- 18 April, 2024
- 0 Comment(s)
- 970 view(s)
- লিখেছেন : নির্বাণ নন্দী
নারী এবং নারীদের কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সে বিষয়ে লেখার কতটা অধিকারী আমি তা অবশ্যই বিতর্কযোগ্য। আমার লেখা পড়ে কেউ বলতেই পারেন যে নারীদের প্রকৃত সমস্যা আমি বুঝতে পারিনি বা উপস্থাপন করতে পারিনি এবং এই অনুযোগ যদি সম্পূর্ণত সত্য নাও হয়, তাহলেও তা সারবত্তাহীন নয়। একজন পুরুষ হিসাবে আমার পক্ষে নারীদের সমস্যাগুলি পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আমি একজন ‘Outsider’; অপর। অবশ্য আমি অপরায়ণের পক্ষপাতী নই এবং ‘Essentialism’-এরও পক্ষপাতী নই। তবুও একটা ব্যাপার স্বীকার করতেই হবে যে, সমাজে নারীদের এমন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় যার সম্মুখীন পুরুষদের, অন্তত একটা বড়ো অংশের পুরুষদের, কোনো দিনই হতে হয় না। এরকমটাই আমাদের সমাজের সমীকরণ। সমাজের এই কাঠামো বিষয়ে এবং এর খুঁত বিষয়ে বহু যুগ ধরেই অনেকে প্রতিবাদ করে চলেছেন। সেই প্রতিবাদ এবং প্রতিবাদের অনুপ্রেরক দর্শনচিন্তার কিছুটা আমি পড়েছি, বুঝেছি; কিছুটা বুঝিনি; কিছুটা জানি না। তবু এঁদের নামোচ্চারণের স্পৃহা প্রবল হয়ে উঠছে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে সমাজের গঠনগত খুঁত কিন্তু পুরুষকেও নিগড়ে বেঁধে রেখেছে। এই প্রতিবাদীরা শুধু নারীমুক্তির পথিকৃৎ নন, এঁদের দ্বারা অর্জিত অধিকার পুরুষকেও শৃঙ্খলমুক্ত হতে সাহায্য করেছে, ব্যক্তিক ও সামূহিক উভয় প্রকার শৃঙ্খল। আমরা এই প্রসঙ্গে প্রাচী ও প্রতীচীর বহু নারীর কথাই স্মরণ করতে পারি। যেমন মনে পড়ছে মধ্যযুগীয় ফরাসি ভাবুক ক্রিস্তিন দো পিজঁ-র কথা কিংবা এলিজাবেথীয় ইংল্যান্ডের লেডি অ্যান ক্লিফোর্ডের কথা। আরও পরবর্তী সময়ে এসেছেন মেরি ওলস্টোনক্রাফট কিংবা মাদাম দো লাফায়েতের মতোন মানুষেরা। ধীরে ধীরে এসেছেন সাফ্রাজেট আন্দোলনকারীরা এবং ভার্জিনিয়া উলফ, সিমোন দো বোভোয়ার প্রমুখ অনেক ভাবুক। এঁদের পর এসেছেন এবং আসছেন আরও অনেকেই। হয়তো নাম করা যেতেই পারে জুডিথ বাটলার কিংবা এলেন সিকজুর। এঁদের সকলের মতামত এক নয়। তাঁদের মতামতের ভিন্নতা আছে। তাঁরাও একে অন্যের মতের আলোচনা-সমালোচনা করেছেন; করেছেন একে অন্যকে গ্রহণ বা বর্জন। কিন্তু এই জটিল দার্শনিক খেলার ভিতরেও রয়ে গিয়েছে আন্দোলনের মূল সুরের একটি রেশ; ক্রমমুক্তির একটা স্বপ্ন। ভারতের ক্ষেত্রেও এরকম ভাবুকেরা ছিলেন, আছেন। বৈদিক-ঔপনিষদিক যুগে গার্গী, মৈত্রেয়ী ছিলেন। গার্গীর প্রশ্নে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য অবধি জর্জরিত হয়ে উঠেছিলেন। সেই ‘স্বর্ণযুগ’ কিছুটা তথ্য এবং কিছুটা কাহিনির সমন্বয়ে আবছা। কিন্তু নিকট ইতিহাসের যুগে যেসব নারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তাঁদের নাম এই সুযোগে স্মরণ করে নিই – সাবিত্রীবাঈ ফুলে, আনন্দীবাঈ জোশী, পণ্ডিতা রমাবাঈ, কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কৈলাসবাসিনী দেবী, রোকেয়া প্রমুখ। তুলনামূলক হাল আমলের মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখের নাম নাহয় আর নাই বা করলাম।
