শাপিতপুরুষ (সপ্তদশ কিস্তি)

  • 20 March, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 425 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
পূর্বকথা--সুমনের ভেতর হতে যে কান্নার ঢেকুর উঠছে তাতে মোবাইলে শাঁ শাঁ শব্দ হচ্ছে। নাক টেনেটেনে দম ফেলে ফেলে সুমন বলছে, অয়ন, তোর পায়ে ধরি, আমি তো আর বাঁচবো না। এক নজর দেখে যেতে চাই আমার বাবুকে। ওকে তুই হত্যা করিস না! ওকে নিয়ে আফ্রিকার জঙ্গলে, না হয় এমন দেশে চলে যাবো যে দেশে ওর পরিচয় জানবে না। ওকে কেউ ঘৃণা ছুঁড়বে না। এ কথাগুলো বলেই অসহায়ের মতো হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে সুমন।

[২৬]

শ্যামল ফিরছে, ভরা গর্ভ লুকাই কোথায় : চৈতি

শ্যামল ফিরছে মাত্র তিনদিন পরে। দিনে নিদেনপক্ষে দু-তিনবার কল করে। কী আশ্চর্য! মুখ ফসকেও বলেনি চৈতিকে যে বাড়ি আসবে। আজ ছেলেটার কাছে লুকাতে পারেনি। পেট ফেটে বেরিয়ে আসে। তারপরও এটা কি কম সারপ্রাইজ? তিন বছরান্তে বউয়ের মুখ দেখবে। আরও কত কী। তিনদিনে বউয়ের দেহের বিষের জ্বালার উথালিপাতালির স্কেল বাড়তে বাড়তে উঠবে চরমে। শ্যামলের চনমনে শরীরে আকুলি বিকুলিও তিনদিনে বাড়তে থাকুক। আহা কী মজা! কানাডার কুইবেকের নির্জন রুমে বিছানায় শুয়ে নিজের জিভ নিজেই একচোট চেটে নিল শ্যামল।

সুমনকে ধরার জন্যে বিকেল থেকে ননস্টপ মোবাইল টেপে চৈতি। প্রতিবার দুঃখিত বলে কেটে যায়। ভয়ে বরফ হয়ে আসছে শরীর। টানা দু মাস মিন্স বন্ধ। শ্যামল এসে শরীর ছুঁলেই টের পাবে ভেতরে বিষাক্ত কিছু ঢুকে আছে। বাসর রাতে জাঁদরেল প্যাথলজিস্টের মতো পরীক্ষা করে দেখেছে চৈতির শরীরের বিশেষ বিশেষ অঙ্গ। সতীচ্ছেদ হয়েছে কিনা? চৈতি সে রাতে বুক ফুলিয়ে গর্ব করে অস্বীকার করে বলেছে, এই প্রথম পুরুষ তুমি...। ভাগ্যিস বুকের ক্ষত চিহ্নটার উপরে চোখ পড়েনি বেহুঁশ শ্যামলের। তবে সে আটকে যেত। আজ আর সেই দম্ভ নেই চৈতির। দুমড়ে মুচড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সেই বিশ্বাস। দু’বার করে মাথায় ঢোকায় মৃত্যুচিন্তা। ছেলেটা তখনি চেঁচিয়ে ডেকে ওঠে, মা মা...

নির্ঘুম রাত কাটিয়ে চৈতি ডিসিশন নিল সুমনের মুখোমুখি হবে। বিকল্প কোন পথ নেই আর। এব্রশন করবে। কুষ্টিয়ায় তো সম্ভব নয়। ডাক্তার রাজি হবে না। পায়ে পায়ে চেনাজানা মানুষ, আত্মীয়-স্বজন, ঠিকই ধরা পড়বে। হাতে মাত্র দুই দিন। স্বাভাবিক হয়ে উঠব তো! বাথরুমে ঢুকে পড়ে তড়িঘড়ি করে। টেনে ছিঁড়ে কাপড় খুলে উপর হতে শরীরে পানির ঝর্ণা ছেড়ে দিল। উদোম শরীরে হাত চালায় এলোমেলো। তলপেটে হাত গেলেই সজোরে টিপে ধরে। যেন ভেতরে থাকা বিষাক্ত বীজ বের করে ফেলবে এখনি। ছেলে ওঠার আগেই পাশের বাসার মাসিকে অনুরোধ করে বেরিয়ে পড়ে। সকালের বিআরটিসি বাস ধরতে পেরেছে। সূর্য খোলস খুলে বেরিয়ে আসছে কেবল।

সকাল এগারোটার দিকে চৈতি বাস হতে নামল কাজলা গেটে। গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতেই ওর ভেতরটা কেমন ধক্ ধক্ করে উঠল। এই কয় বছরে-ই ক্যাম্পাসটা যথেষ্ট বদলে গেছে। বহ্নি, লিলি, শাহনাজ, রাশেদ, আকরাম, মাহবুব, ইবাদত, অখিল, মোহাম্মদ আলী ওরা সবাই এখন কে যে কোথায়? হায় রে জীবন! ক্যাম্পাসের মোহ-ই আমার জন্য কাল হল। নইলে ক্যাম্পাসে কত কিছুই তো ঘটে। কে মনে রাখে? যে যার মতো দেহ ঝেড়ে সব পাপ ক্যাম্পাসে কবর দিয়ে দিব্যি সতী সাধ্বীর অভিনয় করে স্বামীর সোহাগ নিচ্ছে। আমি কেন গোঁ ধরে থাকলাম? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে এবং অনুশোচনার নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে সুমনের রুমের সামনে দাঁড়ায় চৈতি।

চৈতিকে দেখে মধ্যবয়সী এক লোক এগিয়ে আসে বলে, আপনি সুমন স্যারের ইয়ে না?

লোকটার এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেল চৈতি।

স্যার তো এখন আসেন মাঝেমধ্যে। মাথার ডিস্টার্ব দেখা দিয়েছে কিনা। নিজে থেকেই বলে লোকটা।

চৈতি এবার চিনতে পারে। লোকটি সুমনের বিভাগের পিয়ন। সুমন কেথায় থাকে জিজ্ঞেস করলে খুঁটিয়ে পথনির্দেশনা দিল—রিকশা লইয়া সোজা যাইবেন বাজারের বড় মসজিদের সামনে। মসজিদের দক্ষিণ দিক দিয়া দেখবেন একখানা চিকন গলি। গলি ধরে সোজা খানিকটা গেলেই একটা ছোট্ট মন্দির। মন্দিরের সামনে দিয়া আর একখান রাস্তা সোজা নদীর দিকে গেছে। এই রাস্তা ধইরা হাঁটবেন কয়েক কদম। তারপরেই দেখবে একটা চারতালা বাড়ি। এই বাড়ির দো’তলার দক্ষিণের সাইডে থাকেন আমাদের সুমন স্যার।

সাত বছরের চেনা এ শহরটার বর্ণনা লোকটা যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দিল, চৈতির নিজের ভেতরে একটু কৌতুকবোধ হল। ভেতরের অসীম কান্না বুক ফেঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে, এত তুচ্ছ ঘটনায় সে হাসবে কী করে!

চৈতি বাসা খুঁজে পেল সহজেই। রাস্তা লাগোয়া বাসা। ছোট্ট একটা গেট। খোলাই আছে। দপদপ শব্দে পা ফেলে সোজা উঠে গেল দো’তলায়। দক্ষিণে মোড় নিতেই চোখে পড়ে, কাঠের দরজায় কম্পিউটার কম্পোজে লেখা—প্রফেসর সুমন গাঙ্গুলি।

টকটক করে দরজায় দু’টো টোকা দিল চৈতি। মানুষের কোন সাড়াশব্দ নেই। কলিংবেল টিপল। শব্দ হয় না। নষ্ট হতে পারে। ফের দরজা টোকাল। ফটাস করে দরজা খুলে গেল। কোমরে  গামছা পেঁচানো, উদোম একহারা শরীর নিয়ে দরজায় দাঁড়াল সুমন। ঘুমভাঙা দৈত্যের মতো ভয়ঙ্কর লাল চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চৈতিকে।

আঁতকে পেছনে ছিটকে আসে চৈতি, ও ভগবান! সুমন দা!

আস্তে সরে দাঁড়ায় সুমন। ভয়ে ভয়ে রুমে ঢোকে চৈতি। বিশ্রী গন্ধে নাক আটকে আসছে। গা রি রি করছে। তীব্র ঘৃণায় থুতু ছিটিয়েছে যে মানুষটারে, মুহূর্তের দমকা ঘূর্ণির মতো তার-ই জন্যে মায়ায় বুক ভরে উঠল চৈতির। উস্কোখুস্কো তামাটে রঙের চুল, অকামানো কুণ্ডলি পাকানো সাদাকালো দাড়ি, কঙ্কাল দেহ— কী বীভৎস যে দেখাচ্ছে মানুষটাকে! বড় বড় চোখ দুটি সুমনের আগের মতোই আছে। তবে চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুল্কি বের হচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই চৈতির  ভেতরে ত্রাস জাগে।

সামান্য দুরত্ব মেইনটেইন করে সুমনের পাশে বসে চৈতি। কাঁপা কাঁপা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, রিমা আপু নেই বাসায়? সুমন মুখ খুলে ‘না’ বলতেই একটা বিকট গন্ধ জোরে লাথি মারে চৈতির নাকে। হলুদ হলুদ দাঁত। কতদিন যে দাঁতে ব্রাশ ছোঁয়ায় না কে জানে! কোথায় গেছেন রিমা আপু?

সুমন অস্থির কণ্ঠে বলে, ঢাকা। আমাকে খুন করতে গিয়ে ফেইলর হয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে গেছে। এই দেখো ভাঙা টিভি। ও ভেঙেছে। এই দেখো চাকু। এমন গম্ভীর ও ভয়ার্ত কণ্ঠে স্বাক্ষ্য প্রমাণসহ বলছে যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে চৈতিকে ভাবতেই হয়, সতিই কি মানুষটা খুন হচ্ছে? বাস্তবেই কি রিমা খুনের ষড়যন্ত্র করছে?

পরিস্থিতি সহজ করতে চৈতি বলে, আপনি খান কী?

শুকনো পাউরুটি।

তার মানে? শুধু শুকনো পাউরুটি?

রিমা খাবারে বিষ-টিষ মিশেল করে রাখে, তাই আর কিছু খাই না। চৈতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, গলির মোড়ের এক আঙ্কেলের মুদিখানার দোকান আছে। শুকনো রুটি কিনে খাই। তাকে বেশি বেশি টাকা দেই যেন রিমা বিষ মেশালে গোপনে বলে আমাকে।

চৈতি এবার বুঝে ফেলেছে। এই মানুষটি আর মানুষের কাতারে নেই। কার কাছে সে সাহায্য চাইতে এসেছে! মানুষটা ঠিক খেয়াল করে চৈতির এত বড় সর্বনাশ করেনি। সুতরাং ভেতরে ভেতরে সুমনকে ক্ষমা করার জন্যে প্রস্তুত হয়।

দুম করে চৈতির হাত ধরে ফেলে সুমন, আমার একটা অনুরোধ রাখবে চৈতি? আমার একটা উপকার করবে?

চৈতি ফিক করে হেসে দিল, কে কার অনুরোধ রাখবে সুমনদা? কে কার উপকার করবে? আমার সামনে মরণ।

আমার বাবুকে নিয়ে তোমার এখানে ক’দিন পালিয়ে থাকব বলে ভেবে রেখেছি। তারপর সীমান্ত দিয়ে কলকাতা যাব প্রথমে। সেখান থেকে সোজা চলে যাব আফ্রিকার কোন দেশে। আমি অয়নকে কেঁদে কেঁদে বলেছি। দেখি কথা রাখে কি না। শালা শুয়োরের বাচ্চা লম্পটদের তো ধরম-মরম নেই। অন্যথায়, বলেই সোফার সিট কভারের নিচে থেকে ছোট্ট একটি পিস্তল বের করে চৈতির দিকে তাক করে বলে, এর মধ্যে পাঁচটা গুলি আছে। টুস টুস করে গুলি ঢুকিয়ে অয়ন হারামির ছেলের কলিজাটা শিককাবাব বানিয়ে ফেলব, বলেই কুতকুত করে হাসে সুমন।

চৈতির দম আটকে আসে ভয়ে। ওর পেটে যে সুমনের বীজ ক্রমেই ডালপালা গজাচ্ছে, এ কথা সাহস করে বলবার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছে পিস্তল দেখে। সুমনের হাবভাব ও ত্রাস-জাগানো বিদঘুটে চেহারা দেখে চৈতির ভেতরে ভয়ানক কাঁপন ওঠে। শরীর ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে ভয়ে। পালাতে পারলে বাঁচে।

সহসাই সুমন রূপ পাল্টে ফেলল। এখন শান্ত-সৌম্য। তৃষ্ণার্ত ও লোভাতুর চোখের দিকে এক নজর তাকাল চৈতি। এবার অন্তরাত্মায় শুরু হয়ে গেল আট মাত্রার ভূমিকম্প। গলা শুকিয়ে কাঠ। কণ্ঠনালীতে গিঁট পড়ছে। সুমনের লম্বা কাঠ শরীরের পেশীতে পেশীতে ক্ষুধার ভয়ানক উত্তাল ঢেউ। চৈতির বুঝতে বাকি নেই আর বসলে কী ঘটতে পারে।

আজ উঠি সুমনদা, পালাতে উদ্ধত হল চৈতি। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঝট করে দাঁড়িয়ে এক পা এগোতেই খপ্ করে চৈতির হাত টেনে ধরে সুমন। চোখের পলকে আছড়ে ফেলে দিল সোফায়।

টানা প্রায় আধা ঘণ্টা ভয়ানক হিংস্র রমণে পিষ্ট চৈতি ছিটকে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়াল তখন টের পেল বুকের মাংসের স্তুপের উপরের অংশ প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছে হায়েনা। তীব্র টাটানি নাভির নিচেও।

বাসায় পৌঁছার পরে চৈতির বুকের টাটানি আরও বেড়ে গেল।

ছেলে আপন মনে সাপ-লুডু খেলছে। মা ঘরে ঢুকেছে সেদিকে খেয়াল নেই।

[চলবে...]

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক (নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ) 

0 Comments

Post Comment