‘পরমাণু-কন্যা’ লিজা মেইৎনার

  • 23 August, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 572 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯ এবং ২৯ – হ্যাঁ, যথাক্রমে ১৯ এবং ২৯বার রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য নমিনেশন পেয়েছিলেন লিজা মেইৎনার। কিন্তু সেই মেয়ের ভাগ্যে নোবেল ছিল না। এ কেবল লিজারই দুর্ভাগ্য নয়। এই দুর্ভাগ্য নোবেল কমিটির। কিন্তু তাই বলে ৪৮ বারের সুপারিশেও একটি পুরষ্কারকে যখন বিবেচনা করা গেল না - সে কেবল বিজ্ঞান নয়, মনুষ্যত্বেরও ভ্রান্তি। লিজা মেইৎনারকে আরও অনেক মানুষের চেনা উচিত। নারীর বিজ্ঞানচর্চার বিষয়ে ধারাবাহিক (পর্ব ২৫)

“... মোমবাতি জ্বলছে বন্দীশালায়। স্তিমিত আলোকে দেখা যায় খাটের উপরে চুপ করে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। চোখে উদভ্রান্ত পাগলের দৃষ্টি। হাইজেনবের্ক সন্তপর্ণে এগিয়ে আসে। হাতটা তুলে নেয় তাঁর। সম্বিত ফিরে পান বৃদ্ধ। বিহ্বলের মতো তাকিয়ে দেখেন পুত্রপ্রতিম শিষ্যের দিকে। হাইজেনবের্ক বললে, স্থির হন প্রফেসর। হেরে গেছি তাতে হয়েছেটা কি ? হারতেই কি চাননি এতদিন ? আপনি নিজেই তো একদিন বলেছিলেন – হিটলারের হাতে অ্যাটম বোমা তুলে দেওয়ার আগে আত্মহত্যা করব আমি।

বৃদ্ধের ঠোঁট দুটি নড়ে ওঠে। অস্ফূটে বলেন, সেজন্য নয় ওয়ার্নার, সে জন্য নয়!

- তবে কি জন্য ?

- ঐ ম্যাথমেটিক্যাল ফিগারটা। হান্ড্রেড থাউজেণ্ড! টেন টু দি পাওয়ার ফাইভ।

- কিন্তু আপনি তার কি করবেন স্যার ? আপনি কেন এতটা ভেঙে পড়ছেন ?

দুহাতে মুখ ঢেকে বৃদ্ধ হাহাকারে ভেঙে পড়েনঃ আমি – আমিই যে ওদের প্রথম পথ দেখিয়েছিলাম, মাই বয়! আমার হাতটা আজ রক্তে লাল হয়ে গেছে – দেখছ না! হান্ড্রেড থাউজেণ্ড সোলস!

বলিরেখাঙ্কিত হাতটা বাড়িয়ে ধরেন মোমবাতির স্তিমিত আলোয়।

হাইজেনবের্ক ওঁর মাথাটা নিজের বুকের উপরে টেনে নেয়। পাকা চুলে ভরা মাথার উপর হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। যেন বাচ্চা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ...”

- ‘বিশ্বাসঘাতক’, নারায়ণ স্যান্যাল [উদ্ধৃতিতে লেখকের বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে]

