- 27 August, 2021
- 0 Comment(s)
- 598 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
চোখের সামনেটা সবকিছু ধোঁয়া হয়ে আসছে। কোলাহলটাও জনঅরণ্যের মৃদু গুঞ্জনের মতো পাক খেতে খেতে দূর থেকে বহু দূরে কোথাও যেন একটা মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় কেউ একজন এসে হঠাৎ বলল— ‘ম্যাডাম শরীর খারাপ লাগছে নাকি, বাড়ি যাবেন?’ চন্দ্রানী হকচকিয়ে উঠে বসে দেখে টেবিলের সামনে আয়েশা দাঁড়িয়ে আছে। চোখটা কখন যে লেগে গিয়েছিল তা চন্দ্রানী বুঝতেই পারেনি। চোখ রগড়ে নিয়ে সে আয়েশাকে বলল— ‘না ঠিক আছে।’ আয়েশা তবুও বলল— ‘দেখুন ম্যাডাম শরীর খারাপ লাগলে আজকে নয় একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাবেন।’ চন্দ্রানী আয়েশাকে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে, সে একদম ঠিক আছে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার প্রয়োজন হবে না। আয়েশা সি ভি রমন বেসরকারি হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডের একজন নার্স। প্রায় বছর সাতেক হল চন্দ্রানীর সঙ্গে কাজ করছে। তবে চন্দ্রানী একজন হার্ট স্পেশালিস্ট, সিনিয়র সার্জেন। হতেও পারে এত বছর একসঙ্গে কাজ করার ফলেই দুজনের কাজটা আলাদা হওয়া সত্ত্বেও মনের মিল প্রচুর। এতগুলো বছর ধরে চন্দ্রানীকে আয়েশা এখানে চাকরি করতে দেখছে অথচ এর আগে কখনও তাকে এতটা দুর্বল, এতটা ক্লান্ত হয়ে পড়তে দেখেনি। সে যত কাজের চাপই থাকুক না কেন। এই তো গতবছর প্রথম যখন কোভিড-১৯ দেশে পাড়ি দিল হাসপাতালে একটা বেডও ফাঁকা ছিল না। কি প্রচণ্ড কাজের চাপরে বাবা! গোটা হাসপাতালটাই তখন কোভিড হাসপাতাল হয়ে গেল। সেই সময় রাতের পর রাত জেগে হাসপাতালে বন্দি থেকে চন্দ্রানীকে সবকিছু সামাল দিতে হয়েছে। নিজের দিকে একটু তাকানোর সুযোগও হয়নি, বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু তখনও এত ক্লান্ত চন্দ্রানীকে দেখে মনে হয়নি। চন্দ্রানী খুবই চাপা স্বভাবের, আয়েশা যত ভালো বন্ধুই হোক না কেন কাজের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনের কথা বিশেষ কিছু বলতে চায় না। যতটুকু সে চন্দ্রানীকে চেনে তার থেকে আয়েশা আন্দাজ করতে পারে যে চন্দ্রানী একটা বড়সড় সমস্যার মধ্যে আছে। যাই হোক, এখন আবার তৃতীয় ঢেউ চোখ রাঙাচ্ছে। হাসপাতালে কোভিড রোগীর সংখ্যা মাঝখানে একটু নেমে গিয়েছিল বটে কিন্তু এখন আবার তা তিলে তিলে বাড়তে আরম্ভ করেছে। কাজের চাপ থাকার জন্য আয়েশা আর বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। স্বাস্থ্যকর্মী হওয়ার ঝামেলা নেহাত কম নয়!
