- 12 March, 2023
- 0 Comment(s)
- 2042 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
লীলাবতীর কথা খেয়াল আছে আমাদের? নেই তো?--কারণ, খনা নামেই তিনি ছিলেন সর্বাধিক পরিচিত। কেন তাঁর মৃত্যু হয়েছিল জানা আছে? আসলে খনা ছিলেন (একটি কিংবদন্তি অনুসারে) সম্ভবত প্রথম বাঙালি নারী, শ্বশুর বরাহ কর্তৃক যাঁর জিভ কর্তিত হয়েছিল, পাণ্ডিত্যে স্বামী মিহিরকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন বলে। সম্ভবত সেই প্রথম শুরু হয়েছিল বাঙালি বিদুষী নারীর কণ্ঠরোধের চেষ্টা। এরপর সময় ও সমাজ বদলায়। খুব ধীর গতিতে উন্নত হয় নারীর অবস্থান। কলম ধরলেন তাঁরা, লিখলেন কবিতা। কিন্তু পায়ে জড়ানো পুরুষতান্ত্রিকতার শিকল। বহুদিনের লালিত পিতৃতান্ত্রিক হেজিমনিকে উল্লঙ্ঘনের ক্ষমতা তাঁদের নেই। কারণ, রাসসুন্দরীর মতো অনেকের কাছেই তা ‘ঈশ্বরাধীন কর্ম’। এভাবেই ধর্মকে হাতিয়ার করে পুরুষ পদানত করেছে নারীকে--শারীরিকভাবে এবং অতি অবশ্যই মানসিকভাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা দেখবো উনিশ শতকের তিন বাঙালি নারীর কবিতাকে।
কেট মিলেট তাঁর ‘Sexual Politics’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য পিতৃতন্ত্রের মোট পাঁচটি ষড়যন্ত্রের মধ্যে প্রথমটি হল ‘ভাবাদর্শগত’--যা পুরুষের হাতে ক্ষমতা বিস্তারের জন্য যে-নিয়ম তৈরি করে তোলে, তা ক্রমশ সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নারী-পুরষ উভয়ের দ্বারাই সহজভাবে গৃহীত হয়। পিতৃতন্ত্রের তৈরি মেজাজেই নারী তখন নিজের মানসিকতা তৈরি করে ফেলে। সেই প্রবণতা অনুসারে নারীর কাজ হল ঘর-সংসার দেখা, সন্তান পালন করা ইত্যাদি। আর পুরুষের কাজ হল বাইরের কাজ, রোজগারের কাজ। মিলেটের এই বক্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলিয়ে পড়ে নেওয়া যায় উনিশ শতকের নারী কবিদের অন্যতম গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর ‘বঙ্গ মহিলাগণের হীনাবস্থা’ কবিতাটি। কবিতাটিতে তিনি বিদ্যাভাবের কারণে বাঙালি মহিলাদের অন্তঃপুরের জীবনের সংকীর্ণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ফলে, তারা সেঁজুতিব্রত পালনের মধ্য দিয়ে সতীনের মৃত্যুকামনা করেন। এর বিপরীতে রয়েছে ইউরোপের দৃষ্টান্ত--‘দেখ ইউরোপ খণ্ডে যতেক কামিনী / বিদ্যাধন লভে সবে সদা আমোদিনী’। তার ফলে সেখানে কোনো মহিলা হচ্ছেন ডাক্তার, কেউ-বা উকিল। যদিও এর ঠিক পরেই তিনি বলেছেন ‘সত্য বটে পুরুষের ধন উপার্জন, / করিয়া করিবে দারা-পুত্রের রক্ষণ’। এখানেই কাজ করে যাচ্ছে পিতৃতন্ত্রের ভাবাদর্শগত ষড়যন্ত্র যা শেষ পর্যন্ত নারীকেও ভাবতে শেখায় পুরুষ-নারীর আবশ্যিক কর্ম বিভাজন। এই তৈরি-হয়ে-ওঠা নারী-মনকে অবশ্যই হতে হবে কোমল, প্রেমে টলমল। তার পা বা চোখ উপমিত হবে পদ্মের সঙ্গে। এই ছাঁচ থেকে গিরীন্দ্রমোহিনীও তাঁর ‘রাধা’কে মুক্ত করতে পারেননি। ‘শ্যাম’ কবিতায় অভিমানিনী রাধার মানভঞ্জের জন্য শ্যামকে দিয়ে যে-কথা বলিয়েছিলেন, তা প্রকৃতপক্ষে পুরুষতন্ত্রের মনের কথা : ‘যাইবে চলিয়ে, রহিব ঘেরিয়ে, কেমনে ফিরাবে মুখ। /তুমিই রমণী, তনুয়া নবনী, নহে ত পাষাণ বুক’।
বেথুন স্কুলের শিক্ষয়িত্রী কামিনী রায়ের কয়েকটি কবিতায় নারী-জাগরণের সুর বেশ স্পষ্ট। ‘নারী নিগ্রহ’ কবিতায় তিনি দেশপ্রেমিক ভণ্ড নেতাদের প্রতি নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কারণ, কাগজে-কলমে, গানে-বক্তৃতায় তাঁরা দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দিলেও গৃহে প্রবেশের পর নিজেদের ‘সতীনারী’ বধূদের অপমান করে, অত্যাচার করে, অসম্মান করে। এইসব পাষণ্ড দেশ-প্রেমিকদের উদ্দেশে কবির বক্তব্য--ইঁটের ঘরে পাথরের প্রতিমার চেয়ে শতগুণে পূজ্য ‘রমণীর মান’। এর পরে তিনিও আবার সেই পুরুষতন্ত্রের চেনা ছকে কথা বলতে শুরু করেন। তাঁর মতে, বাড়ির রমণীরা হলেন ‘প্রেম-পুণ্য-খনি’ এবং তারা ‘সতী অতুলনা’। প্রেম আর নারীকে এক করে দেওয়ার বিরুদ্ধে তো নারীবাদীরা সর্বত্রই সরব। আর ‘সতী’ শব্দের কোনো পুংলিঙ্গ বাচক শব্দ হয় না বলে তো নারীবাদীরা এই বিশেষ অভিধাটিকে বর্জনের পক্ষপাতী। অথচ, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কামিনী রায়ের মজ্জাগত বলেই ‘নারী-জাগরণ’ কবিতায় তিনি নারীকে ‘জগন্মাতা’ বলে উল্লেখ করে তার পালয়িত্রী মূর্তিকে উজ্জ্বল করে তুলে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। ‘ঠাকুরমার চিঠি’তে তিনি ঠাকুরমার উবাচতে নবীনাদের প্রতি যে-উপদেশ দিয়েছেন তা কার্যত এ যুগের নারীবাদীদের কাছে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। কবিতাটিতে ঠাকুরমা বলেছেন, সংসার অর্থাৎ গৃহ-দেবালয়ই হল নারীর প্রকৃত কর্মক্ষেত্র, তাদের সুখে রাখবে বলেই পুরুষদের বাইরে পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করতে হয়। তাই ঘর থেকে নারী যদি বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে শুরু করে, ফ্যাশানের বিলাসে নিজেকে নিমজ্জিত করে দেয়, তাহলে ‘‘ ‘ফ্যাশানের’ ব্যসনের বিষপানে মুগ্ধ / বিষাক্ত হবেরে হায় জননীর দুগ্ধ!’’। ফ্যাশানের দ্বারা নিজেদেরকে মোহিনী করে উপস্থাপিত করার কৌশলটিও যে পুরষতান্ত্রিক, তা নারীবাদী চিন্তার দ্বিতীয় তরঙ্গে বেটি ফ্রিডান তাঁর ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’ বইটিতে আমাদের জানিয়ে দেন। বোঝা যায়, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যে-সব নারীরা নিজেদের কথা লিখেছেন, তাঁরাও কখনো-কখনো তাঁদের নিজেদের কবিতাতেই নিজেদেরকে করে তুলেছেন পুরুষের পাদটীকা।
অনুরূপে ঊনবিংশ শতাব্দীর আর-এক কবি মানকুমারী বসুর ‘মা’ কবিতায় দেখা যায়, মায়ের সুখ্যাতি করে তিনি যা-সব বললেন, তা সবই ছক-নির্দিষ্ট এবং পিতৃতান্ত্রিক হেজিমনির প্রেসক্রিপশন-ভিত্তিক। মা এখানে জগন্মাতা এবং অবশ্যই সংসারের পালন-কর্ত্রী। স্নেহ-অশ্রু দিয়ে সংসারের সবচেয়ে অবজ্ঞেয়কে হৃদয়ে আশ্রয় দিতে তিনি জুড়িহীন। এক কথায় মা হচ্ছেন ‘প্রীতির অমিয়া মূর্তি’, ‘দেবতার মেয়ে’। স্বাভাবিকভাবেই বিবাহিত নারীরা তাঁর কবিতায় দাসীরূপে আর স্বামীরা রত্নরূপে উল্লিখিত। ‘নিরাকাঙ্ক্ষী’ কবিতায় মানকুমারী জানাচ্ছেন : ‘দাসীরে দয়াল বিধি / দিয়াছেন যেই নিধি, / স্বরগে মরতে প্রভো! কি আছে তেমন?’। ফলে বিধাতার কাছ থেকে হৃদয়ে ভক্তি আর প্রীতি পেয়েই তিনি সন্তুষ্ট। কারণ সমাজ তাঁদের শিখিয়েছিল যে, ‘মেয়েরা ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করিবে, রান্নাবান্না করিবে, লাজশরম করিবে’ (রাসসুন্দরী দেবী--আমার জীবন)। অথচ তাঁরই সমসাময়িক কৃষ্ণভাবিনী দেবীর চোখে যে-নারী পুরুষের সমকক্ষ, কেবল তারাই ‘সতী’। কারণ তারা ‘পাগলের মত হইয়া পুরুষকে স্বর্গীয় দেবতা বলিয়া সর্ব্বদা প্রণয় ও সুখস্বপ্নের চিন্তা করে না’। কৃষ্ণভাবিনী যেহেতু দীর্ঘকাল ইংল্যান্ডে বাস করেছিলেন, তাই সেই যুগের বাঙালি নারীর মানসিকতা থেকে তিনি ছিলেন কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির।
আসলে দোষারোপ করে লাভ নেই, কেন-না তৎকালীন সমাজে কার্পেট বোনা বা পিরাণ শেলাই করতে শিখিয়ে সংসারের কাজে নারীকে আরও উন্নত করে তোলাই ছিল প্রচলিত স্ত্রী-শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য। নারীদের বই পড়াকে তাই ব্যঙ্গ করে কবিতা লিখতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও দু-বার ভাবেননি। রাজনারায়ণ বসুর ‘সে কাল আর এ কাল’ গ্রন্থে তিনি যেমন বলেন, ‘পতিভক্তি ও পতিনিষ্ঠা আমাদিগের হিন্দু স্ত্রীদিগের প্রধান গৌরবস্থল’, সেই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনাই অলক্ষ্যে কাজ করে গিয়েছিল সেই যুগের নারী কবিদের কবিতাতেও। তাই ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে মৃণালের বড়ো জা স্বামী ও সংসারের অপছন্দ বলে নিজের বোন বিন্দুর প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারেনি। নিজেদেরকে ‘মেয়েছেলে’ ভাবতেও তখন তারা কোনো হীনমন্যতা বোধ করতেন না। রাসসুন্দরী দেবী লিখেছেন, ‘তখনকার মেয়েছেলেগুলা নিতান্ত হতভাগা প্রকৃত পশুর মধ্যে গণনা করিতে হইবেক’। ফলে ‘চোখ পাল্টায়ে কয়’ সমীকরণটি সেই যুগের সমাজ-পরিবেশে সার্থক হয়ে উঠতে পারেনি।
উৎসপঞ্জি :
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ, কবিরাণী গিরীন্দ্রমোহিনীর গ্রন্থাবলী, কলকাতা : বসুমতী-সাহিত্য মন্দির।
পূরবী বসু, ২০১৫, কিংবদন্তীর খনা ও খনার বচন, ঢাকা : অন্যপ্রকাশ।
বারিদবরণ ঘোষ (সম্পা), ২০১৬, কামিনী রায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, কলকাতা : ভারবি, দ্বিতীয় মুদ্রণ, (প্রথম প্রকাশ : ২০০১)
বারিদবরণ ঘোষ (সম্পা), ২০০১, মানকুমারী বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা, কলকাতা : ভারবি।
Kate Millett, 2000, Sexual Politics, New York: Doubleday, 4th reprint, (1st published: 1969) ।
Betty Freidan, 1979, The Feminine Mystique, New York: Dell Publishing Co., Second printing, (1st published: 1963) ।
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ১৩ মার্চ ২০২১
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক।
0 Comments
Post Comment