- 15 May, 2024
- 0 Comment(s)
- 135 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
- কে যায় গো?
- চোখে ন্যাবা হয়েছে? দেখতে পাওনা? ব্রজপুরের গয়লানীরা!
- সবার কথা কে জানতে চাইছে? ওই মাঝের জনাটি কে তাই বলনা? যার রূপ সবার চেয়ে চোখ ধাঁধানো? যার গায়ের গয়না বেশি ভারি ভুরি? যার পায়ের মল বেশি রুন ঝুন করে বাজছে?
- আ মোলো যা! ওতো বড়ঘোষের বৌ রাধা গয়লানী!
- তাই বল!
রাধা গয়লানীকে নিয়ে কতই না কানাকানি! তার দেহ ভরা রূপ-যৌবন! গা ভরা সোনা- রূপোর গয়না! তার সই ললিতা, বিশাখা তারাও কম রূপ-যৌবনবতী নয়! তাদের গায়েও সোনা- রূপোর গয়না কম নাই! তবু তাদের কথা কেউ তোলেনা। ঘুরে ফিরে কেবলই রাধা বৌ এর কথা! ঘরে বাইরে সবার মুখে মুখে।
রাধার বর আয়ান ঘোষকে এ তল্লাটের লোক এক ডাকে চেনে-বলে বড়ঘোষ। তার মত এত ধন-সম্পত্তি ব্রজপুরে আর কারো নাই। বিরাট মাঠের মত উঠোনটাকে বেড় দিয়ে তার মস্ত মাটির বাড়ি। প্রকাণ্ড গোয়াল খানায় গাই-বাছুর মিলিয়ে সংখ্যায় যে কত, বড় ঘোষ নিজেও জানেনা। জানে বাড়ির রাখালটা আর বড় ঘোষের বৌ রাধা। তাদের চেহারাও দেখবার মত- গাইগুলো যেমন দলমলে, বাছুরগুলো তেমনই নধর।
রাখালটাই সারাদিন গোরু বাছুরের দেখাশোনা করে। চরাতে নিয়ে যায়। খড় কুচিয়ে জাবনা দেয়। তবে সেটুকুই তো সব নয়? এর পরেও কাজ থাকে- কারো গায়ে ঘা হল কি না, সেখানে চুন হলুদের প্রলেপ লাগানো হল কি না, ঠিকঠাক জাবনা দেওয়া হল কি না। তাছাড়া সন্ধ্যে বেলায় সাঁজাল দেওয়া আছে, ভোর রাতে কচি বাছুরগুলোকে মায়ের দুধ খাইয়ে, একটু তফাতে খুঁটোয় বেঁধে রাখার ব্যাপার আছে। এ কাজগুলো রাখালের হাতে ছাড়তে পারেনা রাধা।
এতগুলো গাই দোয়ানোও কি কম ঝক্কির! রাখলটা সকাল থেকে দুইতে শুরু করে। তবে কিছু কিছু গাই আবার খুব আবদেরে। তারা পেটের তলায় রাখালটাকে বসতে দিতে চায় না। চাঁট মেরে বালতি উলটে ফেলে দেয়। তখন রাধা বৌকে যেতে হয়- গলায় হাত বুলিয়ে তাদের শান্ত করে নিজেই বালতি নিয়ে বসে। এরপর সেই দুধ পাক দিয়ে তাল তাল ননি তৈরি করা। ফুটিয়ে ছানা করা। তাছাড়া রান্নার কাজ আছে, কাছেই যমুনা নদী, সেখান থেকে জল ভরে আনা আছে।
এত সবের পরেও পায়ে পায়ে খুঁত ধরবার জন্য আছে তার দুই ননদ। পান থেকে চুন খসলেই ভাই এর কাছে তারা সাতটি করে লাগায়। বড়ঘোষ মানুষ মন্দ নয়। তবে খুব কান পাতলা। দিদিদের মুখে রাধা বৌ এর নামে নালিশ শুনে, তফাতে দাঁড়িয়ে সে খানিক তড়পায়। তবে ওইটুকুই। এর বেশি কিছু করবার ক্ষমতা তার নাই। রাধার কাছে গিয়ে তাকে ধমক দেওয়া তো দূরের কথা, তার চোখে চোখ রেখে কথা পর্যন্ত কইতে পারে না। তার এই স্বভাবের জন্য দিদিরা পিছনে বলে, “বৌ এর ভেড়া!”
- কই রে তোদের হোল? সাজ গোজ করতেই যে সুয্যি মাথায় উঠল?
এতটা রাস্তা উজিয়ে হাট ধরবি কখন?
বড়াই বুড়ির হাঁক শুনে গয়লা বৌদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সাজগোজ সারা করে দই, ননি, ছানার হাঁড়ি নিয়ে দুদ্দাড় করে তারা বেরিয়ে আসে। শাড়ি ঝলমলিয়ে,মল ঝমঝমিয়ে মথুরার হাটের দিকে রওনা দেয়।
চার-পাঁচখানা গাঁয়ে ওই একটাই হাট। সময় মত না গেলে ঠিকমত দাম পাওয়া যাবে না। এতো আর ঘরে রাখবার জিনিস নয়! শেষে লোকসান করেই জিনিস বেচতে হবে। সামনে বড়াই পিছনে সার দিয়ে কলকল করতে করতে গয়লানীর দল মথুরার হাটের দিকে রওনা দেয়।
ইদানীং নন্দ ঘোষের ছেলে কানাই বড্ড জ্বালাতন করছে। ছোটো থেকেই সে ভারি দুষ্টু। ঢেলা মেরে এর ওর কলসী ভেঙ্গে দেওয়া ছিল তার নিত্যকার কাজ। তার মা যশোদাকে সে কম জ্বালিয়েছে! তার জ্বালায় সর, ননি রাখতে পারত না। বন্ধুদের ডেকে শিকেয় তোলা ননিও পেড়ে খেয়ে নিত। যশোদার হাটে যাওয়া হত না। সে লাঠি হাতে ছেলেকে খুঁজে বেড়াত। কিন্তু অন্য কেউ কানাইএর নামে অভিযোগ করতে গেলে, যশোদার তখন অন্য মুর্তি। ছেলের নামে একটা অভিযোগও সে কানে তুলত না। উলটে কোমর বেঁধে তাদের সাথে ঝগড়া করত।
কানাই এখন ডাগরটি হয়ে উঠেছে। গোরুবাছুর নিয়ে মাঠে যায়। ব্রজপুরে যত রাখাল আছে সে তাদের দলপতি। একটা বাঁশি কোমরে গোঁজা থাকে। মাঝে মাঝে সেটাতে ফুঁ দিয়ে সুর তোলে।দুর থেকে সে সুর শুনেছে রাধা। এই সব রাখলের দল গয়লানীদের সাথে খুনসুটি করে। ললিতা, বিশাখারা এতে করে বেশ মজা পায়। সারাদিন ঘরে গাধার খাটুনি। তাতেও ঘরের মানুষদের মন পাওয়া যায় না। যা কিছু আনন্দ- ফুর্তি এই সময় আর যমুনায় নাইতে যাবার সময়। তাদের আশকারাতে দিন দিন রাখাল ছোঁড়াদেরও সাহস বাড়ছে। কেবল রাধা বৌ এসবের মধ্যে থাকে না। বয়সে ছোটো এই রাখালদের সাথে ফস্টি নস্টি করতে তার কেমন যেন বাধে। সে মুখ নামিয়ে হাঁটে। এ নিয়ে তাকে ঠাট্টাও শুনতে হয়- - বড়ঘোষের বৌ!
- তার উপর রূপসী!
- গুমোরে পা পড়ছেনা!
রাধা শুনেও না শোনার ভান করে থাকে।
কানাই আজকাল সবাইকে ছেড়ে রাধা বৌ এর পিছনে লেগেছে। সে রাধার হাত ধরতে যায়। কাপড়ে কাঁটা আটকে দিয়ে মজা দেখে। ননি,ছানার হাঁড়ি সামলে, কাঁটা ছাড়াতে নাজেহাল হয় রাধা। শেষে বড়াই এসে তাকে মুক্ত করে। কখনও সে রাধার পথ আগলে আড় হয়ে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসতে থাকে। সে এতটাই বেপরোয়া, কিছুদিন আগে বড়াই এর হাত দিয়ে তাকে কর্পূর আর পান পাঠিয়েছিল! তাই দেখে রাধা তো রেগে আগুন! বড়াইকে দু চোখে ভস্ম করে, সেই পান-কর্পূর দু পায়ে মাড়িয়ে দিয়েছিল সে।
-অত দেমাক কিসের লো? ভাতারের মত ভাতার হলে আরো কত করতিস? বড়াই বুড়িও সেদিন অন্যদের মত পাঁচ কথা শুনিয়ে দিয়েছিল রাধাকে।
হাট থেকে ফিরে গয়লা পাড়ার বৌরা যমুনায় যায় স্নান করতে। সে সময় বড়রা কেউ থাকেনা। তাই লাগাম ছাড়া হাসি-ঠাট্টায় বিকেলের যমুনা তোলপাড়িয়ে ওঠে। রাতের গোপন কথাও প্রকাশ্যে চলে আসে।
- হ্যালো রাধা! তোর বর তোকে আদর করেনা? জল ছড়াতে ছড়াতে একজন বলে।
- তোদের যত উলটো পালটা কথা! রাধা ফ্যকাসে মুখখানা অন্য দিকে ফিরিয়ে বলে।
- বড়ঘোষ অন্যদের মত নাকি? সে রাধারানীর সোনার অঙ্গে ফুঁ দিয়ে দিয়ে আদর করে! গা মাজতে মাজতে আর একজন টিপ্পনি কাটে।
- লোকে বলাবলি করে তোর বর নাকি আলাদা ঘরে শোয়? কথাটা কি সত্যি? রাধার উপর এই বৌটির খানিকটা হিংসে আছে। এই সুযোগ সে হাতছাড়া করে না।
- সে তো তার দিদিরা আড়ি পাতে তাই! শুকনো গলায় বলে রাধা।
- শুধুই কি আড়ি পাতার ভয়ে? নাকি অন্য কিছু? এবার যেন হাসির ধুম পড়ে যায়- হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে।
রাধার আর সহ্য হয়না। সে জল থেকে উঠে, ঘাটের পাথরে বসে পাদুখানি ঘষা মাজা করতে থাকে। যেন কত কালের গোবোর-মাটি সেখানে লেগে আছে।
আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। তাই বলে গয়লা বৌদের কাজের বিরাম নাই। রাধাও রোজকার মত ভোর ভোর উঠে কাজে লেগেছে। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। তাই গা টাও যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে। নদীর ঘাটের কথাগুলো তাকে আনমনা করে তুলছে বার বার। একটা চাপা অভিমান উথলে উঠছে। আঁচল ঘষেও দু চোখের কোন শুকনো রাখতে পারছে না সে। ননদেরা তাড়া দিচ্ছে হাটে যবার জন্য। ললিতা-বিশাখারাও এখনি হৈ হৈ করে চলে আসবে। অনিচ্ছা সত্বেও দই, ননির হাঁড়ি সাজিয়ে নিজে সাজতে বসে রাধা।
হাট থেকে ফেরার সময় আকাশ আরো কালো। মেঘের দল বুনো মোষের দাপা দাপি করছে। যমুনাও ফুঁসছে। ঘাটে একটাও নৌকা নাই। কেবল কানাই একা একটা ভাঙ্গা নৌকো নিয়ে বসে আছে।
- পার করিয়ে দেবে? গয়লানীরা হাঁক দেয়।
- সে জন্যই তো বসে আছি।
সবাই হুড়মুড় করে নৌকোর দিকে এগোয়- বাড়ির মানুষ চিন্তা করবে। তাদের ভারি তাড়া।
- দেখছ না আমার ভাঙ্গা নৌকো! এতজন একসঙ্গে হবে না। এক এক করে এস।
অন্য দিন হলে গয়লানীরা কানাইকে পাত্তা দিত না। কিন্তু আজ সে ছাড়া গতি নাই। কানাই একে একে সবাইকে পার করিয়ে দেয়। বাকি থাকে কেবল রাধা। রাধা নৌকোয় উঠতে গেলে কানাই নানা বায়নাক্কা জোড়ে।
- কি দেবে পার করতে?
- সবাই যা দিল তাই।
- সবার সাথে তোমার সাথ হবে কি করে? ওদের সাথে আমার বরাবরের লেন দেন। তোমার সাথে তো তা নেই? তুমি তো আমাকে দেখেও দেখনা। আজ নিরুপায় হয়ে আমার নৌকায় উঠতে এসেছ। কাল থেকে আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে।
- রাধা ব্যাকুল হয়ে বলে, আমার সইরা চলে গেছে। আকাশের অবস্থা ভাল নয়। যা বলবে তাড়া তাড়ি বল?
- রাধার চোখের দিকে চেয়ে কা্নাই বলে,তোমার যা আছে সব দিতে হবে?
- নিজের বলতে আমার কি আর আছে? দই, ননি বেচা কটা আনি। সেকটাও তো আমার নিজের নয়! গিয়েই বড় ঘোষকে হিসাব দিতে হবে। তার থেকেই না হয় কিছু দোবো?
রাধা আজ কেন যে কানাইএর সাথে এত কথা বলছে, সে নিজেও জানেনা। অন্য দিনের মত কা্নাইকে দেখলে তার রাগ হচ্ছেনা। বরং তার সাথে কথা বলতে পেরে যেন হাল্কা লাগছে। জল ভরা মেঘের মত ভারী হয়ে ওঠা রাধার মন থকে টুপ টাপ বৃষ্টি ঝরতে শুরু করেছে।
- কি ঠিক করলে? নৌকোয় উঠবে? নাকি চলে যাব?
- নৌকো ভেড়াও।
কানাই নৌকো ভেড়ালে, লাফ দিয়ে উঠে পড়ে রাধা। নৌকো দুলে উঠতেই সে হুড়মুড়িয়ে নৌকোর উপর পড়ে যায়। দই, ছানার হাঁড়ি কুড়ি ছত্রখান হয়ে নদীতে পড়ে ভাসতে থাকে। রাধা নিজেকে নিয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। এমন সময় প্রবল বেগে ঝড় বইতে শুরু করে। সেই সাথে কড় কড় শব্দে বাজ পড়ে। ভয়ব্যাকুল রাধা ঝড়ের আঘাতে ঝরে পড়া একগুচ্ছ বন মল্লিকার মত কানাইএর বুকের উপর ঝরে পড়ে।
উপরে বিক্ষুব্ধ আকাশ, নীচে যমুনার উথাল পাথাল ঢেউ, ভাঙ্গা নৌকোয় বার বার শিহরিত হয় রাধা। বার বার কানাই তাকে অভয় দেয়। রাধা ভাবে- এই জন্যই কি প্রকৃতিতে এত আয়োজন! এই ক্ষণটুকুর জন্যই কি এতকাল ধরে অপেক্ষা করেছিল সে!
তখন সন্ধ্যে ঘন হয়ে এসেছে। বড় ঘোষ যমুনার ঘাটে গিয়ে কোনো নৌকো দেখতে না পেয়ে ফিরে এসেছে। এমন সময় রাধাকে বাড়ি ঢুকতে দেখে তার ননদরা লাঠি হাতে তেড়ে আসে। বড় ঘোষের হাতেও চ্যালা কাঠ। কিন্ত এ কোন রাধা? কোমরে ননি, ছানার হাঁড়ি-কুড়ি নাই! গায়ে এক কুচি গয়না নাই! সম্পুর্ণ নিরাভরণ। কেবল ভিজে শাড়ির আঁচলটুকু ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। গালে কপালে ছড়িয়ে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুল থেকে টপ টপ করে জল ঝরছে। তার বৌ রাধা রূপবতী, যৌবনবতী। সে সরাসরি তার দিকে খুব একটা তাকায় না। তবে আড়ে আড়ে তো দেখে। সর্বক্ষণই দেখে। তার আগুনের মত রূপ দেখে সে ভয় পায়, পালিয়ে বাঁচে। কিন্তু আজকের রাধা তেমন নয়! জোৎস্নার মত স্নিগ্ধ, চোখ জুড়ানো! যেন কোনো সুদক্ষ কারিগরের হাতে আঁকা দেবী প্রতিমা! কোন কারিগর তাকে এমন ভাবে আঁকল! বড়ঘোষের মুখের কথা মুখেই থেকে যায়। নতমুখী রাধার দিকে অপলক চেয়ে থাকে সে।
বহুক্ষণ পর মুখ তোলে রাধা। সে মুখে ভয়-ভীতির চিহ্ন মাত্র নাই। শান্ত, স্নিগ্ধ, গভীর প্রশান্তিতে ভরা চোখ তুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বড়ঘোষের দিকে চায়। যাই হোক, আজ সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত সে। কিন্তু বড়ঘোষ এত সবের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। তার হাত থেকে চ্যালা কাঠ খসে পড়ে। সে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনই দাঁড়িয়ে থাকে।
লেখক : ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment