- 29 August, 2023
- 0 Comment(s)
- 905 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আনোয়ার
বুকের ভেতরে কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়ে থাকা আত্মঘাতী সাপটি এভাবে দিনের আলোয় বেরিয়ে আসবে এবং মানুষের মধ্যে চলাফেরা করে বেড়াবে, একথা ভাবেনি লাইলি। সাপটির ঘুম স্বেচ্ছায় ভাঙেনি এবং বের হয়েও আসেনি। বুকের ভেতর থেকে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে বের করে বাইরে এনে তবেই ছাড়ল মজিদা ভাবি! আধা-বুড়ি মেয়েমানুষ, ছেলে-মেয়ে বিয়ের যোগ্য, সে কী লোভে কী লাভে এসব কথা শোনে, লাইলির কাছে রহস্য। ছয় মাস নয় মাস গিয়ে বছর ঠেকল, কিন্তু লাইলি ধৈর্যহারা হয়নি। মুখ ফুটে বলেনি, কিন্তু মায়ের চোখ ঠিকই ধরে ফেলে— ঠোঁট সেলাই কইর্যা নে, খুব শক্ত কইর্যা সেলাই কইর্যা নে, নইলে তুই মরবি রাক্ষুসি! গরিব মাইনসের মাইয়া তুই, এসব সুখের অসুখ থাকতে অয় না। ঘর পাইছস্, পেট ভইর্যা ভাত পাইছস্, পরনের নতুন কাপড়, যেমন-ই হোক মিনসে তো। এ মিনসেটার পায়ের নিচেই তোর সুখ-সংসার।
মা’র আরও কিছু পরামর্শ, সতর্ক চোখ এবং মুহুর্মুহু সতর্কবাণীর কারণে লাইলি মোটামুটি মেনেই নিয়েছে, ক্ষিধেটা না হয় মিটেই না, রক্তখেকো সাপটা না হয় বেশিই ফোঁস ফোঁস করে, তবু ঘর-বর-সংসার তো একটা জুটেছে কপালে। বিছানাটাই না হয় অসুখের, দীর্ঘশ্বাসের হয়ে রইল। ভেতরের ঝড় আর কে দেখে, বাইরে তো সুখ উছলে পড়ছে।
রক্তখেকো সাপটি জেগে ওঠে মাথা নাড়ায় কেবল; স্ফীত বুক টগবগ করে ফুটে উঠে কেবল; কঠিন নির্মম ছোবলের অপেক্ষায় লাইলির সমস্ত শরীরে ভয়ঙ্কর খিঁচুনি ওঠে, তপ্ত রক্ত তখন সুনামির মতো ভয়ঙ্কর তোড়ে বহে; ঠিক সেই মুহূর্তে হাঁপিয়ে দাবড়িয়ে অসময়ে উরুতে শীতল বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ইস্ত্রি করা শার্টের ভাঁজ খুলে ব্যবহার না করেই এলোমেলো করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো লাইলিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রণেভঙ্গ দিয়ে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে লাশের মতো পড়ে থাকে জয়নাল। সামান্য দূরত্বে বালিশ কামড়ে ধরে সাপে কামড়ানো মানুষের মতো বিষাক্ত শরীর নিয়ে ছটফট করে লাইলি। ওর মুখে শক্ত সেলাই, মুখ হা করে লাভ নেই। মিনসেটা জানলেই বরং সর্বনাশ। পাঁচকান হলে আরও ভয়ানক সর্বনাশ। মেয়েমানুষের এই সুখের অসুখের ওষুধ বড় বিষাক্ত।
লাইলির অসুখ ঠিকই ধরে ফেলে মজিদা ভাবি। বাড়ির উঠোনটাই আলাদা, কিন্তু পূর্বমুখী-পশ্চিমমুখী দুইটা ঘর প্রায় পেটে পেটে লাগানো। জোরে নিশ্বাস ফেললেও শোনা যায়। লাইলি তাই সর্বদাই সতর্ক, এভাবে ঘর বাঁধে নাকি? মন খুলে কথা বলার উপায় নেই। প্রথম দিকে দাবি তুলেছিল, ঘরটা দক্ষিণে না হয় উত্তরের দিকে নিলে হয় না? জয়নাল পাত্তা দেয়নি। গাঁওগ্রামে এসব কিছুই না, বাপ-ছেলে একঘরে বউ লইয়া শোয়। আমাদের আলাদা ঘর। বাপ-চাচারা বাইন্ধ্যা গেছে, এই ঘর নড়াই কী কইর্যা? লাইলি বলেছিল, তারপরেও ব্যাপারটা কেমন হয়? জয়নাল প্রত্যাখ্যানই করে, স্বামী-স্ত্রীর কথা শোনার লাইগা কে কান পাতবো, মানুষের আর কাম নাই?
এরপরে লাইলি আর কিছুই বলেনি। কিন্তু মজিদা ভাবিকে ঠেকায় কী করে? কী সব প্রশ্ন করে, সোজাসুজি উত্তর দিলেই বিপদ, ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে কথা বলার স্বভাব লাইলির ধাতেই নেই। তাই, নানান কাজের ব্যস্ততার ছুঁতোয় প্রথমদিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে যায়, মানুষটা বরং বন্ধুই হতে চায়। বয়সের দূরত্ব অনেক, কিন্তু সম্পর্কে স্বামীর চাচাত ভাবি, তাই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বেশ পাকাপোক্তভাবেই গড়ে ওঠে। তবু লাইলি সতর্ক, ওর সুখের অসুখ নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না। নাছোড় মাছির মতো মজিদা ভাবি ঘুরেফিরে একই দিকে নৌকা ঠেলে, কি লা, রাতে ঘুমাসনি, মেলা রাইত পর্যন্ত হুনলাম ফিসফাস? লাইলি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে, রাইত নয়টায় ঘুমাইছি, আর উঠছি ফজরের আজান হুইনা, ফিসফাস হুনলা কইত্তে? তোমার কানের অসুখ অইছে, রুক্কির মার মলম লাগাও। এভাবেই হাসি-তামাশা দিয়ে উতরে যায় লাইলি। জয়নালকে একা নির্জন পেলেই ঘুরেফিরে ওই একই কথা, কি রে, তোর বউ কেমন? খুশিনি তুই? জয়নাল মুচকি হাসে, অর্থাৎ সন্তুষ্ট। লাইলির সুখের অসুখ তখন কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে আসে।
বিয়ের বছর পূর্তির দিন। লাইলির মনে পড়তেই বিষাদ-আনন্দে ভরে ওঠে মন। জয়নাল প্রত্যুষে উঠেই হাটে চলে গিয়েছে। মুদিখানার ছোট্ট একটা দোকান আছে। কোনোদিন দুপুরে বাড়ি আসে, কোনোদিন আসে না, রাতে ফেরে। লাইলির বিছানা ছাড়ার আলস্য তখনও কাটেনি, মজিদা ভাবি ঘরে ঢুকে, কি লা, কি করছিস? গাঁয়ে-গতরে ব্যথা নাকি? বলেই মুখ টিপে হাসে। লাইলির কী হলো কে জানে! বেশ উষ্ণকণ্ঠেই বলে, গাঁয়ে-গতরে ব্যথা না, ছাই! লখিন্দরের বাসরঘরের ছিদ্রের মতো লাইলির উষ্ণতার মধ্যে সামান্য ছিদ্র পেয়ে সেখান দিয়ে কথার ছুরি ঢুকিয়ে দেয় মজিদা ভাবি, তাই লা, একদিনও তোর কান্দন শুনলাম না! মাইয়া মানুষ না কাঁনলে সুখ আছে নাকি?
লাইলির কী মতিভ্রম হলো! হঠাৎ ফণা তোলা সাপের মতো ফোঁস করে ওঠে, হুঁ! কান্দন! মিনসেটা চড়ুই পাখির জাত। মাজাভাঙা কুত্তার লাহান কুঁই কুঁই করে আর চড়ুই পাখির লাহান উঠে আর নামে। অমন কোমরভাঙা মিনসের সাথে ঘর করার চেয়ে বিধবা থাকাই ভালো।
মজিদা ভাবি ক্ষিপ্রগতিতে হাত চালিয়ে মুখ চেপে ধরে লাইলির, হারামজাদি কী বলিস এসব! তোর কি মাথা নষ্ট অইয়া গেল? কিন্তু সর্বনাশ ঠেকাতে পারেনি। দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছিল মুখরা রমণী মর্জিনা। লাইলির কথাগুলো স্পষ্টই শুনে এবং শুনেই চম্পট।
এক কান থেকে দুই কান, দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এভাবে রেললাইনের মতো কখনো সোজা হয়ে কখনো এঁকেবেঁকে বড়োজোর দুপুর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গ্রামের সব নারীর কানে খবরটি পৌঁছায়। অতঃপর বিকেলেই দু-একজন পুরুষ মানুষের কানে পৌঁছায় এবং রাতে গ্রামের নারী-পুরুষ সকলেই জেনে যায়, জয়নালের বউয়ের সুখের অসুখ এবং এ অসুখের দাওয়ায় জয়নাল দিতে পারছে না।
ভয়ানক আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে দিন কাটে লাইলির। ঘুরেফিরে মজিদা ভাবির কাছে গিয়ে কাঁদে। মায়ের মতো নিরাপত্তা ও সান্ত¦না দেয়, ভয় করিস না, আমি দেখছি। দু-বার করে মর্জিনার বাড়ি গিয়েও পায়নি। এরমধ্যেই খবরটা পৌঁছে গেছে কানে কানে, মজিদা ভাবি লাইলির কাছে লুকিয়ে যায়।
জয়নালের বাড়ি ফিরতে রাত নয়টা বাজে। খেয়েই শুয়ে পড়ে এবং নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু লাইলির চোখ দুটি অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগা। খুনের আসামীর মতো ভয় নিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। কী কুক্ষণে যে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাগুলো? একবার ভাবে, মানুষটাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। নারীজন্মে ঘোরতর এই অপরাধের ক্ষমা নাই যদিও, তারপরেও মানুষটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে লাইলি হাতজোড় করে নিজের অজান্তেই, আমি তোমার পায়ে পড়ি, আমি ভুল করেছি, তুমি আমার স্বামী, তুমিই আমার দেবতা, তোমার পায়ের নিচেই আমার স্বর্গ-নরক, তোমার পায়ের নিচেই আমার সুখ-সংসার, আমার বাঁচা-মরার মালিক তুমিই, আমি পাপিষ্ঠা আমি লোভী, আমি মুখ ফুটে নিজের অপূর্ণ কামনা-বাসনার কথা বলে ফেলেছি, আমি অবলা নারী, তুমি শক্তিমান পুরুষ, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। জয়নালের বিকট নাক ডাকার শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে প্রার্থনারত লাইলির বুক।
বাইরে ভরা পূর্ণিমা। কাঠের খোলা জানালা দিয়ে আস্তো চাঁদটাই যেন ঢুকে পড়েছে লাইলির ঘরে। চাঁদের আলো গিয়ে পড়েছে লাশের মতো টান হয়ে শুয়ে থাকা জয়নালের কালো মুখের উপরে। দক্ষিণের দমকা হাওয়া জানালা দিয়ে ঢুকে লাইলির শরীর শীতল করে দেবার পরিবর্তে আরও ভয়ার্ত করে তোলে। কাত হয়ে শুয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে জয়নালের মুখের দিকে। শিশুর খাতায় আঁকাআঁকির মতো অসংখ্য প্যাঁচানো জটিল দাগে ভর্তি জয়নালের মুখমণ্ডল। বিড়িখাওয়া কালচে ঠোঁট দুটি নড়ছে টিকটিকির লেজের মতো। আয়তকার বুকে দূর্বাঘাসের মতো ঘন লোমে ভর্তি, বাতাসে কাঁপছে তির তির করে। নাভিমূলের নিচে লুঙ্গির গিঁট খোলা, নিচের দিকে হাঁটুর উপরে উঠে এসেছে লুঙ্গি। সেখানেও চোখ যায় লাইলির। মনে হয় লেপামোছা। হাত-পায়ের থাবা, একহারা কোমর, প্রশস্ত বুক, প্রশস্ত কাঁধ, উঁচা সিনা, চওড়া কপাল, মাথায় চুলের অরণ্য দৈহিক গঠনে পরিপূর্ণ নিঁখুত, এক নজরেই যে কেউ বলবে সুস্থ সবল শক্তিমান সুপুরুষ, চামড়া রং-ই শুধু মহিষের মতো কালো। লাইলির ভেবে পায় না, এই মানুষটার শরীরের তুলনায় জিনিসটা এতো ক্ষুদ্রাকৃতির কেন? দড়ির মতো নড়বড়ে কেন? শরীরে শক্তির তো অভাব নেই। ঝড়ে ভেঙে পড়া আমগাছ একাই টেনে খাড়া করে ফেলেছিল। এতো শক্তি যার শরীরে, তার দম ফুরিয়ে আসে কেন কিছু বুঝে উঠার আগেই? নাকি পুরুষ মানুষ এমনিই হয়—আমিই রাক্ষুসী, আমারই ক্ষিধেটা বেশি। স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লাইলির চিন্তা এই পর্যন্ত এসে দাড়ি পড়ে। সাথে সাথে বুকের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসে কাতর প্রার্থনা, আল্লাহ, তুমি আমার শরীরে ভিতরের কামনার সাপটারে গলা টিইপা মাইরা ফেলো, গরিব মাইনসের মাইয়া আমি, এই সাপের ছোবল আমি আর সহ্য করতে পারি না।
লাইলির স্মৃতিতে জেগে ওঠে ভয়ঙ্কর এক রাতের গল্প। বয়স তখন নয় বা দশ। খালার বাড়িতে মোটে দুটিই ঘর। একটা ঘরে থাকে খালা আর একটা ঘরে থাকে সদ্য বিয়ে হওয়া খালাত বোন দিলরুবা। লাইলি যেদিন গেল ঠিক সেদিনই দিলরুবার স্বামী হাজির। লাইলি ছোট্ট মানুষ, তাই মাটিতে বিছানা করে দিল। উপরে চৌকিতে দিলরুবা আর স্বামী। কালো খাটো ভগ্ন স্বাস্থ্যের স্বামীটাকে দিলরুবার মোটাতাজা শরীরের কাছে মনে হল রাখালের মতো। লাইলির মোটেই পছন্দ হয়নি বলে দুলা ভাই ডাকেনি।
ওই তুই ঘুমা, বলে দিলরুবা ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়েই পড়েছিল লাইলি। চাপাকণ্ঠের ফিসফিসানি কানে প্রবেশ করলে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারের মধ্যে চোখ মেলে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দিলরুবা বুবু চিৎকার দিয়ে উঠলে, লাইলিও চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠে, ও বুবু, তোমারে মাইরা ফেললো, ও খালা...। মুহূর্তের মধ্যে চৌকি থেকে লাফিয়ে নেমে লাইলির মুখ চেপে ধরে দিলরুবা। এরপরে লাইলি চুপসে গিয়েছিল। ঘুমাইনি সারারাত। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে দিলরুবা চাপা কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠে, কখনও গোঙিয়ে ওঠে, কখনও হাসে, আবার কখনও কাঁদে, হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করে, গলাকাটা পাখির মতো হাত-পা আছড়ে ছটফট করে, চৌকি নড়ে রেলগাড়ির মতো। একেকবার লাইলির মনে হয়, বুবুটাকে মেরেই ফেলবে কি না?
সকালে লাইলির চোখ ছানাবড়া, রাতভর কেঁদে কেঁদে প্রাণ যায় যায যে বুবুটার, সেই বুবুর চোখে-মুখে কী খুশি! যে জল্লাদটা রাতভর সাজা দিল, তাকে খাওয়ানোর জন্যেই তোড়জোড়! এই রাত থেকেই পুরুষ মানুষ চিনেছে লাইলি। পুরুষ মানুষ এমনি হয়, রাতভর মেয়েমানুষকে কাঁদায়। এমন একটা ভয়ঙ্কর রাত নিজের জীবনেও আসবে, চিৎকার করতে হবে, কাঁদতে হবে, হাসতে হবে, গোঙাতে হবে, হাতে-পায়ে ধরতে হবে, হাত-পা ছুঁড়তে হবে গলা কাটার জন্যে মাটিতে শুইয়ে ফেলা গরুর মতো, এই ভয় তাড়া করে ফিরেছিল লাইলিকে। প্রাণটাই বের হয়ে যায় কি না কে জানে। এই রাতকে মোকাবেলা করার জন্যে মনে মনে কত রকমেরই না প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে রেখেছে। সুস্থ সবল জোয়ান ছেলে দেখলেই ঐ রাতের কল্পনা করে বুকটা ধক করে ওঠে, হায় আল্লাহ, এ না জানি কি ভয়ঙ্কর জল্লাদ!
বিয়ের দিনের আগে পর্যন্ত জয়নালকে দেখেনি লাইলি। বিয়ের সাজে একসাথে বসানোর পরেই ঘোমটার আড়াল থেকে এক নজরে দেখেছিল এবং দেখেই বুকে ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায়, অজ্ঞান হলেই বাঁচা। গা ঘেসে বসে আছে ছোটখাটো একটা মহিষ, পেশিতে শক্তি যেন ফুটবল খেলে বেড়াচ্ছে। সেই রাতের স্মৃতি এবং পরবর্তী জমা আরও কিছু নির্মম স্মৃতি হাতড়ে লাইলি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, আজ রাতই বোধহয় আমার জীবনের শেষ রাত! এই মানুষটার শরীরে যা শক্তি, হাড়-হাড্ডিসহ এক লুকমায় গিলে ফেলবে। কাঁদবার সময়ই দেবে না, এর আগেই মরণ!
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে লাইলির স্বামীর ভিটায় পৌঁছায় রাত প্রায় ১১ টায়। শ্বশুর বাড়ির আনুষ্ঠানিকতা ১ ঘণ্টার মধ্যেই সম্পূর্ণ করে তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। লাইলি পূর্বের সব প্রস্তুতি ভুলে গেল, গলা শুকিয়ে কাঠ, হাত-পা কাঁপছে ভয়ঙ্কর ভাবে, নিশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে, ও যেন মৃত্যুদণ্ডের আসামি, ফাঁসি কার্যকর হবে এখনি, জল্লাদ উপস্থিত সামনে। কোন কথা না বলেই জয়নাল বাতিটা নিভিয়ে দিলে লাইলির ভয়ার্ত শরীর দখলে নেয় নিবিড় অন্ধকার। এই এক প্রকার স্বস্তি, অন্ধকারের মধ্যেই মরণ ভালো। মরলে তো অন্ধকারেই যেতে হয়।
লাইলি ভেবেছিল, উদ্ধত হওয়ার আগে মানুষটা অন্তত দু-চারটা কথা তো বলবেই, কিন্তু না, চৌকির উপরে উঠেই লাশের মতো টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। কিছু কিছু পুরুষ লাজুক হয়, বিশেষত, যে পুরুষরা বিয়ের আগে মেয়েমানুষ চেখে দেখেনি, তারা বাসর রাতে মেয়েমানুষকে ভয় পায়, আসন্ন পরাজয়ের ভয়। বাসর রাতে পরাজয় অর্থাৎ সারা জীবনের লজ্জা। জয়নালের আশ্বর্য নীরবতা দেখে লাইলির ভয়ার্ত মন আনন্দে নেচে ওঠে, যা হোক, মানুষটা আনকোরা, এই প্রথম। কোনমতে প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতে পারলে নিজের মতো তৈরি করে নেওয়া যাবে। তারপর দেখা যাবে কে জিতে কে হারে? বড়জোর বিশ কি পঁচিশ মিনিট পরেই, লাইলির সমস্ত ভয়কে আশ্বস্ত করে নিস্তব্ধতা ভেঙে রাখালের বাঁশিতে ফুঁ দেবার মতো সুরে ডেকে ওঠে জয়নালের নাক। বিছানা থেকে ধড়ফড়িয়ে ওঠে কপালে হাত দিয়ে বসে লাইলি, এ কী কাণ্ড!
উল্টাপাল্টা কিছুই ভাবেনি লাইলি। ক্লান্তির ধকল সহ্য হয়নি, তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই রাত তো শেষ রাত নয়, সারা জীবনে কত হাজারটা রাত আসবে, মানুষটা প্রাণভরে ঘুমাক্। লাইলি নিজে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। মসজিদে আজান পড়ছে, লাইলির চোখে ঘুম লেগেছে কেবলি, ঠিক তখনি আঁতকে ওঠে, ওর শরীরে হাত পড়েছে। ভয়ে জমে আসে শরীর। মানুষটা কী একটা কথাও বলবে না! এভাবে লুট করে নেবে এতোকালের সঞ্চয়? শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মুখ ফুটে কথা বলার শক্তি আর লাইলির মধ্যে নেই। মানুষটার হাত সর্ব শরীর প্রদক্ষিণে ব্যস্ত। এরিমধ্যে একটি পা-ও উঠে এসেছে। নিবিড় অন্ধকার, তাই লাইলির চোখ দুটি খোলা। কিন্তু ঠোঁটে কামড় দিয়ে ধরায় রক্ত বের হয়ে গেল বুঝি, নোনতা লাগছে। ধীরে ধীরে জয়নালের সমস্ত শরীরের ভার যখন লাইলির উপরে ন্যস্ত হয়, তখন লাইলির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বড় একটা ছোরা বেঁধানোর তীব্র যন্ত্রণায় মরণ চিৎকার দিয়ে উঠার জন্যে মুখ হা করেই আছে, কিন্তু ছোরাটার উপস্থিতি এক ঝলক টের পেল শুধুমাত্র, তলপেটের ৯০% শূন্যই পড়ে আছে। কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে দাবড়িয়ে মানুষটা নেমে গেল। লাইলির আর চিৎকার দেওয়া হয়নি। ঊরুসন্ধি ভেজা দেখে লাইলির ভয়ার্ত মন বিজয়ানন্দে নেচে ওঠে। মানুষটা ভয় পাইছে! এই ভয়কে পুঁজি করে এবার জিতবে লাইলি। কিন্তু লাইলি ভাবতেই পারেনি, এই মানুষটার সর্বোচ্চ পুঁজি এই!
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে এবং একই সঙ্গে লাইলির কল্পনাকাতর মন কাঁপিয়ে বাইরে থেকে কেউ একজন ডেকে ওঠে, জয়নাল ঘুমাইয়া আছিস নাকি? একবার বাইরে আও দেহি। নিজের নামটি কানে পৌঁছা মাত্রই ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে জয়নাল, কে, কে ডাকে? প্রত্যুত্তরে যে নামটি বলে, লাইলির অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। এই মানুষটা মেম্বারের ফেউ। গ্রামে সালিশ-দরবার করে বেড়ায়।
ঘুমভাঙা চোখ কচলাতে কচলাতে ঘর থেকে বের হয় জয়নাল, রাজ্জাক ভাই, এতো রাইতে তুমি?
মেম্বার সাব পাঠাইছে। তোর দরকারেই পাঠাইছে।
কী হইছে? আমার কী দরকার?
কী হইছে তুই জানিস না! এক বছর ধইরা এক বিছনায় শঙ্খিনী মাইয়ামানুষ লইয়া থাকিস, তুই টের পাস নি?
কেন? কী হইছে?
আবার জিগাই, তুই মরদ নাকি হিজড়া?
জয়নাল চোখ রাঙিয়ে ওঠে, মুখ সাবধান কইর্যা কথা কইও।
আমার মুখ সাবধান কইর্যা কী অইবো? তোর বউ-ই তো কইছে?
জয়নালের শরীর ঝড়ে থাক্কা খাওয়া খুঁটির মতো নড়ে ওঠে, কী কইছে?
তোর বউ কী কইছে তুই হুনিস নাই?
না। কী কইছে?
তোর তো গলায় দড়ি দেওয়া উচিৎ। ঘরের মাইয়ামানুষ এই কথা বলার সাহস পায় কোত্থে? গ্রামের সম্মান তো গেলই। পুরুষজাতির মানসম্মানও তোর বউ ডুবাইলো। একটা পুরুষ মানুষ চারটা মাইয়ামানুষ বিয়া করতে পারে। এমন শঙ্খিনী মাইয়া মানুষ হইলে তো...
ধৈর্যহারা জয়নাল, আর দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন, বকবক থামাইয়া কী কইছে হেই কথাটা কও?
তোরে চড়ুই পাখি কইছে।
জয়নাল প্রথমে কথাটি ধরে উঠতে পারেনি, কীয়ের চড়ুই পাখি? কিন্তু রাজ্জাকের রহস্যময় হাসি ও চোখে অশ্লীল ইঙ্গিত দেখে ঠিকই ধরে ফেলে। কার লগে কইছে, কেডা শুনছে, আর কেডা কইছে?
তোর বউ পেডের কথা কার লগে ক? হেরে জিগা।
আর কেডা হুনছে?
সারা গ্রামের মাইনসে হুনছে।
মুহূর্তের মধ্যে কী হলো, চোখের পলকে জয়নাল রাজ্জাকের ঘাড় থাবা দিয়ে ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলল। উত্তেজনায় উন্মত্ত জয়নাল বুঝতে পারেনি রাজ্জাক একা আসেনি। সামান্য দূরে কাঁঠাল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই চ্যালা ছুটে আসলে রান্নাঘরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা মজিদা ভাবি এগিয়ে এসে পথ আটকায়, ওর মাথা ঠিক নাই, তোমরাও পাগল অইছো নি?
জয়নালের থাবা থেকে মুক্তি পেয়ে উঠে যাবার সময় রাজ্জাক ছোট্ট করে শুধু বলে গেল, কাল দিনেই এর বিচার অইবো।
চ্যালা দু’টি সরল মনে বলে গেল, জয়নাল ভাই, নিজে না পারলে ছোট ভাইদের ডাকবা, ফাউ ফাউ খেপ মাইর্যা দিমু নে, খালি খালি পাকা ক্ষেত নষ্ট করো কিয়ের লাইগা?
জঙ্গলের দুর্বল শক্তির কোন প্রাণীর হাতে আঘাত খাওয়া সিংহের মতো রাতের নীরব পৃথিবী কাঁপিয়ে গর্জন করে ওঠে জয়নাল, ও কি ঠিক কইছে? খানকিটা এই কথা কইছে?
মজিদা ভাবি জয়নালের মুখ টিপে ধরে, সর্বনাশের কথা। ভুল কইর্যা মুখ ফইসক্যা বাইর অইয়া গ্যাছে. তুমি ওরে ক্ষমা কইর্যা দাও।এতক্ষণ সামান্য দূরে রান্নাঘরের ছায়ার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল লাইলি। জয়নাল উঠোনে এলে মজিদা ভাবি ডাকে, এদিকে আই লা রাক্ষুসী, মাফ চা মিনসের পা ধইর্যা। ভয়ে ধুন্ধমার লাইলি উঠোনের মধ্যখানে এসে দাঁড়াতেই চিল যেভাবে মোরগের বাচ্চাকে থাবায় নিয়ে উড়াল দেয়, ঠিক একই ভাবে চুলের মুঠো থাবা দিয়ে ধরে এক টানে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল জয়নাল। মজিদা ভাবি লাইলির ঠ্যাং টেনে ধরেছিল, কিন্তু মহিষের মতো মিনসের সাথে শক্তিতে পারে কী করে?
অন্ধকারের মধ্যে লাইলির বুকে-পিঠে-মুখে নির্বিবাদে এলোপাতাড়ি লাথিয়ে ক্লান্ত হয়ে জয়নাল ক্ষান্ত দিলে শান্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকে লাইলি।
আপাত শান্তি নেমে এসেছে ভেবে নিজের ঘরে গেল মজিদা ভাবি।
মাটিতে লুটিয়ে থাকা লাইলি ভাবে, এই মার খাওয়ার পরেও যদি মানুষটা ক্ষমা করে। পায়ে ধরার জন্য উঠে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু হাড়-হাড্ডিগুলো যেন ভেঙে গুড়িয়ে গেছে, সামান্যও নড়ার শক্তি নেই।
ঘণ্টাখানেক পরেই, কালনাগিনী শঙ্খিনী তোর বিষের জ্বালা মিটাইয়া দেই, দাঁড়া, বলেই দরজা খুলে ক্ষিপ্রগতিতে বাইরে গেল জয়নাল। রান্নাঘর ঘর হতে মোটা ধারালো দেড়হাতি একটি চ্যালাকাঠ হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকেই দরজা বন্ধ করে দিল। কাটা গাছের মতো মাটি কামড়ে থাকা লাইলির বিধ্বস্ত শরীর খোঁজে পেল। ব্লাউজ টেনেছিঁড়ে বের করে ক্রিকেট বলের মতো দুই স্তন দুই হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে লাফিয়ে চড়ে বসে লাইলির কোমর বরাবর। মরদানি দেখবি না, এই দেখ, বলেই দানবীয় শক্তির সবটুকু দিয়ে স্তনজোড়ায় মোচড় দিয়ে ছিঁড়ে ফেলার জন্যে টেনে ধরলে শিকড়সহ উপড়ে ওঠা গাছের মতো উঠে আসার সময় মা-গো বলে শুধু একবারই চিৎকার দিতে পারে লাইলি। সাথে সাথেই গলা পর্যন্ত কাপড় ঢুকিয়ে দিল। গোঙানির আওয়াজটি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। স্তনজোড়ার একটা ছিঁড়ে হাতে এলো সহজেই, কিন্তু আর একটা কিছুতেই ছিঁড়ছে না। ঊরুসন্ধির মাঝখানে চ্যালাকাঠের ব্যবহারের সময় লাইলির নড়াচড়া বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও জয়নালের শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। অর্ধেকটা চ্যালাকাঠ শেষ পর্যন্ত ব্যবহার হয়।
লাইলির গোঙানির আওয়াজ শুনে মজিদা ভাবি দুই ধরনের ভাবে, মার খেয়ে মেয়েটা বুঝি শরীরের ব্যথায় গোঙাচ্ছে; অথবা মিনসেটা ক্ষ্যাপে গিয়ে লাইলির নারীজন্মের সাধ পূর্ণ করছে, তাই এভাবে গোঙাচ্ছে, একবার চিৎকার দিয়েছে। কিন্তু গোঙানির শেষ আওয়াজটা কেমন ভয়ঙ্কর ঠেকে, তাই মজিদা ভাবি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঠিক তখনি দরজা খুলে বের হয় জয়নাল। রক্তখেকো দানবের মতো ঠোঁটে-মুখে-বুকে তাজা রক্ত। মজিদা ভাবি দৌড়ে ঘরে ঢুকেই আলো জ্বালে, ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার বুকে ফেটে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থেমে গেল।
টলটলে রক্তের মধ্যে পড়ে আছে লাইলি। সর্বশরীরেই রক্তের গাঢ় প্রলেপ; মনে হয়, লাল বেনারসি শাড়ি শরীরে জড়িয়ে বুকে ভয় নিয়ে স্বামীর প্রতীক্ষায় বাসরঘরে শুয়ে আছে। একপাশে পড়ে আছে একটি ছিন্ন স্তন ও রক্তাক্ত চ্যালাকাঠ।
বাঁশঝাড়ের নিচে কচুরিপনার ডোবার মধ্যে গর্ত খুঁড়ে লাইলিকে মাটি চাপা দিয়ে জয়নাল ও মজিদা ভাবি যখন ঘরে ফেরে তখন চাঁদটা ডুবে ডুবে।
ঘর লেপামোছা করে মজিদা ভাবি যখন ঘরে ফেরে তখন মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকে ফুঁ দিচ্ছে আজান দেবার জন্যে।
দুপুর পর্যন্ত বিমর্ষচিত্তে মাথা নিচু করে উঠোনে বসে ছিল জয়নাল। এমন অপবাদ দিয়ে যে পুরুষের বউ সংসার ছেড়ে পালিয়েছে, তার কী মাথা উঁচু থাকে!
যারা সমবেদনা জানানোর জন্য জয়নালের বাড়ি এসেছে এবং যারা ব্যস্ততার জন্যে আসতে পারেনি, গ্রামের সকলের মুখে জিজ্ঞাসা একটিই, যুবতী মাইয়াটা কই গ্যালো? বাপের বাড়ি তো যায়নি।
এবং সকলের মুখে উত্তরও একটিই, এই সব মাইয়ামানুষ আর কই যাইবো, ওদের যাওনের জায়গা তো একটাই—বেশ্যাপাড়া।
লাইলি নিখোঁজের দ্বিতীয় সপ্তাহে হৃষ্টপুষ্ট এক যুবতীকে বিয়ে করে জয়নাল।
জয়নালের নতুন সংসার ভরা সুখের সংসার।
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ৬ অক্টোবর ২০২১
লেখক: অধ্যাপক , প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক
ছবি: সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment