কাটা হাতে স্বপ্নেরা ডানা মেলে

  • 11 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 384 view(s)
  • লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
ঘুণ ধরে আছে সমাজের গভীরে। পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণে। শিশুকন্যাকে পুতুল, হাড়ি, কড়াই খেলনা  দিয়ে গৃহসংসারের সেবার দায়িত্ব দেওয়ার ট্রেনিংয়ের মধ্যেই। আজ রেণুর হাত কাটা দেখে চমকে উঠছি। সুতপাকে নিয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যাম কয়েকদিন তোলপাড় করছে। তারপর সব ঠাণ্ডাঘরে। আততায়ী তৈরির আসল কারখানাটা ভেঙে ফেলার কথা একবারও কি ভাবছি? হ্যাঁ, মেয়েরা লড়ছে। লড়ছে আধিপত্যের বিরুদ্ধে। রক্তাক্ত শরীর-হৃদয় জুড়ে স্বপ্নেরা ডানা মেলেছে।

রেণু খাতুনের ডান হাত কেটে দিয়েছে তার মালিক-স্বামী। রেণু কেন সরকারি চাকরি করবে স্বামী-প্রভুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে? মনিবকে অমান্য করার শাস্তি পেয়েছে অধস্তন দাসী। তবে কোনও  কোনও গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কেউ রেণুর স্বামী শের মহম্মদের মহানুভবতার কথা জানাতেও কার্পণ্য করেনি। সে স্ত্রীকে ভালোবাসে। মেরে ফেলতে চায়নি। কাছে রাখতে চেয়েছিল অঙ্গচ্ছেদ করে। শুধু তাকে ছেড়ে যেন চূড়ায় না ওঠে। তার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে দৈনন্দিন পরিষেবা দিয়ে যাক মনিব স্বামীর চাহিদা অনুসারে। রেণুদের, এ সমাজের মেয়েদের দাসত্বের বন্ধন কাটানোর সাহস হলে এমন কত শাস্তি যে জুটছে। রেণুর হাত কেটেছে, রক্ত ঝরেছে, কাজ করার প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, প্রশাসন, সরকারের তৎপরতায় মানুষের কাছে রেণুর যন্ত্রণার খবর পৌঁছোচ্ছে। কাটা হাত ঘিরে আছে স্বপ্নেরা। রেণুর হিম্মতের তারিফ করি। রেণুর বার্তা ছড়িয়ে পড়ুক সেই মেয়েদের অন্তরে, যাদের জীবনকে কেটে ছিঁড়ে জর্জরিত করা হচ্ছে। রেণু এখন এক প্রতীকী নাম।

সামিমার (পরিবর্তিত নাম) মা দুই কন্যাশিশু নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হলেন। আয়ার কাজ শুরু করলেন বাড়ি বাড়ি। পুরুষের পরিচর্যার কাজও নিতেন। তাহলে এই মেয়ের চরিত্র ঠিক নেই।  আত্মীয়, প্রতিবেশীর মুখের ভাষা, চোখের দৃষ্টি গেল পাল্টে। শরীরটা সামিমার শুদ্ধ আছে তো?  শব্দ-পাথরের রক্তক্ষরণ নিয়ে দুই শিশুর খাবার যোগাড় করেছেন সামিমা। চৌদ্দবছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিলেন। সামিমার ছোট মেয়ে পরপর দুই কন্যার জন্ম দিয়ে ভয়ানক অপরাধী এখন স্বামীর চোখে। নিয়মিত মার খেয়ে শরীর বেঁকে যাচ্ছে। মায়ের কাছে এসে একটু শান্তি পেতে চায়। মা মেয়ের ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিলে, মেয়েকেও তার মতো অপমানের জীবন বইতে হবে মনে করছেন। সমাজের নানা প্রশ্ন আর কৌতূহলের মুখে মেয়ের বেঁচে থাকার পথ সংকীর্ণ হবে আরও। তাই মেয়ে মার খেয়েও, শরীরে মনে রক্ত ঝরিয়ে টিকে থাকুক স্বামীর আশ্রয়ে। রেণু,  সামিমাদের রক্ত ঝরে ঘরে-বাইরে। শিরা-উপশিরা, হাত-পা কেটে পঙ্গু করলে, মেয়েদের স্বপ্নকে খানখান করে ভেঙে দিলে তবেই না দাসত্বের বন্ধন আরও দৃঢ হয়!

বহরমপুর গার্লস কলেজের সুতপা চৌধুরীকে খুন করলো সুশান্ত চৌধুরী। সুশান্ত চৌধুরীর দাবি, সুতপা তার প্রেমিকা ছিল। পরে তাকে ছেড়ে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। বড্ড অপরাধ!  প্রেমিকা যখন ছিল, তাহলে তাঁকে মেরে ফেলা বা বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা যেন তার হাতেই। সুশান্তের হয়ে কিছু মানুষ বুকের ব্যথায় ভুগলেন (হয়তো এখনও ভুগছেন)। আহা, ছেলেটাকে কষ্ট দিল এই মেয়ে। মেয়েটি আর নেই। খুন হয়েছে। তাতে কী? ছেলেটিকে একনিষ্ঠ ভালোবাসা না দেখিয়ে অপরাধ করেছে। যে ছেলে তার ভালোবাসায় পাগল তাকে সে ভালো না বেসে ভয়ানক অন্যায় করেছে। খুনী সুশান্ত তখন আর খুনী না হয়ে পাগল-প্রেমিকের উচ্চাসনে আসীন। অপরাধী হচ্ছেন খুন হয়ে যাওয়া সুতপা। সমাজের এই মুখগুলো কোথা থেকে তৈরি? খুনীর প্রতি সমবেদনা জানানো মানুষগুলো অ্যারেস্ট হয় না কেন?

ঘুণ ধরে আছে সমাজের গভীরে। পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণে। শিশুকন্যাকে পুতুল, হাড়ি, কড়াই খেলনা  দিয়ে গৃহসংসারের সেবার দায়িত্ব দেওয়ার ট্রেনিং - এর মধ্যেই। আজ রেণুর হাত কাটা দেখে চমকে উঠছি। সুতপাকে নিয়ে গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যাম কয়েকদিন তোলপাড় করছে। তারপর সব ঠাণ্ডাঘরে। আততায়ী তৈরির আসল কারখানাটা ভেঙে ফেলার কথা একবারও কি ভাবছি?

মেয়েরা এগিয়ে আসছে। আসছে অনেক লড়াই সেরে। পুরুষের একছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে। আর কত মেয়ের প্রাণ নেবে, হাত কাটবে, হৃদয় রক্তাক্ত করবে তা দেখার জন্য রেণু খাতুনদের কাটা শরীরে স্বপ্নরা ডানা মেলেছে।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত   

0 Comments

Post Comment