সম্পত্তি আইন সংস্কারের দাবিতে ওঁরা

  • 25 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 655 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
ভারতের মর্জিনা বিবিদের ভিটেছাড়া করার নির্লজ্জ বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বললে রাজ্যের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দল রে রে করে বলে ওঠে, ‘মুসলিমরা নিজের ধর্ম নিজের মতো পালন করবে’। মুসলিম পিতৃতন্ত্র অনধিকার ‘হিত’ করার প্রবণতায় মৃতের পরিবারকে দান করার নিদান দিয়ে ধর্ম পালনের আত্ম অহংকারে তৃপ্ত হয়। ব্যক্তিকে বঞ্চনা, অপমান করে ইসলামকে অক্ষত রাখার ফতোয়াধারী স্বার্থান্বেষী অধার্মিকদের বিরুদ্ধে তাই ওঁরা জোট বেঁধেছেন। (মুসলিম সম্পত্তি আইন পর্ব-৩) 

বাঁকুড়ার মর্জিনা বিবির কোলে তখন দু মাসের বাচ্চা রমজান শেখ। ১৯৮২ সাল। স্বামী মতলেব শেখের মৃত্যু হল। মতলেব শেখের সংসার চলত পৈতৃক জমির ফসলে। নিজেই চাষ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর মর্জিনা বিবি শুনলেন স্বামী চাষ করত সেই জমি, স্বামীর সঙ্গে বাস করা এই ঘর সবই তাঁকে ছাড়তে হবে। ননদ, দেওররা ধর্মের নিদান শুনিয়ে দিলেন। মর্জিনার বৃদ্ধ শ্বশুর মৃত সন্তানের পরিবারকে বাস্তুভিটে, বসতজমি দিতে পারলেন না অন্য ছেলে-মেয়েদের চাপে। উনিশ বছর বয়সের মর্জিনার সামনের দিনগুলো অন্ধকারে ডুবে গেল। স্বামীর ঘরে, শ্বশুরের আশ্রয়ে ছেলেকে মানুষ করার আকুতি ব্যর্থ হল। স্বামী-মৃত্যুর শোক কাটানোর আগেই তিনি ভিটেছাড়া হলেন। তাঁকে আশ্রয় নিতে হল ভাইদের সংসারে। ছেলেকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও সেটা ক্লাস ফোর পর্যন্ত গড়ায়।

চল্লিশ বছর বয়সের রমজান শেখ এখন রাজমিস্ত্রি। অতীতের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়েছেন। যে জমিতে তাঁর আব্বা চাষ করতেন, যে ঘরে তিনি জন্মেছিলেন সেখানকার অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য তাঁর লড়াই। পৈতৃক বাড়িতে গিয়েছিলেন বিচারের আশায়। পঞ্চায়েত থেকে ওয়ারিসান সার্টিফিকেটও বের করেছেন। বৈধব্যের সঙ্গে বঞ্চনা, মায়ের জীবনকে যারা ভেঙেচুরে দিয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে ন্যায় বিচারের দাবি নিয়ে রমজান শেখ এখন পথে। তাঁদের প্রতি গ্রামের বহু মানুষের সমবেদনা রয়েছে কিন্তু সমর্থন তেমন নেই। যুক্তি ধর্মের, যুক্তি শরিয়তের। রমজান শেখ মৃত দাদুর সম্পত্তির অংশ দাবি করে বাড়িতে ঢুকেছিলেন বাস করার ইচ্ছায়। কাকারা মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ রমজান শেখ নাকি ধর্মবিরোধী কাজ করছেন। শরিয়ত আইনকে অবজ্ঞা করে জবরদখল করতে চাইছেন। রমজান শেখ বললেন, ‘ওরা শরিয়তের জোরে আমার ওপর লাঠি ধরেছে আমিও আদালতের কাছে বিচার চাইব ঐ সম্পত্তির শরিক হওয়ার জন্য।’

বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের মাহমুদা বিবি ও মাজেদা বিবিও একই ঘটনা পরম্পরাই আক্রান্ত। ২০০৩ সালে হায়দার আলি মীর মারা গেলে, তিনটি ছেলে একটি মেয়ে নিয়ে বিধবা হলেন মাহমুদা বিবি ও তাঁর সতীন মাজেদা বিবি। মাহমুদা বিবির বড় ছেলে মিলন মীর তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। তিন ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছাড়লেন মাহমুদা বিবি। মামাদের সাহায্যে মিলন মীর ও তাঁর ছোট ভাই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়তে পেরেছেন। মেজ ভাই হাফেজ। মিলন মীর এখন টেলারিং-এর কাজ করেন। মাজেদা বিবি তাঁর মেয়েকে নিয়ে মৃত স্বামীর বাড়ির এককোণে ঠাঁই নিয়েছেন শত অপমান সইয়েও। দিনরাত  বিড়ি বেঁধে চালু রেখেছেন উপার্জন। স্বামীর ভিটেতেই এক চিলতে ঘর বানাবার জন্য ধারদেনা করে স্বামীর ভাইদের কাছ থেকে একটু জায়গাও কিনেছেন। কিন্তু মিলন মীর জানালেন, এই অনাচার আর মেনে নেবেন না। শরিয়তের আশ্রয়ে চাচারা তাঁদের জীবনে যে জুলুম করছেন তার জবাব নাকি নিয়েই ছাড়বেন। মিলন মীর তাঁর আব্বার সঙ্গে চাষ জমিতে মাঝেমধ্যে কাজ করতেন। সেই স্মৃতি তাঁকে এখনও তাড়া করে। বললেন, ‘বুক ফেটে যায় ওই জমি, বাড়ির দিকে তাকালে। চাচাতো ভাইদের বাপ ছিল তাই দাদুর জমির মালিক হল। আমাদের বাপ মারা যাওয়ায় পা রাখার মতো জায়গাও  হকে এলো না। গ্রামের লোকদের বললাম আমাদের জন্যে জমি আদায় করে দিতে। মসজিদ কমিটির সেক্রেটারির কাছেও আবেদন জানিয়েছি। কিন্তু আইনের কাছে সবাইকে হটতে হচ্ছে। মানুষকে ভিখিরি বানানোর এই আইন কীভাবে পাল্টাতে হয় এখন তার খোঁজে আমরা একটা দল তৈরি করেছি। কাগজপত্র যোগাড় করছি কোর্টে যাওয়ার জন্য।’    

মুসলিম সম্পত্তি আইনের এই বঞ্চনার বাস্তবতা নানাভাবে গল্প উপন্যাসেও রূপায়িত হয়েছে। মর্জিনা, মাহমুদা, মাজেদা বিবিদের জীবনে ঘটে যাওয়া নির্যাতনগুলো প্রতিফলিত হয়েছে শওকত ওসমানের জননী উপন্যাসে (প্রথম প্রকাশকাল ১৯৫৮, ঢাকা)। উপন্যাসের  দরিয়া বিবির স্বামী মারা যায় শ্বশুর বেঁচে থাকাকালীন। সন্তান  মোনাদিরকে নিয়ে দরিয়াবিবির জীবন। দরিয়াবিবি দেখল, ‘যৌথ সম্পত্তি বণ্টন হইতেছে ভাইয়ে ভাইয়ে। কিন্তু এক কানাকড়িরও অধিকার নাই তার। স্বামী পিতার কোলে ইন্তেকাল করিয়াছেন। শরিয়ৎ মতে শ্বশুরের সম্পত্তির উপর তার বা মোনাদিরের কোন অধিকার নাই।’ দরিয়াবিবি দেওরদের সঙ্গে লড়াই করে হেরে যায়। কারণ ‘কোরান-কেতাবে যা হুকুম আছে’ সেই মতোই তার দেওররা কাজ করেছে। তাদের পথে নামিয়ে দেওয়ার মধ্যে দেওররা কোন অন্যায় খুঁজে পায়নি। কিন্তু মানুষকে হাদিস কালাম শুনিয়ে পথের ভিখিরি করার বিরুদ্ধে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানে আইন তৈরি হয়েছে। যে আইন এখন বাংলাদেশেও প্রচলিত। ওদেশের দরিয়াবিবিদের এখন শরিয়তের যুক্তিতে অধিকার হরণ করা যায় না। শরিয়ত আইন সংস্কার করে  মৃত সন্তানের পরিবারকে সম্পত্তির পূর্ণ হক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতের মর্জিনা বিবিদের ঘটে এখনও হাদিস, কালামের ধর্ম ঢেলে ভিটেছাড়া করার নির্লজ্জ বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বললে রাজ্যের ক্ষমতাবান রাজনৈতিক দল মৌলবাদকে তোয়াজ করার  জন্য রে রে করে বলে ওঠে, ‘মুসলিমরা নিজের ধর্ম নিজের মতো পালন করবে’। মুসলিম পিতৃতন্ত্র অনধিকার ‘হিত’ করার প্রবণতায় মৃতের পরিবারকে দান করার নিদান দিয়ে ধর্ম পালনের আত্ম অহংকারে তৃপ্ত হয়। দান যে অপমান সেই বোধ যাদের নেই তারাই দান দেওয়ার ও নেওয়ার পরামর্শ দেয়। আইনকে সংস্কার করে সম্মানের সঙ্গে হকের দাবিদার হওয়ার কথা উত্থাপন করা তাঁদের কাছে ইসলামের অবমাননা। ঘটে ধর্ম ঢেলে পেটের ভাত মারা, ব্যক্তিকে বঞ্চনা, অপমান করে ইসলামকে অক্ষত রাখার ফতোয়াধারী স্বার্থান্বেষী অধার্মিকদের বিরুদ্ধে তাই জোট বেঁধেছেন রমজান শেখ, মিলন মীররা।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত    

0 Comments

Post Comment