- 04 June, 2022
- 0 Comment(s)
- 341 view(s)
- লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
বৈবাহিক প্রেমের সমর্থকরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য স্বেচ্ছায় সওয়াল করেন যে, এটা প্রেম নয় এবং সেটাই তাকে একটি বিস্ময়কর চরিত্র দান করেছে। কারণ, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বুর্জোয়ারা একটি মহাকাব্যিক শৈলী উদ্ভাবন করেছেন : দিনানুদৈনিকতা চেহারা নিয়েছে অ্যাডভেঞ্চারের, বিশ্বস্ততা গ্রহণ করেছে তুরীয় উন্মাদনার স্বরূপ, একঘেয়েমি হয়ে উঠেছে বিজ্ঞতা এবং পারিবারিক ঘৃণা হয়েছে প্রেমের গভীরতম রূপ। আসল ব্যাপার হল, একে-অপরকে ঘৃণা করে চললেও একে-অপরকে ছেড়ে থাকতে না পারা দু-জন ব্যক্তির সম্পর্ক সমস্ত মানবিক সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে সত্য বা সবচেয়ে মর্মস্পর্শী নয়, তা সবচেয়ে করুণ। এর বিপরীতে, আদর্শটি হল--মানুষেরা যথাযথভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবেন এবং তাঁদের প্রত্যেকের একে-অপরের সঙ্গে কেবল ভালোবাসার মুক্ত সম্মতিতেই শৃঙ্খলিত হওয়া উচিত। টলস্টয় প্রশংসা করে বলেছেন যে, পিয়েরের সঙ্গে নাতাসার বন্ধন হল “সংজ্ঞাতীত, যদিও তাঁর নিজের আত্মার সঙ্গে দেহের মিলনের মতো দৃঢ় এবং অটুট”। এখন আমরা যদি দ্বৈতবাদী অনুমানকে গ্রহণ করি, তাহলে বলতে হয় আত্মার জন্য দেহ শুধুমাত্র একটি বিশুদ্ধ বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং, দাম্পত্য মিলনে, প্রত্যেকের কাছে অপরের জন্য থাকবে আনুষঙ্গিক সত্যের অনিবার্য ওজন। একটা অর্থহীন উপস্থিতি এবং যা নিজের দ্বারা নির্বাচিত নয়, অথচ প্রয়োজনীয় শর্ত এবং অস্তিত্বের অবশ্যম্ভাবী প্রকরণ, এইভাবে ভেবে নিয়ে দাম্পত্যকে গ্রহণ করতে হবে এবং ভালোবাসতে হবে। ‘দায়িত্ব গ্রহণ’ এবং ‘ভালোবাসা’ এই দুটি শব্দের মধ্যে একটি ইচ্ছাকৃত বিভ্রান্তি রয়েছে এবং সেখান থেকেই রহস্যের জন্ম। আমরা যার দায়িত্ব নিই, সেটা আমরা পছন্দ করি না। আমরা আমাদের শরীর, অতীত এবং বর্তমানের দায়িত্ব নিই : কিন্তু প্রেম হল অন্যের দিকে, নিজের থেকে আলাদা একটি অস্তিত্বের দিকে, একটি পরিণতি, একটি ভবিষ্যতের দিকে চলন। যদিও একটি বোঝা, একটি অত্যাচার গ্রহণ করার পন্থা ভালোবাসা নয়, তা হল বিদ্রোহ করা। একটি মানবিক সম্পর্কের কোনো মূল্যই থাকে না যদি তা তাৎক্ষণিকতার অধীন হয়। উদাহরণস্বরূপ, শিশু এবং পিতামাতার সম্পর্ক কেবল তখনই মূল্যবান হয় যখন সেই সম্পর্কগুলি চেতনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়। কেউই দাম্পত্য সম্পর্কের প্রশংসা করতে পারেন না যদি সেই সম্পর্কগুলি তাৎক্ষণিকতার মধ্যে পতিত হয় এবং তার মধ্যে গ্রস্ত হয় স্বামী-স্ত্রীর স্বাধীনতা। সংযুক্তি, বিরক্তি, ঘৃণা, নির্দেশ, সমর্পণ, অলসতা, কপটতার এই জটিল মিশ্রণ, যাকে বলা হয় দাম্পত্য প্রেম, সেই দাম্পত্য প্রেমকে আমরা কেবল সম্মান করার দাবি জানাই যেহেতু তা একটি অজুহাত হিসাবে কাজ করে। তবে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যা সত্য, শারীরিক প্রেমের ক্ষেত্রেও তা সত্য। বন্ধুত্বকে খাঁটি হতে হলে তাকে প্রাথমিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। স্বাধীনতা বলতে কিন্তু খামখেয়ালিপনা বোঝায় না : এই অনুভূতি হল একটি অঙ্গীকার যা তাৎক্ষণিকতাকে অতিক্রম করে চলে যায়। তবে এটা কেবল ব্যক্তির ওপরেই নির্ভর করে--কীভাবে তিনি তাঁর সাধারণ ইচ্ছা এবং নিজস্ব আচরণীয় পন্থার মধ্যে মোকাবিলা করে হয় নিজের সিদ্ধান্তকে বহাল রাখবেন, অথবা বিপরীতে তা ভেঙে দেবেন। অনুভূতি তখনই স্বাধীন যখন তা কোনোরকম বাইরের নির্দেশের ওপর নির্ভর করে না, যখন তা একটি নির্ভীক আন্তরিকতার মধ্যে বেঁচে থাকে। বিপরীতে, ‘দাম্পত্য প্রেম’-এর নির্দেশ আমন্ত্রণ জানায় সমস্ত রকম অবদমন এবং সমস্ত রকম মিথ্যাকে। এই নির্দেশ প্রথমত স্বামী-স্ত্রীকে বাধা দেয় একে-অপরকে সত্যরূপে জানতে। প্রতিদিনের ঘনিষ্ঠতা বোঝাপড়া বা সহানুভূতি কোনোটাই তৈরি করে না। স্বামী তাঁর স্ত্রীকে অতিমাত্রায় সম্মান করেন স্ত্রীর মনস্তাত্ত্বিক জীবনের রূপান্তরগুলির প্রতি আগ্রহী থাকার জন্য। এর অর্থ হল, স্ত্রীর মধ্যে থাকা গোপন স্ব-শাসনকে চিনতে চাওয়া, যে-গোপন স্ব-শাসন হতে পারে বিব্রতকর, বিপজ্জনক। বিছানায় স্ত্রী কি সত্যিই আনন্দ উপভোগ করেন? স্ত্রী কি সত্যিই তাঁর স্বামীকে ভালোবাসেন? স্ত্রী কি সত্যিই স্বামীর আজ্ঞা মেনে চলতে পেরে খুশি? স্বামী নিজেকে এই প্রশ্নগুলি করতে পছন্দ করেন না। এমনকি প্রশ্নগুলি স্বামীর কাছে অতিশয় বেদনাদায়ক বলে প্রতিভাত হয়। একজন ‘সৎ মহিলাকে’ তিনি বিয়ে করেছেন। স্বভাবের দিক থেকে স্ত্রী গুণী, নিবেদিত-পরায়ণ, বিশ্বস্ত, খাঁটি, সুখী এবং তিনি সেই সব কথাই চিন্তা করেন যা তাঁর চিন্তা করা উচিত। একজন অসুস্থ ব্যক্তি তাঁর বন্ধুবান্ধব, নিকটজন, সেবিকাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর নিজের অল্পবয়সি স্ত্রীকে বলেন, যে-স্ত্রী ছ-মাস স্বামীর বিছানা ছেড়ে যাননি, “তোমাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি না। তুমি কেবল তোমার দায়িত্ব পালন করেছ”। স্ত্রীর সদ্গুণের জন্য তাঁকে কোনো কৃতিত্ব তিনি দেন না। সমাজের দ্বারা সেগুলি নিশ্চিত করা হয়েছে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা সেগুলি অভিপ্রায়িত। স্বামী লক্ষ করেন না যে, তাঁর স্ত্রী বোলান্ডের বই থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র নন, তিনি রক্তমাংসের একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি। তথ্য হিসাবে স্বামী গ্রহণ করেন স্ত্রীর নিজের ওপর চাপানো নির্দেশাবলির প্রতি আনুগত্যকে। স্বামী এই বিষয়টি বিবেচনা করেন না যে স্ত্রীরও নানা প্রলোভনগুলি থাকতে পারে যা তিনি জয় করতে চান, অথবা সেইসব প্রলোভনের কাছে স্ত্রী আত্মসমর্পণও করতে পারেন। যে-কোনো ক্ষেত্রেই কিন্তু স্ত্রীর ধৈর্য, সতীত্ব এবং শালীনতা ইত্যাদি জয় করা শক্ত। এমনকি আরও বেশি সম্পূর্ণতার সঙ্গে স্বামী উপেক্ষা করেন স্ত্রীর স্বপ্ন, স্ত্রীর কল্পনা, স্ত্রীর নস্টালজিয়া, মানসিকভাবে যে-আবহাওয়ার মধ্যে স্ত্রী দিন কাটান সেই আবহাওয়াকে। এভাবে ‘ইভ’-এ শারদন আমাদের এমন একজন স্বামীকে দেখান যিনি বছরের পর বছর ধরে তাঁর বিবাহিত জীবনের একটি ডায়েরি রাখেন : তিনি তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কে মার্জিতভাবে কথা বলেন। তবে শুধুমাত্র তেমনভাবেই স্ত্রীর সম্পর্কে কথা বলেন যেমনভাবে তিনি স্ত্রীকে দেখেছেন, যেমনভাবে তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী প্রতিভাত হয়েছেন কখনোই নিজের স্বাধীন ব্যক্তিত্বের দিকগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা না-করে। স্বামী বজ্রাহত হন যখন তিনি আকস্মিকভাবে জানতে পারেন যে, স্ত্রী তাঁকে ভালোবাসেন না, স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে দিচ্ছেন। আমরা প্রায়শই বলেছি মেয়েলি বেইমানি বা বিশ্বাসঘাতকতার সামনে সরল এবং অনুগত পুরুষের মোহের কথা। লজ্জাকর অনুভূতির সঙ্গেই বার্নস্টাইনের স্বামীরা আবিষ্কার করেন যে তাঁদের জীবনসঙ্গীরা চোর, দুষ্ট এবং ব্যভিচারী। পুরুষোচিত বীরত্বের সঙ্গে এই আঘাত তাঁরা গ্রহণ করেন। যদিও তা সত্ত্বেও লেখক তাঁদের উদার এবং শক্তিশালী দেখাতে ব্যর্থ হন না। সর্বোপরি, আমাদের কাছে তাঁরা সংবেদনশীলতা এবং সদিচ্ছা-বর্জিত ভারসাম্যহীন মানুষ বলেই মনে হয়; খলতার জন্য পুরুষ নারীকে তিরস্কার করেন। তবে নিজেকে এমন ধারাবাহিকতার সঙ্গে প্রতারিত হতে দেওয়ার জন্যও অনেক আত্মতুষ্টি লাগে।
0 Comments
Post Comment