নিউক্লিয়ার ফিসন। বা পরমাণুর বক্ষবিদীর্ণকরণ। বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে ভয়ানক যে আবিষ্কার। কল্যাণময় কাজে সেই আবিষ্কারকে ব্যবহার করা হয়নি। বরঞ্চ সেই আবিষ্কারকে ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে কুখ্যাততম মারণাস্ত্রটিকে, আর সেই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত সমস্ত বৈজ্ঞানিকেরা। নীলস বোর, রিচার্ড ফাইনম্যান, লিও জিলার্ড, রবার্ট ওপেনহাইমার এমনকি এ্যালবার্ট আইনস্টাইন। হিরোশিমার সেই বীভৎসতার সংবাদ পেয়ে উপরের উদ্ধৃতিটিতে যে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকের আত্মদহনের কথা লেখা আছে, তাঁর নাম অবশ্য এই পরমাণু-দৌড়ে ‘বিজয়ী’দের তালিকাতে ছিল না। তবু এই দৌড়ের একেবারে গোড়াকার যে সূত্রপাত, ইতিহাসের কাল অনুসারে এই বৈজ্ঞানিকের হাত ধরেই তা অযাচিত ভাবে শুরু হতে পেরেছিল। ইতিহাস বলছে, এঁর নাম অটো হান। কিংবদন্তী জার্মান বৈজ্ঞানিক। ১৯৪৪ সালে তিনি রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। সেই পুরষ্কারের কারণ, নিউক্লিয়ার ফিসন পদ্ধতির আবিষ্কার। নিউট্রন কণার মাধ্যমে এক সফল ও সার্থক প্রক্রিয়াতে পরমাণুর বক্ষবিদীর্ণকরণ। কিন্তু সেই গবেষণাতেও তিনি একেবারে একক ছিলেন না। সহকর্মী হিসেবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন বৈজ্ঞানিক অটো ফ্রিৎশ এবং লিজা মেইৎনার। শেষোক্তদের ভাগ্যে নোবেলের শিরোপা জোটেনি। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষ ও বৈজ্ঞানিক হিসেবে আশ্চর্য কৃতিত্বের এবং তদুপরি আশ্চর্য রোমাঞ্চকর এক জীবনের যাত্রী ছিলেন শ্রীমতি মেইৎনার। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে পরমাণু বোমার প্রথম সূত্রটিকে আবিষ্কারের বিষয়ে অতখানি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকলেও পরবর্তীতে যিনি সবরকম ভাবে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে সেই শক্তিকে ব্যবহারের সমস্ত প্রকল্প থেকে। ইহুদী, জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান বিদূষী এই বৈজ্ঞানিক তাঁর জীবৎকালে যে বিপুল অবদান রেখে গেছেন, বিজ্ঞান এবং মানবতার চোখ থেকে আজ সেই ইতিহাসকে ফিরে দেখব। লিজা মেইৎনার ... জন্ম নভেম্বর, ১৮৭৮।

১৯ এবং ২৯ – হ্যাঁ, যথাক্রমে ১৯ এবং ২৯বার রসায়ন এবং পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য নমিনেশন পেয়েছিলেন লিজা মেইৎনার। কখনও বা তাঁর নাম সুপারিশ করেছিলেন গুরু অটো হান স্বয়ং, কখনও বা নোবেল কমিটির কাছে তাঁর নামটিকে সুপারিশ করে পাঠিয়েছিলেন আর্থার ক্রম্পটন, নীলস বোর অথবা ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কদের মতো একেকজন। কিন্তু সেই মেয়ের ভাগ্যে নোবেল ছিল না। আইনস্টাইন একবার লিজার সম্পর্কে বলেছিলেন, “এই মেয়ে জার্মানির ‘মারী কুরি’ হতে পারত।” কি হতে পারত বা কি হয়েছে সেই বিষয়ে কিছু বলতে পারব না – কেবল একটা তুলনাকে না টেনে কিছুতেই থাকতে পারছি না, মহাত্মা গান্ধীর নাম নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য চার থেকে পাঁচবারের বেশী সুপারিশ করা হয়নি। সেই জায়গাতে দাঁড়িয়ে, ১৯+২৯ = ৪৮ বার নোবেলের জন্য নমিনেশন পেলেও শিকে ছেঁড়েনি লিজা মেইৎনারের ভাগ্যে। এ কেবল লিজারই দুর্ভাগ্য নয়। এই দুর্ভাগ্য নোবেল কমিটির। আমরা নারী বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে মূলত মারী কুরির কথাই সবচেয়ে বেশী করে শুনে থাকি। পরপর এতগুলি প্রবন্ধের মধ্যে দিয়ে এগুতে এগুতে সেই বিশ্বাস যে শতটুকরো হয়ে ভেঙেছে সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাই বলেও, ৪৮বারের সুপারিশেও একটি পুরষ্কারকে বিবেচনা করা গেল না। এ কেবল বিজ্ঞান নয়, মনুষ্যত্বেরও ভ্রান্তি। মারী কুরি বা আরও কাউকে দিয়ে সেই ভ্রান্তিকে মোছার চেষ্টা করা হলেও লিজা মেইৎনারকে আরও অনেক মানুষের চেনা উচিত।

৪৮বার যিনি নোবেল-সুপারিশের তালিকাতে নাম তুলেছেন, তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার কোনরকম চেষ্টা করাটাও আমার পক্ষে অন্তত ধৃষ্টতা হবে। বিশেষত, পরমাণু গবেষণা এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার মতো জটিল বিষয় যাঁর কাজের সঙ্গে জড়িয়ে, তাঁর বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের জায়গা এটা নয়। আমরা কেবল তাঁর জীবন এবং কৃতিত্বগুলিকেই কিছু কিছু করে ছুঁয়ে যেতে চেষ্টা করব। গল্পের মতো তুলে ধরতে চাইব গল্পের চেয়েও বিস্ময়কর এক জীবনকে।

ভিয়েনাতে জন্ম, আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ১৮৯৭ সাল অবধি অস্ট্রিয়াতে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার্থে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এদিকে ১৮৯২ সালেই স্কুলশিক্ষার পাঠ মোটামুটি শেষ করে ফেলেন লিজা মেইৎনার। এরপর ১৯০০ সালে একটি মেডিকেল স্কুলে ভর্তির আগে গৃহশিক্ষকের কাছে স্কুলস্তরের বাকি শিক্ষাটুকুর পড়াশুনো শেষ করতে তিনি সচেষ্ট হন। শোনা যায়, এক বছরের মধ্যে তিনি আট বছরের পাঠ্যক্রমকে অনায়াসেই শেষ করেছিলেন। ১৯০১ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় লিজা এবং তাঁর চৌদ্দ জন মেয়ে বন্ধুর মধ্যে চারজন মাত্র উত্তীর্ণ হন। লিজার উল্লেখযোগ্য সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদ লুডউইগ বোল্টজম্যানের কন্যা হেনরিয়েট বোল্টজম্যান। তিনিও এই পরীক্ষাতে সফল হয়েছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক বোল্টজম্যানের ক্লাস সম্পর্কে লিজা মেইৎনার বিশেষ ভাবে উৎসাহিত ছিলেন। আরেক কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক ম্যাক্সওয়েলের পূর্বতন গবেষণার উপরে লিজা মেইৎনার যখন তাঁর ডক্টরাল থিসিসটি সম্পন্ন করেন, তখন অধ্যাপক বোল্টজম্যানই ছিলেন তার অন্যতম পরীক্ষক। ১৯০৩ সালে ওলগা স্টেইন্ডলারের পর, লিজা মেইৎনার ১৯০৫ সালে দ্বিতীয় মহিলা হিসেবে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রিতে ভূষিত হন। ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯০৬ তারিখে লিজার সম্পূর্ণ পিএইচডি থিসিসটি ‘অসমঞ্জস দেহে তাপপ্রবাহের ধরণ’ শীর্ষক একটি বই হিসেবে ভিয়েনাতে প্রকাশিত হয়।  এই সময়, লিজার মেধা সম্পর্কে তাঁর অধ্যাপকেরা এতটাই উৎসাহিত ছিলেন যে, আরেক বিশ্ববন্দিত পদার্থবিদ লর্ড র‍্যালে কর্তৃক রচিত একটি গবেষণাপত্রের অংশকে তাঁরা লিজার কাছে যাচাই করতে পাঠান। সেই গবেষণা সংক্রান্ত একটি পরীক্ষার ফলাফল বিষয়ে স্বয়ং র‍্যালেও সন্দিহান ছিলেন এবং সেই অংশটিকে তিনি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতেও অসমর্থ হন। লিজা মেইৎনার সেই অংশটির রহস্য উদ্ঘাটন করেন, এবং হাতেকলমে সেই পরীক্ষাটিকেও সম্পন্ন করে দেখিয়ে, তার ব্যাখ্যাকে সহজ করে বুঝিয়ে দেন। এরপর স্টেফান মেয়ারের অনুপ্রেরণায় তিনি পরমাণু গবেষণায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

বার্লিনের ফ্রেডরিখ উইলহেলম ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে প্রথম পরমাণু গবেষণা এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার উপরে গবেষণা শুরু করেন লিজা মেইৎনার। এই সময় একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে অধ্যাপক অটো হান একজন সহযোগী পদার্থবিদের খোঁজ করছিলেন। তখনই নানাবিধ তেজস্ক্রিয় মৌল-সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে অটো হান রীতিমতো পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন। এর আগে কানাডার মন্ট্রিলে তিনি স্বয়ং রাদারফোর্ডের অধীনে গবেষণা করে এসেছেন। এই অটো হানের সঙ্গেই তাঁর ল্যাবে গবেষণা শুরু করেন লিজা মেইৎনার। কিন্তু ল্যাব বা গবেষণাগার বললে ভুল হবে – গতানুগতিক রসায়নের জগতে তখনও ‘নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি’ বিষয়টি ততটাও বিখ্যাত হয়নি। কাজেই রসায়ন বিভাগের অন্যান্য বৈজ্ঞানিকেরা সেই সময়ে অটো হানের কাজকে খানিকটা তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখতেন। যে পরমাণুকে চোখে দেখা যায় না, হাতে ছোঁয়া যায় না, এমনকি নাকে শোঁকাও যায় না – সে আবার কিরকম ‘কেমিস্ট্রি’ হল ? মূলত এই ছিল তাঁদের উন্নাসিকতা। এর কারণে অধ্যাপক হানের গবেষণাগারটি ছিল মূল ভবন থেকে দূরে, এক ছুতোর মিস্ত্রির পরিত্যক্ত ওয়ার্কশপের ভিতরে। লিজার পক্ষে এই সমস্যা ছিল আরও ভয়াবহ। কারণ, জার্মান প্রুশিয়াতে তখনও অবধি মেয়েদের সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশাধিকার ছিল না।  লিজা তাই সেই ওয়ার্কশপের বাইরে অটো হানের নিজস্ব ঘর বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য বিভাগেও কখনও যেতে পারতেন না। গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটিও মেয়েদের শৌচাগার না থাকায় এই বিষয়ে বেশ খানিক দূরের এক রেস্তোঁরার শৌচাগারের উপরেই তাঁকে নির্ভর করতে হত। যদিও, এই কষ্ট তাঁকে বেশীদিন সহ্য করতে হয়নি। বছরখানেকের মধ্যেই প্রুশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নারীর প্রবেশাধিকার স্বীকৃত হয় এবং মহিলা শৌচাগার বানানোরও কাজ শুরু হয়।

