নারীদের শব্দ দিয়ে জব্দ করার রাজনীতি

  • 17 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1133 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
প্রাচীনকাল থেকে নারীদের প্রতিনিয়ত মুখের ভাষা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া চলে আসছে। কৌশলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীদের মাথায় গেঁথে দিয়েছে— শরীরকে কোনো মূল্যে অপবিত্র করা যাবে না। নারী মাত্র শরীর সর্বস্ব। আর এই ফাঁকে সমাজের ধ্বজাধারী পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ এবং তাদের দাসেরা, নারীদের তথাকথিত শারীরিক পবিত্রতাকে হাতিয়ার করে বিশেষ কিছু কিছু শুধু স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ প্রচলিত করেছে। এই ভাষার সঙ্গে জুড়ে আছে নারীকে মূল্যায়ন করার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি।

পল্লীকবি জসীমউদ্দিন অনেক আগে তাঁর কবিতায় বলেছিলেন— ‘হাতেতে যদি না মারিত শত মারিত ঠোঁটে’। অর্থাৎ অনেকক্ষেত্রে শব্দ দিয়ে জব্দ করা যায়। প্রাচীনকাল থেকে নারীদের প্রতিনিয়ত মুখের ভাষা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া চলে আসছে। কৌশলে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীদের মাথায় গেঁথে দিয়েছে— শরীরকে কোনো মূল্যে অপবিত্র করা যাবে না। নারী মাত্র শরীর সর্বস্ব। এরফলে অবুঝ নারীর দল সৌন্দর্যের পিছনে শান দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, বুদ্ধিহীন হয়ে ত্বকের পেলবতা, রঙের উজ্জ্বলতা বাড়াতে দিনরাত রূপচর্চা করছে!  তাদের প্রশ্ন করতে বয়েই গেছে— কেন তাদের সুন্দর হতে হবে! এই ফাঁকে সমাজের ধ্বজাধারী পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ এবং তাদের দাসেরা, নারীদের তথাকথিত শারীরিক পবিত্রতাকে হাতিয়ার করে কঠিন কিছু শব্দ প্রয়োগ করে। পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের দুজন নায়িকার ব্যক্তিগত জীবনকে কেন্দ্র করে বিগত কয়েকদিন উত্তাল ছিল ম্যাড়মেড়ে বাঙালিদের জীবন। আনন্দ সহকারে উচ্চশিক্ষিত কাকা, কাকিমা, দাদা, দিদি, ভাই-বোনেরা অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন ও সামাজিক মাধ্যমের মন্তব্য বিভাগ ভরিয়ে দিয়েছে— খানকি, মাগী, পতিতা, বেশ্যা, অসতী, ছিনাল,বারোভাতারি, চুতমারানি, নটী প্রভূত শব্দে।

এই বিশেষ গালিগালাজগুলির মধ্য দিয়ে নারীদের চারিত্রিক অপবিত্রতা ঘোষণা করা হয়। উল্লেখিত গালিগুলির আভিধানিক অর্থগুলি আমরা একবার দেখে নেবো—

খানকি > বেশ্যার মতো আচরণ 
বেশ্যা > যে স্ত্রী লোক যৌন সহবাসের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে। বৈশ্য শব্দ থেকে বেশ্যা শব্দটির আগমন হয়েছে। বর্ণপ্রথার সময় ব্যবসায়ী হিন্দু শ্রেণিকে বৈশ্য বলা হতো। একসময় বিক্রি অর্থে বেশ্যা শব্দটি ব্যবহৃত হতো। পরবর্তীতে স্বাধীনচেতা নারীদের বেশ্যা বলার প্রচলন শুরু হয়েছে।
মাগী > প্রাপ্ত বয়স্কা, স্ত্রীলোক, সাবালিকা নারী, বেশ্যা, গণিকা।
পতিতা > দেহব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের বোঝানো হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকভাবে যে সকল নারী অর্থের বিনিময়ে অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনসঙ্গমে মিলিত হতে সম্মত হন এবং হয়ে থাকেন তাদের পতিতা বলে অভিহিত করা হয়।
ছিনাল > ভ্রষ্টা নারী, কুলটা; ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোক। 
অসতী > সাধ্বী নয় এমন। ভ্রষ্টা বা ব্যভিচারিণী 
বারোভাতারী > যার বারো জন (অনেক) স্বামী, প্রায়োগিক অর্থ ব্যভিচারী রমণী। আসলে এটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ব্যভিচারী বোঝাতে। বারোভাতারী মানে চরিত্রহীন মহিলা যার একাধিক স্বামী বা প্রণয়সঙ্গী থাকে।
চুতমারানি > যত্রতত্র যৌনসঙ্গম করে।
নটী > নর্তকী, বেশ্যা, অভিনেত্রী।

মজার বিষয় হলো পুরুষদের শরীরের অপবিত্রতা নিয়ে কোনো শব্দ তৈরি হয়নি। সুন্দর, অসুন্দর শব্দ প্রয়োগ করে পুরুষদের সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা হয় না। বুদ্ধি  ও কাজ দিয়ে পুরুষদের বিচার করা হয়। সিন্দুকে তুলে রাখা গুরুগম্ভীর শব্দ দিয়ে তাদের আখ্যায়িত করা হয়। কোটিপতি, লাখপতি, সভাপতি, বীরপুরুষ, লিডার, জ্ঞানতাপস, বলবান, শক্তিমান এই শব্দগুলি নারীদের ক্ষেত্রে কখনো সংযুক্ত করা হয় না। পৃথিবীর কোনো ধর্মে নারীদের বহুগামিতাকে প্রশয় দেওয়া হয়নি। বহুগামিতা যেন কেবলমাত্র পুরুষদের একচ্ছত্র অধিকার। নারীদের দেবী, মমতাময়ী, সতী, কোমলমতি ইত্যাদি শব্দের মোড়কে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। যখন স্বাধীনচেতা নারীরা আওয়াজ তোলার চেষ্টা করেন, তখন অসতী তকমা দিয়ে নারীদের দাবিয়ে দেওয়া হয়। বহুগামিতা কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্বের একটি অংশ, তাই খুব স্বাভাবিকভাবে এই প্রবণতা নারীদের মধ্যে থাকবে। নারীদের মানুষের পর্যায়ে ফেলা হয় না, তাই তাদের যৌনতা নিয়ে কথা কওয়া বারণ! আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে ক্ষমতার রাজনীতি করেন। সেইজন্য প্রতিটি শব্দ সচেতনভাবে ব্যবহার করা উচিত। জেন্ডার বিশেষজ্ঞ কমলা ভাসিন প্রথম পিতৃতান্ত্রিক ভাষার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানান। তিনি 'জেন্টললেডিস অ্যান্ড ম্যান’ বলা শুরু করেন। এভাবেই পরিবর্তন শুরু হয়। 'জেন্টলম্যান' অভিধায় কেবল পুরুষদের সম্বোধন করা হত। নারীদের যেহেতু মানুষের পর্যায়ে রাখা হয় না ফলে তারা 'লেডিস'।

প্রতি পদে পদে বিভিন্ন ভাবে নারীদের হেট করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে ভাষা ব্যতিক্রম নয়।  ভাষা পুরুষকে মহান করেছে। আমাদের শিশুরা প্রতিনিয়ত পাঠ্যবই, কার্টুন, বিজ্ঞাপন, গেমস থেকে কী শিক্ষা লাভ করছে? সমস্ত মাধ্যমে বীরবিক্রম পুরুষদের রমরমা। আমরা ছোটবেলায় পাঠ্যবইতে গল্প, কবিতা, লিংগ, প্রবাদ প্রবচন, বাগধারা পড়ে, রাস্তা চলাচলের সময় পুরুষদের মুখ থেকে গালিগালাজ শুনে, বাড়িতে গৃহকর্তার দাপট দেখে সমাজের নারী-পুরুষের অবস্থান সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা তৈরি করি। অর্থাৎ শিশু অবস্থায় ছেলে ও মেয়ে তাদের অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হচ্ছে, তারা ধরে নেয় ছেলেরা হবে মহান, ছেলেদের তত্ত্বাবধানে মেয়েরা থাকবে।

ভুলে ভরা একটি পৃথিবীতে শিশুরা বড় হতে থাকে। বলাই বাহুল্য কু-ভাষা শিশুমনে কিরকম প্রভাব ফেলে! সাম্প্রতিককালে দুই দেশের দুজন নায়িকা যেভাবে হেনস্থার শিকার হলেন, এবং তাদের চরিত্র হননে যেসব ভাষার ব্যবহার করা হলো, সেইসব ভাষার সঙ্গে শিশু থেকে বয়ঃসন্ধিকালে পদার্পণকারী কিশোর-কিশোরীরা পরিচিত হয়েছে। মুর্শিদাবাদের কয়েকজন কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম সমাজের প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক ধারনা তাদের মাথায় গেঁথে গেছে। সাউথ কোরিয়ান মিউজিক ব্যান্ড বিটিএস প্রত্যন্ত গ্রামগুলির কিশোর, কিশোরীদের আক্রান্ত করেছে। তবে, কিশোরীরা এই ব্যান্ডের সদস্যদের বেশি পছন্দ করে। এরফলে বিপদ ঘনিয়েছে। ছেলে-মেয়েদের ঝামেলা মারামারি প্রতিনিয়ত চলতে থাকে কারণ এই দলের সদস্যদের মধ্যে পুরুষালি ভাব নেই। এরফলে ছোট ছেলেরা এদের মেয়েলি, হাফলেডিস, হিজড়ে, ছক্কা, ছামিয়া সম্বোধন করে। এবং ঘেন্না করে কারণ তারা মেয়েদের মতো আচরণ করে বলে। এই ঘটনা জেনে শিহরন জাগে। এই নারী-পুরুষ বিদ্বেষ কতদূর গড়িয়েছে!

সতীত্ব

নারীকে সতী হতেই হবে, এমন বস্তাপচা ধারণা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। সেই আদিকালে সীতার সতীত্বের অগ্নিপরীক্ষা থেকে এই অসম্মানজনক শব্দের সূচনা হয়েছে। এখনও এই ভাষাকে আশ্রয় করে নারীদের 'মৌখিক নির্যাতন' বা ইভটিজিং’ করা হয়।

পূর্বপুরুষ

আমাদের অভিধানে পূর্বনারী বলে কোনো শব্দ নেই। আমাদের পিতারা মনে করেন বংশের ধারকবাহক কেবল তারা। নারীর কোনো স্থান নেই সেখানে। তবে অভিধানে স্থান না পেলেও নারীবাদী লেখকরা ‘পুরুষানুক্রম’, 'পূর্বপুরুষ' শব্দের পাশে প্রচলন করেছেন ‘নারীক্রম’ ‘পূর্বনারী’ ‘উত্তরনারী’ শব্দগুলি।

বিধবা

বিধবার তকমা কেবল মেয়েদের জন্য! পুরুষদের জন্য এই ধরনের অকল্যাণকর শব্দ প্রয়োগ আজ অবধি করা হয়নি, এবং অদূর ভবিষ্যতে হবে না!

প্রবাদ প্রবচন 

প্রবাদে নারীদের অত্যন্ত ছোট করে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি পুরুষরা সম্মানীয়ভাবে বিরাজ করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে—

ক)   পুরুষ রাগলে হয় বাদশা, নারী রাগলে হয় বেশ্যা
খ)    ভাই বড়ধন রক্তের বাধন, যদিও বা পৃথক হয় নারীর কারণ
গ)    রান্ধি বাড়ি যেবা নারী, পুরুষের আগে খায়, ভরা কলসীর জল তার তরাসে শুকায়
ঘ)    সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, রমণী সুন্দর হয় সতীত্ব রক্ষণে
ঙ)    লজ্জা নারীর ভূষণ
চ)    পুরুষের বল টাকা, নারীর বল শাঁখা
ছ)    সতী নারী গঙ্গা জল, অসৎ নারী বদ্ধ জল
জ)   বাপ কা বেটা
ঝ)   চোরের মায়ের বড় গলা
ঞ)  পতিহারা নারী মাঝি হারা তরী 
 ট)   পুড়বে আগুন উড়বে ছাই তবেই কন্যার গুণ গাই

'বাংলায় নারীর ভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে সুকুমার সেন বিশেষ কিছু শব্দের উল্লেখ করেছেন যার ফলে পুরুষ ও নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। যেমন— অনাছিষ্টি, লক্ষ্মীছাড়া, আটকুঁড়ো, আড়ি, আদিখ্যেতা, কটুনী, খোঁটা, গাদী, গুমর, গা, ছিরি, ঠমক, ঢঙ, দেমাক, ন্যাকা, পোয়াতি, বিয়েন, বেহায়া, কুট্টি, মিনসে, রাঁড়, রাঁড়ী, সেয়ানা, ইত্যাদি।

ইদানীন্তন নারীবাদী লেখকদের নতুন কিছু শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে— ‘সুপারওমেন’, ‘সিস্টারহুড‘ ‘ওমেনহুড', ‘শিরো‘ (হিরো), ‘জেন্টলওমেন’, ‘ওমেনলি’, ইত্যাদি। আবার  নারীবাদী লেখকদের অভিধানে কিছু নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে। আধুনিক প্রজন্ম জীবনসঙ্গীদের পরিচয় পার্টনার  বা সঙ্গী হিসাবে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ‘পতিত’, ‘রক্ষিত’, ‘ভ্রষ্ট’ ও ‘নষ্ট’ হিসাবে পুরুষদের পরিচিতি দেওয়া হচ্ছে। আবার সমাজের একটি বিশেষ স্থানে এখন কলবয়, জিগোলোদের নাম উচ্চারিত হতে দেখা যায়।

আমদের কথা বলা ও লেখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। আগামী প্রজন্মর কাছে নারীপুরুষ সমান, এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের ভাষা হয়ে উঠুক উদার, স্বাধীন, মানবিক, আধিপত্যহীন।

তাঁবেদার ভাষা মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ুক দিকদিগন্তে।

পুনঃপ্রকাশ

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment