- 25 October, 2025
- 0 Comment(s)
- 88 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
অষ্টমীর সান্ধ্য আড্ডাটা সঞ্চারী সাহার ফ্ল্যাটে যখন জমে উঠেছে তখন বন্ধ জানলার স্বচ্ছ কাঁচের পাল্লার ওধারে মুষলধারে পড়ে চলা বৃষ্টিতে বহির্বিশ্বের সবকিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের তীক্ষ্ণ ঝলকানিতে বাইরের অন্ধকারটা আরও বেশি রহস্যময় হয়ে উঠেছে। দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টির ছাঁট প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝাপসা করে দিচ্ছে জানলার শার্সিগুলোকে। সঞ্চারী সাহার নতুন ফ্ল্যাটটা বেশ বড় এবং ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো। ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণায় তাঁর সূক্ষ্ম রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। সঞ্চারী সাহার বয়স সদ্য তিরিশ পেরিয়েছে। এর মধ্যেই তাঁর ঝুলিতে এসে জমেছে জাতীয় পুরস্কারসহ একাধিক খেতাব ও আন্তর্জাতিক সম্মান। সঞ্চারীদি বিখ্যাত গায়িকা হওয়া সত্ত্বেও একটু নিরিবিলিতে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন। তাই অনুরাগীদের উপদ্রব থেকে বাঁচতে আমাদের এই বকুলতলাতে চার মাস হল একটা ফ্ল্যাট কিনে থাকতে শুরু করেছেন। এর আগে তিনি যাদবপুরের পৈতৃক ভিটেতেই থাকতেন। এই এলাকার কাউন্সিলর পারমিতা চট্টোপাধ্যায় অর্থাৎ আমাদের পারোদির সঙ্গে সঞ্চারী সাহার ভালোই সম্পর্ক। ক্লাবের পুজোর হাজারটা ব্যস্ততার মধ্যেও একটুখানি সময় বের করে পারোদি আমাকে আর মনীষাকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছেন সঞ্চারীদির আস্তানায়। বাইরে ঝমঝম করে পড়ে চলা একনাগাড়ে বৃষ্টি আর তার সঙ্গে আমাদের জন্য কড়া চা, গরম ধোঁয়া ওঠা শিঙাড়া আর নরম পাকের টাটকা সন্দেশের অফুরন্ত আয়োজন দেখেই ভেবেছি গানে, গল্পে আজ অষ্টমীর আড্ডাটা দারুণ জমবে। সঞ্চারীদি আমাদের নিরাশ করেননি। আমাদের একবার অনুরোধমাত্রই তিনি বাইরের বৃষ্টিপতনের ছন্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কী যেন রাগে অপূর্ব একটা গান শোনালেন। আমার সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি নেই তবুও গানটি যেন আমার হৃদয়ে একটা হিল্লোল তুলে দিল। গানের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই মনীষা সঞ্চারীদির কাছ থেকে আসল গল্পটা জানার লোভে তাঁকে খুঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রায় পঞ্চাশটার কাছাকাছি গান এতদিন ধরে লিখলে, নিজে সুর দিয়ে গাইলে আর লোকে তোমাকে চিনলো মাত্র একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য?’ একাত্তরের যুদ্ধের সময় সঞ্চারীদির বাবা যশোর থেকে এপারে এসেছিলেন। তারপর এদেশে কাপড়ের ব্যবসা করে বেশ অবস্থাপন্ন হন। সেই শিকড়ের টান এখনো জড়িয়ে আছে সঞ্চারীদির ভাষায়। সঞ্চারীদি তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় বললেন, ‘গানডার লগে নয়, লোকে আমারে চিনছে পরিস্থিতির লগে। আমাগো মুখের বাঙাল ভাষা হুইন্যা তোমরা হাসাহাসি কর। ওপার থিক্যা তো কম লোকে আসে নাই কিন্তু বেশিরভাগ মানুষে মুখের ভাষার টান বদলাইছে। আর তা বদলাইছে তিনডি কারণে- প্রথমত, হগলে নিজের শরীল থিক্যা উদ্বাস্তু হওনের তকমাটারে ঘইষ্যা মাইজ্যা তুইল্যা ফ্যালতে চায়। দ্বিতীয়ত, লোকের উপহাস আর ঘেন্নার থিক্যা নিজেরে বাঁচাতে চায় আর তৃতীয়ত, নিজেরে ভারতীয় হিসাবে প্রমাণ করতে চায়। নইলে এই ভাষার টান দেইখ্যা যদি আবার সীমান্ত পার করাইয়া বাংলাদ্যাশে ছুঁইড়্যা ফ্যালাই দেয় হেই ভয়ে। কিন্তু আমার মনে হয় ভাষার এই টানডারে ছাইড়্যা দিলেই আমি চিরকালের উদ্বাস্তু হইয়া পড়ুম।’ পারোদিকে দেখলাম সে একমুহূর্ত সঞ্চারীদির মুখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে চেয়ে ছিল আবার পরমুহূর্তেই মুখে সামান্য হাসি টেনে বললো, ‘তুমি শেষ যে সমস্যাটার কথা বললে সেটা সামনের বিধানসভার আগে শুরু হয়েছে আবার ভোট মিটে গেলে মিলিয়েও যাবে।’ সঞ্চারীদি বললেন, ‘সে তুমরা রাজনীতির মানুষ ঐসব তুমরা ভালো বুঝবা। রাজনীতি করনের বিষয়ের কি আর অভাব আছে? দ্যাশখান তিন টুকরা কইর্যাও এহনও রাজনীতির ক্ষুধা মিটে নাই।’ জল অন্যদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে আমি সঞ্চারীদিকে বললাম, ‘আরে ওসব ছাড়ো, তোমার ঐ গানটার ভাইরাল হওয়ার গল্পটা বলো না?’ চায়ের কাপটা এক চুমুকে শেষ করে ফেলে চোখ মুখ কুঁচকে সঞ্চারীদি কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘এঃ একেবারে জল অইয়া গ্যাসে।’ তারপর কয়েকমুহূর্ত চোখ বুজে বোধহয় গল্পটা মনে মনে সাজিয়ে নিয়ে আবার বলতে আরম্ভ করলেন, ‘তোমরা তো জানোই গান গাওনের লগে আমারে মাঝেমধ্যে ভিন রাজ্যে বা দ্যাশের বাইরে যাইতে অয়। সেই বছর শীতে ঊড়িষ্যার কেওনঝড়ে একখান ক্লাবের অনুষ্ঠানে গান গাওনের লগে নিমন্ত্রণ পাইয়া গিয়াছিলাম। উহারা আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি রাখে নাই। আমারে দেখাশোনার লগে একখান বাঙালিরে রাখছিল। গণ্ডগোলখান বাঁধলো মঞ্চে উঠবার সময়। আমারে যাঁরা চেনে তাঁরা হগলেই জানে যে আমি বাঙাল ভাষাতেই বেশি কথা কই আর দরকার পড়লে ইংরিজিতে। এহন মাইনষের কী খেয়াল জানিনা। মঞ্চে উঠবার আগে শুনি যে মাইয়াখান ঘোষণা করতাছিল সে আমারে সম্বোধন করে কয় কিনা বাংলাদ্যাশী গায়িকা! আমাগো জন্মের আগে বাপ আইছিল যশোর থিক্যা। আমার জন্ম এই দ্যাশেই। তারপর তিরিশডা বছর এই দ্যাশের মাটির সনে মিশ্যা কাটাই দিলাম। বছর বছর দ্যাশের লগে ভোট দিত্যাছি আর এহন লোকে আমারে কয় কিনা বাংলাদ্যাশী? মাইয়াডা তহনও ঊড়িয়ায় গলা ফাটাইয়া বাংলাদ্যাশী গায়িকার লগে শ্রোতাগো হাততালি দিয়া অভিবাদন করতে কইতাছে। যে বাঙালি লোকখান আমারে মঞ্চে নিয়া যাইতাছিল আমি তারে কইলাম “আমারে বাংলাদ্যাশী কয় ক্যান, এই দ্যাশেই জন্ম, এই দ্যাশেই মরুম তা বাংলাদ্যাশী অইলাম কোন যুক্তিতে?” লোকডা আমাগো কথার ধরণ হুইন্যা প্রথমে ফিক কইর্যা হাইস্যা ফ্যালাইল তারপর নিজেরে একটু সামলাইয়া কইলো, “আসলে ম্যাডাম আপনি বাঙাল ভাষা বলেন কিনা তাই ও বুঝতে পারেনি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এক্ষুনি সংশোধন করে দিয়ে আসছি।” আমার মাথায় তহন রক্ত চরছে। আমি শুধু কইলাম, “থাক, আর গান গাওনের দরকার নাই। বাংলাদ্যাশীই যহন অইছি তহন আমারে বরং বাংলাদ্যাশেই ছাইড়্যা আইসো।” পরের দিন আমারে লইয়া খবরের কাগজে অনেক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উইঠ্যা গেল। সেইদিন থিক্যাই এই উৎপাতের শুরু। আমি ভাবি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সত্যজিৎ উঁআদের পূর্বপুরুষ কি বাংলাদ্যাশ থিক্যা আসে নাই নাকি উঁআরা দ্যাশরে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরে নাই? তোমাদের এই সস্তা রাজনীতির চক্করে আজ তেঁনারা পড়লে আমার থিক্যা খুব একডা ভালো অবস্থা অইতো বলে বোধ অয় না। সে যাকগে, এরপর আর একবার অনুষ্ঠান করতে গিয়াছিলাম আসামের গৌহাটির একখান কলেজের সোশ্যালে। সেইখানে বুঝি কিছু বাঙালি ছাত্রছাত্রী আছিল। মঞ্চে উঠতেই সামনের অন্ধকারের একদিক থিক্যা আওয়াজ উঠলো বাংলা গান গাইতে হবে। আমি ঠিক করলাম একখান নিজের লেখা লোকসংগীত গাইবো। গানডার এক লাইন গাইছি কি গাই নাই অমনি সেই অন্ধকার থিক্যা কোলাহল ভাইস্যা উঠলো, “গো ব্যাক বাংলাদেশ, গো ব্যাক বাংলাদেশ” আমি প্রথমডায় কিছু বুঝতে না পাইর্যা চুপ কইর্যা মঞ্চে খাঁড়াই রইলাম। তারপর যহন ব্যাপারখান বুঝলাম তহন আমার চোখ দুটা ভিজ্যা উঠতাছে। সেই প্রথম নিজেরে বড় অসহায় বোধ অইলো। আমার এই দশ বছরের সফল শিল্পী জীবনে ইতিপূর্বে কখনো এমন অপমানিত অইতে অয় নাই। স্লোগান না ছাইড়্যা গান গাইতে জানি নাই কইয়া আমারে ঢিল ছুঁইড়্যা স্টেজ থিক্যা নামাইয়া দিলেও আমি তত দুঃখ পাইতাম না। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে আমার অন্তরাত্মা পর্যন্ত তহন থরথর কইর্যা কাঁপতাছে। একবার ভাবলাম গতবারের মতন চুপচাপ স্টেজ থিক্যা নেমে যায়। তারপর ভাবলাম এর যোগ্য জবাব না দিলে এরা ভাববে আমি বোধঅয় হত্যই বাংলাদ্যাশী, ওরা আমার চালাকিডা ধইর্যা ফ্যালাইছে বলে আমি সুড়সুড় কইর্যা কেটে পড়তাছি। এহন কথা হইলো এর প্রতিবাদ করুম কিভাবে? আমি চিৎকার কইর্যা যা কইবো তা উয়াদের হল্লায় বালির বাঁধের মতন ভাইস্যা যাবে। তারপর মনে হইলো আমি গায়ক মানুষ গানই আমার প্রতিবাদের ভাষা। তাই ওরা যহন আমারে বাংলাদ্যাশী করনের লগে উচ্চগ্রামে চিল্লাইতাছে তহন আমিও নিজেরে উজাড় কইর্যা মুক্তকন্ঠে গান ধইর্যাছি, “ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা/ তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।” গান শুরু করার পর দ্যাখলাম আস্তে আস্তে অডিটোরিয়ামটা একেবারে ঠান্ডা অইয়া গেল। আমার সেই উদাত্ত কন্ঠের গানই শ্রোতার ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ ভিডিও করে সমাজমাধ্যমে ছাইড়্যা থাকবে। তবে আমি এহনও বলবো গান গাওনের লগে আমি ভাইরাল হই নাই, অইছি পরিস্থিতির লগে। আমি সমাজমাধ্যমে নাই। সস্তার কূটকাচালির লগে থাকতে ভালোও লাগেনা। আমি খবরখান দ্যাখতে পাইলাম পরের দিনের কাগজে। তহন থিক্যা লোকে আমারে চিনছে। একডা সময় আছিল যহন একখান প্রোগামের আশায় মাসের পর মাস বইস্যা থাকতে অইতো। এহন দ্যাশ বিদ্যাশ থিক্যা এত ডাকাডাকি যে যাওয়ার সময় হইবো না বলে অনেকগুলা ছাইড়্যা দিতে অয়।’ সঞ্চারীদি থামলো। ওদিকে বাইরে বৃষ্টি থামলেও “গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি/ গরজে গগনে গগনে।” ঠিক এই সময় নিরবতা ভেঙ্গে পারোদি যা বললো মানে যেভাবে বললো তাতে আমাদের সকলেরই তাক লেগে গেল। আমাদের তিনজনকে অবাক করে দিয়ে পারোদি বলতে লাগলো, ‘আমাগো পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বরিশাল। কাজের জায়গায় অসুবিধার লগে আমাগো বাবা বাঙাল ভাষা কইতো না। আমিও কোনোদিন কই নাই। তবে আমাগো দাদু ঠাকুমারা কইতো। তাগো কাছ থিক্যা ছোটবেলায় হুইন্যা কিছুডা শিখছি। দাদু ঠাকুমা গত হইলে পর আমাগো ভিটায় বাঙাল ভাষার চর্চাও চিরতরে উঠ্যা গেল। একডা সময় আছিল যহন দাদু ঠাকমারে এই বাঙাল ভাষা কওনের লগে কত উপহাস করছি, “বাঙাল” কইয়া খ্যাপাইছি। কহনও কহনও তাঁদের চোখ থিক্যা জল পড়তে দ্যাখছি। তহন সেই চোখের জলের মানে আমি বুঝি নাই। কিন্তু আজ আবার সেই ভাষা তোমার কাছে হুইন্যা মনে অইতাছে যেন শিকড়ের বড্ড কাছাকাছি আইয়া পড়ছি। যে শেকড়ের টান দ্যাহের মাঝে শিরায় শিরায় বহমান তা অস্বীকার করনের উপায় কী? অহন আর নুতন কইর্যা কারুর কাছে এই ভাষায় কথা কইতে পারুম না, লোকে হাসবে। কিন্তু তোমার কাছে যহনই আসুম সেই শেকড় আবার খোঁজার চেষ্টা করুম। কাল আবার নবমীর পূজা আছে তার আয়োজনডা কতটা কি এগোলো একবার গিয়া দেইখ্যা আসি। আজ তবে আসি ক্যামন?’ এই বলে পারোদি উঠে পড়লো। ফেরার সময় দেখলাম সঞ্চারী সাহার টলটলে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো দু’ফোঁটা জল।
লেখক : শিক্ষার্থী, ছোটগল্পকার
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment