সলিলা

  • 16 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 121 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
এইমাত্র পাঁচটা ষোলোর ভিড়ে ঠাসাঠাসি গেদে লোকাল সাইরেন দিয়ে আমার সামনে বেরিয়ে গেল আর আমি তখনও টিকিটের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিরক্ত হয়ে টিকিট কাউন্টারের ভিতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখে পড়লো বছর পঁয়তাল্লিশের সলিলাদিকে। তাঁর মুখ দেখে মনে হল এই ভিড়ের চাপ সামাল দিতে গিয়ে বেশ হিমসিম খাচ্ছেন। একটা লোককে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলতে শুনলাম, ‘কেন যে মহিলাদেরকে এই সব কাজে রাখে কে জানে? একটা সাধারণ জিনিস ঠিক করে করতে পারে না। যত্তসব।’

বিকেল পাঁচটার শিয়ালদহ স্টেশন। দম বন্ধ করা গরমে গিজ গিজ করছে অসংখ্য মানুষের কালো কালো মাথা।টিকিট কাউন্টারের লম্বা লাইনে পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার পক্ষে যেমন অস্বস্তিকর তেমনই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে কারণ এইমাত্র পাঁচটা ষোলোর ভিড়ে ঠাসাঠাসি গেদে লোকাল ইরেন দিয়ে আমার সামনে বেরিয়ে চলে গেল আর আমি তখনও টিকিটের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বিরক্ত হয়ে টিকিট কাউন্টারের ভিতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার  চেষ্টা করতে গিয়ে চোখে পড়লো বছর পঁয়তাল্লিশের সলিলাদিকে। সলিলাদি আমাদের পাড়াতেই থাকেন। বেশ মনোযোগ দিয়ে কাজ করলেও তাঁর মুখ দেখে মনে হল এই ভিড়ের চাপ সামাল দিতে গিয়ে বেশ হিমসিম খাচ্ছেন। আমার আশপাশের মানুষজনের মুখ থেকে বেশ কিছু চরম বিরক্তিসূচক আওয়াজ বেরিয়ে আসতে শুনতে পেলাম। আমার সামনের লম্বা লোকটি যার পরনে ছিল একটা ময়লা লুঙ্গি ও বাদামি শার্ট সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো, ‘পাশের লাইনটাতে দাঁড়ালেই ভালো হত, কত তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে।’ টিকিট কেটে দিতে দিতে সলিলাদির বোধহয় একটা গুরুত্বপূর্ণ ফোন এল যেটা এই মুহূর্তে না ধরলেই নয়। তিনি এক হাত ল্যাপটপের কীপ্যাডে রেখে তাঁর অন্য হাত দিয়ে কানে ফোনটা চেপে ধরে কথা বলতে লাগলেন। কথা বলতে গিয়ে সলিলাদি বোধহয় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কারোর গন্তব্য স্থানের নাম ভুল লিখে ফেলায় লোকটি চেঁচামেচি করে একেবারে গণ্ডগোল বাঁধিয়ে তুলল। তারপর সলিলাদি কান থেকে ফোনটা কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রেখে ভুল সংশোধন করে নিলেন। সেই লোকটিকে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলতে শুনলাম, ‘কেন যে মহিলাদেরকে এই সব কাজে রাখে কে জানে? একটা সাধারণ জিনিস ঠিক করে করতে পারে না। কাজের সময় ফোনে কথা বলেই যাচ্ছে, যত্তসব।’ আমার মনে হল ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়। কিন্তু মেয়েদের সামান্য  ভুলকে বেশি করে তুলে ধরে তাদের অযোগ্যতা প্রমাণ করার অকাট্য যুক্তি একবার হাতে পেলে আমাদের সমাজে পুরুষ ও মহিলা নির্বিশেষে তার সদব্যবহার করতে ছাড়েনা।সলিলাদির স্বামী বছর দুই আগে ঘরে একটি শিশু পুত্র ও নাবালিকা কন্যাকে তাদের অসহায় মায়ের কাছে রেখে দিয়ে মারা যান। নিজের কথা না ভাবলেও সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে কত কষ্ট করে যে সলিলাদি এই চাকরিটা যোগাড় করেছেন তা আমি কিছু কিছু জানি। তাঁর জীবনের কষ্টটা কিছুটা জানি বলেই কেবল নয় সলিলাদিকে দেখলেই মনের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা শ্রদ্ধা জন্ম নিতে বাধ্য। দেখলাম সলিলাদি আর সামাল দিতে না পেরে ফোনটা নিয়ে উঠে গিয়ে অন্য একটি লোককে ভিতর থেকে ডেকে তার চেয়ারে কিছুক্ষণ বসিয়ে উঠে গেলেন। লোকটি কিন্তু কোন কাজ না করে শুধু বসেই রইলো। লাইন থেকে বেশ কিছু মানুষ এবার হুংকার দিয়ে উঠলো, ‘কি হল ম্যাডাম, বাড়ির লোকের সঙ্গে পরে কথা বলবেন টিকিটটা আগে দিন।’ দেখলাম কিছু লোক পাশের কাউন্টারে এক ভদ্রলোককে টিকিট কেটে দিতে দেখে ‘ধুর’ বলে লাইনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে পিছনে গিয়ে পাশের লাইনটির একেবারে শেষ মাথায় জমা হল। আমার মনে হল অন্য লাইনগুলির চেয়ে এই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের অস্বস্তি যেন অনেক বেশি।সলিলাদি ফোন রেখে এসে আবার কাজে মন দিলেন। এই লাইনের লোকগুলির মুখভঙ্গি দেখে তাদের মনের কথা যেন নিজের মনের মধ্যে স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘নেগলেজেন্সির চূড়ান্ত। এই জন্য মহিলাদের কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে রাখাই উচিৎ নয়। শুধুমাত্র  এনার জন্য ট্রেনগুলো সব মিস হয়ে যাচ্ছে। ফোনে এত কিসের  দরকার কে জানে? এখানে মহিলার বদলে একটা লোক থাকলে কত দ্রুত কাজ করে দিতে  পারতো।’ আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেইদিন ব্যাঙ্কে কে ওয়াই সি ফর্ম জমা দেওয়ার সুদীর্ঘ লাইনের কথা। সেইদিন লাইনের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই দুর্ভোগ দেখে ভেবেছিলেন হয়ত সেই ম্যাডাম কাউন্টারে বসে আছেন যিনি অত্যন্ত চড়া মেকআপ করতে ভালোবাসেন। কিন্তু পরে দেখা গেল বছর তিরিশের এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ ফর্ম জমা নেওয়ার পর অকারণেই উঠে গিয়ে একবার বাইরে থেকে হাওয়া খেয়ে আসছেন তারপর আবার ফিরে এসে ফর্ম জমা নিচ্ছেন এবং আবার কিছু পরে দীর্ঘ লাইনের দিকে একবার কটাক্ষপাত করে ধুমপান করতে উঠে যাচ্ছেন। ব্যাঙ্কের সেই ম্যাডামকে অন্যত্র দেখতে পাওয়ার পর লাইনের পিছনে থাকা জনগনের রাগ এত ‘নেগলেজেন্সি’ সত্ত্বেও স্বাভাবিক ভাবে অনেকটা পড়ে যেতে দেখেছিলাম। এখন টিকিট কাউন্টারের একেবারে সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় গ্রামের মামার বাড়িতে থাকার সময় দেখেছিলাম একটা নদীকে। তপ্ত বালুরাশির ওপর দিয়ে একাকী বয়ে চলা নদীটার পরিসর গঙ্গার মত বিশাল নয়। তবু নিজের গতিপথে নিয়ত কুলকুল শব্দে ধীর লয়ে বয়ে যেত তার জলরাশি। নদীতে জোয়ার আসতো, ভাটাও পড়তো, কখনো প্রকৃতির রুদ্র তেজ সঞ্চারিত হয়ে তার দুই কুল ছাপিয়ে যেত। নদীর পাড়ে কত মানুষ কত আবর্জনা নদীর জলে ভাসিয়ে দিত। নদীটির প্রতি বাঁকে বাঁকে সেই জন্মলগ্ন থেকে ভেসে চলেছে কত আশীর্বাদ, কত অভিশাপ। তবুও তার ধারা কখনো শুকিয়ে যায়নি। অবিচলিত ভাবে তার অম্বুরাশি সার্থকতার সন্ধানে বাঁধনহারা সমুদ্রের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ছুটে চলেছে। শহরের এই ব্যস্ততম স্টেশনের টিকিট কাউন্টারে বসে কর্মরত সলিলাদিকে চূড়ান্ত কর্মব্যস্ততায় দেখে মনে হল ঠিক যেন সেই নাম না জানা নদীটার মত। যে যাই বলুক না কেন তিনি তাতে বিশেষ কান দেন না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment