প্রতিবাদী মেয়েরা ও মোদি জমানা

  • 19 March, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 769 view(s)
  • লিখেছেন : প্রতিভা সরকার
মোদি সরকারের সব অত্যাচার তুচ্ছ করে, মনুবাদী অনুশাসনের তোয়াক্কা না করে  প্রতিবাদীদের একেবারে সামনের সারিতে উঠে আসছে মেয়েরা। এই মেয়েরা কেউ শহরের, কেউ গ্রামের, অর্থনৈতিক অবস্থাও তাদের ভিন্ন ভিন্ন, শিক্ষা স্ট্যাটাস সুবিধা কোনকিছুতেই তারা সমান নয়। শুধু একটি জায়গায় তারা এক—স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অকুতোভয় প্রতিবাদ।

মোদি সরকার মেয়েদের ওপর এতো খাপ্পা কেন?‌ হতে পারে সব অত্যাচার তুচ্ছ করে প্রতিরোধ গড়ছে বলে, হতে পারে মনুবাদী অনুশাসনের তোয়াক্কা করছে না বলে। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই এই ঘোরতর নিও লিবেরাল জমানায় এবং পোস্ট ট্রুথের জগতে, যেখানে কামারাদারি ব্যাপারটাই আরো উবে গেছে অতিমারির কল্যাণে, মেয়েরা উঠে আসছে প্রতিবাদীদের একেবারে সামনের সারিতে। এই মেয়েরা কেউ শহরের, কেউ গ্রামের, অর্থনৈতিক অবস্থাও তাদের ভিন্ন ভিন্ন, শিক্ষা স্ট্যাটাস সুবিধা কোনকিছুতেই তারা সমসত্ত্ব নয়। একটি জায়গায় কেবল তারা এক, সেটা হল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অকুতোভয় প্রতিবাদ। সেখানে কারখানা থেকে ছাঁটাই দলিতকন্যা নদীপ কাউর আর জামিয়া মিলিয়ার এম ফিল ছাত্রী সারফুরা জারগারের মধ্যে কোনো তফাত নেই। বিভেদ নেই ব্যাঙ্গালোরের পরিবেশকর্মী দিশা রবি এবং ইউএপিএ-তে আটক কাশ্মিরি সাংবাদিক মাসরাত জাহারার মধ্যে। এইখানে আমি পার্ক সার্কাস আন্দোলনের সংগঠক সদ্যপ্রয়াত আসমত জামিলের কথা ও শাহিনবাগের দাদির কথাও স্মরণ করতে চাই।

মেয়েদের ওপর নিপীড়নও নেমে আসছে সেইরকম। গৌরী লঙ্কেশকে যে কায়দায় ছুটি করানো হল, সে কায়দা তো বার বার প্রয়োগ করা চলে না। তাই সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেনদের জেলে ঢোকানো হল। সেই ভীমা কোরেগাঁও মামলার অন্তঃসারশূন্যতা এমনই ভয়াবহ যে আদালতের সন্দেহ, পুলিশ জাল নথি পেশ করছে। এরপর শাসকের কাছে ঈশ্বরের বর হয়ে এল দিল্লি দাঙ্গা। নির্বিচারে প্রতিবাদীদের জেলে পোরা শুরু হয়ে গেল। উমর খালিদ, অন্তঃসত্ত্বা সাফুরা সবাই নাকি দেশদ্রোহী, এদের প্রত্যেকের নাকি মদত আছে দিল্লি দাঙ্গায়। 

অথচ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে খোলাখুলি ভয় দেখানো ও দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়া বিজেপি-র কপিল মিশ্র স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। ভালো আছে মাননীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, যে প্রকাশ্য মিছিলে ‘‌দেশ কো গদ্দারো কো / গোলি মারো সালো কো’‌-র মতো চমকপ্রদ শ্লোগানের উদগাতা। বিজেপি এমপি পরবেশ শর্মারও কোনো শাস্তি হয়নি। শাস্তি পায়নি রাতের অন্ধকারে মুখ ঢেকে জেএনইউ আক্রমণ করা এভিবিপির গুন্ডাবাহিনী।

ভবিষ্যতে যখন বিজেপি কবলিত ভারতের ইতিহাস লেখা হবে, দেখা যাবে নারীদের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন নামিয়ে আনার ব্যাপারে এই দলটি ব্রিটিশ সরকারের একান্ত অনুসারী। পারলে হয়ত গুলি চালিয়ে সবাইকে এরা নিকেশ করে দিত, অথবা আইন প্রণয়ন করত যে কন্যা সন্তান হলেই দুর্গা বাহিনীতে তার ট্রেনিং অবশ্যকর্তব্য। যতদিন তা হচ্ছে না ততদিন নাতাশা নারওয়াল বা দেবাঙ্গনা কলিতার জন্য নির্দিষ্ট থাক জেলের লপসি। ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনের এমন আকছার ব্যবহার আর কোন আমলে দেখা গেছে?  

নাতাশা নারীদের জন্য কাজ করা পিঞ্জরা তোড় সংস্থার কর্মকর্তা। শাসকের বিরোধিতা করবার জন্য তার ওপরেও নেমে আসে সন্ত্রাসবিরোধী আইনটির খাঁড়া। তিন তিনটি এফআইআর দায়ের করে তাকে তিহার জেলে আটকে রাখা হয় দীর্ঘ সাত মাস। নাতাশা তাও জামিন পেয়েছে, ফটোজার্ণালিজমে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পাওয়া মাসরাত জাহারা কাশ্মিরি বলেই আরো বিপদের মধ্যে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ এনে ওই একই আইনে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। 
 
নদীপ কাউরের তো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে জানা গেল তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নদীপের কেসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ কৃষক বিদ্রোহ শুরু হবার পর নতুন করে কৃষক-শ্রমিক ঐক্য যে দানা বাঁধছে তারই দ্যোতক এই ঘটনা। নদীপের অপরাধ তার কারখানার নীচু তলার কর্মীদের সে কৃষক বিদ্রোহের সমর্থনে সংঘবদ্ধ করেছিল। এছাড়া শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যেস ছিল তার। মজদুর অধিকার সংগঠনের পতাকা নিয়ে সে সিঙ্ঘুতে কুন্দলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে বেতন না পাওয়া মজদুরদের নিয়ে আন্দোলন করেছিল। এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। তার জন্য তাকে গ্রেপ্তার হতে হল।
তবে এই ২৩ বছরের নেত্রীর আহবান মিথ্যে হয়নি। ১লা ডিসেম্বর ২০২০-‌তে প্রায় ২০০০ মজুর একদিনের বেতন কাটার ভয়কে জয় করে কিষাণ আন্দোলনের স্বপক্ষে র‌্যালি বার করে।

ভার্জিনিয়া উলফের ভয়ে ভীত কে, এই বহুশ্রুত প্রশ্নকে যদি একটু পালটে জিজ্ঞাসা করা যায়, ভারতে মহিলা আন্দোলনকারীকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় কারা, একমাত্র উত্তর হবে শাসক দল, আবার কারা। অধ্যাপক রামচন্দ্র গুহ এই ভয়ের পেছনের কতগুলো কারণ স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। যদিও সেটা শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়ে সমস্ত প্রতিবাদী তারুণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মূল তফাত এইখানে যে মোদিবিরুদ্ধ নারীশক্তিকে কোনো বয়সের সীমারেখায় বাঁধা যাচ্ছে না। আশি থেকে আঠারো, ক্ল্যাসিকাল নারীবাদী থেকে নারীশ্রমিক, নারীকৃষক, সব বয়সের এবং ধর্মের, সব শ্রেণীর এবং সব প্রেক্ষিত থেকে উঠে আসা নারীরাই এই প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে। 

কেন এরকম হচ্ছে? এনআরসি, সিএএ-র বেলায় মনে হয়েছিল যেহেতু ঘর এবং দেশ হারালে নারীই হবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, তাই হয়ত তার এই রণংদেহি মূর্তি। কিন্তু যেখানে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যের বাজেটে পরিবেশ খাতে নয়াপয়সাও বরাদ্দ হয় না, পরিবেশ যে দেশে নন-ইস্যু, সেখানে একটি একুশ বছরের পরিবেশ-কর্মী তরুণী কোন সাহসে নিজের কেরিয়ার ও নিরাপত্তা বিসর্জন দিয়ে আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠে? কোন সাহসেই বা দিল্লি সীমান্তে মাসের পর মাস ধর্ণায় বসে থাকে বৃদ্ধা থেকে তরুণী কিষান?

মেয়েরা বেশি আবেগী হয়, সেটা তাদেরকে তুচ্ছ করবার জন্য পিতৃতন্ত্রের হাতিয়ারও হয়ে দাঁড়ায় অনেকসময়। আবেগ-প্রাবল্য না থাকলে কী বিদেশে লোভনীয় চাকরি ও বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে সুধা ভরদ্বাজ নিজের মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ দেশে সমাজসেবাকেই আঁকড়ে ধরেন? শেহলা রশিদ রাজনীতিকে বেছে নেন? তাঁরা মেয়ে বলেই সমাজ সংসারের বিরুদ্ধাচারণ করে এইধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক বেশি কঠিন। বিপদের ভয়ও অনেক বেশি। সেইসব বাধা টপকে ভারতীয় মেয়েরা যে এই কঠিন সময়েও কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে থাকছেন না, সেটা খুবই আশার কথা। 

প্রথম কারণটি অবশ্যই বশ্যতার বিরুদ্ধে নারীর জেহাদ ঘোষণা। মেয়েদের হতেই হবে অনুগত, বাধ্য এবং শালীন। পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি, এমনকি রাষ্ট্রের প্রতি। সে জায়গায় এই মেয়েরা সমালোচনামুখর ও আন্দোলনে বিশ্বাসী। মোদি-শাহের সার্বিক আধিপত্যকামী জমানায় এই দুঃসাহস অমার্জনীয়। ফ্যাসিবাদের চিরকালের বৈরী হল স্বাধীন ও মুক্ত চিন্তাধারা। এই কারণেই জেএনইউ এবং যাদবপুর বিজেপির তো বটেই, তৃণমূলেরও চক্ষুশূল। বিজেপির শত্রুতালিকায় এর পর পর জায়গা নেবে ধর্মীয় বহুত্ব, জাত এবং লিঙ্গের সাম্য, স্বচ্ছতা এবং পরিবেশসচেতনতা। অতএব যে মেয়েরা এতোসবে জড়িত তাদের সামনের সারিকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে জেলখানায়। আদর্শবাদী এবং নিঃস্বার্থ মুক্তমনা আধুনিক নারীর জন্য এই ভারতবর্ষে ওই একটি জায়গাই বরাদ্দ আছে।

তা না করে উপায়ই বা কী, অন্য দলের এমএল এ, এমপিদের মতো এদের টাকা ছড়িয়ে কেনা যায় না যে! ফলে কেনাবেচাযোগ্য ঘোড়াগুলির থেকে ধান্দাবাজরা এদের অনেক বেশি ডরায়। সেই ভয়মুক্ত হতেই শাসক উলটো চাল চালে। প্রথম সারিকে ঘানি টানতে দেখলে অন্যান্যরা ভয় পাবে। তাদের অভিভাবকরা রাশ টেনে ধরতে চাইবে। মেয়েদের পক্ষে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। সুরক্ষার দোহাই দিয়েই তাদের ঘরে রাখবার চেষ্টা হবে। ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হবে যোগী আদিত্যনাথকথিত প্রতিবেশ যেখানে মনে করা হয় মেয়েরা স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার যোগ্য কোনদিন ছিল না, ভবিষ্যতেও কোনোদিন তা হবে না।

যো হুজুরের জমানাতে তাহলে মেয়েদের লাঞ্ছনাই চূড়ান্ত সত্যি এবং স্বাভাবিক। সাংবাদিক নিখিল বাগলে ঠিকই বলেছেন যে মনস্তাত্ত্বিক লেভেলে সঙ্ঘ পরিবার এই তরুণ প্রজন্মকে বাঘের মতো ডরায়। রাহুল গান্ধী, মায়াবতী, মমতার মতো বিরোধী নেতাদের থেকে অনেক বেশি। ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থায় বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠিয়েছিল, মোদি অনৈক্য জর্জরিত নখদন্তহীন বিরোধী নেতাদের জেলের বাইরেই রেখেছে। এই রাজত্বে তার শিকার হচ্ছে স্বাধীন ভয়হীন চিন্তকরা, বিশেষ করে নারীরা যারা সাংবিধানিক অধিকারগুলির পূর্ণ প্রতিষ্ঠা চায়। ভয় পাওয়া শাসক এখন ভয় দেখাতে মরিয়া। দুই জরুরি অবস্থার তখন ও এখনের মধ্যে এইটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য। 

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত 

0 Comments

Post Comment