নামের একটি তালিকা প্রস্তুত করা এখানে আমার লক্ষ্য নয়। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধটি একটি অনুধ্যান। এই অনুধ্যানে দার্শনিক পাণ্ডিত্যের বিশেষ কোনো প্রকাশ ঘটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি না তত পণ্ডিত, না তত সময় আমার হাতে রয়েছে। অথচ সমাজ এবং সমাজে নারীদের অবস্থান বা তাদের সমস্যা এরকম একটি স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখার গুরু দায়ভার আমার কাঁধে। তাই পাণ্ডিত্য প্রদর্শন অপেক্ষা স্বীয় হৃদয়বৃত্তিজাত ভাবনা নিবেদন করাই শ্রেয়। আবার প্রাথমিক প্রতর্কে ফিরে যাই। একজন পুরুষ হয়ে আমার পক্ষে কি সত্যিই এই বিষয়ে লেখা সম্ভব? হয়তো না, আবার হয়তো-বা হ্যাঁ। এই প্রসঙ্গে জৈবিক লিঙ্গপরিচয় (Sex), সামাজিক লিঙ্গপরিচয় (Gender) এবং আমার নিজের কথা কিছুটা বলব। বাংলা ভাষায় ‘জেন্ডার’ নেই, অন্তত অন্যান্য বহুতর ভাষা আপেক্ষা বাংলা অনেক বেশি জেন্ডার-নিরপেক্ষ। ইংরেজি ভাষাও মোটামুটি জেন্ডার-নিরপেক্ষ ভাষা। কিন্তু পৃথিবীর বহু ভাষাতেই জেন্ডারের ধারণা খুব প্রবল এবং সেই ধারণা মূলত অস্পষ্ট। ফরাসি, রুশ, জার্মান, চেক প্রভৃতি সব ভাষাতেই জৈবিক লিঙ্গপরিচয়ের বাইরেও জেন্ডার বর্তমান। অবশ্য ভাষাগত জেন্ডার-নিরপেক্ষতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালি সমাজ বা ইংরেজ সমাজও কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সামাজিক লিঙ্গপরিচয়ের বাইরে বেরতে পারেনি। আমাদের সমাজেও পুরুষ এবং নারী উভয়কেই কিছু জেন্ডারের নিগড়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আমি নিজের জীবনে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি কারণ আমার ব্যক্তিগত জীবনের সমস্ত আচরণ সবসময় তথাকথিত পুরুষোচিত হয়নি। সেই কারণে হয়তো নারীদের বা বলা ভালো অবদমিত সত্তার সঙ্গে কিছুটা সংযোগ আমার রয়েছে।
সভ্যতা কী করে পুরুষের অধিকারে গেল আমার জানা নেই। তবে গিয়েছে এবং পুরুষতন্ত্র হয়ে উঠেছে তার রক্ষক। পুরুষতন্ত্র নারীকে গৃহাভ্যন্তরে বন্দি করেছে। সেই অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসতেই লেগে গিয়েছে অনেক সময়। এখনও কি সবাই বেরতে পেরেছেন? না, উত্তর খুব স্পষ্ট। প্রশ্ন জাগে মনে যদি উলটো হত? যদি সভ্যতা হত মাতৃতান্ত্রিক? তাহলে কি পুরুষ নিপীড়িত হত? বলা সম্ভব নয়, কারণ তেমন কখনও হয়নি। এই মুহূর্তে আমার মতে নারীদের সবচেয়ে বড়ো সমস্যা অন্তত আমাদের দেশে হল--নারী এখনও অবরোধবাসিনী। নারীশিক্ষা এবং নারীর অগ্রগতি আমাদের দেশে হয়নি তা নয়, কিন্তু নারীর প্রতি অবজ্ঞা এখনও পূর্ণমাত্রায় বলবতী। গৃহ থেকে কর্মক্ষেত্র সর্বত্র। প্রসঙ্গক্রমে হয়তো কবিতা সিংহকে স্মরণ করা যেতেই পারে –
“কিছু কি আলাদা রাখো?
শমীবৃক্ষে রমণী হে একা?
সত্যকার এলোকেশ সত্যকার রমণী-নয়ন
সত্যকার স্তন?
খুলে রাখো নিজস্ব-ত্রিকোণ।” (-- ‘পৃথিবী দেখে না’)
আমি সমস্যার সমাধান দেব না। কারণ এই সমস্যার কোনো সমাধান হয় কি না সে বিষয়ে আমি অনিশ্চিত। কিন্তু আমাদের লড়াই চলবে একটি নিরপেক্ষ সমাজের দিকে। ততদিন অনুধ্যান চলুক।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ২ সেপ্টেম্বর ২০২০
ছবি : প্রতীকী
লেখক : শিক্ষক, এলজিবিটি+কর্মী
0 Comments
Post Comment