- 16 July, 2022
- 0 Comment(s)
- 371 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
সামাজিক মাধ্যম না থাকলে সত্যিই আমরা বুঝতেও পারতুম না তথাকথিত শিক্ষিত সমাজের মানসিকতা। প্রতিনিয়ত 'কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ' নিয়ে মনের সুখে, তীব্র আক্রমণাত্মক হয়ে, হাতে তরবারি নিয়ে নারীদের হেনস্থা করতে সত্যিই কী মজা না পাওয়া যায়! আমরা যে বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করেছি, সেখান থেকে যে ফলাফল পেয়েছি সেগুলি একবার দেখে নেব।
সামাজিক মাধ্যম ও পিতৃতান্ত্রিকতা : সামাজিক মাধ্যমগুলি পিতৃতান্ত্রিক মনভাব প্রকাশ, প্রচার, সমর্থনের স্বর্গরাজ্য। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে মনের সুখে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে নারীদের উদ্দেশ্যে অপমানজনক ভাষা, শব্দ, ছবি, প্রতীক ব্যবহার করে মন্তব্য করতে পারেন।
কটুভাষা প্রয়োগ : আমরা যে আলোচনা করেছি, সেখানে দেখতে পেয়েছি প্রায় সব মাধ্যমেই সুতপা, পল্লবী, রেণুর উদ্দেশ্যে অপমানজনক মন্তব্য করেছেন মন্তব্যকারীরা। চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে সকল অবমাননাকর ভাষা প্রয়োগ করেছেন সেগুলো- পরকীয়া করেছে, শারিরীক সম্পর্কে জড়িত, বারোয়ারি মেয়ে, প্রস্টিটিউট, বারোভাতারী, বাজে মেয়ে, রাত কাটাবে, চরিত্রের ঠিক নেই ইত্যাদি।
নৈতিক অধ:পতন: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জনপ্রিয়তার জোয়ারে ভাসছে। আবালবৃদ্ধবনিতা অতীব আনন্দের সহিত এই মাধ্যমগুলিতে অবলীলায় নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। তরুণ প্রজন্ম যেহেতু বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অতিবাহিত করেন, তাই আমাদের অতি প্রিয় দেশ যে কোন উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে চলেছে, বোঝাই যাচ্ছে!
বিকারগ্রস্ত সমাজ: নারীবিদ্বেষমূলক মন্তব্যগুলি দেখে বোঝা যায়, কী অসুস্থ পরিবেশে আমরা বাস করছি!
বিকৃত রুচির প্রকাশ: বিকৃত রুচির মন্তব্যগুলিতে লাইক, এবং প্রত্যুত্তরের মন্তব্যগুলি দেখে বোঝা যায়, সামাজিক মাধ্যমে অধিকাংশ অসুস্থ মস্তিষ্ক সচল থাকেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোলামেলাভাবে নিজের বক্তব্য রাখলে, খোলামেলা পোশাক পরলে, টেলিভিশন অভিনেত্রী হলে, মডেল হলে আমাদের পিতারা 'মন্দ মেয়ে’ তকমা লাগিয়ে দিচ্ছেন। আবার তাঁরা মনে করছেন- এই ধরনের মেয়েদের, যা ইচ্ছা মন্তব্য করা যায়! বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন -"রাস্তার ইভ টিজার এবং অনলাইনে অশালীন কটু মন্তব্যকারী—দুজনের অপরাধ প্রায় একই। যারা নিয়মিত কটূক্তি করে বেড়ায় তাদের কয়েকজনকে সাজা দিলে হয়তো অন্যরাও সতর্ক হবে। অনলাইনে এ বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচারণাও করা যেতে পারে।" (তথ্যসূত্র: কালের কন্ঠ, ৩ অক্টোবর, ২০১৯)
করোনা পরবর্তীকালে এই 'নিউ নরমাল' দুনিয়ায় আগের থেকে দ্বিগুণ উৎসাহে আমাদের পিতারা নারী বিদ্বেষ শুরু করেছেন- "সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (যেমন: ফেসবুক, টুইটার), নারী বিদ্বেষ বেশ চোখে পড়ছে। করোনাভাইরাসের (কোভিড ১৯) মাহামারির এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে নারীর প্রতি কুটুক্তি, হয়রানি, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের মাত্রাও আশংকাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে নতুন সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। ( তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ২০ জুন, ২০২০)
আদ্যিকাল থেকে এই যে সমস্যার শুরু হয়েছে, তার তো শেষ দেখতে পাচ্ছি না। বৈষম্যমূলক পৃথিবীতে বাস করা বড়ই কষ্টকর! এমন রাজনৈতিক গোলকধাঁধায় পড়েছি আমরা! এই যে নারীবিদ্বেষ সেটি যে একটি রাজনীতি এর পিছনে যে আমাদের পিতারা ফোঁস ফোঁস করছেন, অপরদিকে 'চরিত্রহীনা', 'বারোভাতারী', 'খানকি', 'বারোয়ারী মাল', ইত্যাদি নাম দিয়ে নারীদের শরীর পুরুষদের নিজস্ব সম্পদ ভাবানোর প্রাচীন রাজনীতির খপ্পরে পড়ে; 'বাবা গো মা গো' বলে পাঁচিলের ফোঁকল গলে' নাজেহাল অবস্থার মধ্যে পড়েছি।
সম্প্রতি প্রাক্তন বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেনকে নিয়ে আমাদের পিতারা সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের নারী বিদ্বেষমূলক প্রচার চালাচ্ছেন। কারণ তিনি একাধিক প্রেম করেছেন, শিল্পপতির প্রেমে পড়েছেন তাই গোল্ড ডিগার নারী, সাতচল্লিশ বছর বয়সে বাড়াবাড়ি করছেন ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের যে স্থানে নারী বিচরণ করুক, পিতাদের ছকে না চললে, সাড়ে সর্বনাশ!
আমাদের আলোচনায় বিয়াল্লিশটি মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বিদ্বেষমূলক মন্তব্য যাঁরা লিখেছেন তাঁরা সকলেই তথাকথিত শিক্ষিত এবং এইদলে বিভিন্ন পেশার নারী ও পুরুষ আছেন। মন্তব্যকারীরা নরমে,গরমে তাঁদের মনের ভাব সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। না, তাঁরা কোন লজ্জা পাননি, সগর্বে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সকলে একই সুরে গান গেয়েছেন। তাহলে, মোদ্দা কথা কী দাঁড়ালো? মিসোজিনি থুক্কু নারীবিদ্বেষ চলছে, চলবে। আমাদের পিতাদের চোখ রাঙানো সহ্য করেই কালাতিপাত করিতে হইবে। মাঝে মধ্যে আমাদের হুঁশ হলে, দু- একটা কথা কয়ে, পুনরায় দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে পড়িবো। আবার কড়ানাড়া শুনতে পেলে বেরিয়ে এসে, অরণ্য রোদন করে মনের বেদন প্রকাশ করিয়া যাইবো!
0 Comments
Post Comment