অটো হানের সঙ্গে এই গবেষণাগার থেকেই যৌথ ভাবে একাধিক তেজস্ক্রিয় মৌল, তাদের আইসোটোপ এবং তাদের বিকিরণ সংক্রান্ত গবেষণায় নিজের প্রতিভার ছাপ রাখেন লিজা মেইৎনার। প্রথমদিকে গবেষণার প্রয়োজনে কিছুটা অর্থকষ্টে ভুগলেও ১৯১৪ সালে মেসোথেরিয়াম নামে রেডিয়ামের একটি আইসোটোপকে আবিষ্কারের জন্য তার পেটেন্টমূল্য হিসেবে এক বিশাল পরিমাণ অর্থের অধিকারী হন অটো হান। যার একটি অংশ তিনি লিজাকে প্রদান করেন। চিকিৎসাবিদ্যায় এই আইসোটোপটির বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। এইভাবে একটির পর একটি গবেষণায় নিজেদের প্রতিভার ছাপ রাখতে রাখতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অটো হান এবং লিজা মেইৎনার প্রোএ্যাক্টিনিয়াম নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করেন। উল্লেখ্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হান এবং মেইৎনার দুজনকেই এ্যাক্টিভ সার্ভিস অথবা যুদ্ধক্ষেত্রে সরাসরি পরিষেবা দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। যুদ্ধ থেকে ফিরে লিজা মেইৎনারই প্রথম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ পিচব্লেন্ড থেকে প্রোএ্যাক্টিনিয়াম নিষ্কাশন করতে সক্ষম হন। পরে অটো হান শিষ্যার এই আবিষ্কারের বিষয়ে জানতে পারেন। আলফা ও বিটারশ্মি বিকিরণ-সহ তেজস্ক্রিয় মৌলের বিষয়ে লিজার গবেষণা দ্রুতগতিতে চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনের ছবিতে আমরা দেখতে পাই বক্তৃতাকক্ষের একেবারে সামনের সারিতে বসে রয়েছেন, নীলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, উলফগ্যাং পাউলি, অটো স্টার্ন এবং লিজা মেইৎনার। লিজা-ব্যতীত সেই কক্ষে আর একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন হিল্ডা লেভি। ১৯৩৮ পরবর্তী সময়ে এই দুজনকেই কোনওমতে নিলস বোর এবং অন্যান্যদের সাহায্য নিয়ে জার্মানি ছেড়ে পালাতে হবে। কারণ জার্মানিতে তখন নাৎসি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবং লিজা মেইৎনার সহ আরও অনেকেরই প্রথম এবং একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তাঁরা ইহুদী। তাঁরা অনার্য।

প্যারিসের পতনের পর যখন সেখানকার ইহুদীদেরকে সরকারি খাতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে হচ্ছিল, তখন হেনরি বার্গসন নামে এক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন, “শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, নোবেল পদক বিজয়ী, ইহুদী পুরুষ”। ১৯২৭ সালে হেনরি বার্গসন সাহিত্যক্ষেত্রে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তখন গোটা ইউরোপ জুড়েই হিটলার এবং নাৎসিবাদের নামে এক পাগলা ঘোড়ার মারণদৌড় শুরু হয়েছে। চাকরি চলে গিয়েছে লিজা মেইৎনারের আত্মীয় ও বৈজ্ঞানিক অটো ফ্রিৎশের। পদ খুইয়েছেন অটো স্টার্ন। এই সময় অধ্যাপক পদ খোয়ালেও, জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান হওয়ার সুবাদে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সরকারি ভাবে এ্যাক্টিভ সার্ভিস প্রদানের কারণে প্রাথমিক ভাবে কিছুটা হলেও বেঁচে গিয়েছিলেন লিজা মেইৎনার। কিন্তু তিনিও বুঝতে পারছিলেন যে সময় ফুরিয়ে আসছে। ১২ই মার্চ, ১৯৩৮ – লিজা মেইৎনারের অস্ট্রিয়ান নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই সময় নীলস বোর তাঁকে কিছু বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ জানিয়ে কোনওমতে সুইৎজারল্যান্ড অথবা ডেনমার্কে চলে আসতে বলেন। এদিকে নাগরিকত্ব খোয়ানোর কারণে বিদেশ যাত্রার জন্য ভিসা জোগাড় করাটাও লিজার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অটো ফ্রিৎশ যদিও অটো হানের সঙ্গে সহযোগিতায় নিজের গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জার্মানি ছাড়ার জন্য লিজা মেইৎনার ততদিনে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। শেষ অবধি, নীলস বোর, গণিতবিদ হ্যান্স ক্রেমার, পদার্থবিদ পিটার ডিবাই প্রমুখ একাধিক জনের পরিকল্পনায় আরেক বিজ্ঞানীর সঙ্গে রীতিমতো এককাপড়ে দেশ ছাড়েন লিজা মেইৎনার। ট্রেনে চেপে তাঁরা জার্মান-সীমান্তে পৌঁছন। সীমান্তরক্ষীরা লিজা মেইৎনারকে সেই সময়, সঙ্গে থাকা জার্মান বৈজ্ঞানিকের স্ত্রী বলে ভুল করেন। নিরাপদেই সীমান্ত পার হয়ে যান লিজা মেইৎনার। কিন্তু নিউক্লিয়ার ফিসনের গবেষণারও আরও খানিক দেরী আছে তখন।

