হিজাব দ্বন্দ্ব

  • 06 April, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 465 view(s)
  • লিখেছেন : প্রতিভা সরকার
মুসলমানদের এইভাবে "সবক" শিখিয়ে, হেনস্তা করে, নিজেদের জায়গা বুঝিয়ে দিয়ে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তারা তাদের মূল ভোটারদের দেখাতে চায় তারা কতোটা শক্তিশালী। তবে ভোটে লাভালাভই এ গল্পের সবটা নয়। উঠতে বসতে, প্রত্যেকটা ব্যপারে মুসলমানদের হেনস্তা করাটাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য। এটি একটি বিশেষ মানসিকতা। একটি নতুন "সংস্কৃতি"।

হিজাব নিয়ে ভারতভূমে এখন মহা কোলাহল। হিজাব পরা উচিত কী উচিত নয়, তাই নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই নানা মুনির নানা মত। নারীবাদীরা অনেকে চাইবেন প্রথম থেকেই মেয়েরা মুক্ত মস্তকে সোজা হয়ে দাঁড়াক, কেউ আবার গেরিলা যুদ্ধের মতো করে ধর্মীয় এবং পিতৃতন্ত্রের নির্মাণকে কাজে লাগিয়ে ক্রম-মুক্তির পথকে শ্রেয় মনে করবেন। ধার্মিকরা তীব্র অসন্তোষ জারি রাখবেন, যুক্তিবাদীরা ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দেবেন। কিন্তু একটি ব্যাপারে সবাই একমত হতে বাধ্য যে এদেশের বর্তমান শাসক চূড়ান্ত নির্লজ্জ এবং দু কান কাটা। নাহলে যে দেশের প্রধানমন্ত্রী গলায় রুদ্রাক্ষমালা ঝুলিয়ে তিলক কেটে রামমন্দিরের ভজন পূজনে অংশগ্রহণ করেন, সে দেশে সংখ্যালঘুর ধর্মীয় আচার ব্যবহারে লাগাতার সরকারি হস্তক্ষেপ হয়েই চলে কীভাবে? কীভাবে গেরুয়া আলখাল্লা পরা বৃহত্তম রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আলিগড়ের কলেজে হিজাব বন্ধ করার ফরমান নিয়ে হাজির হয় তার গেরুয়া রঙের উত্তরীয় পরা পোষ্য গুন্ডারা? আর কলেজ কর্তৃপক্ষও সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়?

আসলে হিজাব-দ্বন্দ্ব কেবল হিজাব নিয়েই নয়। এর পেছনে আছে ধর্মীয় আধিপত্যকামিতা, অসহিষ্ণুতা এবং অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা।

দু আড়াই মাস আগে কর্ণাটকের স্কুল কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলিম ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের মধ্যে অনেকেরই মতে হিজাব তাদের ধর্মীয় পরিচিতি, তাদের বিশ্বাস ও আবেগের চিহ্ন। সংবিধানে সবার ধর্মাচরণের পরিপূর্ণ অধিকারের কথা স্পষ্টাক্ষরে লেখা রয়েছে। যে রাজ্যগুলো হিজাব নিষিদ্ধ করছে তারা সংবিধান বিরোধী কাজে লিপ্ত।

এমনিতেই মুসলমান সম্প্রদায় এখন এ দেশে কোণঠাসা। তাদের ধর্মীয় আচারে হিন্দুত্ববাদী শাসকের এই নাক গলানো তাদের আরও ক্রুদ্ধ ও বিভ্রান্ত করে তুলেছে। এগুলো তাদেরকে আরও প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেবার চক্রান্ত হিসেবেই প্রতিভাত হচ্ছে। এইভাবে পোশাকের ওপর বিধিনিষেধ জারি করার মূল উদ্দেশ্য কি অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাংস্কৃতিক একীকরণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান মেয়েদের সামনে নতুন নতুন বাধা সৃষ্টি করা ?

একথা তো সম্পূর্ণ ঠিক, যে মেয়েদের যে কোনো কাজেই পিতৃতন্ত্র প্রচুর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শিক্ষা যেহেতু মনের প্রসার ঘটিয়ে 'মেয়েমানুষ'-কে মানুষ করে তোলবার হাতিয়ার, তাই শিক্ষাক্ষেত্রে বোধহয় সবচেয়ে বেশি কাঁটা বিছানো থাকে। বিদ্যাসাগর রামমোহন নিরন্তর যুদ্ধে কতটা অর্জন করতে পেরেছিলেন তা আমরা সবাই জানি। তাদের কাজে জল ঢালবার জন্য ব্যগ্র রক্ষণশীল সমাজ আজও বর্তমান। গ্রামের দিকে কোনো বিবাহিত হিন্দু মেয়েকে শাঁখা সিঁদুর না পরে স্কুলে যেতে বলা হলে তার অভিভাবক সেটা মেনে নেবে?  হয়ত মেয়েটির পড়াই বন্ধ হয়ে যাবে। তেমনিই হিজাব না পরে মুসলমান ছাত্রী যদি স্কুলে আসতে চায়, রক্ষণশীল সমাজ, তাকে অনুমতি দেবে কি?  আমরা কি হলফ করে বলতে পারব মেয়েটি নিরুপদ্রবে তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে? তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য কী?  শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে নারীকে তার নিজের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিতে উদবুদ্ধ করা, নাকি তার সব সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা? আজকের যে মুসলমান কিশোরীটি হিজাব পরে স্কুলে যাচ্ছে, শিক্ষাশেষ করে নিজের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিয়ে, সে যদি হিজাব পরতে না চায় পরবে না।