আয়েশা সরে যেতেই চন্দ্রানী টেবিলের ওপর হাত ভাঁজ করে রেখে তার ভেতর মাথাটাকে গুঁজে দিয়ে ভাবতে লাগল, কোনটা তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তার বহুকষ্টে তিলে তিলে গড়ে তোলা কেরিয়ারটা নাকি হুড়মুড়িয়ে চোখের সামনে ভেঙে পড়তে বসা তার স্বপ্নের সংসার? চন্দ্রানীর সংসারের বয়সটা অবশ্য তার কেরিয়ারের বয়সের থেকে অনেকটাই কম, মাত্র সাড়ে চার বছর। বিয়ের আগে মা বারবার করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন— মেয়েদের সংসারটাই হচ্ছে আসল, তার জন্যে সবকিছু ত্যাগ করা চলে। যারা সংসারী তারা সমাজের সব থেকে সুখী ও নিশ্চিন্ত মানুষ। মা বলেছিলেন— ‘দেখ মা-বাবাকে তো জীবনে সবসময় পাশে পাবি না, আমাদেরও বয়স হচ্ছে আজ আছি কাল নেই। তখন তোকে দেখবে কে? যতটা পারিস সংসারে একটু মানিয়ে ঝুলিয়ে চলার চেষ্টা করিস। শাশুড়িমায়ের কথাগুলো একটু শুনে চলিস।’
চন্দ্রানীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে টেবিলটা ভিজে যাচ্ছে। মা এখন আর নেই। কোভিডের প্রথম ঢেউই তাকে টেনে নিয়ে চলে গেছে জনাকীর্ণ জীবন তটভূমি থেকে অনন্ত মৃত্যু সমুদ্রের মাঝখানে। চন্দ্রানী ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও কিছুই করতে পারেনি তখন। আর আজ মায়ের এই কথাগুলোও হয়তো তার পক্ষে পালন করা সম্ভব হবে না। না হওয়ার পিছনে কারণের অভাব নেই। বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ির সকলেই জানতো যে চন্দ্রানী একজন ডাক্তার। তখন কেউ তার এই পেশা নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেনি। দুবছর ভালই কাটলো। সমস্যাটা শুরু হল চন্দ্রানীর ছেলে হবার পর থেকেই। শাশুড়িমা আর চাইছিলেন না যে চন্দ্রানী এই চাকরিটা করুক। কিন্তু সেটাকে ছেড়ে দেওয়া কি অতই সোজা? ডাক্তারি করাটা চন্দ্রানীর প্রধানত একটা নেশা এবং সেটা অনেক ছোটবেলা থেকেই তার দুটো চোখে স্বপ্ন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। চন্দ্রানীর সঙ্গে তার শাশুড়ির খিটিরমিটির যখন বড় একটা অশান্তির আকার নিতে শুরু করল তখন মোহিত মানে চন্দ্রানীর স্বামী ওকে নিয়ে সল্টলেকে একটা ফ্ল্যাটে এসে থাকতে শুরু করে। চন্দ্রানী একদিক থেকে নিশ্চিন্ত ছিল যে মোহিত অন্তত তার পাশে আছে। মা তখন বলেছিলেন— ‘অনেক ভাগ্য করে এমন স্বামী পেয়েছিস।’ অবশ্য চন্দ্রানী নিজে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল শাশুড়ি যদি বেশি ঝামেলা করতে শুরু করেন তাহলে ও সেখান থেকে পালিয়ে আসবে। মোহিত যে কোম্পানিটায় কাজ করে লকডাউনের কটাদিন বন্ধ থাকার জন্য তার অবস্থার একটু অবনতি ঘটে ঠিকই কিন্তু এখন আবার সে ছন্দে ফেরার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। নতুন ফ্ল্যাটটা কেনা হয়েছিল চন্দ্রানীর টাকাতেই সে হিসাব চন্দ্রানীর আছে। এত দিন মোহিত পাশে থাকায় যত ঝড়ঝঞ্ঝায় এই ডাক্তারি করতে গিয়ে তার ওপর দিয়ে গেছে সেসব সে সামলে নিতে পেরেছে। কখনো নিজেকে নিরুপায় বা অসহায় বলে মনে হয়নি। কিন্তু ইদানিং তা খুব করে মনে হচ্ছে।
সত্যি বলতে কি চন্দ্রানীর আজ প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। শরীরটা মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ক্লান্ত। কেবল মনের জোরে আজ সকালে হাসপাতালে এসেছে। না এসে আর যেতই বা কোথায়? এটা যে তার অশান্তির হাত থেকে কিছুক্ষণের জন্য পালিয়ে বাঁচবার একটা আশ্রয়স্থল। গতরাত্রে আবার তুমুল ঝগড়া হয়েছে মোহিতের সঙ্গে। চন্দ্রানী শুধু রাতটা কেটে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল। তারপর ভোর হতে না হতেই চলে এসেছে হাসপাতালে। সারা রাত আর ঘুম হয়নি। মোহিতের সাথে এই ঝগড়াটা অবশ্য নতুন নয়। এটা চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসার পর থেকেই। তখন সদ্য বিধানসভা ভোটটা শেষ হয়েছে, আর দেশ জুড়ে কোভিডের এমন বাড়বাড়ন্ত এর আগে কেউ কখনও দেখেনি। চন্দ্রানী রোজ হাসপাতালে যাতায়াত করুক সেটা মোহিতের পছন্দ ছিল না। হয়ত শাশুড়িমা মোহিতের কানে কোনো বিষ ঢেলে দিয়েছিলেন। মোহিত অমনি আপত্তি করা শুরু করে দিল— ‘তুমি এই চাকরিটা এখনকার মতো ছেড়ে দাও।’
চন্দ্রানী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল— ‘কেন?’ এর কোনো জবাব মোহিত দেয়নি। চন্দ্রানী তখন বলেছিল— ‘মানুষের এমন বিপদের দিনে আমি যদি ডাক্তার হয়ে নিজেকে কোভিডের ভয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে রেখে দিই, সেটা আমার বিবেকে সইবে না।’ মোহিত বলেছিল— ‘ঘরে নিজের বাচ্ছাটার বিষয়েও ভাববে না?’ — ‘না আমি ওকে ছোটো থাকতেই শেখাতে চাই যে দেশের বিপদে শুধু নিজের স্বার্থটুকু দেখলেই হবে না, সকলের কথা ভেবে চলতে হবে। আর তাছাড়া ও একজন ডাক্তারের ছেলে, সেটা ওকে বুঝতে হবে।’ মোহিতের মুখ দেখে স্পষ্টতই বোঝা গিয়েছিল যে এ উত্তরে মোহিত খুশি হয়নি। চন্দ্রানীকে তবুও সে বলেছিল— ‘দেখো তোমার চাকরিটা ছেড়ে দিলে আমাদের সেরকম কোনো অসুবিধা হত না। আমারটা তো আছেই।’ চন্দ্রানী বলেছিল— ‘আমি তোমার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না। আমাকে চাকরি ছাড়তে কে বলেছে, তোমার মা?’ মোহিত মাথা নিচু করে জবাব দিয়েছিল— ‘হ্যাঁ। মা চায় না যে তুমি এখন আর বাইরে কাজ কর।’ চন্দ্রানী চড়া সুরে জবাব দিয়েছিল— ‘জানিয়ে দিও তা সম্ভব নয়। তোমাকে আমি কতবার বলেছি যে ও বাড়ির সাথে আর সম্পর্ক রেখো না। আমি শুধু দাসীবৃত্তি করতে এ সংসারে আসিনি। আমার একটা স্বাধীনতা আছে। আমার হাতে টাকা থাকুক সেটা তোমার মা চায় না, এটা কেন বুঝছো না? উনি অশান্তি এমনি এমনি বাঁধাতেন না। এখন বুঝতে পারছি আমাকে নিজের অধীনে শাসনের মধ্যে রাখতে পারতেন না বলে এমন করতেন। যাতে আমি ঝগড়ার চোটে পাগল হয়ে যাই কিংবা ফাস্ট্রেটেড হয়ে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিই। যখন কোনো উদ্দেশ্যই সফল হল না তখন এসে তোমার মাথা খেতে বসেছেন। কিছুতেই আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবেন না উনি। আমি ওনার সাথে কী শত্রুতা করেছিলাম? পদে পদে সম্মান করেছি, যখন যা বলতেন মেনে চলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তা বলে চাকরি ছাড়বো কেন? বলতে পারো এত মানসিক টরচার কেন করতেন উনি আমার ওপর? আমার ননদ দেওর সকলকে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছিলেন আমাকে চাকরি থেকে ছাড়াবার জন্য, কিন্তু কেন? আমার কি মানুষের মত বাঁচার অধিকার নেই? নিজের কোনো শখ আহ্লাদ মেটাতে পারব না আমি? ওনাদের আমার ওপর অত্যাচার করার ইচ্ছার ব্যাপারটা আগেভাগে বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম বলে আমার ওপর এত রাগ। আমাকে দিয়ে কি কেবল বলদের মত সংসারের ঘানিটাই টানিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল গায়ে গতরে, কিন্তু কেন?’ মোহিত এসব চুপচাপ শুনে যায়নি। চন্দ্রানীর এতগুলো ‘কেন’-র উত্তর দেওয়া অসম্ভব যদিও তবু গৃহিণীর এত চড়া সুরে কথা বলা কখনোই শোভা পায় না। মোহিত তখন একটা কথাই বলেছিল— ‘মা ঠিকই বলে, তোমাকে একটু বেশি লায় দিয়েছি বলে একেবারে মাথায় উঠে নাচছ। তোমার কাছে তো পরিবারের বাকিদের কথার কোনো দামই নেই। সেগুলো না শুনলেও চলে।’ চন্দ্রানী বুঝতে পারে সে মোটেই এই সংসারের লক্ষ্মী বউটি হয়ে উঠতে পারেনি। শাশুড়িমা এখন হয়ত ভাবছেন— শ্বশুরমশায় চন্দ্রানীর মত মেয়েকে নিজের ছেলের জন্যে পছন্দ করেছিলেন কী দেখে? শ্বশুরমশায় ছিলেন অনেক উন্নত মনষ্ক। চন্দ্রানীর মধ্যে তিনি হয়ত অনেক সম্ভাবনাকেই সত্যি হতে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখন আর বেঁচে নেই। মোহিতের বিয়ের আগেই তিনি মারা যান। যার জন্য ওদের বিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিল আরও একটা বছর। শ্বশুরের শেষ ইচ্ছা রক্ষার্থেই তখন শাশুড়িমা এ বিয়েতে মত দেন।
চন্দ্রানী যখন ও বাড়িতে থাকত তখন সত্যিই ওর ওপর নেহাত কম অত্যাচার হত না। এমন কিছু কিছু নির্দয় ঘটনা, চন্দ্রানী যা কখনও কল্পনাও করতে পারেনা, ওর সাথে ঘটেছে যা সে কোনোদিনই ভুলতে পারবে না। চন্দ্রানীর যেদিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল সেদিন রাতে ফিরে এসে দেখে বাড়ির মেইন দরজায় তালা পড়ে গেছে। মোহিতকে ফোন করে ডাকতে সে এসেছিল তালা খুলে দিতে। মোহিত তখন ইশারা করে চন্দ্রানীকে বলেছিল চুপিসারে ঘরে ঢুকে পড়তে যাতে কেউ টের না পায়। চন্দ্রানীর মাথা গেল গরম হয়ে। নিজের বাড়িতে শেষে কিনা চোরের মত ঢুকতে হবে? চন্দ্রানী ফিরেছে সেটা টের পেয়েই শাশুড়িমা ঝগড়ার পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে একেবারে যেন ময়দানে নেমে পড়লেন। পরদিন সকালেও বাথরুমে নিজে ঢুকে সেটাকে আটকে রেখে চন্দ্রানীর হাসপাতালে যেতে দেরি করে দেওয়ার মতলবে ছিলেন, তাই সেদিন স্নান না করেই বেরিয়ে গেছে সে। কোনো কোনো দিন অবশ্য কাজে আসতে সত্যিই তার দেরি হয়ে গেছে। দু-এক দিন শাশুড়ি সাত সকালে উঠে জল-কল নিয়ে ননদের সাথে এমন ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন যে চন্দ্রানীর সেই দিনগুলো আর হাসপাতালে আসাই হয়নি। তখন ঘরে জানলার বাইরে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে যে আকাশের বুকে ভাসমান সাদা মেঘগুলো অনেক বেশি স্বাধীন। যদি চন্দ্রানী মেঘগুলোর সাথে মিশে যেতে পারত... কিন্তু বিশেষ একটা কিছু কল্পনা করার মত সময় চন্দ্রানী পায়নি। ঘরের অনেক কাজ পড়ে ছিল যে, তাই ননদের ডাক এসে গেল। হসপিটাল সুপারকে অনেক প্রকার শারীরিক অসুবিধার বিস্তর মিথ্যা কৈফিয়ত দিয়ে কোনোক্রমে চাকরিটা সে আজ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছে। ওর সহকর্মীরা এই সুযোগে ওকে খোঁচা দিতেও ছাড়েনি। তারপর, অন্যত্র সরে আসতেই চন্দ্রানী ঠিক করেছিল যে শ্বশুরবাড়ির বাকি লোকেদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক একেবারে ছিন্ন করে দেবে। কিন্তু মোহিত এখনো সমান তালে তার মায়ের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেছে দেখে চন্দ্রানী বুঝতে পারে এই নাড়ীর টান কাটানো বড়ই শক্ত।
ভাগ্যের ঈশান কোণে কখন যে কালো মেঘ এসে জমা হয়েছে তা চন্দ্রানী জানত না। মোহিতের জন্য আবার নতুন করে পাত্রী খোঁজা শুরু হয়েছে। চন্দ্রানীকে ত্যাগ দেওয়ার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখার বিধানও দিয়ে দিয়েছেন মোহিতকে তার মা। কাল রাতের ঝগড়ায় চন্দ্রানী এই গোপন তথ্যটি জানতে পারে। কদিন আগে থেকেই ছোটোখাটো ঝামেলার সময়ও কথায় কথায় ডিভোর্স দিয়ে দেওয়ার কথা বলত মোহিত। চন্দ্রানী তখন চুপ করে যেত। এইবার সে বুঝতে পারছে যে মোহিত অনেক দিন আগে থাকতেই একটু একটু করে ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। চন্দ্রানীর ছেলেটার বয়স এখন সবে তিন বছর। ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সারারাত ফুঁপিয়ে কেঁদে চোখ লাল করেছে চন্দ্রানী। ছেলেটাকেও যদি ওরা কেড়ে নেয়? বাবার কাছে ফিরে যাবে কি? ভিতর থেকে কেমন যেন একটা অপরাধবোধ ওকে সবার কাছে লজ্জিত করে যাচ্ছে বারবার। এই ডিভোর্সের কথাটা চন্দ্রানী কাউকে জানাতে পারবে না। সমাজের শ্যেন দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যাচ্ছে। খালি মনে হচ্ছে সকলের চোখ যেন কেবল ওর ওপরই স্থির হয়ে আছে। কিন্তু অপরাধটা যে কি সেটাই বুঝতে পারছে না চন্দ্রানী। তাছাড়া এখন থাকবেটাই বা কোথায়? এই চূড়ান্ত অপমানের পর মোহিতের সাথে আর থাকা চলে না।
কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে গেছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চন্দ্রানী টেবিল থেকে মাথা তুলে এখন সোজা হয়ে বসলো। চোখটা দুহাত দিয়ে রগড়ে নিয়ে দেখলো বাইরে থেকে ব্যালকনির কাঁচের দরজাটায় উজ্জ্বল রোদ এসে পড়েছে। বাইরে স্পাইডার প্ল্যান্টটার সবুজ রঙটা রোদে ঝলমল করে বারবার চোখে এসে পড়ছে। চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে চন্দ্রানী কাঁচের জানলাটার একদম পাশে এসে বসল। নীল আকাশের বুকে অপূর্ব শরতের তুলোর মত মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। চন্দ্রানীর চোখ নিচের দিকে নেমে আসতেই দেখল স্পাইডার প্ল্যান্টে একটা হালকা সবুজ রঙের ফড়িং এসে বসে রোদে তার স্বচ্ছ কাঁচের মত ডানা দুটোকে থরথর করে কাঁপাচ্ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য! একটা গান মনে আসতেই সেটা গুনগুন করে গাইতে লাগল চন্দ্রানী—‘‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে,
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।। দেহমনের সুদূর পারে হারিয়ে ফেলি আপনারে, গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে।। আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে, দুঃখ বিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।’’ ‘কঠিন কাজ’, হ্যাঁ এখন ওকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এই নতুন ফ্ল্যাটটা ওর নামে এবং পুরোটাই ওর টাকায় কেনা। মোহিতের যদি না পোষায় তবে মোহিত নিজে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে অথবা চন্দ্রানী আর মোহিতকে সেখানে থাকার কোনো অনুমতি দেবে না। ছেলে যদি কখনও বাবার কাছে যেতে চায় তবে চন্দ্রানী তাকেও আর আটকাবে না। এই জীবনটা শুধুমাত্র ওর নিজের। স্বাধীনতার জন্য যদি সংসার ত্যাগী হতে হয় তবে সেও অনেক ভালো। চন্দ্রানী বাঁচবে নিজের কাজ নিয়ে। মৃত্যুর কাছে অসহায় এই মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে তোলাতেই তার সুখ। পেসেন্ট আছে, তাই চন্দ্রানীকে উঠে যেতে হল।
আয়েশা পিছন থেকে অনেকক্ষণ ধরেই চন্দ্রানীকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। আয়েশা জানে হসপিটালে চন্দ্রানীকে নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলে। চন্দ্রানীর এক পুরুষ সহকর্মীর মুখেই সে বহুবার শুনেছে—‘আসলে বিয়েটা হয়ে গেছে তো। আগে ঘর সংসারের কাজ করবে, না রুগী সামলাবে? তাই বাসন মাজতে গিয়ে আজ আসতে দেরি হয়ে গেছে বোধহয়।’ যাকে বলা হয়েছে, তার উত্তরটাও ছিল বড় নির্দয়— ‘দেখো, কটা দিনই বা আর চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে পারে সুপারকে তেল মাখিয়ে।’
তবে চন্দ্রানীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথা কেউ কখনও ভাবেওনি। সকলেই এই নির্যাতনটাকে নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে মেনে নেয়। কেউ কেউ, যারা চন্দ্রানীর প্রমোশনে খুশি ছিল না তারা এই অবস্থায় ঠাট্টা করতেও পিছপা হয়নি। তবে আয়েশা জানে, চন্দ্রানীর ভেতর একটা খুবই শক্তিশালী যোদ্ধা লুকিয়ে আছে। জীবনে জেতার জন্য কারোর কোনো দয়া মায়ার প্রয়োজন নেই তার। তাই আজ তার জিত হচ্ছে বুঝতে পেরে আয়েশা আর খুশি না হয়ে থাকতে পারল না।
লেখক: ছাত্রী, গল্পলেখক
ছবি: প্রতীকী
0 Comments
Post Comment