছিলেন। যে কারণেই আজীবন এক ভীষণ একাকীত্বের সঙ্গে তাঁকে লড়াই করে আসতে হয়েছে। ফারুখজাদের জন্ম ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৩৪, ইরানের তেহরানে। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা, কুড়ি না পেরোতেই বিবাহ। ১৬ বছর বয়সে ফারোর বিবাহ হয়। ১৭ বছর বয়সে এক সন্তানের মা হন তিনি। ছেলের নাম দেন কামিয়ার শাপুর, তাঁর প্রথম দিককার কবিতাতে সরাসরি এবং পরবর্তীতেও প্রচ্ছন্ন ভাবে প্রভাব থেকে যায় কামিয়ারের। কুড়ি না পেরোনো এক মহিলা, একাকী কতগুলো কাগজ হাতে করে নিয়ে সম্পাদকের দরবারে এসে হাজির। কবিতা লিখে এনেছে সে। কবিতার নাম ‘পাপ’। প্রথম কয়েকটি পংক্তিকে অনুবাদ করতে চাইলে অনেকটা এইরকম দাঁড়াবে,
“আমি পাপ করেছি,
আস্বাদ নিয়েছি গভীর পাপে নিমজ্জিত এক আনন্দের আমি,
সেই পাপের উৎস দুহাত প্রসারিত এক উষ্ণ আলিঙ্গনের গভীরতায়,
আমি সেই দুই বাহুর ঘেরাটোপে থেকে, পাপাসক্ত হয়ে উঠেছি,
সেই বাহুদুটি ছিল লোহারই মতো সবল আর অবাক উষ্ণতায় পরিপূর্ণ!
আমি – পাপ করেছি!” (ফারো ফারুখজাদ, স্বকৃত অনুবাদঃ লেখক)
কি ভয়ানক ছিল সেই উচ্চারণ। পুরুষ বলে বলুক। মেয়ে হয়ে কি না, বিবাহিত মা হয়েও কি না পরপুরুষের প্রতি ভালোবাসার কথা এমন সরাসরি লিখে আনতে পেরেছে। সেই লেখা কি না প্রকাশও করতে সাহস পায়। সেই কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। রাতারাতিই খ্যাতি (এবং কুখ্যাতি’রও) আকাশে পৌঁছেছিলেন ফারুখজাদ। এই কবিতা প্রকাশের কারণেই তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ। একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগ এনে তাঁর একমাত্র পুত্রকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া। দ্বিতীয় এই ঘটনাটির কারণে আজীবনের জন্য ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলেন ফারুখজাদ। ছেলের সঙ্গে তাঁকে প্রায় দেখাই করতে দেওয়া হতো না। ছেলেকে নাকি বোঝানো হয়েছিল তার মা এখন খারাপ চরিত্রের মানুষ। তার মা’ই নাকি তাকে ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছেন। সমালোচকেরা অনেকে ফারুখজাদের রচনার সঙ্গে সিলভিয়া প্লাথের সদৃশতা খুঁজে পান। প্লাথের মতোই প্রবল একাকীত্বে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন ফারুখজাদ। এই সময়ই তিনি ইউরোপে পাড়ি দেন। নয়মাস পর আবারও ইরানে ফিরে আসেন। এই সময় চিত্রপরিচালক ইব্রাহিম গোলেস্তানের সঙ্গে তিনি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দুজনে বিবাহ না করলেও, আমৃত্যু এই গোলেস্তানের সঙ্গেই এক গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন ফারুখজাদ।
এর পরেপরেই ‘দ্য ওয়াল’ (মূল ফারসিতে যার নাম ‘দিভার’) ও ‘দ্য রেবেলিয়ন’ (মূল ফারসিতে যার নাম ‘তাভালোদি দিগার’) নামে তিনি দুটি কাব্যসংগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৬২ সালে ছকভাঙা প্রতিভার এক শ্রেষ্ঠ বিচ্ছূরণ ঘটিয়ে তিনি ইরানের তবরিজ শহরে পাড়ি জমান। সেখানকার এক কুষ্ঠাশ্রমের আবাসিকদের বিবর্ণ জীবনযাত্রার উপরে ভিত্তি করে বানিয়ে ফেলেন তাঁর এক ও একমাত্র ডকুমেন্টারি শর্ট ফিল্ম, ‘দ্য হাউজ অব ব্ল্যাক’, যা কিনা জার্মানির এক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্রের পুরষ্কার লাভ করে। এই সূত্রেও অনেকে মনে করেন, ইরানীয় চলচ্চিত্রে যে ‘নতুন ঢেউ’ বা ‘ন্যুভেল ভাগ’এর জোয়ার, তারও অন্যতম সূচনাবিন্দু হিসেবে এই ‘দ্য হাউজ অব ব্ল্যাক’ তথ্যচিত্রটিকেই বিবেচনা করা চলে। ১২দিন ধরে এই ছবির শুটিং চলেছিল। শুটিং চলার সময়ই দুই কুষ্ঠরোগীর সন্তান হাসান মানসৌরি নামের এক শিশুকে ভালো লেগে যায় ফারোর। তিনি পরে তাকে দত্তক সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেন। ফারুখজাদকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর কবিতায় নারীবাদের এতখানি প্রকট পরিবেশনা থাকে কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, “সৌভাগ্যবশত আমি একজন নারী, তাই আমার লেখাতে নারীত্বের প্রভাব থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাহিত্যের গুণাগুণ বিচারে সেই সাহিত্যের পুরুষত্ব কিংবা নারীত্বকে বিচার করতে যাওয়াটা আদতে বোকামির পরিচায়ক। সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পুরুষ ও নারীর দৃষ্টির বিভিন্নতা থাকে, প্রতিক্রিয়ার বিভিন্নতা থাকে, এমনকি প্রতিক্রিয়ার গভীরতারও বিভিন্নতা থাকে। তাই তাদের দুজনকার সাহিত্যে ধরা পড়ে। কিন্তু কেউ যদি লিখতে বসার আগে আমি পুরুষ অথবা আমি নারী ভেবে সাহিত্য সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে তা আর সাহিত্য থাকে না।” তিনি আরও বলেছিলেন, “কবি হতে গেলে পরে একমাত্র কবিতাকেই সারা জীবনের মতো সেই মানুষটির যাপন হয়ে উঠতে হবে। কেবল কবিতা লেখার সময় আমি কবি, আর বাকি সময়টুকুর জন্য আমি একজন ধান্দাবাজ মানুষ – এভাবে সাহিত্যিক হওয়া চলে না।” ১৯৬৪ সালে ফারুখজাদের শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘রিবর্ন’ প্রকাশিত হয়।
এমন এক উত্তাল জীবনকে সামান্য এই কয়েক পংক্তির মধ্যে দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলে পরে সেই প্রচেষ্টা কতদূর সফল হয় জানি না, কিন্তু মনের ভিতরটুকুতে একটা আলোড়ন পড়ে। আমাদের অনেকের চোখেই, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান, অথবা ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির মহিলাদের প্রসঙ্গে যে গতানুগতিক ভাবনাচিন্তাগুলো কাজ করে – সেগুলো যেন বা হঠাৎ করেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে চায়। অবাক হয়ে তখন বরং ভাবতে ইচ্ছে করে, ফারুখজাদ পেরেছিলেন। তিনি তাঁর কবিতার মতোই সৎ থাকতে পেরেছিলেন। কখনও তাঁকে অসততার আড়াল খুঁজতে হয়নি। সমাজে সকলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন, “হ্যাঁ আমি যা কিছু লিখেছি, আমি তাই। আমি যা কিছু বলেছি, আমি তাই। আমি যা কিছু করেছি – আমি তাই!” এখনও, তাঁর প্রয়াণের পাঁচ দশক পেরিয়েও তাঁর কবিতা অথবা তাঁর সাহিত্যকে নিয়ে যখন আলোচনা হয়, আলোচকেরা একটি মূল বক্তব্যকেই তুলে ধরতে চান কেবল। ফারো ফারুখজাদের কবিতা ছিল আগল ভাঙার কবিতা, সমাজের প্রতিটা নিগড়কে ভেঙে চুরমার করার কবিতা, নিজের প্রতি – কবিতার প্রতি চূড়ান্ত ভাবে সৎ থাকতে চাওয়ার কবিতা। এমন একেকজন মানুষ ছিলেন বা থাকেন বলেই, আমরা সাহিত্যের উদযাপন করি – খোমেইনির খানসাহেবগিরিকেও আমরা তুড়ি মেরেই তাচ্ছিল্য করতে পারি তখন।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, তেহরানেই এক ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ফারো। দুর্ঘটনার কারণ ও বিবরণ নিয়ে আজও ধোঁয়াশা থেকে গিয়েছে। সরকারি বয়ান অনুযায়ী উলটো দিক থেকে আসা একটি স্কুলবাসকে বাঁচাতে গিয়েই সহসা স্টিয়ারিং ঘোরাতে বাধ্য হন তাঁর জিপের চালকের আসনে বসে থাকা ফারো। সেই সময়েই ভারসাম্য রাখতে না পেরে তিনি আসন থেকে ছিটকে বেরিয়ে যান, রাস্তার পাথরে তাঁর মাথা গিয়ে লাগে। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই ফারোর মৃত্যু হয়।
উচ্ছল, উদ্দাম, একাকী অথচ উৎসাহী, অবাধ এক প্রাণচাঞ্চল্যের প্রতিমূর্তি ফারুখজাদকে এই ভাবেই বিদায় নিতে হতো বোধহয়। এঁরা পৃথিবীতে কিছু পেতে আসেন না, কেবল নিজের জীবনের আনন্দটুকুকে উজাড় করে বিলিয়ে দিতে আসেন। পৃথিবীর মানুষ এঁদেরকে বড় একটা কিছু দেয় না। নিজের বাসনার সৎ ভাবনাটুকুকে উজাড় করে লেখার জন্য নিজের ছেলের কাছ থেকেও তাঁকে বিচ্যুত হতে হয়েছিল। তবুও নিজের প্রাণশক্তিতে ফারো ভাটা পড়তে দেননি। কবিতা লিখেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ছবি এঁকেছেন। জীবনকে উদযাপন করেছেন নিজের জীবনের মাধ্যমেই। ফারো ফারুখজাদ তাই কেবল ইরান নয়, কেবল নারীত্বের নয় – জীবন ও সাহিত্যের এক পরিপূর্ণ উদাহরণ। যিনি ১৯৫৫-৬৫ সালের ইরানে উজাড় করে লিখতে পেরেছিলেন,
“আমি সেই মোমবাতির মতোই জ্বলব,
যে মোমবাতি তার জ্বলনের মধ্যে দিয়ে এই খন্ডহরকে আলোকিত করে,
নিজের হৃদয়কে পুড়িয়ে, এই খন্ডহরকে আলোকিত করে,
আমি বেছে নেব নীরব সেই অন্ধকারকে,
আর নিয়ে আসব এই খন্ডহরের ভিতর,
এক নতুন পাখির বাসার মতো আশ্বাস!” (ফারো ফারুখজাদ)
0 Comments
Post Comment