- 09 July, 2022
- 0 Comment(s)
- 351 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
"একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে
ফিরবে না সে তো আর কারো আকাশে" (মুকুল দত্ত)
হয়তো এই গানটা শের মহম্মদের মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। রেণু পাখি হতে চেয়েছিল, স্বাধীন ভাবে, স্বচ্ছল হয়ে, চাকরি করার স্বপ্ন দেখেছিল, সে দুবেলা ভাত রেঁধে, পঞ্চ ব্যঞ্জন সাজিয়ে, শের মহম্মদের লুঙ্গি-গেঞ্জি- জাঙ্গিয়া কেঁচে, মুখ চেপে হেসে, দুঃখকে শিকেয় তুলে, কষ্ট ভুলে, ফিসফিস করে কথা বলে, সাবধানে পা ফেলে বাঁচতে চাননি; তারফলে রেণুকে জব্দ করতে শের মহম্মদ তাঁর ডানা ছেটে ফেলে!
আমদের অগোচরে নেই সেই ঘৃণিত ঘটনা। রেণু নার্সিং ট্রেনিং করেছিলেন। তারপর তিনি যখন চাকরির জন্য মনোনীত হলেন, কালের নিয়মে সংসারে অশান্তি শুরু হয়।
শেরের দম্ভে আঘাত লাগে। রেণু কয়েক কদম এগিয়ে গেছে, তাই তাঁকে সন্দেহ করতে থাকেন । কী করে সে সরকারি চাকরি করে, তা দেখে নেওয়ার হুমকিও দেয়। বিচারকের কাছে জবানবন্দিতেও রেণু এই দাবি করেছেন। চার্জশিটে তাই জানানো হয়েছে। পুলিশের দাবি, মুর্শিদাবাদের ভরতপুরের তালগ্রামের এক তুতোভাই ও তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে সেখানে রেণুর হাত কাটার পরিকল্পনা করে শের মহম্মদ। সে অনুযায়ী, ৪ জুন রাতে একটি স্কুটারে শের-সহ চার জন কেতুগ্রামের কোজলসার বাড়িতে পৌঁছয়। রাত ১০টা নাগাদ ঘুমন্ত রেণুর মুখ বালিশ দিয়ে চেপে ধরে শের মহম্মদ। পা চেপে ধরে তার তুতো ভাই। বাকি দু’জনে টিন কাটার কাঁচি দিয়ে রেণুর ডান হাত কাটারির কোপে কব্জি কেটে নেয়। রেণুকে কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে, ‘কাটা হাত’ নিয়ে আসার নাম করে বেপাত্তা হয়ে যায় শের মহম্মদ।(তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার অনলাইন, ০৭ জুলাই ২০২২)
এরকম নৃশংস ঘটনার খবর পড়ে আমার,আপনার কী হবে? সাধারণ সুস্থ বোধ সম্পন্ন মানুষ হা-হুতাশ করবেন, উহু-আহা করবেন। আবেগে ভেসে গিয়ে 'আহারে জীবন' বলে হয়তো বিড়বিড় করে উঠবেন। মেরে, কেটে ফেললে ঐ মোম মিছিল, নরম গরম স্ট্যাটাস অবধি আমাদের সীমাবদ্ধতা! আর কীই-বা করতে পারি? তা যাই হোক, অনলাইন সংবাদপত্রে রেণুর ঘটনা পড়ে থমকে, চমকে, আটচল্লিশ হয়ে আছি, সেইসময় দেখি পিতারা এয়ে পড়েছেন রেণুর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে। এখানে আনন্দবাজার পত্রিকা, Zee 24 Ghanta, এইসময় ফেসবুক পেজের পুরুষদের কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি-
ক) ওদের পরিস্থিতিটা কী আছে আমাদের জানা নেই, ওরাই ভাল জানে। কোন হাসব্যান্ড জোর করে ওয়াইফের ক্ষতি করতে চাই না।
খ) আজকাল ছেলেদের আর মেয়েদের ক্যারেক্টর কী এক? তফাৎ তো আছে।
গ) ঠিক কাজ করেছে, স্বামীর কথা শোনে না।
ঘ) এটা পরকীয়ার পরিণতি।
ঙ) আজগবি কথা বল্লেন, স্বামী ওরে ভালোবাসে বলেই হাত কাটছে যাতে অন্য পুরুষের সাথে চলে না যায়।
চ) মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঐ মেয়েটাকে নার্সিং ট্রেনিং করিয়ে, যখন চাকরি পেয়ে গেল, তখন নিজের স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য একটি ছেলেকে বিয়ে করার চেষ্টা করছিল। তাই উচিত শিক্ষা পেয়েছে।
ছ) ছোট্ট ঘটনা এটা নিয়ে এতো মাতামাতি করছেন কেন?
জ) একটা তথাকথিত পুরুষতান্ত্রিক দেশে এবং একইসাথে পুরুষতান্ত্রিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক হয়েও একজন পুরুষকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে তারমানে নৈতিক অবক্ষয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঝ) আমার মনে হয়েছে কেউ হয়তো ওকে বলেছে তোর বউ চাকরি করলে ডাক্তারদের সাথে রাত কাটাবে আর তুই একা রাতে আঙুল চুসবি এই ধরনের কিছু একটা হয়েছ, তার থেকে এই ঘটনা।
ঞ) কেউ চাইনা প্রিয়তমা পরকীয়ায় আসক্ত হোক।
ট) পরকীয়া করেছিল মেয়েটি? কী জানি যা ভেজাল চলছে সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না তবে ছেলেটি যা হিংস্রতা দেখিয়েছে ক্ষমার অযোগ্য।
এই ঘটনার কিছুদিন পর রেণুর বিরুদ্ধে পরকীয়ার অভিযোগ তুলেছে প্রধান অভিযুক্ত শের মহম্মদ ওরফে শরীফুল শেখ। সে জানায়- "বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও পরকীয়ার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তাই হাত কেটে নেওয়ার মতো পদক্ষেপ! এই অভিযোগের পরেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায়।" (তথ্যসূত্র :এইসময়, ১৮ জুন ) এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দাজে ঢিল ছোড়া মন্তব্যকারীরা অত্যন্ত আনন্দিত হন। তাঁহারা যে কত বড় গোয়েন্দা, আগেই এই পরকীয়া সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলেন, মেয়েটির চরিত্রের দোষ আঁচ করতে পেরেছিলেন ইত্যাদি ইত্যাদি জানিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাঁদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে সামাজিক মাধ্যম ভরে ওঠে। এইসময়, সংবাদ প্রতিদিন, Zee 24 Ghanta ফেসবুক পেজ থেকে তেমন কিছু মন্তব্য একবার দেখে নেব-
ঠ) পরকীয়ার অভিযোগ তুলে হাতকাটার অভিযোগ মাপ হয়ে যায় না। তবে সত্যি পরকীয়া ছিল কি না সেটাও সামনে আসা দরকার।
ড) যা রটে তার কিছু তো বটে।
ঢ) স্বামী থাকতে অন্য কোন ছেলের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করবে এটি কোন সভ্যতা?
ল) যদি পরকীয়া করে থাকে সত্যি তাহলে ছেলেটা হাত কেটে ভুল করেছে মুন্ডুটা আলাদা করে জেল খাটলে ঠিক হতো।
ত) লজ্জা করে না স্বামীকে ধোকা দিয়ে পরকীয়া করতে।
থ) সরিফুলের কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
দ) হলেও হতে পারে।
ধ) It Is Right News.
ন) Tit for Tat.
প) আসল ঘটনা এবার সামনে এলো।
ফ) ভালো করেছে, বারোভাতারী গুলো এটা থেকে কিছু শিখবে।
শরিফুলের মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে রেণু জানিয়েছেন- "নিজেকে বাঁচানোর জন্য এই মন্তব্য করছে ও। এলাকার সকলেই জানে আমাকে চাকরি করতে দেবে না বলেই আমার হাত কেটে দেওয়া হয়েছে। একা এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক এই কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এখন ওরা বেঁচে পালাতে চাইছে। আমি ওর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দাবি করছি।” (তথ্যসূত্র:এইসময়, ১৮/৬/২২)
গুণগত আধেয় বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে তথ্য সমূহ উপস্থাপন করা হল-
|
তথ্যসূত্র |
মন্তব্যের সংখ্যা ও ধরন |
মন্তব্যের ভাষা |
মন্তব্য সম্পর্কে ধারণা |
৬/৬/২০২২ |
আনন্দবাজার পত্রিকা |
ক-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। তবে‘কোন হাসব্যান্ড জোর করে ওয়াইফের ক্ষতি করতে চাই না’বাক্যটি দেখে মন্তব্যকারী রেণুরপ্রতি সন্দিহান বলে মনে হচ্ছে। |
শের মহম্মদের পক্ষ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
খ-লিখিত মন্তব্য |
মেয়েদের ক্যারেক্টর। |
চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। |
৬/৬/২০২২ |
আনন্দবাজার পত্রিকা |
গ- লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী হাত কাটা ঠিক বলে মনে করছেন। |
৬/৬/২০২২ |
আনন্দবাজার পত্রিকা |
ঘ-লিখিত মন্তব্য |
পরকীয়া। |
মন্তব্যকারী পরকীয়ার পরণতি এরকম হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন। |
৬/৬/২০২২ |
আনন্দবাজার পত্রিকা |
ঙ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারীর পুরো বিষয়টিতে খুব মজা পেয়েছেন। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
চ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
রেণু উচিত শিক্ষা পেয়েছে বলে মনে করেছেন মন্তব্যকারী। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
ছ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী এই হাতকাটাকে ছোট্ট ঘটনা বলে মনে করছেন। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
জ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যে তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
ঝ-লিখিত মন্তব্য |
রাত কাটাবে, আঙুল চুষবি। |
মন্তব্যকারী মনে করেছেন, নার্সের চাকরি পেয়ে রেণু ডাক্তারদের সঙ্গে রাত কাটাবেন। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
ঞ-লিখিত মন্তব্য |
পরকীয়ায় আসক্ত। |
মন্তব্যকারী রেণু পরকীয়া করেন বলে মনে করছেন। |
৬/৬/২০২২ |
Zee 24 Ghanta |
ট-লিখিত মন্তব্য |
পরকীয়া। |
মন্তব্যকারী রেণু পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।তিনি মনে করেছেন শের-রেণুর অসুস্থ সম্পর্ক ছিল।তবে শের ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছেন বলে মনে করেছেন। |
১৮/৬/২২ |
এই সময় |
ঠ-লিখিত মন্তব্য |
পরকীয়া |
মন্তব্যকারী রেণুর পরকীয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। শেরের সাজা হওয়া দরকার বলে মনে করছেন। |
১৮/৬/২২ |
Zee 24 Ghanta |
ড-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী যা রটেছে তা সত্যি বলে মনে করেছেন। |
১৮/৬/২২ |
এই সময় |
ঢ-লিখিত মন্তব্য |
শারিরীক সম্পর্ক। |
মন্তব্যকারী মনে করছেন- রেণুর অন্য পুরুষের সঙ্গে শারিরীক সম্পর্ক আছে। |
১৮/৬/২২ |
এই সময় |
ল-লিখিত মন্তব্য |
মুন্ডু কাটা। |
মন্তব্যকারী মনে করছেন- রেণুর পরকীয়া থাকলে মাথা কেটে নেওয়া উচিত। |
১৯/৬/২২ |
Zee 24 Ghanta |
ত-লিখিত মন্তব্য |
পরকীয়া |
মন্তব্যকারী মনে করছেন- রেণু শের মহম্মদকে ঠকিয়ে পরকীয়া করেছেন। |
১৯/৬/২২ |
Zee 24 Ghanta |
থ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী শের মহম্মদকে সমর্থন করেছেন। |
১৯/৬/২২ |
সংবাদ প্রতিদিন |
দ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী শের মহম্মদকে সমর্থন করেছেন। |
১৯/৬/২২ |
সংবাদ প্রতিদিন |
ধ-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী শের মহম্মদকে সমর্থন করেছেন। |
১৯/৬/২২ |
সংবাদ প্রতিদিন |
ন-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী শের মহম্মদকে সমর্থন করেছেন। |
১৯/৬/২২ |
সংবাদ প্রতিদিন |
প-লিখিত মন্তব্য |
অসংবেদনশীল ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি। |
মন্তব্যকারী মনে করেছেন রেণু পরকীয়া করে। |
১৯/৬/২২ |
সংবাদ প্রতিদিন |
ফ-লিখিত মন্তব্য |
বারোভাতারী |
মন্তব্যকারী শের মহম্মদকে সমর্থন করেছেন।সমাজের অন্য নারীরা এর থেকে শিক্ষা পাবেন বলে মনে করেছেন। |
উপরিউক্ত মন্তব্যগুলি দেখে মনে হয় রেণুর চরিত্র নিয়ে অধিকাংশ মন্তব্যকারী সন্দিহান। একজন নারী চাকরি করতে চেয়েছিলেন, সেই অপরাধে হাত কেটে নেওয়া হল? চাকরি করা অপরাধ? পান থেকে চুন খসলে নারীর চরিত্র খারাপ হয়ে যায়? আজকের দিনে এসে দেখা যাচ্ছে পচনশীল সমাজের ছত্রে ছত্রে নারীবিদ্বেষীরা বহাল তবিয়তে বিরাজমান। কেন? আমরা এই জঘন্য অপরাধী মানসিকতার তথাকথিত শিক্ষিত পিতাদের কেন সমর্থন করছি?
This girl is on fire
She's walking on fire
This girl is on fire (Songwriters: Salaam Remi / William Squier / Alicia Keys / Jeffrey Bhasker)
রেণুর হাত কেটে নেবার পর রেণু বেঁচে আছেন।
তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে সবাই চমকে গেছেন। ডান হাত কেটে নেওয়ার পরে তিনি মুষড়ে পড়েননি। একটু সুস্থ হবার পরে তিনি হাসপাতালে বসেই বাঁ হাতে লেখা অনুশীলন শুরু করে দিয়েছেন। চরিত্র ধরে টানাটানি, অশ্লীল মন্তব্য কোন কিছু নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে গেছেন। তিনি আমাদের অগ্নিকন্যা। বস্তাপচা সমাজ, বস্তাপচা চরিত্র তাঁকে দাবাতে পারেনি। ভালবেসে তিনি শের মহম্মদের সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন, সেই ভালবাসার মানুষ তাঁকে উচিত শিক্ষা দিয়ে অনেক অনেক মজবুত করে তুলেছেন।
0 Comments
Post Comment