বিচারপতি কেটাঞ্জি ব্রাউন - মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা

  • 04 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 364 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
 ... তবুও আমরা কেটাঞ্জির মনোনয়নকে উদযাপন করব। আমার পিতৃদেব স্বয়ং, আমাকে অনেকবারে বুঝিয়েছেন – সমাজ আসলে এক ইলেক্ট্রিকাল সার্কিটের মতোই, উইথ এ ভেরি হাই, এক্সট্রিমলি হাই টাইম কনস্ট্যান্ট! অর্থাৎ কি না কোনও একটি বিষয়ে সমাজের তরফে সঠিক সাম্যে পৌঁছতে গেলে পরে অনেকখানি সময়ের প্রয়োজন, তারই মধ্যে আসতে থাকবে ওঠাপড়া অনেক। তারই মধ্যে এমন একেকটি পদক্ষেপেই আমরা এগিয়ে চলব সত্যিকারের আলোকিত ভবিষ্যতের অভিমুখে। মার্কিনি ইতিহাস আলো, অন্ধকার, পাঁক ও হীরকখণ্ডে পরিপূর্ণ। পৃথিবীর আর পাঁচটা দেশের ইতিহাসের মতোই।

একদিকে যখন রো বনাম ওয়েড নিয়ে উত্তাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেই একই সময়ে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের ২৩৩ বছরের ইতিহাসে আরও এক স্মরণীয় ঘটনার উদযাপন। আমরা যতই আমাদের দেশে বিভাজনের সমস্যা, সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর সমস্যা, গোঁড়ামির সমস্যা ইত্যাদিকে নিয়ে কপাল চাপড়াই না কেন, বিভাজন ও বিদ্বেষ রয়েছে সব দেশেই। তাই গোঁড়ামিতেও সেই ‘প্রগ্রেসিভ আমেরিকান’দের বাস্তবে টেক্কা দেওয়াটা মোটেই সহজ কাজ নয়। পাশাপাশিই আমরা তাই দেখতে পাই রো বনাম ওয়েডের বিতর্ক এবং সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার অবশেষে মনোনয়ন প্রাপ্তির খবর। গত ৩০শে জুন, আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা বিচারপতি হিসেবে শপথ নিয়েছেন কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসন। সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের ২৩৩ বছরের ইতিহাসে এই নিয়ে মোট ৬ জন মহিলা বিচারপতি এমন দায়িত্বভার পেলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে নিজেদের পদে রয়েছেন, এবং এহবাহ্য – ব্রাউনের আগে শেষ তথা পঞ্চমতম যে মহিলা বিচারপতিকে সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে আমরা পেয়েছিলাম তাঁর নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছিল ২০২০ সালে, দুই বছরেরও কম সময় আগে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির অধীনে। সেই নিয়েও তখন হাজারো বিতর্ক দানা বেঁধেছিল।

 

কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসনের ব্যক্তিগত জীবন ও ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় যাব না। সেই ইতিহাসের সবটুকুকে এখানে তুলে আনা নিষ্প্রয়োজন। বরং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিশেষ অংশকে তুলে এনে সাম্প্রতিকের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের বিশ্লেষণ সাজাই। কেটাঞ্জির বাবাও ছিলেন পেশাগত ভাবে আইনব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কাজেই ছোটবেলা থেকেই এক আইনি পরিবেশে তাঁর বড় হয়ে ওঠা। মা ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষিকা। কিন্তু সেদেশের কৃষ্ণাঙ্গ সমাজে আলোর পাশাপাশিই থাকে গভীরতর অন্ধকার। কেটাঞ্জির এক কাকা তাঁর ছোটবেলায় ১৪কেজি কোকেন-সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বিচারে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এই ঘটনার অনেক বছর পর, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সহায়তায় বিচারপতি ব্রাউন এই মামলাটিকে আবারও চালু করেন এবং তাঁর কাকার শাস্তি মকুবে সফল হন। একে হয়তো এতখানি সরল ভাবে দেখলে পরে ‘পরিবারের স্বার্থে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার’ বলে অনেকে মনে করতে পারেন। কিন্তু কেটাঞ্জির দীর্ঘ কেরিয়রে একাধিকবার মাদক সংক্রান্ত মামলায় তিনি মানবাধিকার ও সমাজে মাদকাসক্ত মানুষদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে মনে রেখে রায়দান করেছেন এবং তদুপরি সেদেশের মাদক-সংক্রান্ত মামলা ও আইনগুলির ক্ষেত্রে মানবাধিকারমুখী বদল আনতে সচেষ্ট হয়েছেন। ছাত্রজীবনে কেটাঞ্জি ব্রাউন হার্ভার্ড ল রিভিউয়ের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে চুটিয়ে কমেডি নাটকে অভিনয় করেছেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এক সহপাঠী ছাত্র তাঁর ডরমিটরিতে কনফেডারেট পতাকার প্রদর্শন করলে পরে দল বেঁধে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মুক্তচিন্তা, ও উদার ভাবমূর্তির প্রতি তাঁর ছিল সহজাত আকর্ষণ। নিজেকেও তিনি তাই সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন।

 

হার্ভার্ড ল রিভিউইয়ের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি ও নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব বারাক ওবামা স্বয়ং, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা সম্পাদক হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেন কেটাঞ্জি ব্রাউন। ক্ষমতার অলিন্দে তিনি যতই উপরে উঠেছেন, ততই তিনি প্রমাণ করেছেন তাঁর পাণ্ডিত্য, নৈপুণ্য ও দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা, যার কারণেই কলম্বিয়া অঞ্চলের ডিস্ট্রিক্ট সার্কিট জাজ হিসেবে মনোনীত হওয়ার সময়ে একাধারে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের আইনপ্রণেতারা একযোগে তাঁকে সমর্থন করেন। কেন এই প্রসঙ্গকে উল্লেখ করলাম, সেই কথাই বলব পরবর্তী অনুচ্ছেদের আলোচনায়।

 

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র ২০ দিন আগে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে সরকারিভাবে প্রথমবারের জন্য নিজের মেয়াদ ফুরনোরও মাত্র চার মাস বাকি থাকতে, ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সুপ্রিম কোর্টের আরেক দিকপাল মহিলা বিচারপতি রুথ ব্যাডার গিন্সবার্গের প্রয়াণে, বিচারপতি এ্যামি কোনি ব্যারেটকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে উদ্যোগী হন। এই নিয়ে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়। কারণ ইতিপূর্বে ২০১৬ সালেও একই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদে তাঁরও প্রাথমিক মেয়াদ ফুরনোর ১০ মাসেরও কিছু বেশি সময় বাকি থাকতে, বারাক ওবামার মাধ্যমে মনোনীত বিচারপতি মেরিক গারল্যাণ্ডের সুপ্রিম কোর্টে মনোনয়ন রিপাবলিকান বিরোধীরা আটকে দিয়েছিলেন। কাজেই একই কারণে এ্যামি কোনি ব্যারেটের মনোনয়নও নির্বাচন অবধি স্থগিত রাখাটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। কিন্তু, সেনেট হিয়ারিং কমিটিতে সকল নির্বাচিত ডেমোক্র্যাট সদস্যের ঘোষিত অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ১২-০ ভোটে বিচারপতি ব্যারেটের প্রাথমিক মনোনয়নকে ডোনাল্ড ট্রাম্প পাশ করিয়ে আনেন এবং পরবর্তীতে সেনেটেও ৫২-৪৮ ভোটে তাঁর মনোনয়ন নিশ্চিত হয়। এই মনোনয়নের পিছনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্যই ছিল মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে, স্থলাভিষিক্ত ৯ জন প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে ৬-৩ ব্যবধানে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের মাধ্যমে মনোনীত বিচারপতিদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থা কায়েম করা। যার কারণেই আজ রো বনাম ওয়েড মামলারও ওভাররুলিং সম্ভব হল। বিচারপতি ব্রাউনের মনোনয়নও মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের এই রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবস্থাকে (বিচারপতিদের হিসেবে ৬-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতা) পালটাতে পারল না। আর একদিকে যেমন এ্যামি কোনি ব্যারেটের সময় সাংবিধানিক সমস্ত ঐতিহ্যের প্রতি নিজের অবজ্ঞা প্রকাশ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, বিচারপতি ব্রাউনের মনোনয়নের সময় (যিনি ডিস্ট্রিক্ট জাজ হিসেবে নিজের মনোনয়ন প্রাপ্তির সময়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলেরই সমর্থন পেয়েছিলেন) সেনেট হিয়ারিং কমিটিতে তাঁর মনোনয়ন ১১-১১ ভোটে অনির্ধারিত থাকে। শেষ অবধি সেনেট ভোটিংয়ের মাধ্যমে ৫৩-৪৭ ব্যবধানে তিনি সুপ্রিম কোর্টে নির্বাচিত হন। রিপাবলিকান সেনেটরদের মধ্যে মিট রমনি, লিজা মুরকোয়স্কি, এবং সুসান কলিন্স পার্টি লাইন অমান্য করে বিচারপতি ব্রাউনকে সমর্থন করেন।

 

যতই উপরে ওঠা যাক না কেন, শেষ অবধি তাই আমাদের হাতে পড়ে থাকে রাজনৈতিক হানাহানি অথবা বিদ্বেষ-প্রেজুডিস-প্রত্যক্ষ-বা-পরোক্ষ-পুরুষতন্ত্রের পেনসিলটুকুই। যে কারণে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদেরকে দেখতে হয় প্রথম বিশ্বের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা, বিচারপতিরা আড়াআড়ি ভাবে দুইটি ভাগে ভেঙে গিয়েছেন। একদিকে বৈজ্ঞানিক গর্ভপাতের বিপক্ষে মানুষ, অন্যদিকে রয়েছেন প্রো-চয়েসের আন্দোলনকারীরা। বিজ্ঞান সেখানে বিচার্য বিষয় নয়। বিচারপতি এ্যামি কোনি ব্যারেটের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ উঠেছিল, তিনি নাকি রায়দানের সময় আইনের চেয়ে নিজের ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ২০০৮ সালে মনে করে দেখুন, ট্রাম্পের আগমনেরও আগে রিপাবলিকান উপ-রাষ্ট্রপতি পদের উমেদার হিসেবে উঠে এসেছিলেন সারা পলিন, প্রো-চয়েসের ক্ষেত্রে তাঁর বিরোধিতার তীব্রতায় অস্বস্তিতে পড়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন স্বয়ং। শ্বেতাঙ্গ জঙ্গিবাদ, ক্যাথলিক গুরুবাদ, বন্দুক আইন, একের পর এক বিষয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ অন্ধকারকে নিজে থেকেই বিশ্বের দরবারে বারংবার উন্মোচিত করে দিয়েছে সেই দেশ। ‘ল্যাণ্ড অব অপরচুনিটি’র পাশাপাশি সেদেশ তাই ‘ল্যাণ্ড অব ডার্কনেস’ও বটে। হাজার হোক, একবার হলেও তো তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সুযোগ দিয়েছিল রাষ্ট্রপতির আসনে বসার। এখনও সেদেশের সুপ্রিম কোর্টে ৬-৩ সংখ্যাধিক্যে আধিপত্য বজায় রেখেছে সংরক্ষণবাদী মানুষেরা। খুঁটিয়ে দেখতে গেলেই বেআব্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে সেদেশেরও উচ্চপদগুলিতে ক্ষমতাসীন মানুষদের নগ্ন স্বজনপোষণের ইতিহাস।

 

কিন্তু তবুও আমরা কেটাঞ্জির মনোনয়নকে উদযাপন করব। আমার বাড়ির সেই প্রৌঢ় মানুষটি, আমার পিতৃদেব স্বয়ং, আমাকে অনেকবারে বুঝিয়েছেন – সমাজ আসলে এক ইলেক্ট্রিকাল সার্কিটের মতোই, উইথ এ ভেরি হাই, এক্সট্রিমলি হাই টাইম কনস্ট্যান্ট! অর্থাৎ কিনা কোনও একটি বিষয়ে সমাজের তরফে সঠিক সাম্যে পৌঁছতে গেলে পরে অনেকখানি সময়ের প্রয়োজন, তারই মধ্যে আসতে থাকবে ওঠাপড়া অনেক। তারই মধ্যে এমন একেকটি পদক্ষেপেই আমরা এগিয়ে চলব সত্যিকারের আলোকিত ভবিষ্যতের অভিমুখে। মার্কিনি ইতিহাস আলো, অন্ধকার, পাঁক ও হীরকখণ্ডে পরিপূর্ণ। পৃথিবীর আর পাঁচটা দেশের ইতিহাসের মতোই। কেটাঞ্জি ব্রাউনেরা একেকজন আমাদেরকে আশার অভিমুখে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হন। তাঁর বা তাঁদের মতো একেকজনের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছাকেই তখন, আমরা উদযাপন করতে সচেষ্ট হই। মনে মনে বিশ্বাস অনুরণিত হয়, ‘উই শ্যাল ওভারকাম! সামডে ...’ আগামীর সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়!

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবিতে : কেটাঞ্জি ব্রাউন জ্যাকসন

0 Comments

Post Comment