- 28 April, 2021
- 0 Comment(s)
- 740 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
১
বিয়ের পরে প্রায় তিন মাস হয়ে গেল, এখনো প্রজ্ঞার সাথে তার শাশুড়ির সম্পর্কটা কোনোভাবেই মোলায়েম হতে পারলো না। মফস্সলের পুরোনো আমলের এত বড়ো বাড়ি— শরিকি ভাগাভাগিতে এখন ছিন্নভিন্ন। শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী আর অবিবাহিত ননদকে নিয়ে প্রজ্ঞার নতুন পরিবার। চিলেকোঠার ছোট্টো ঠাকুর ঘরটার মেঝে পুরোটাই সাদা মার্বেল দিয়ে বাঁধানো। গ্রীষ্মের দুপুরে ঘরটা একেবারে তেতে রয়েছে। ঘরের উত্তর দিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা আছে একটা বেশ বড়ো আকারের রূপোর সিংহাসন। সেখানে অধিষ্ঠিতা চতুর্ভুজা কালীমূর্তি শববৎ শিবের বুকের উপর দণ্ডায়মানা। পরনে লাল পাড় সাদা শাড়ি। ইনিই প্রজ্ঞার শ্বশুরবাড়ির কুলদেবী। পিতলের থালায় দেবীর নৈবেদ্য সাজাতে সাজাতে প্রজ্ঞার মনে ভিড় করে আসছে অনেক পুরোনো কথা। ওর মনে হচ্ছে বিয়ের আগের জীবনটা কতই না ভালো ছিল। সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা জীবন। কত স্বপ্ন, কত আনন্দ, কত ইচ্ছা! আর এখন প্রজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে ফেঁসে গেছে এই সংসারের জালের মধ্যে। শাশুড়ি আর ননদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এক জীবন। একে তো বিয়ের আগে ঘরের কোনো কাজেই প্রজ্ঞা হাত পাকায়নি তার ওপর এ বাড়িতে এসে দেখে ছেলের বিয়ে দিয়ে শাশুড়ি নিশ্চিন্তে সংসারের কাজ থেকে হাত গুটিয়েছেন। আর ননদ, ও বাবা সে তো এ বাড়ির একমাত্র আদুরে মেয়ে, ঘরের কাজ করবে ও! এ আবার হয় নাকি? প্রজ্ঞার হাতের আনকোরা কাজ দেখে শাশুড়ির একটু বোঝা উচিৎ ছিল, এত লোকের এত কাজ একা হাতে করা এখনকার যুগের মেয়েদের কাছে বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিয়ে করে প্রথম প্রথম এ বাড়িতে পা রেখেই শাশুড়ির নির্দেশে ঢুকে যেতে হয়েছে সোজা হেঁসেলে। এই বীভৎস গরমে সত্যিই প্রজ্ঞা আর পেরে উঠছে না। একে তো একেবারে নতুন অন্য একটা পরিবেশ, সকলেই অপরিচিত। তার মধ্যে এই রকম গার্হস্থ্য নির্যাতন। সবেমাত্র ইংলিশে অনার্সটা কমপ্লিট করেছিল। ভেবেছিল অন্য কোনো সরকারি চাকরি যদি না ও জোটে তাহলে বি.এড. করে টিচারি প্রফেশনের দিকে চলে যাবে। কিন্তু বাবা সে স্বপ্ন আর পূরণ করতে দিলেন না। একে লকডাউনে বাবা বাইরের চাকরিটা খুইয়েছেন। বড় চাকরিটা চলে যাওয়ায় প্রজ্ঞাদের ইকোনমিকস-এর মেরুদণ্ডটাতে বড় রকমের চিড় ধরে যায়। একমাত্র মেয়ের উপর ভরসা রাখতে না পেরে তড়িঘড়ি দেখে-শুনে বাবা একটা বিয়ে দিয়ে দেন। প্রজ্ঞা এই অকাল বিয়েতে একেবারেই রাজি ছিল না।
পাত্রের নাম রণজিৎ, বয়সে প্রজ্ঞার থেকে সাত বছরের বড়ো। একে প্রজ্ঞা এত বয়স্ক বরকে কখনোই বিয়ে করতে চায়নি তার উপর পাত্রের মুখচ্ছবি দেখে পছন্দও হয়নি। শহরের মেয়ে হয়ে মফস্সলে গিয়ে থাকতে হবে একথাটা ভেবেই প্রজ্ঞার মন বিতৃষ্ণায় ভরে যায়। কিন্তু বাবা তখন প্রজ্ঞার কোনো কথাই কানে তোলেননি। তখন বাবার এমনই অবস্থা যে কোনোরকমে কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে পারলে বাঁচেন। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে প্রজ্ঞা জানতে পারে তার বিয়েটা স্বাভাবিক ভাবে হয়নি। মেয়েকে পাত্রস্থ করতে বাবাকে দুই লাখ টাকা পণ দিতে হয়েছে। আরো কিছু লাভের আশায় শ্বশুরমশাই এখনো হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছেন বাবার কাছে। বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন বলে কথা। এখনো ঘরে অবিবাহিত ছোট মেয়ে রয়েছে, এইটুকু পণে কি আশ মিটে যায়? মানুষ এতটা অভদ্র হতে পারে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি প্রজ্ঞা। ইদানিং শ্বশুরমশাই প্রজ্ঞাকে ডেকে তার সামনেই বাবাকে ফোন করে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেন শুধুমাত্র পণের টাকার জন্য। অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে প্রজ্ঞাকে সবকিছু সহ্য করে যেতে হয়।
এ সংসারের খুঁটোটিও নাড়েন না প্রজ্ঞার শাশুড়ি অন্নদা। অথচ এ পরিবারের সব মানুষ যেন তাঁর ইশারাতেই কাজ করে চলেছে। প্রজ্ঞার মনে হয় হয়তো শাশুড়িই এই পণ নেওয়ার ব্যাপারে শ্বশুরমশাইকে আরও উস্কে দিচ্ছেন। আর এখন এমন পরিস্থিতি এসে দাঁড়িয়েছে যে প্রজ্ঞা আর দু'চক্ষে সহ্য করতে পারছে না অন্নদাকে। দেখলেই কেমন একটা মনের মধ্যে বিরক্তি লাগে। অন্নদাও প্রজ্ঞাকে দেখলে কেমন যেন জ্বলে ওঠেন। তিনিও হয়তো একেবারেই পছন্দ করেন না প্রজ্ঞাকে। সবসময়ই প্রজ্ঞাকে তার মেয়ে মেঘার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখেন। মুখের শ্রী তার এমনই যেন নিয়ম করে বিশ্বের সমস্ত কর্কশতম কথাগুলোকে বেছে বেছে রেখে দেন প্রজ্ঞাকে শোনাবেন বলে। প্রজ্ঞার সাথে ঝগড়ার জন্য সবসময়ই কেমন যেন একটা মারমুখী হয়ে থাকেন অন্নদা। প্রজ্ঞা শান্ত স্বভাবের মুখ চাপা মেয়ে। ঝগড়া একেবারেই করতে পারেনা। তাই বিরুদ্ধ পরিস্থিতি সামনে এলেই সেটাকে সবসময় এড়িয়ে যেতে চায়। যত রাগ সব ওর মনে মনে। প্রজ্ঞা অনেক ভেবেছে এরপর কাজে খুঁত ধরতে এলে শাশুড়িকে শুনিয়ে দেবে দু-চার কথা কিন্তু শেষ এবং চরম মুহূর্তে এসে মুখের কথাগুলো মুখেই আটকে যায় ওর।
মা কালীর পায়ে জবা ফুল উৎসর্গ করতে গিয়ে প্রজ্ঞার মনে হলো— এই অত্যাচার চুপচাপ সহ্য করে যাওয়াটাও অন্যায়। কতদিনই বা এভাবে ঝগড়া-অশান্তি করে থাকা যায়? অস্বস্তিকর একটা জীবন, কিছুই আর ভালো লাগছে না প্রজ্ঞার। মেয়েদের গোটা জীবনটাই কি শুধু সংসারের চরকায় তেল ঢালার জন্যে? না, আর চুপ করে সহ্য করবে না প্রজ্ঞা। নিজেকে ভালো রাখার জন্য ও লড়বে। নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়বে। প্রজ্ঞাকে যে লড়তেই হবে। হঠাৎ কী মনে হলো একটা শ্যামাসংগীত আপন খেয়ালে গুনগুন করে গেয়ে উঠলো। গানের সুরটা হয়ত ঠিক নেই তবুও প্রজ্ঞা গাইলো। হঠাৎ একটা রুক্ষ গলার আওয়াজে চমকে উঠলো প্রজ্ঞা। পিছন ফিরে দেখে দরজার কাছে মেঘা দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা একইভাবে রুক্ষ কণ্ঠে আবার বলল, ‘বেসুরো গলায় চেঁচাচ্ছ কেন দুপুরবেলা? আমার পড়াশুনাই ডিসটার্ব হচ্ছে।’ সরি বলতে গিয়েও কথাটা চেপে প্রজ্ঞা বলল, ‘চেঁচিয়ে গায়নি তো আমি, আস্তে আস্তেই গেয়েছি।’ প্রজ্ঞা দেখলো চেঁচামেচি শুনে ইতিমধ্যেই অন্নদা এসে দাঁড়িয়েছেন মেঘার পাশে। তাঁর বোধহয় দুপুরে ঘুমের ডিসটার্ব হচ্ছিল। তবে আজ অন্নদা অনেকটাই শান্ত, প্রায় কিছুই বললেন না প্রজ্ঞাকে। শরীর খারাপ অথবা মন খারাপ হতে পারে হয়ত। উনি তো আবার কাউকেই মনের কথা বলেন না। মেঘা একাই চেঁচিয়ে গেল, ‘ইডিয়েট, মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির ইললিটারেট একটা বউকে ঘরে নিয়ে এসে জুটিয়েছে দাদা। পড়াশোনার কোনো ভ্যালু জানেনা। ভর দুপুরবেলা চিৎকার করে ভূত ভাগাচ্ছে, ডিসগাস্টিং!’ প্রজ্ঞা কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দিল। এতদিনে প্রজ্ঞা বুঝে গেছে ঝগড়ার সময় কোনো কথা গায়ে মাখতে নেই। অন্নদা তখন মেঘাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘরে পাঠালো বটে কিন্তু নিজেকে আর সান্ত্বনা দিতে পারছে না। এতদিন ধরে একটা বউয়ের সাথে ঝগড়া করে করে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অন্নদার মনে হল প্রজ্ঞা কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা রক্তের মেয়ে, শরীরে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। ঝগড়া করে না, কেউ অপমান করলেও কানে শুনলো কি শুনলো না কিছুই বোঝা যায় না। নিজের খেয়ালে কেমন থাকে। এই মেয়ের উপর ঠিক শাশুড়িগিরিটা যেন ফলানো যাচ্ছে না। নিজের যে একচ্ছত্র আধিপত্যখানা প্রজ্ঞাকে সে বোঝাতে চেয়েছিল সেটা কি আদৌ এ মেয়ে বুঝতে পেরেছে? মেঘার সাথে প্রজ্ঞার পার্থক্যটা এখানেই। একজন উষ্ণপ্রস্রবনের গরম জলের ধারা তো অপরজন যেন ধ্রুবতারার মতো শীতল ও স্থির। অন্নদা তার দীর্ঘ জীবনে দেখেছে একটা মেয়ের জীবনের সুবর্ণময় যুগ আসে যখন সে অন্য একটা মেয়ের শাশুড়ি হতে পারে। অন্নদা তার ঠাকুমাকে দেখেছে, নিজের শাশুড়িকেও দেখেছে যে তাঁরা কেমন বউমা স্বামী ছেলেদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে থাকতে পারে। সেই প্রথম বুঝি মেয়েরা জীবনে একটু স্বাধীনতার স্বাদ পায়। কারণ তখন সে শাসক আর শোষিত হওয়ার জন্য পড়ে থাকে তার বউমারা। না, প্রজ্ঞাকে একবার স্টাডি করতে হবে। ঠিক কেমন ভাবে শাসন করলে এই মেয়ে জব্দ হবে তা জানতে হবে। একে কলকাতা শহরের মেয়ে তার ওপর ছেলের ইচ্ছাতেই শিক্ষিত মেয়েকে ঘরের বউ করে আনা হয়েছে। কিন্তু অন্নদা এত সহজে হাল ছাড়বে না। শাশুড়িত্ব ফলানোর জন্য তাকেও লড়তে হবে। আর কত কাল ধরে সকলের সেবা করে যাবে অন্নদা? জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় সংসারের ঘানি বলদের মতো চোখ বুজে টানতে টানতেই তার কেটে গেল। জীবনের শখ আহ্লাদ আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এখন প্রজ্ঞাও যদি হাতছাড়া হয়ে যায়? শেষকালে দু’দিন হল এ বাড়িতে এসে প্রজ্ঞা পায়ের উপর পা তুলে অন্নদার সেবা নিয়ে যাবে? না, এই রকম পরিস্থিতি কিছুতেই তৈরি হতে দেওয়া যায় না। এই জন্য প্রজ্ঞাকে প্রথম দিন থেকেই অন্নদা একেবারে কড়া শাসনে রেখেছে। অন্নদার দুর্বলতা যেন কোনো ভাবেই প্রজ্ঞা ধরতে না পারে। কিন্তু যত সহজ ভাবে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে ভেবেছিল তত সহজে কিছুই ঠিক হল না এই তিন মাসে। প্রজ্ঞাকে বুঝতে গেলে অন্নদাকে এখন প্রজ্ঞার মনের কাছাকাছি যেতেই হবে। কিন্তু কিভাবে সে রাস্তাটাকে সহজ করবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না অন্নদা। প্রজ্ঞা আজ দুপুরে গান গাইছিল না? হ্যাঁ, সেই সূত্র ধরেই কথা আরম্ভ করা যেতে পারে।
২
সন্ধ্যেবেলা প্রজ্ঞা সন্ধ্যা-দীপ জ্বালিয়ে ধূপকাঠি ঘরে ঘোরাতে গিয়ে দেখলো ঠাকুর ঘরের দরজার কাছে অন্নদা দাঁড়িয়ে আছে। প্রজ্ঞা একটু ঘাবড়ে গেল। অন্নদা বলল, ‘তুমি ধূপ ঘুরিয়ে এসো, আমি এই ঠাকুর ঘরে বসছি। তোমার সাথে কিছু কথা আছে।’ প্রজ্ঞা কিছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। প্রজ্ঞার মনে একটু খটকা লাগল। অন্নদার কী এমন বিশেষ কথা আছে তার সঙ্গে যে এভাবে একাকী বলতে হবে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। শ্বশুরমশাই বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন, রণজিৎ অফিস থেকে এখনো ফেরেনি আর মেঘা গেছে বন্ধুর বাড়ি নোটস্ নিতে। প্রজ্ঞা একটু বেশ সতর্ক হয়ে গেল। নিঃশব্দে ঠাকুর ঘরে ফিরে এসে প্রজ্ঞা দেখল শাশুড়ি এখনো ঠাকুর ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন। প্রজ্ঞা শাশুড়ির সামনে খুব আস্তে করে এসে বসল। অন্নদা বলল, ‘তুমি গান করতে পারো, শিখতে আগে?’
প্রজ্ঞা অন্নদার মুখে এই অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে রীতিমতো ঘাবড়ে গেল। তারপর খুব সাবধানে বলল, ‘না।’ অন্নদা বুঝতে পারল প্রজ্ঞা মন খুলে কথা বলছে না। না বলাটাই স্বাভাবিক, এতদিন শাশুড়ির যা রুদ্রচণ্ড মূর্তি প্রজ্ঞা দেখেছে, সেই তার মুখে এই প্রশ্ন অবান্তর মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্নদা এবার তার কথার সুরে একটু একটু করে বাৎসল্যের রস মেশানোর চেষ্টা করলো, ‘জানো প্রজ্ঞা, আমি আগে খুব ভালো ধ্রুপদী সংগীত গাইতে পারতাম। শিখেছিলাম গুরুজির কাছ থেকে। বিয়ের পর থেকে সব বন্ধ হয়ে গেছে।’ প্রজ্ঞা এবার সত্যিই অবাক হল। অন্নদা ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলছে যেন প্রজ্ঞাকে কতই না স্নেহ করে। প্রজ্ঞা সংক্ষেপে উত্তর দিল,‘ও।’ অন্নদা এবার প্রজ্ঞাকে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি বিয়ের আগে কিছু নাচ-গান শিখতে না?’ প্রজ্ঞা সাবধানে উত্তর দিল, ‘নাচ শিখতাম।’
প্রজ্ঞার সন্দেহ হচ্ছে অন্নদা নিশ্চয় ওর পেটের খবর কিছু জানতে চায় তাই এই সব অবান্তর প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করছে। অন্নদা বলে চলল, ‘জানো, ছোটোবেলায় মেঘা নাচতে খুব ভালোবাসতো। বাজারের মুখে ওষুধের দোকানের পাশের গলিতে একজন ম্যাডাম খুব ভালো নাচ শেখাতেন। ভর্তিও করিয়েছিলাম শখ করে। কিন্তু তোমার শ্বশুরমশাই ছাড়িয়ে দিলেন। বললেন নাচ শিখে কী হবে? এর থেকে পড়াশোনাটাই ভালো করে করুক বড় হয়ে ভালো চাকরি পেয়ে যাবে। মেঘাও হল তেমনি ঠিক তার বাপের মতো। যাও ভেবেছিলাম বড় হলে নিজে থেকেই হয়ত কিছু একটা শিখবে, সেও গতানুগতিক পড়াশুনার মধ্যেই ডুবে রয়ে গেল। শিল্পে কোনো আগ্রহই রাখলো না।’ প্রজ্ঞা খুব মন দিয়ে কথাগুলো শুনলো, তারপর বললো, ‘মা, আমি মেঘার ব্যাপারে একটা কথা বলছি খারাপ ভাবে নেবেন না। আপনি ওর কাছে এতটা সহজ ভাবে থাকেন, এতটাই স্নেহ দেন যে সে অনুশাসনের অভাবে এখন আপনার মাথায় উঠে নাচছে। এখন আপনি ওকে কিছু বলতে গেলেই দেখি আপনার সাথে খুব খারাপ ভাবে উঁচু গলায় কথা বলে। মায়ের সাথে আমি সবসময় বিনম্র ভাবে কথা বলতে শিখেছি, কারণ মায়ের থেকে বেশি ভালোবাসা আর কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় না এবং মায়ের থেকে বেশি শ্রদ্ধার পাত্রও এ পৃথিবীতে কেউ নেই। আপনাকে দেখে আমার মেঘার মা নয়, মেঘার দাসী বলে মনে হয়।’ অন্নদার মনে হল প্রজ্ঞা একদম তার মনের কথাটাই বলে ফেলল। সত্যিই মেঘা এখন এতটাই উদ্ধত হয়ে গেছে যে তাকে শাসন করার মতো আর কিছুই অন্নদার হাতে নেই। এর জন্য অবশ্যই দায়ী মেঘার বাবা। তার ভয়েই মেঘার দোষ দেখেও চুপ করে থাকতে হয়েছে অন্নদাকে। আর এখন মেয়ের কথা চুপচাপ সহ্য করে যেতে হয়। না, প্রজ্ঞার কাছে হার মেনে নিলে চলবে না। অন্নদা প্রজ্ঞাকে বলল, ‘তুমি যে আমার মেঘাকে নিয়ে এত কথা বলছো তোমার স্বামী কি করে তা জানো? বিয়ের আগে রণ’র এক বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, এখনো বহাল রেখেছে হয়ত। তাকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা নেই তোমার।’ একথাটা প্রজ্ঞার জানা ছিল না। রণজিৎ নেশা করে একটু বেশি রাতেই প্রতিদিন বাড়িতে ফেরে এটা দেখে রণ’র প্রতি ওর এমনিতেই মনের ভিতর একটা ঘৃণা জন্ম নিচ্ছিল। অন্নদার কাছে এই কথাগুলো শুনে প্রজ্ঞা মনে মনে খুশিই হল। বুঝলো এ পরিবারে সে অতিথি হয়েই এসেছে। চিরকাল এখানে আর তাকে বাঁধা পড়ে থাকতে হবে না। এবার তবে প্রজ্ঞার মনে মনে একটু হাসি পেল, শাশুড়ির কথাটা শুনে বলল, ‘মা আপনি ভাবছেন রণজিতের দোষগুলোকে আমার সামনে তুলে ধরে আমাকে ঘায়েল করবেন? সেটা সম্ভব নয়। কারণ আমার থেকেও আপনার অনেক কাছের জন। আপনার ছেলে ও। তাহলে দেখলেন তো মা, ‘মা’ হিসেবে আপনি কতখানি ব্যর্থ। আপনার মেয়ের দোষ আপনার নিজেরই চোখে পড়ে আর ছেলের দোষটাও নিজেই ফলাও করে বাইরের একটা মেয়ের সামনে তুলে ধরছেন। মা আপনি আমারও মা, ‘শাশুড়ি মা’। কিন্তু এই মা-এর কর্তব্যটাও আপনি ঠিক করে করতে পারেন না। ঝগড়া-অশান্তি করে এভাবে কতদিন চলা যায় বলুন। আপনারও তো বয়স হচ্ছে। শুধুমাত্র শাসন করলেই সম্মান শ্রদ্ধা পাওয়া যায় না। মানুষকে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসলেই ভালোবাসা পাওয়া যায় আর এর থেকে বড় আনন্দের, বড় সম্মানের আর কিছুই নেই।’
প্রজ্ঞার কথাগুলো যেন শেষ হওয়ার পরও অন্নদার কানে বাজতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে অন্নদার মনটা কেমন যেন একটা বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। যোগ্য মা হতে পারেনি অন্নদা! তাহলে কিই বা হলো এই সংসার ধর্ম করে? প্রজ্ঞার কথাগুলো যেন ধারালো সত্যের মতো অন্নদার বুকে বিঁধতে লাগল। সারা জীবন ধরে শুধু সংসার ধর্মই করে গেছে অন্নদা। এই কাজটাও সে ঠিক করে করতে পারেনি। তবে পুরো জীবনটাই কি তার ব্যর্থ? অন্নদার থমথমে মুখ দেখে প্রজ্ঞার মনে হল অন্নদা বুঝি তার কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। একজন মাকে এভাবে তার মাতৃত্ব তুলে প্রশ্ন করা একেবারেই উচিৎ হয়নি তার। কিন্তু কী করবে প্রজ্ঞাও যে শাশুড়ির সাথে কথা বলতে বলতে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। না, বেশি সহমর্মিতা দেখাতে গেলে হবে না। অন্নদার মনে আঘাত লেগে সে এখন একটু দুর্বল হয়ে রয়েছে। এই মুহূর্তে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে প্রজ্ঞা আর যেকটা দিন এ বাড়িতে আছে সেকটা দিনের জন্য যদি একটু ভালো থাকার কোনো ব্যবস্থা করে নিতে পারে তাতেই ওর লাভ। প্রজ্ঞা অন্নদার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার গা ঘেঁষে একেবারে পাশে এসে বসে পড়ল। আস্তে আস্তে অন্নদার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলল, ‘মা, আপনি গান নিয়ে চর্চাটা আবার শুরু করুন দেখবেন মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। মনের কথা কাউকে বলতে না পারলেও গানের মাধ্যমে তা অনায়াসে ব্যক্ত করা যায়। নিজের ইচ্ছাগুলোকে সম্মান জানান মা, দেখবেন খুব ভালো থাকবেন।’ অন্নদা বলল, ‘তা হয় না প্রজ্ঞা। এতদিন হয়ে গেল গান ছেড়ে দিয়েছি। তোমার শ্বশুরমশাই এসব পছন্দ করেন না।‘ প্রজ্ঞা বলল, ‘চেষ্টা করলেই সবাই সব বয়সে সবকিছুই পারে মা। আপনিও পারবেন। আর আপনার মেয়ের হয়ে আমি নাচ শিখে আপনার ইচ্ছা পূরণ করব। আমাকে নাচ শিখতে যেতে দেবেন তো মা?‘ প্রজ্ঞার আবদার শুনে অন্নদা কোনো উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ মাটিতে পা ভাঁজ করে বসে থেকে হাঁটুতে ব্যথা হয়ে গেছে। প্রজ্ঞার কাঁধের উপর ভর দিয়েই অন্নদা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর শাড়িটাকে গুছিয়ে নিয়ে সামান্য টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে গেল।
৩
পরের দিন সকালে প্রজ্ঞা ওষুধ কিনতে যাওয়ার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। বাজারের মুখে ওষুধের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো সেই ম্যাডাম এখনো নাচ শেখান। পাশের গলি দিয়ে ঢুকে দু’নম্বর বাড়ির দিকে এগোতে একটা অল্প বয়সি মেয়েকে ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখলো। তার পোশাক দেখে প্রজ্ঞার মনে হল হয়ত নাচ শিখে ফিরে যাচ্ছে। প্রজ্ঞাকে গেটের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখে গেটের ভিতর থেকে এক ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাকে চাইছেন?’
প্রজ্ঞা দেখলো মহিলার বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ হবে। চুলটা বাদামি রং করা। পরনে হলুদ কুর্তি, কালো পাটিওয়ালা আর কাঁধ থেকে আড়াআড়ি ভাবে একটা কালো ওড়না কোমরে বাঁধা। প্রজ্ঞা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে কেউ নাচ শেখান?‘ মহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ আমি শেখাই, বলুন।’ প্রজ্ঞা বলল, ‘নাচে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই আপনার সাথে।’
ভিতরে আসতে বলে মহিলা প্রজ্ঞাকে নিয়ে গিয়ে বসালো নিচের তলার একটা বড় হলঘরে। সামনেই রাখা একটা পিতলের নটরাজ মূর্তি। এই ঘরেই বুঝি ম্যাডাম নাচ শেখান। প্রজ্ঞা তার নাচের ব্যাপারে সমস্ত সুবিধা-অসুবিধা ম্যাডামকে খুলে বলল। সব শুনে ম্যাডাম প্রজ্ঞাকে বললেন, তিনি আজ সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা থেকে ফাঁকা আছেন, প্রজ্ঞা এলে তাকে এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে একটু তৈরি করে দিতে পারবেন। তবে ভারতনাট্যমে ঘুঙুর সঙ্গে আনা মাস্ট।
প্রজ্ঞা বাড়ি ফিরে এসে মনে মনে স্থির করল, সে আজ যাবেই। কোনো বাধা-বিপত্তিকেই সে তোয়াক্কা করবে না। সন্ধ্যে ছ’টা বাজতে না বাজতেই প্রজ্ঞা রেডি হতে শুরু করে দিল। শ্বশুড়বাড়িতে তার কুর্তি-চুরিদার এসব পরা মানা তাই শাড়ি পরেই রাস্তায় বেরোতে হবে। কুর্তি আর পাটিওয়ালাটা ব্যাগে পুরে নিল প্রজ্ঞা। বিয়ের সময় যে ঘুঙুরটাকে এনে এ বাড়িতে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল প্রজ্ঞা সেটাকে একটা নীল কাপড়ে ভালো ভাবে জড়িয়ে ব্যাগে পুরে নিল যাতে কারোর কানে কোনো আওয়াজ না পৌঁছায়। বাইরে পাঁচ মিনিট ধরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। উঠোনটা পিছোল। পা টিপে টিপে সাবধানে প্রজ্ঞা ছাতা মাথায় দিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ছিটকানিটা যতটা সম্ভব আস্তে করে খুললো যাতে আওয়াজ না হয়। তবুও শেষ রক্ষে হল না। মেঘা পিছনে বারান্দা থেকে চেঁচাচ্ছে, ‘কোথায় যাচ্ছ বৌদি এই বৃষ্টির মধ্যে?’ প্রজ্ঞা মনটাকে শক্ত করল। আজ যেভাবেই হোক তাকে যে যেতেই হবে। নিজের শখ মেটাতে আজ মরিয়া হয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা বলল, ‘ওষুধের দোকানে যাচ্ছি।’ মেঘা বলল, ‘আজ সকালেও তো গেলে, তাতে হল না? দাদাকে বললেই পারতে, এনে দিত। এত বাইরে বেরোনোর শখ হয় কেন তোমার আজকাল?’ মেঘার গলা শুনে ইতিমধ্যে অন্নদা ছুটে এসেছে। সব শুনে তার বুঝতে মোটেও বাকি থাকলো না যে প্রজ্ঞা কোথায় যাচ্ছে। অন্নদা মেঘাকে বলল, ‘যেতে দে মেঘা।’ তারপর প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যাও প্রজ্ঞা, সাবধানে যেও আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো কেমন।’ শাশুড়ি কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই প্রজ্ঞা উধাও। না, এ মা-মেয়েকে একেবারেই বিশ্বাস নেই। কখন আবার বেঁকে বসে। এদের সব কথা শুনে চলতে গেলে প্রজ্ঞা পাগল হয়ে যাবে। মেঘা মায়ের এই অদ্ভুত আচরণে একেবারে জ্বলে উঠে বলল, ‘ওকে যেতে দিলে কেন মা?’ অন্নদা বলল, ‘যাক্, আমাকে আগেই বলে রেখেছিল ভ্যাকসিন নিতে যাবে।’
—‘কীসের ভ্যাকসিন, করোনার?’
—‘না, ভালো থাকার ভ্যাকসিন।’
লেখক : ছাত্রী, গল্পলেখক
ছবি : প্রতীকী
0 Comments
Post Comment