- 21 May, 2022
- 0 Comment(s)
- 365 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার এক বন্ধু সেদিন কথায় কথায় বলে উঠেছিল, “একটা মজার জিনিস কি লক্ষ্য করেছিস? সাদা চামড়ার ইয়োরোপে যখনই হানাহানি শুরু হলো, তখনই সেটা হয়ে গেল ‘ওয়ার’ অথবা যুদ্ধ। অথচ অন্যদিকে গোটা পৃথিবী জুড়েই যে সমস্ত দীর্ঘমেয়াদী হানাহানির খবর আমরা প্রত্যহই পেয়ে থাকি, সেগুলির মধ্যে একটিকেও কিন্তু আমরা ‘ওয়ার’ বলে চিহ্নিত করি না। সেগুলি হলো আমাদের কাছে ‘কনফ্লিক্ট’, অর্থাৎ কিনা সংঘাত মাত্র। যেমন কিনা ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যকার বিষয়টা ...” কথাগুলোকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হলো। এমন ভাবে তো সত্যিই ভেবে দেখিনি কোনোদিন। হানাহানির বীভৎসতাও কি তবে জাতি-ধর্ম-ভৌগোলিক-অবস্থান, ইত্যাদির উপরে নির্ভরশীল? আজ আমরা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মধ্যকার যে সংঘাত, তার একেবারেই সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উপরে নজর রাখতে চলেছি। আমরা এখানে শিরিন আবু আলেখের বিষয়ে আলোচনা করব।
শিরিন জন্মসূত্রে প্যালেস্তিনীয়-আমেরিকান। কর্মসূত্রে সাংবাদিক। কাতারের আল-জাজিরা সংবাদগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি যুক্ত ছিলেন। ছিলেন, কারণ গত ১১ই মে, ২০২২ ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যবর্তী বিতর্কিত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক অঞ্চলে জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরে সংবাদ সংগ্রহের সময় অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ীর গুলিতে তিনি নিহত হন। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের রিপোর্টে শিরিন সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করে, “প্যালেস্তাইন ও আরব দুনিয়াতে তিনি কার্যত প্রত্যেক পরিবারের কাছেই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন।” আরব দুনিয়াতে সাংবাদিকতা এবং বিশেষত যুদ্ধ-সাংবাদিকতার মতো একটি ক্ষেত্রে মেয়ে হিসেবে তাঁর উঠে আসা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় একটি ঘটনা। এই অঞ্চলে, পরবর্তী প্রজন্মের আরও অজস্র মেয়েরাই শিরিনের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই পেশাকে তাঁদের জীবিকা হিসেবে বেছে নিতে আগ্রহী হয়েছে। শিরিনের হত্যা-প্রসঙ্গে দু’এক কথা নিশ্চয়ই বলতে চাইব, কিন্তু তারও পূর্বে শিরিনের শিরিন হয়ে ওঠার বিষয়ে দু’চার কথা বলা উচিত।
৩রা জানুয়ারি, ১৯৭১, জেরুজালেম শহরে শিরিন আবু আলেখের জন্ম হয়। তাঁর মায়ের দিককার আত্মীয়স্বজনেরা নিউ জার্সির বাসিন্দা হওয়ার কারণে তিনি বেশ কিছুকাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটান এবং সেদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন। জর্ডনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচার নিয়ে পড়াশোনা করলেও, শেষ অবধি কেরিয়রের প্রশ্নে সেই বিষয়টিকে নিজের জীবিকা হিসেবে বেছে নিতে তিনি অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে জর্ডনেরই ইয়ারম্যোউক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সাংবাদিকতার পাঠ নেন, এবং সাংবাদিক হিসেবে প্যালেস্তাইনে ফিরে আসেন।
।। “আমি সাংবাদিকতাকে নিজের জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছি কারণ, এর ফলে আমি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পারি। বাস্তবকে এক লহমার ভিতরে পালটে দেওয়া চলে না, কিন্তু - অন্ততপক্ষে আমি সেই মানুষদের অভিজ্ঞতাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরতে পারি” – শিরিন আবু আলেখ, আল-জাজিরাকে দেওয়া এক পুরনো সাক্ষাৎকার থেকে উদ্ধৃত ।।
১৯৯৭ সাল থেকে তিনি আল-জাজিরা সংবাদগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হন, এবং এও উল্লেখ্য যে ফিল্ড-জার্নালিজমের ক্ষেত্রে আল-জাজিরা সংবাদগোষ্ঠীর অন্যতম প্রথম ও প্রধান রিক্রুট ছিলেন এই শিরিন আবু আলেখ - মেয়ে হিসেবে যে অধিকার অর্জন এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই পেশাটিকেই বেছে নেওয়া, পশ্চিম এশিয়ার আরব দুনিয়াতে দাঁড়িয়ে, আজ – এই একবিংশ শতাব্দীতেও সে কাজ খুব সহজ নয় বোধহয়।
এর পরবর্তীতে তিনি পূর্ব জেরুজালেমে বসবাস শুরু করেন এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে সাংবাদিক হিসেবে নথিবদ্ধ করার সুযোগ পান। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’র সময়ে তিনি সংঘাত-দীর্ণ এলাকা থেকে সাংবাদিক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে জেনিনের সংঘাত, এবং তার পরবর্তীতে গাজা স্ট্রিপের উপর ইজরায়েলি সেনার একাধিক হামলার ঘটনাকে তিনি সাংবাদিক হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। ২০০৫ সালে প্রথম আরব সাংবাদিক হিসেবে তিনি ইজরায়েলের কুখ্যাত শিকমা জেল পরিদর্শন করেন এবং সেখানকার দীর্ঘমেয়াদী প্যালেস্তিনীয় বন্দীদের সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করেন। ক্ষমতাসীন, আগ্রাসী ইজরায়েলি নেতাদের ক্ষেত্রে আলেখের অস্তিত্ব তাই কখনই স্বস্তিদায়ক এক অনুভূতি ছিল না। অনেক দিন ধরেই ইজরায়েলি সেনা ও আধিকারিকদের তরফে শিরিনের বিপদের আশঙ্কা ক্রমেই পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। সাম্প্রতিক মে’মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অভূতপূর্ব এক পরিস্থিতিতে শিরিনের মৃত্যু, এবং তার পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনা, এই মৃত্যুকে নিয়ে কলম ধরতে আমাদেরকে বাধ্য করেছে।
শিরিন-হত্যার পর, যে গুলির খোলটিকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি যে বিশেষ এ্যাসল্ট রাইফেলের দুটি মডেলে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, ইজরায়েলি সেনা এবং প্যালেস্তিনীয় বিক্ষুব্ধদের দুইপক্ষের কাছেই সেই অস্ত্রের যোগান রয়েছে। ইজরায়েলি সেনার তরফে প্রথমেই বিবৃতি দেওয়া হয়, প্যালেস্তিনীয় জঙ্গিদের ছোঁড়া গুলিতেই শিরিনের মৃত্যু হয়েছে। এর সপক্ষে তারা একটি ভিডিওচিত্রও প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যাচ্ছে একটি বাড়ির ছাদ থেকে বেশ কিছু ‘প্যালেস্তিনীয় জঙ্গি’ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে। তারা দাবি করে, এই ভিডিওটি জেনিনের উদ্বাস্তু শিবিরের যে অংশ থেকে তোলা হয়েছে, মৃত্যুর সময় শিরিন সেই অংশেই অবস্থান করছিলেন। অন্যদিকে প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ও স্থানীয় আরেক সংবাদপত্রের বয়ান অনুযায়ী শিরিনের অবস্থানের সময় জেনিনের সেই অংশটিতে সামান্যতম কোনও উত্তেজনার ঘটনা ঘটেনি। যে ছাদটিকে ভিডিওচিত্রে দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে শিরিনের অবস্থান অনেকটাই দূরে ছিল, এবং তারও মাঝে বেশ কিছু বাড়ি ও দেওয়ালের বাধা ছিল। সেক্ষেত্রে মাথায় হেলমেট ও গায়ে প্রেস জ্যাকেট পরে থাকা শিরিনের ঠিক কানের নীচ দিয়ে গুলি করা কিভাবে সম্ভব হলো, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই সন্দেহ করছেন শিরিন হত্যার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কোনও স্নাইপার যোদ্ধাকেই ব্যবহার করা হয়েছিল, আর সেক্ষেত্রেও সন্দেহের আঙুল উঠছে ইজরায়েলি বাহিনীর দিকেই। ইজরায়েলি সেনা শেষ অবধি আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে শিরিন-হত্যার দায় ‘অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী’দের ঘাড়ে চাপাতে বাধ্য হয়। যদিও কোনও ধরনের অপরাধমূলক তদন্তের বিষয়ে তারা একেবারেই আগ্রহী নয় বলেও ইজরায়েলি কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। বীভৎসার তখনও বাকি ছিল বোধহয়।
দুইদিন পর বাসস্থান জেরুজালেমে শিরিনের মরদেহ নিয়ে শেষযাত্রা বের হলে পরে কাতারে কাতারে মানুষ সেই শোকমিছিলে পা মেলায়। পূর্ব জেরুজালেমের সেন্ট জোসেফ হাসপাতাল চত্বর থেকে এই শেষযাত্রা শুরু হয়। শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইজরায়েলি পুলিশ ও সেনাবাহিনী নির্বিচারে হাসপাতাল চত্বরের অভ্যন্তরেই শোকমিছিলের উপর লাঠিচার্জ শুরু করে। কাঁদানে গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার করে শোকমিছিলে আসা মানুষদের ছত্রভঙ্গ করতে চেষ্টা করা হয়। পুলিশের লাঠির হাত থেকে শিরিনের কফিনবাহকেরাও রক্ষা পাননি। প্রচারিত একাধিক ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, পুলিশের লাঠির ঘায়ে একসময় কফিনবাহকদের কাঁধ থেকে শিরিনের কফিনবন্দি দেহটিও প্রায় খসে মাটিতে পড়তে যাচ্ছিল। পুলিশ তারপরেও লাঠিচার্জ বন্ধ করেনি। এভাবেই কোনওমতে শিরিনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সাংবাদিক হত্যা এবং তারপরেও শোকমিছিলের উপর এভাবে নির্লজ্জ পুলিশি আক্রমণ সারা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেয়। শিরিনের বাড়িতেও ইজরায়েলি পুলিশ তল্লাশি অভিযান চালায়, এবং ব্যক্তিগত বহু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে।
জন্ম ও মৃত্যুতে শিরিন যে দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন, আমরা কেবল তাকে লিপিবদ্ধ রাখতে চেয়েছি। এই পৃথিবীতে প্রত্যেক সংঘাতের মুহূর্তে, প্রত্যেক সন্ত্রাসের মুহূর্তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইনকে মনে মনে উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে হয়, “কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে! এখানে সবাই মানুষ ...” ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন, যে দীর্ঘমেয়াদী ‘সংঘাত’, অনাদি-অনন্ত এক বীভৎসার যাত্রাপথ। এর শেষ কোথায়, আমরা জানি না। কেবল শিরিনেরা একেকজন অকালেই হারিয়ে যান।
আমরাও তখন কেবল মোমবাতি হাতে নিয়েই, বেঁচে থাকতে চেষ্টা করি ...
0 Comments
Post Comment