- 25 November, 2024
- 0 Comment(s)
- 109 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
বৈশাখী
ছিপছিপে চেহারার বছর বাইশের মুখচোরা বৈশাখী ইতিহাসে অনার্স নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। মাঝে মাঝে একটা সবজি ভর্তি সাইকেল ভ্যান থেকে তাকে নামতে দেখি। কোনো কোনো দিন দেখি, কলেজ ছুটির আগে ভ্যানের মালিক খালি ভ্যান নিয়ে কলেজের গেটে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বছর চল্লিশের যুবকটির পরনে রঙ জ্বলা শার্ট-প্যান্ট। মাথায় টুপি। পরে জেনেছিলাম, মাথার টাক ঢাকতে সে সব সময় টুপি পরে থাকে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার দাদা?”
“না! হাজব্যান্ড।” লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল বৈশাখী।
“আমার কথায় কিছু মনে করলে না তো?”।
“না, ওর সাথে আমার বয়সের তফাত একটু বেশি বলে অনেকেই এই ভুল করে”।
“সবজির ব্যবসা? ”
“হ্যাঁ! চাষীদের কাছ থেকে আনে। একেবারে টাটকা। একদিন আপনাকে খাওয়াব। এই সময়টায় ও এই পাড়ায় ঘোরে। আসার সময় আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায়। আবার ফেরার সময় নিয়ে যায়। বারণ করলেও শোনেনা জানেন?”
স্বামীর কথায় লজ্জার সাথে বৈশাখীর চোখ মুখ আলো হয়ে উঠল। বিয়ে করিনি। দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবুও বৈশাখীর আলো জ্বলে ওঠা মুখখানা দেখে মনে হল, ওর দাম্পত্য জীবনটি মধুর।
একদিন বৈশাখী তার স্বামী বিশ্বনাথের সাথে আমার আলাপ করিয়ে দিল। এই পাড়াতে থাকি জানতে পেরে সে বলল, আমার বাড়িতে টাটকা সবজি পৌঁছে দেবে। আমি এখন যেখানে থাকি সেখান থেকে বাজার বেশ খানিকটা দূরে। রবিবার ছুটির দিনে হাজার কাজের মধ্যে বাজার করতে হয়। সপ্তাহের শেষে সেগুলো ফুরিয়ে যায়, নয়তো খাওয়ার যোগ্য থাকে না। তাছাড়া বাজার করতে অনভিজ্ঞ বুঝে নিয়ে সবজি ওলারা আমাকে ঠকায়। দাম বেশি নেয়, পচা সবজি গছিয়ে দেয়।
বিশ্বনাথ আমার প্রয়োজন মত টাটকা সবজি দিয়ে যায়। সেই সাথে মাছ ও দুধের দায়িত্বটাও আগ বাড়িয়ে নিয়েছে। মাছটা ওর চেনা একজনের কাছ থেকে আনে। দুধ ওর নিজের গোরুর। আমি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। একটা আস্ত রবিবার এখন আমার হাতে থাকছে। সবজি দিতে এসে এটা সেটা গল্প করে। বৈশাখীর কথা উঠলে সে থামতে ভুলে যায়। বলতে গেলে বিশ্বনাথের সুত্র ধরেই বৈশাখীর সাথে আমার একটা অন্য রকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে।
পর পর বেশ কদিন বিশ্বনাথের পাত্তা নেই। এদিকে আমার ফ্রিজ খালি। বিশ্বনাথের সাথে পরিচয় হবার পর বাজার যাওয়া ভুলে গেছি। বাজার যাওয়ার কথা ভাবলে মাথা ধরে যাচ্ছে। কোনো রকমে আলু সেদ্ধ দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। বৈশাখীকে যে জিজ্ঞেস করব, সেও কলেজ আসা বন্ধ করেছে।
জয়িতার কাছে সবার খবর থাকে। জিজ্ঞেস করতে সে বলল, বিশ্বনাথের বড় রকমের এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একটা ট্রাক বিশ্বনাথের সবিজ ভ্যানের পিছনে ধাক্কা দেয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে। জয়িতারা হাসপাতালে গিয়ে তাকে দেখে এসেছে। একটা পায়ে ও কোমরে চোট পেয়েছে। তবে আঘাত তেমন মারাত্মক নয়। শুনে মনটা খুব খারাপ হল।
এক বিকেলে জয়িতারা দল বেঁধে কোথাও যাচ্ছে দেখে শুধোলাম, "কোথায় চললে? আমি তো তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম। বৈশাখীর খবর কি?”
“বৈশাখীর সাথে দেখা করতেই তো যাচ্ছি। আপনি যাবেন?”
“গেলে হয়, হাতে তেমন কোনো কাজ নেই”। বৈশাখীর সাথে দেখা করে বিশ্বনাথের খবর নেওয়ার কথাটা বার বার মনে হচ্ছিল। কিন্তু যেতে সংকোচ হচ্ছিল। সেটা ওদের কাছে আর প্রকাশ করলাম না।
মেন রোড ছাড়িয়ে বেশ কয়েকটা গলি পার হয়ে যেখানে এসে পৌঁছালাম সে জায়গাটা বস্তি না হলেও বস্তির থেকে বেশি কিছু নয়। দুটি ঘর নিয়ে বৈশাখীদের ছোটো একতলা বাড়ি। তার গায়ে টিনের শেড দেওয়া একটা চালা ঘর। সেখানে একটা দুগ্ধবতী গাই শুয়ে জাবর কাটছে। বুঝলাম এরই দুধ আমি খাই।
বৈশাখী কিছুক্ষণ আগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। আমাদের দেখে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। আমাকে এভাবে আশা করেনি। একটু যেন অপ্রস্তুত। কোথায় বসতে বলবে বুঝতে না পেরে দু হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা ঝাড়তে লাগল।
“ব্যস্ত হয়ো না। বিশ্বনাথের এত বড় বিপদটা গেল। ঈশ্বরের কৃপায় রক্ষা পেয়েছে”। আমি তার পাশে বসতে বসতে বললাম।
অন্যরা যে যেখানে পারে বসে পড়েছে।
“বিশ্বনাথ এখন কেমন আছে? ডাক্তার কী বলছে? কবে ছাড়বে?” বৈশাখীকে মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বললাম।
“সামনের সপ্তাহে ছেড়ে দেবে বলেছে”।
“যাক। বিশ্বনাথ বাড়ি ফিরলে একদিন এসে ওর সাথে দেখা করে যাব। এই সময় তোমার নিজের কেউ একজন তোমার কাছে থাকলে ভালো হয়। তুমি একা কদিক সামলাবে?”
“দাদা রোজ আসে। রাতে এখানে থাকে”।
“খুব ভাল। আর মা?"
মায়ের কথায় বৈশাখীর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভাষাহীন চোখে সে যেন বহু দূরে কিছু দেখছে। আমরা সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করছি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। নিশ্চয় মা নেই। একে বেচারি স্বামীকে নিয়ে চিন্তায় আছে, তার উপর মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলাম।
“এই বৈশাখী কী হল?” জয়িতা অনড় হয়ে বসে থাকা বৈশাখীকে নড়িয়ে দিতে তার চমক ভাঙ্গল। কাঁচু মাচু মুখ করে বলল, “ কিছু নয়। কদিন থেকে মাকে খুব মনে পড়ছে ! ওকে কথা দিয়েছি মাকে মনে করব না। তবু পারি না!”।
সেদিন বাড়ি ফিরতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। বৈশাখী তার জীবনের কিছু কথা আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছিল।
“জানেন দিদি! জ্ঞান হবার পর থেকে যাকে ‘মা’ ডেকেছি, সে আমার গর্ভধারিনী মা ছিল না। আমার নিজের মাসি। আমাদের দুই ভাইবোনকে রেখে মা মারা গেলে বাবা মাসিকে বিয়ে করে। তখন আমার বয়স দশমাস, দাদার তিন। সেই থেকে আমরা মাসিকেই মা বলে জানি। আর মাসিও আমাদেরকে সন্তান স্নেহে বড় করেছে। আমাদের জন্য সে নিজের কোনো সন্তান নেয়নি।
অভাবের সংসার। বাবা পরের জমিতে জনমজুর খাটে। সেই সামান্য টাকায় মা টিপে টিপে সংসার চালায়। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস! মাঠে কাজ করার সময় বাজ পড়ে বাবা মারা গেল। সংসার বাঁচাতে মা মাঠে চাষীদের কাছ থেকে সবজি কিনে হাটে বিক্রি করতে শুরু করল। রোজগার যা হয় তাতে তিনটে পেট চলে যায়। কিন্তু শুধু পেট তো নয়? আমাদের পড়াশোনা আছে। মা অবশ্য সাহস দেয়। বলে, “ভাবিস না। আমি ঠিক চালিয়ে নোবো”। দাদা তখন ক্লাস এইট। সে পড়া ছেড়ে একটা দোকানে কর্মচারীর কাজ নিল। মায়ের বারণ শুনল না।
সংসারে এখন অভাব থাকলেও তেমন দুঃসহ নয়। মায়ের কাজ না করলেও চলে। কিন্তু মা বলল, “এখন থেকে তোর ঘাড়ে বসে খাব? যতদিন পারি করি। তা ছাড়া মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে?” মা সবজির ব্যবসা ছাড়ল না। আমি পড়াশোনায় বেশ ভাল ছিলাম। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কলেজে ভর্তি হলাম। কিন্তু মা চায় না আমি আর পড়ি। আমার বিয়ে নিয়ে তার ঘুম নাই।
সবজি বিক্রি করতে গিয়ে মায়ের সাথে বহুজনের আলাপ। এদের মধ্যে একজন তাকে ‘মা’ বলে ডাকে। মাঝে মাঝে মা তার কথা বলে। দাদা বলে, তোমার সেই ছেলেকে একদিন বাড়িতে ডাকলেই তো পার? আমরাও একটু দেখতাম”। মা এড়িয়ে যায় ।
কিছুদিন পাতানো ছেলেটিকে দেখতে না পেয়ে বাড়ি বয়ে তার খবর আনতে গিয়ে মা জানতে পারল সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার বৌ মারা গেছে। পাঁচ দিন বেঁচে থেকে সন্তানটিও মারা গেছে। স্বাভাবিক কারনে সে খুব ভেঙ্গে পড়েছে।
বাড়ি এসে মা বায়না করল, সেই ছেলের কাছে ক’টা দিন থাকবে। দাদার বারণ না শুনে মা পুঁটুলি গুছিয়ে চলে গেল। আমাকে বলল, “সাবধানে থাকবি। ক’টা দিন পরেই ফিরে আসব”।
এরপর থেকে মাঝে মাঝেই মা সেই ছেলের বাড়ি যেতে লাগল। দাদা এতে বেশ বিরক্ত। আমিও। কিন্তু মা আমাদের কোনো কথাই কানে তোলে না। মায়ের সেই ছেলে নাকি অন্ন- জল ত্যাগ দিয়ে বসে আছে। বৌ-মেয়ের শোকে পাগল হতে বাকি। তাকে দেখার কেউ নেই।
একদিন মা সেই ছেলের বাড়ি যাচ্ছি বলে বেরিয়ে তিনদিন পরে ফিরে এল। তবে একা নয়, দাদার থেকে বয়সে অনেকটা বড় একজনকে সঙ্গে নিয়ে। হাবে ভাবে বোঝা গেল, এই মায়ের পাতানো ছেলে। আমি ,দাদা দুজনেই ভাবলাম মাকে বোকা পেয়ে এই চালাক লোকটা তার ঘাড়ে ভর করেছে। সহজে নামবে বলে মনে হয়না। দাদা কোনো দিন মায়ের মুখের ওপর কথা বলে না। আজও বলল না। তবে মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। আমি তাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকি। কিন্তুমায়ের পোষ্য পুত্রটির কোনো বিকার নেই। সে দিব্যি আছে। মায়ের সাথে সবজি নিয়ে বাজারে যাচ্ছে। ফেরার সময় গুচ্ছের কেনা কাটা করে আনছে। যেন এটা তার নিজের বাড়ি।
সে এখন মাকে রাঁধতে না দিয়ে নিজেই রান্না করে। “সরপুঁটির ঝালটা কেমন হয়েছে দ্যাখ তো?” দাদার পাতের পাশে বাটিটা নামিয়ে দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দাদা সরপুঁটি খেতে ভালবাসে তার জানা হয়ে গেছে। মায়ের জন্য যত্ন করে টকডাল রান্না করে। আমি পায়েস খেতে ভালবাসি । মাঝে বানিয়ে বলে, “খা বোনটি ! রাগ পুষে রাখতে নেই!”
ধীরে ধীরে একটা সময় তার উপর থেকে আমাদের বিরক্তি, রাগ চলে গেল। নিজগুনে আমাদের মন জয় করে, সে আমাদের সংসারের একজন হয়ে উঠল। নীলেশ থেকে “নীলদা”। যাকে দেখলে দাদা মুখ ঘুরিয়ে চলে যেত, সেই দাদাই এখন নীলদাকে না শুধিয়ে কোনো কাজ করে না। সবার থেকে খুশি হল মা।
সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ মায়ের মনে আমার বিয়ের চিন্তা ঢুকল। আমার বিয়ে দেবার জন্য সে দাদাকে খোঁচাতে লাগল। ছেলেও নাকি তার দেখা হয়ে গেছে । এখন দাদার মত পেলেই হয়।
বিয়ের কথা শুনে আমি বেঁকে বসলাম। আমি পড়তে চাই। দাদাও তাই চায়। কিন্তু মায়ের এক কথা এমন পাত্র নাকি আর পাওয়া যাবে না। শেষ মেশ দাদা মায়ের কথা মেনে নিয়ে বলল, "চল তাহলে একবার দেখেই আসি ছেলেটিকে”
“কোত্থাও যেতে হবেনা। পাত্র সামনেই আছে”।
“সামনে? পাড়ার কেউ? কার কথা বলছ?”
“কেন নীলুকে তোদের পছন্দ নয়?”
“নীলদা?” দাদা আকাশ থেকে পড়ল।
“কী বলছ মা? আমি ওকে বোনের মত দেখি। ও আমার হাঁটুর বয়সী”। নীলদাও মায়ের কথা শুনে আঁতকে উঠল।
“রাখ তো? অমন আকছার হয়”।
“তোমার এই কথা আমি রাখতে পারবনা মা। আমাকে ক্ষমা করো”। নীলদা সেখান থেকে চলে গেল।
“নীলদা ঠিক বলছে। বুনি পড়ছে পড়ুক। বিয়ের কথা পরে ভাবা যাবে”।
“কিন্তু নীলুর মত পাত্র কোথায় পাবি? তাছাড়া নীলুকেও তো সংসারী করতে হবে। সারা জীবন ওকি একা থাকবে? আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি”।
“নীলদা তো রাজি নেই? আর বুনিও রাজি হবে বলে মনে হয় না”।
“নীলু মুখে যাই বলুক, আমার কথা ফেলতে পারবে না । বুনিকে তুই একটু বোঝাস”।
আমি শুনে কাঁদলাম, আমি বিয়ে করতে চাইনা। তার থেকেও বড় কথা যাকে দাদা বলে ভাবতে শুরু করেছি তাকে বিয়ে করা যায় নাকি!
“আরে বাবা, ওর সাথে তোর কোনো রক্তের সম্পর্ক তো নেই? ভাই ভোঁটাও দিসনি? বয়সটাই যা একটু বেশি, নাহলে ওর মত ছেলে লাখে একটা মেলে”। মায়ের সাথে সাথে দাদাও আমাকে বোঝাতে লাগল। কিছুদিন ধরে সে নীলদাকে দেখছে। সেও এখন মায়ের সাথে একমত।
শেষে উপায়ান্তর না দেখে একদিন নীলদাকেই ধ’রে বসলাম, “নীলদা আমকে বাঁচাও। আমি এ বিয়ে করতে পারবনা”।
“আমিও তো চাইনা। মা যে এমনটা ভেবেছে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। দেখছি কী করা যায়। তুই ভাবিস না”।
পরদিন নীলদাকে আমাদের বাড়িতে দেখা গেল না। মাকে মনমরা দেখে দাদা বলল, “আমি জানতাম এটাই হবে। ওকে অমন জোরাজুরি না করলেই পারতে?”
আমার সাথে নীলদার কি কথা হয়েছে কেউ জানল না। পরে জেনেছিলাম, মা নীলদার বাড়ি গিয়ে তাকে বুঝিয়ে ছিল কিন্তু সে অনড়। মায়ের কথা সে রাখতে পারবে না। তবে আমার কথা সে মায়ের কাছে প্রকাশ করেনি।
মা একটু বিমর্ষ থাকে তবে বিয়ের কথা তোলে না। আমিও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। নীলদাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাই।
একদিন যথারীতি মাকে সবজি গোছগাছ করতে দেখে আমি বললাম, “তোমার শরীরটা ভাল নেই বলছিলে, তাহলে আজ না গেলেই পারতে?”
“না গেলে মাল খারাপ হয়ে যাবে। তাছাড়া আড়তে কালকের জন্য সবজির অর্ডার দেওয়া আছে। কথার খেলাপ করলে পরে তারা মাল দিতে গড়িমসি করবে”।
“তাহলে বরং আজ আমি যাই তুমি বাড়িতে থাক। আমি তোমার সাথে আগেও অনেকবার সবজি নিয়ে হাটে গেছি? আমি পারব”।
“তখন ছোট ছিলি। এখন বড় হয়েছিস। কে কখন কী বলে বসবে? সবাই তো সমান নয়? চিন্তা করিস না। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব”।
মাকে একা যেতে দিলাম না। মায়ের সাথে সবজি নিয়ে হাটে গেলাম। ফেরার সময় আমরা বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একটা ট্রাক হুড়মুড়িয়ে একেবারে আমাদের গায়ের উপর এসে পড়ল। আমরা সরে দাঁড়াবার অবসরটুকু পেলাম না । ওর মধ্যেই মা আমাকে সজোরে একটা ধাক্কা দিল। আমি রাস্তা থেকে হাত তিনেক দূরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ট্রাকটা আমার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল।
কয়েকজন এসে আমাকে টেনে তুলল। সবাই এত চেঁচামেচি করছে কেন? আশে পাশে কত লোক ওদের মধ্যে আমার মাকে দেখছি না। আমি ধাতস্ত হয়ে তাকিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার প্রাণ কন্ঠায় এসে লাগল! একটা মানুষের ধড় আর মাথা আলাদা হয়ে গেছে। থৈ থৈ রক্তের মাঝে সে দুটো তখনো নড়া চড়া করছে। কিন্তু রক্তমাখা মুখটা অত চেনা লাগছে কেন? আর ওই চোখ দুটো! তারপর কি হয়েছে আমি কিছুই জানিনা। আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন আমি হাসপাতালের বেডে, নীলেশদা আর দাদা আমার মাথার কাছে বসে আছে, তাদের মুখে জানতে পারলাম, মায়ের মৃত্যুর তিনদিন পেরিয়ে গেছে।
এরপরেও আমাকে অনেকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। বাড়িতে কিছুক্ষণ একা থাকলেই মায়ের সেই দু টুকরো রক্তমাখা শরীর, বিশেষ করে রক্তের মাঝে ভেসে থাকা দুটি চোখ, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি জ্ঞান হারাই। দাদা আমাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজের ব্যবসা বন্ধ হবার জোগাড়। দাদা এখন নিজে একটা ছোট- খাট ব্যবসা করে।
দাদা, নীলদাকে আমাদের সাথে থাকতে বললে, সে এবার রাজি হলনা। বলল,”তখন মা ছিল, এখন আমি এখানে থাকলে পাড়ায় বুনির নামে বদনাম রটতে পারে।”
নীলদা আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসে। কিছুক্ষণ থেকে চলে যায়। দাদা যখন থাকে সেই সময়টাতেই আসে। নীলদা এলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করি। চলে গেলেই ভীষণ অসহায় লাগে। আমার কিছু ভাল লাগে না। মনে হয় আমার ভাল-মন্দ নীলদার মত করে কেউ যেন বোঝে না। আমার নিজের দাদাও না। নীলদার প্রতি আমার এই মনোভাব আমার নিজের কাছেই অদ্ভূত মনে হয়। নীলদা হয়তো এটাকে অসুখের লক্ষণ ভাবে।
“আচ্ছা নীলদা! তুমি বিয়ে করে বৌ নিয়ে যদি এখানে থাক? তখন তো কেউ কিছু বলতে পারবে না।” আমার কথা শুনে নীলদা ম্লান হেসে বলল, “একবার বিয়ে করে তাকে রাখতে পারিনি। এখন আর সে সাধ নেই। এবার তোর বিয়ে দেব”।
আমার বিয়ে? কার সাথে?
“কেন ছেলের অভাব আছে?”
মনে মনে ভাবলাম। ঠিক এই কথাটা দাদা একবার মাকে বলেছিল, শুনে মা বলেছিল, "তা হয়তো নেই তবে, নীলুর মত ছেলের অভাব আছে”।
আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু হল। আমার মানসিক রোগের ব্যাপারটা তাদের জানানো হল না। আমাকে দেখে তাদের পছন্দ হল। বিয়ে প্রায় স্থির। নীলদাও দাদার সাথে আমার বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত।
বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসছে আমি ততই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। একটা চিন্তা আমাকে সর্বক্ষণ তাড়া করছে। বিয়ের পর আমার যদি আবার সে রকম কিছু হয় তখন কে আমাকে সামলাবে? আমি কি পারব? আর পাঁচটা মেয়ের মত স্বামীর ঘর করতে? রাতে ঘুমুতে পারছিনা। মাকে খুব মনে পড়ছে। মা থাকলে তাকে সবটা খুলে বলতে পারতাম। মায়ের জিনিসপত্রগুলো নাড়া চাড়া করলে কষ্ট বাড়ে। তবুও মাঝে সেগুলো নাড়া চাড়া করি। না করে থাকতে পারিনা। মা পান খেত। মায়ের পানের বাটা এখন আমার কাছে। একদিন সেটা খুলে দেখতে গিয়ে দেখি, দুটো শুকনো পান। চুনের জায়গায় চুন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কিছু জোয়ান। কুচোনো সুপুরি। একটা খাপে কিছুটা গুঁড়ো তুঁত। মা তুঁত দিয়ে পান খেত। আমি অনেক সময় দোকান থেকে কিনে দিয়েছি। মৈরি খাবার লোভে পানের বাটায় হাত দিলে মা সাবধান করে দিত, “তুঁত যেন ভুলেও মুখে দিসনা।”
“কেন?”
“তুঁত যে বিষ? তাও জানিস না?”
“তাহলে তুমি খাও যে?”
“আমি খুব অল্প খাই। তাও পানের রস গিলি না ফেলে দিই। বেশি খেলে মানুষ বাঁচে না”।
আমি আগু-পিছু না ভেবে সবটুকু তুঁত মুখে ঢেলে জল দিয়ে গিলে ফেললাম। মনের ভার সহ্য করতে পারছি না। এর থেকে মুক্তি পেতে গেলে এ ছাড়া আর উপায় কি? হঠাৎ করে আমার মনে হল, আমি মরে গেলে আমার দাদাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে না তো? নীলেশদা সেও কি ছাড়া পাবে এর দায় থেকে? একটা কাগজ নিয়ে যা মনে এল লিখে দিলাম। ততক্ষণে অসহ্য পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। দাদা বাড়িতেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। মরতে মরতে ফিরে এলাম।
আমি সেই চিরকুটে লিখে ছিলাম, "আমি নীলদাকে ছাড়া বাঁচতে পারবনা। তাই এ ছাড়া আমার আর রাস্তা নেই”।
নীলেশের বাড়িতে তার বৌ হয়ে এলাম। নীলেশ সবজির ব্যবসা করে। আমি সারা দিন কীভাবে কাটাব? দাদা একটা গোরু কিনে দিয়ে গেল বলল, এটাকে সেবা যত্ন কর, সময় কেটে যাবে।
আমি পড়াশোনা করতে চেয়ে পাইনি। নীলেশ জানত। সে আমাকে কলেজে ভর্তি করে দিল। এখানে এসে ধীরে ধীরে ট্রমা থেকে বের হতে পেরেছি। আগে অল্প সময়ও একা থাকতে পারতাম না। এখন তেমন অসুবিধে হয়না। তবে নীলেশ আমাকে একা থাকতে দেয়না। সব সময় আগলে রাখে।
নীলেশ না থাকলে আমি এতদিনে পাগলা গারদে থাকতাম। বৈশাখী চুপ করে গেল।
“বুনি”। বৈশাখীর দাদার গলা শোনা গেল।
আমরা সবাই এবার উঠে পড়লাম ।
( ক্রমশ )
লেখক : কথাসাহিত্যিক
ছবি : সৌজন্য ইন্টারনেট
0 Comments
Post Comment