১৯৩৮ সালেরই ডিসেম্বর মাসে সুইডেনের এক বরফাবৃত শহরে ক্রিসমাসের অবসরে মিলিত হন অটো ফ্রিৎশ এবং লিজা মেইৎনার। এর আগেই নিজের একটি সাম্প্রতিকতম পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়ে লিজার মতামত জানতে চেয়ে তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন অধ্যাপক অটো হান। বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই বিষয়েই আলোচনা করছিলেন লিজা এবং অটো ফ্রিৎশ। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ইউরেনিয়াম পরমাণুকে নিউট্রন কণার বৃষ্টি দিয়ে আঘাত করলে অবশেষ হিসেবে পড়ে থাকছে বেরিয়াম, যার এ্যাটমিক মাস ইউরেনিয়ামের চাইতে অন্তত ৪০% কম। এই পরিমাণ এ্যাটমিক মাসের কমে যাওয়া অস্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে অটো হান, স্ট্রাসম্যান এবং অটো ফ্রিৎশ সকলেরই। সেই বরফাবৃত সকালে লিজা মেইৎনারই অঙ্ক কষে অটো ফ্রিৎশকে দেখান যে এই ঘটনা সম্ভব, এবং তা ঘটতে পারে একমাত্র যদি মূল পরমাণুটিই সম্পূর্ণ ভাবে বিদীর্ণ হয়ে যায়, এবং তার থেকেই জন্ম নেয় নতুন কোনও উপাদান। জীবনবিজ্ঞানে দুটি কোষের এভাবে বিদীর্ণ হয়ে, বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ফিসন বলা হত। অটো হান ইউরেনিয়ামের উপরে নিউট্রন কণার বর্ষণের মাধ্যমে পরমাণু বিদীর্ণকরণের এই যুগান্তকারী প্রক্রিয়াটির নাম দিলেন নিউক্লিয়ার ফিসন। লিজা মেইৎনার অঙ্ক কষে সেই দিনই দেখিয়ে দিয়েছিলেন, এর প্রতিক্রিয়াতে যে বিপুল শক্তির উদ্ভব হবে তা আইনস্টাইনের ই ইক্যুয়াল টু এম সি স্কোয়ারের সূত্রকে মেনে চলবে। পরমাণুবিদীর্ণকরণের সঙ্গে সঙ্গে সেই দিনই তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। মহাকাল মনে মনে হেসে বলল, মানবতার কুখ্যাততম অস্ত্রটিকে নির্মাণের এই তো সবে শুরু! নিজেদের অজান্তেই এক ভয়াবহ অশুভ শক্তিকে রসদ যুগিয়ে দিলেন বিজ্ঞানীরা। এমনটা তো তাঁরা করতে চাননি!

লিজা মেইৎনারকে লস এ্যালামোস বা ম্যানহাটান প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হতে অনুরোধ করেছিলেন নীলস বোর। এই সেই ম্যানহাটান প্রজেক্ট যার অন্তিম ফল হিসেবে আমরা হাতে পাব লিটল বয় এবং ফ্যাটম্যান নামে সেই দুটি বিধ্বংসী অস্ত্রকে, যারা চিরতরে মাটিতে মিশিয়ে দেবে হিরোশিমা এবং নাগাসাকি দুটি শহরকে। চিরতরে মুখ ঢাকবে মনুষ্যত্ব ... লিজা মেইৎনার এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে অস্বীকার করেন।

“নাও আই বিকাম ডেথ – দ্য ডেস্ট্রয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস!” হিন্দু গীতার উদ্ধৃতি থেকে পরমাণু বোমার বিধ্বংসী রূপ সম্পর্কে নিজের স্বতঃস্ফূর্ত অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন বিজ্ঞানী রবার্ট জে. ওপেনহাইমার। লিজা মেইৎনার এই ধ্বংসনৃত্যের সঙ্গী হতে চাননি। একসুরে তিনি সমালোচনা করেছিলেন অটো হান, অটো ফ্রিৎশ, হাইজেনবার্গ ও অন্যান্যদের – যাঁরা সেই সময়েও জার্মানিকে ত্যাগ করেননি। খাস বার্লিনে বসেই পরমাণু গবেষণা চালাচ্ছিলেন তাঁরা, যার অন্তিম ফলশ্রুতিতে যদি বা বোমা তৈরিও হত – সেই বোমার মালিকানা পেতেন উন্মাদ হিটলার। বিজ্ঞানীদের এই বোমা বানানোর প্রতিযোগিতাকে লিজা মেইৎনার একেবারেই মেনে নিতে পারেননি।

একথাও যে সত্য, ইউরোপে মিত্রশক্তির বিজয়ের পর অটো হান, হাইজেনবার্গ এবং আরও অনেক জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিককে ইংল্যান্ডের ‘ফার্ম হল’ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা জানতেও পারেননি যে লুকনো মাইক্রোফোনের সাহায্যে তাঁদের সমস্ত কথোপকথন অবধি রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে। যেদিন হিরোশিমাতে পরমাণু বিস্ফোরণের কথা রেডিওতে প্রচারিত হল বৃদ্ধ অটো হান বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তাঁরা বোমা তৈরি করতে পারেননি বলে। বাকি বৈজ্ঞানিকেরা কিন্তু সরাসরি এই আবেগের ভাগীদার ছিলেন না। পরমাণু বোমার বিধ্বংসী ক্ষমতা তাঁদেরকে যত না আপ্লুত করেছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী আপ্লুত করেছিল আমেরিকান প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁদের মেধার হেরে যাওয়ার বিষয়টা। মনের গভীরে সত্যি সত্যিই কি তাঁরা নিজেদের অজান্তেই বোমা বানানোর এক ইঁদুর দৌড়ে নেমে পড়েছিলেন ? অটো হান সেদিন লিজা মেইৎনারের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিলেন, “সেই অনার্য মেয়েটি, যে আমার সঙ্গে কাজ করত! তাঁকে অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমাদের গবেষণাগারে রাখতে ...” হান সেদিন কাতরোক্তি করে বলেছিলেন, “আমাদের উচিত ছিল সমস্ত ইউরেনিয়ামকে একত্র করে সমুদ্রের গভীরে ডুবিয়ে দেওয়া!” অদ্ভুৎ এক বিষাদগ্রস্ততা। অদ্ভুৎ এক মানবসত্তার প্রকাশ। “নাও আই বিকাম ডেথ – দ্য ডেস্ট্রয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস!”

নীলস বোর অথবা ফাইনম্যান পারেননি – কিন্তু লস এ্যালামসের অনেক বিজ্ঞানীই সেদিন শয়তানের নৃত্য নেচেছিলেন তাঁদের ‘সাফল্যে’। এই সবকিছুর থেকেই দূরে, অনেক দূরে বসেছিলেন লিজা মেইৎনার। মেধা এবং সৃষ্টি ব্যতীত আর কোনওকিছুই যে লিজাকে ছুঁতে পারেনি কোনোদিন। ... শেষ জীবনে তিনি সরাসরি হাইজেনবার্গের উদ্দেশ্যে লিখবেন, “তোমরা প্রত্যেকে বোমা বানাতে নাৎসি জার্মানিকে সহায়তা করেছ। সম্ভব হলে কখনও তাকিয়ে দেখো – তাকিয়ে দেখো লক্ষ লক্ষ সেই সমস্ত মানুষদের দিকে, যাঁরা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নামক বিভীষিকার মধ্যে বাস করেছে।”

১৯৪৭ সালে সুইডেনের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লিজা মেইৎনারের তত্ত্বাবধানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও ফলিত গণিতের সঙ্গে পরমাণু ফিসন প্রক্রিয়াটির সম্পর্কের বিষয়ে তিনি গবেষণার চেষ্টা করেন। মাঝে দীর্ঘসময় তিনি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পান। আমেরিকা সফরের সময়ই তাঁর সঙ্গে লিও জিলার্ড, এনরিকো ফার্মি এবং পূর্ব পরিচিত উলফগ্যাং পাউলির সাক্ষাৎ ঘটে। শেষ জীবনে তিনি আবার অটো হানের সঙ্গেই জার্মানিতে কিছুকাল বসবাস করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজন, দুজনের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল, গুরু-শিষ্যার এক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। ১৯৬৪ সালে আমেরিকা সফরের সময় লিজা মেইৎনার হৃদরোগে আক্রান্ত হন। সেই থেকেই তিনি ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেন। সুইডেন থেকে অবসর নেওয়ার পর পাকাপাকি ভাবে লিজা ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ারে থাকতে শুরু করেছিলেন। ২৭শে অক্টোবর, ১৯৬৮তে  ৮৯ বছর বয়সে লিজা মেইৎনার প্রয়াত হন। এর মাত্র কিছুদিন আগেই একই বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসে জার্মানিতে প্রয়াত হন অধ্যাপক অটো হান ও তাঁর স্ত্রী এডিথ। এঁদের মৃত্যুর খবর লিজাকে জানানো হয়নি। ...

লিজা মেইৎনারের সমাধির উপরে লেখা রয়েছে “এ ফিজিসিস্ট হু নেভার লস্ট হার হিউম্যানিটি”। পরমাণু-অস্ত্রের শ্মশান-নৃত্যের সম্মুখে দাঁড়িয়েও সেই বিপুল ক্ষমতাকে অস্বীকার করা বড় সহজ কর্ম নয়। লিজা মেইৎনার তাই একজন সার্থক বৈজ্ঞানিক ছিলেন। ধ্বংসে নয়, কল্যাণেই যাঁর প্রকাশ।

সূত্রঃ

[১] অটো ফ্রিৎশ, ‘হোয়াট লিটল আই রিমেমবার’, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৯

[২] রিচার্ড রোডস, ‘দ্য মেকিং অব দ্য এ্যাটমিক বম্ব’, নিউ ইয়র্ক সাইমন এ্যান্ড শ্যুস্টার, ১৯৮৬

[৩] অটো হান, ‘অটো হান – এ সায়ান্টিফিক অটোবায়োগ্রাফি’, অনুবাদঃ উইলি লি, চার্লস ক্রিবনার এ্যান্ড সনস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৬

[৪] রুথ লিউইন সাইম, ‘দ্য ডিসকভারি অব প্রোএ্যাক্টিনিয়াম’, জার্নাল অব কেমিক্যাল এডুকেশন, খন্ড ৬৩, সংখ্যা ৮, আগস্ট, ১৯৮৬

[৫] রুথ লিউইন সাইম, ‘লিজা মেইৎনার এ্যান্ড দ্য ডিসকভারি অব ফিসন’, জার্নাল অব কেমিক্যাল এডুকেশন, খন্ড ৬৬, সংখ্যা ৫, মে, ১৯৮৯

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

ছবি: সংগৃহীত

 

0 Comments

Post Comment