একটা সমাজ, একটা সম্প্রদায়কে পেছনে রেখে দেবার সবচেয়ে ভালো চাল হচ্ছে তাদের নারীদের অশিক্ষিত করে রাখা।

অথচ স্কুল কলেজগুলিতে হিন্দুত্ববাদী শাসকের অনুগামী বলে পরিচিত ছাত্ররা গলায় গেরুয়া কাপড় জড়িয়ে, কপালে লম্বা টিকা লাগিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এগুলোও কিন্তু ধর্মীয় প্রতীক। এইসব ব্যবহার করা ছাত্র ছাত্রীরাই হিজাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে মুখর। প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করতেও এরা পিছ পা নয়।

তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম, মুসলমানত্বের চিহ্নগুলি লুকিয়ে ফেলতে হবে, কিন্তু হিন্দুত্বকে যতো পারা যায় প্রকাশ করাই নতুন যুগের, নতুন ভারতের নিদান। ফিরে আসতে পারে পৈতের রমরমা, উপনয়নে দ্বিজত্ব লাভ, অন্তর্জলিযাত্রা, ষোড়শপচারে শ্রাদ্ধ, বাল্য এবং বহু বিবাহ, অনেকের মতে সতীদাহও। অথচ কোনদিন এমনও কি হতে পারে, যাতে ফরমান জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হবে মুসলমান পুরুষের দাড়ি রাখা? এখনও অনেক মুসলমান এমনিতেই দাড়ি রাখেন না, কিন্তু যেইই এটি চাপিয়ে দেওয়া হবে, অমনি নিজেদের ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় স্পেসে জবরদখল বলে তাদের প্রত্যেকেরই সঙ্গতভাবেই তা মনে হবে।

 অবশ্য এখন অব্দি দেখা যাচ্ছে নারীঘটিত ব্যাপারেই শাসকের "সংস্কার" বেশি উৎসাহী।  

একজন হিন্দু ধর্মাচারী ও একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর মধ্যে এই বিভেদ সংবিধান বিরোধী তো বটেই। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থই হচ্ছে অন্যের ধর্মাচরণে নাক না গলানো। তাহলে  কেন এইরকম  হবে?  চিরকাল জেনে এসেছি, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীর সমস্ত বিশ্বাসের মিলনক্ষেত্র। সেখানে এই নির্লজ্জ দম্ভ ও আগ্রাসনের প্রকাশ আমরা মেনে নেব? সংবিধানের জায়গা নেবে মনুসংহিতা ?

মুসলমানদের এইভাবে "সবক" শিখিয়ে, হেনস্তা করে, নিজেদের জায়গা বুঝিয়ে দিয়ে হিন্দুত্ববাদের প্রবক্তারা তাদের মূল ভোটারদের দেখাতে চায় তারা কতোটা শক্তিশালী। তবে ভোটে লাভালাভই এ গল্পের সবটা নয়। উঠতে বসতে, প্রত্যেকটা ব্যপারে মুসলমানদের হেনস্তা করাটাই হিন্দু জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য। এটি একটি বিশেষ মানসিকতা। একটি নতুন "সংস্কৃতি"।

এই মানসিকতা বোঝাবার জন্য কর্ণাটকেরই আরও একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। প্রায় ছ'টি বিখ্যাত মন্দিরের কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে যে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে যে সব মেলার আয়োজন করা হয় তাতে মুসলমান ব্যবসায়ীরা আর অংশগ্রহণ করতে পারবে না৷ অথচ এই অংশগ্রহণ হয়ে এসেছে বংশানুক্রমিকভাবে, সুপ্রাচীন কাল থেকে। ধর্মীয় বিভেদ আজ কোথায় পৌঁছেছে যে এক সম্প্রদায় আর এক সম্প্রদায়কে এইভাবে হাতে ও ভাতে মারার বন্দোবস্ত করতে পারছে!

সবচেয়ে দুঃখপ্রদ, বিচার বিভাগীয় কান্ড কারখানা। কর্ণাটক হাইকোর্ট স্কুল কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ রেখেছে। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে গেলে শুনতে হয়েছে তাড়াহুড়ো করে কোনো শুনানি হবে না। এখন অব্দি শুনানির জন্য কোনো দিন ঘোষণাও হয়নি। প্রধান বিচারপতি এনভি রামানা বলেছেন, পরীক্ষা সন্নিকট বলে হিজাব মামলা এগিয়ে আনতে হবে এই আবদার মানতে তিনি অপারগ। অথচ হিজাবহীন হয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে যাবার অনুমতি মিলবে না বলে সত্যিই হয়ত অনেক মেয়ের বছর নষ্ট হবে, চাই কী পড়াশুনা বন্ধ হয়েও যেতে পারে। পিতৃতান্ত্রিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জারি রাখা লড়াইতে মেয়েদেরকে হারিয়ে দিতে এই রাষ্ট্র  সত্যিই এতটা উদগ্রীব ! এটা বোঝা কি এতোই কষ্টের ব্যাপার যে যা ছিল নিছক ধর্ম ও পিতৃতন্ত্রের সৃষ্টি মস্তকাবরণ, সংখ্যাগুরুর আগ্রাসন তাকেই করে তুলেছে প্রতিরোধের প্রতীক ? স্বাতন্ত্রের চিহ্ন? সব বুঝেও ক্রমাগত কোণ ঠাসা করার যে খেলা হিন্দুত্ববাদীরা খেলছে তার পরিণামে কত যে রক্ত ঝরবে, কত বছর পিছিয়ে যাবে নারী মুক্তির সলতে পাকানো, তা কে জানে!

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment