চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ : ভারত কি বেটি বনাম পঁচাত্তুরে আজাদীর অমৃত

  • 29 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 372 view(s)
  • লিখেছেন : সরিতা আহমেদ
১৫ আগষ্ট— তারিখটি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি মহোৎসবের মোচ্ছব উদযাপনে খামতি নেই দেখনদারি স্তরে। ওদিকে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করার পরেও নারী বেচাকেনার ডার্ক ওয়েব যথেষ্ট সক্রিয় আজও। তেরঙা উৎসবের চাকচিক্য থেকে একটু চোখ ফেরালেই ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা লগ্নে ভারতের বেটিদের সামাজিক অবস্থানটা বেশ স্পষ্টই দেখা যায়। ২০০২-এর ভয়ঙ্কর গোধরা কাণ্ডে গণধর্ষণের শিকার বিলকিস বানোর ১১ জন ধর্ষক আক্ষরিকভাবেই ‘আজাদি’ পেল ১৫ই আগষ্টের সকালে।

স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র শব্দ দুটি আলাদা মাত্রা দেয় একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রকে। স্বাধীনতার ব্যাখ্যাটা নানা মুনি নানা মত দিয়ে ব্যক্ত করেন। তবে গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভের মধ্যে আইন-আদালতের ব্যাপারটা আজও ভারতের মেয়েদের জন্য ঠিক অর্থে আজাদির বার্তাটা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পিছিয়েই রয়েছে। আমরা দেখছি একদিকে যেমন নারী-উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারতের সর্বোচ্চ-ন্যায়ালয় নানা যুগান্তকারী ছকভাঙা রায় দিচ্ছেন, তেমনি নানা ক্ষেত্রেই একেবারে বিপরীত রায় শোনা যাচ্ছে বহু স্বনামধন্য উচ্চ আদালতে।

সুল্লি ডিলস্‌ ও বুল্লি বাঈ — ডিজিটাল নারী-কেনাবেচার মাধ্যম নিয়ে কিছুদিন আগেই তোলপাড় হয়েছিল গোটা দেশ। দেশে তখনও আজাদির অমৃত মহোৎসবের আয়োজন চলছিল জোরেশোরেই। ১৫ আগষ্ট— তারিখটি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি মহোৎসবের মোচ্ছব উদযাপনে খামতি নেই দেখনদারি স্তরে। ওদিকে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করার পরেও নারী বেচাকেনার ডার্ক ওয়েব যথেষ্ট সক্রিয় আজও। আমরা সেসব দেখতে চাই না, তাই পাই না। আমাদের নজর কেবল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক রেটের দিকেই বেশি উৎসাহী।

তেরঙা উৎসবের চাকচিক্য থেকে একটু চোখ ফেরালেই ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা লগ্নে ভারতের বেটিদের সামাজিক অবস্থানটা বেশ স্পষ্টই দেখা যায়।

প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও’ যোজনা থেকে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের ঢক্কানিনাদ— প্রচারের আলোকবৃত্তের বাইরে ধুঁকেধুঁকে বেঁচে থাকছে আরেকটা ভারত নাকি ‘ভারতী’।

যে ভারতে ১৫ আগষ্টের সকালেও হোয়াটস্যাপে ঘুরেছে নারীবিদ্বেষী নানা জোকস – ‘সাংসারিক ঝক্কিতে জেরবার স্বামী’দের কাছে যা মাংসভাত ঘুমের ‘আজাদি’র মোক্ষম বিনোদন!

এই অন্ধকার ভারতে সাধারণ বাড়ির মেয়ে সরকারি নার্সিং স্টাফের চাকরি পাওয়ার ‘দোষে’ স্বামীর আক্রোশে খুইয়ে ফেলছে তার সক্রিয় ডান হাতখানি।   

শিক্ষিকা হওয়ার ‘দোষে’ পেশাদারি জগতের বাইরে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জগতেও তাঁর পছন্দ অপছন্দ, পোশাকবিধি, আদবকায়দা, চলনবলন সবই নিয়ন্ত্রিত করছে খাস কলকাতার মেট্রোপলিট্যান সমাজের নীতিবাগীশ জ্যাঠামশাইরা, যাদের অভিধানে মহিলাদের অবাধ্যতার শাস্তি চাকরি হারানো অথবা পথে বসা।

স্রেফ সন্দেহের বশে অথবা খাবারে নুন কম হওয়ার ‘দোষে’ মাংস কাটার চপার দিয়ে স্ত্রীর ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা করে দিয়েছে গুণধর স্বামী (মেদিনীপুর)।

২০০২-এর ভয়ঙ্কর গোধরা কাণ্ডে গণধর্ষণের শিকার বিলকিস বানোর ১১ জন ধর্ষক আক্ষরিকভাবেই ‘আজাদি’ পেল ১৫ই আগষ্টের সকালে। ধর্ষণ নিয়ে নানাবিধ আইনের বুলি কপচানো সরকার ও আধুনিক সমাজের মুরুব্বিরা ধর্ষকের পক্ষে দাঁড়িয়ে জানালো ‘ব্রাহ্মণ সন্তানেরা ধর্ষক হতেই পারে না’। সুতরাং এইসব অভিযোগ আরোপিত! তাই তাদের আজাদি মুবারক হো!

দেশের আজাদি যে ধীরেধীরে এবার শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদী ঠেকেদারদের হাতে চলে যাচ্ছে তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত পাচ্ছি আমরা মেয়েরা।

আমরা দিন গুনছি প্রাচীন বেদ-বেদান্তের পাঠ পড়ানো টোল শিক্ষাব্যবস্থার হাত ধরে সরকারিভাবে কবে ফিরবে মনুর বিধান যার পরতে পরতে নারীর পায়ের শেকল ভারি করার নির্দেশ রয়েছে। বুঝতে পারছি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের মাটিতে এভাবেই লেখা হবে সমাজের ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’র নাগরিকদের আজাদির দাস্তান!

হয়ত এই ব্রাহ্মণ্যবাদী আজাদির দৌলতেই এমনভাবে মগজধোলাই অথবা পারিবারিক ‘ধোলাই’ হচ্ছে মেয়েদের যাতে জন্মাষ্টমীর দিন ‘গোপাল’(পুত্রসন্তান) লাভের ইচ্ছেয় হাসপাতালে লম্বা লাইন পড়ছে সিজারের জন্য।

খাস বাংলার (কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায়) বুকে ‘হাউজফুল ওটি’র রেকর্ড বলে দিচ্ছে শিক্ষিত-অভিজাত পরিবারে খাতায়কলমে লিঙ্গবৈষম্য যতই ব্যাকফুটে থাকুক না কেন, আচার-বিশ্বাস অথবা ঈশ্বরভক্তির আড়ালে তা ঠিক ফ্রন্টফুটে ব্যাট (থুড়ি তরবারি) চালায়। কারণ সমাজে ছেলে ও মেয়ের অবস্থান আজও ঠিক কেমন তা জানতে পঁচাত্তর বছরের অভিজ্ঞতা লাগে না, পাঁচ-সাতটা পরিবার ঘাঁটলেই বোঝা যায়। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের মতই পুত্রসন্তান বনাম কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার চাপ আদি অনন্তকাল ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে জুড়ে গেছে। সেই ভয়ানক মহোৎসবের স্বাদ পায়নি এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

স্বাধীনতার পঁচাত্তরটি বসন্ত দেখা দেশে তাবড়তাবড় রাজনীতিক থেকে চিন্তাবিদ থেকে শিল্পী-বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত মহিলাদের নিয়ে কুকথার চাষ করা জিভে আগল পরাতে পারছেন না এখনও। আজও প্রখ্যাত ও প্রবীণ বলিউড শিল্পীর মুখে আমাদের শুনতে হচ্ছে “মেয়েদের মুখে যৌনতা মানেই ধান্দা”।

অথচ এই কিছুদিন আগেই ‘পরকীয়া’, ‘যৌনকর্মীদের ইচ্ছে অনিচ্ছে’ থেকে শুরু করে ‘ম্যারিটাল রেপ’ পর্যন্ত সবেতেই সুপ্রিমকোর্ট মহিলা ও যৌনতা বিষয়ে যথেষ্ট পরিষ্কার ও সাহসী রায় দিয়ে জানিয়েছেন মেয়েদের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-কে আক্ষরিক অর্থেই ইতিবাচক বা নেতিবাচক বক্তব্য বলে ধরতে হবে। এমন নয় যে এসব নিয়ে চর্চা হয়নি বা এইসব পাব্লিক ফিগারদের কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু তাঁদের তথাকথিত শিক্ষিত মগজের কোষে তা গেঁথেছে বলে মনে হয় না।

নইলে ‘রক্ষাবন্ধন’ নামের সিনেমায় আজও দেখানো হয় প্রতিবন্ধী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া নিয়ে দাদার ‘অসহায়তা’। ষাটের দশকের চিত্রনাট্য নিয়ে আজও মজে আছে হিন্দি-স্তানের বিনোদন জগৎ। দর্শকের কাছে মধ্যযুগীয় বার্তা যাচ্ছে দাদাভাইদের রাখি বাঁধা ক্রাচ ছাড়া মেয়েদের স্বনির্ভরতাটা জাস্ট একটা মিথ!

রবীন্দ্রনাথ যে উদ্দেশে রাখিবন্ধন পালনের ডাক দিয়েছিলেন সেই অগ্নিযুগে— আজকের হিংসায় উন্মত্ত কলিযুগেও আমরা, এই সংস্কৃতিমনষ্ক বাঙালিরা, সেই মহান উদ্দেশ্যকে ব্রাত্য রেখে পরিবারে দাদাভাইয়ের উঁচু স্থান ও ‘নিচুতে অবস্থিত’ ‘অসহায়’ বোনেদের রক্ষা করার মত বস্তাপচা ধ্যানধারণার পালেই হাওয়া দিচ্ছি। এই হল আমাদের লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠা, এই আমাদের লিবারল চিন্তাধারার বিকাশ!

একটা সমাজ কতটা পচে গেছে তা বোঝা যায় তার বুদ্ধিজীবী ও শিল্পজগতের পচন দেখে।

আর অবক্ষয় কতটা শিকড় গেড়েছে তা বোঝা যায় শিক্ষাজগতের দিকে তাকালে।

পঁচাত্তুরে বৃদ্ধ স্বাধীনতা যা একশ পঞ্চাশ কোটি সন্তানদের প্রতিবার ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার পাঠ দেয়— সে যে জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠতে অপারগ এখনও তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলিত পেটানো, দলিত দমন করা ঘটনায়।

গান্ধীর দেশে গান্ধীর জন্মস্থানের পড়শি রাজ্যেই স্রেফ একটি জলের পাত্র ছুঁয়ে ফেলার ‘দোষে’ পিছিয়েপড়া জনজাতির এক তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া ইন্দ্র মেঘাওয়ালকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে ‘উচ্চবর্ণের শিক্ষক’ জালি সিং। সাদা চামড়াদের হাতে কালো চামড়ার মানুষের যে দেশ জাতিবর্ণের শিকলে বাঁধা পড়েছিল টানা দু’শ বছর, তাদের মুক্তির স্বাদ এনে দিতে, স্বরাজ আর স্বাধীনতার মানে বোঝাতে শহীদ হয়েছিলেন যাঁরা—৭৬তম আজাদির এমনতর মহোৎসব উদযাপনের কথা কি তাঁরা স্বপ্নেও ভেবেছিলেন!

‘#মি_টু’, #মাই_বডি_মাই_চয়েস নিয়ে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের ধাক্কার ঢেউ যথেষ্ট জোরেই লেগেছিল ভারতের গায়েও। তবুও ১৫ অগাষ্টের আগেরদিন আমাদের পঁচাত্তুরে আজাদি দেখল যৌন হেনস্তার অদ্ভুত বিধান— যেখানে কেরালার কোঝিকোরের দায়রা আদালতের বিচারক জানালেন ‘খোলামেলা উত্তেজক পোশাকের জন্যই অভিযোগকারিণীর যৌন হেনস্তার মামলা ‘দাঁড়ায় না’!

বিস্তর বিতর্কের পরেও একই বিচারক একই বিধান বহাল রেখে ১৯ অগাষ্ট ২০২২ আরেকটি কেসে একজন বর্ষীয়ান ধর্ষককে বিলকুল বেকসুর ঘোষণা করে জানান যে, ধর্ষিতা যেহেতু এক তপশিল জাতির মহিলা সুতরাং একজন উচ্চবর্গীয় লেখক যিনি আবার প্রবীণ সমাজকর্মীও বটে— তিনি ছুঁতেই পারেন না দলিত শরীরকে, যৌনহেনস্তা তো দূরের কথা!

এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয় নব্বইয়ের শুরুতে রাজস্থানের উঁচু জাত ‘গুজ্জর’দের হাতে গণধর্ষিতা হওয়া ‘নিচু জাত’ কুম্‌হা পরিবারের বৌ ভাঁওরি দেবীর কেস। তিন দশক আগে কেবলমাত্র গুজ্জর জাতের পুরুষ বলেই তাদের বেকসুর খালাস করে জয়পুর আদালত বলেছিল “জেনেশুনে নিচু জাতের মহিলাকে ধর্ষণ করে কোনও উঁচুবর্ণের মানুষ নিজেকে কলুষিত করবে— তা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য না’।

গত ত্রিশ বছরে স্বাধীনতার বয়স বৃদ্ধির সাথেসাথে ভারতের বেটিদের ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ আর্তনাদ বেড়েছে বৈ কমেনি—নিত্যদিনই উচ্চবর্গের রোষ-লালসার শিকার হয়েছেন দলিত শ্রেণির মেয়েরা। হালফিলের হাথরস (২০২০) শুধু না, পাঞ্জাবের দলিত শিল্পীর মেয়ে (২০০২), ওড়িশার পিপলি গণধর্ষণ (২০১১) থেকে শুরু করে আজ অবধি নারীনির্যাতনের তালিকা বেড়েই চলেছে।

২০১২ সালের নির্ভয়া কেসের পরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যতই কড়া আইন পাশ হোক না কেন, তা যে তৃণমূল স্তরের মেয়েদের জীবনে লাগু হয়নি আজও, তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত পাচ্ছি আমরা।

ন্যাশানাল ক্রাইম রিপোর্ট ২০১৯ বলছে দেশে গড়ে রোজ ১০ জন করে দলিত মহিলা ধর্ষিতা হন, যাদের মধ্যে ৮০% ধর্ষকের পরিচয় সামাজিক খাতায় উচ্চবর্গের ও প্রভাবশালী অংশেরই।

 সুতরাং ‘বেটি বাঁচাও’ স্লোগান যত প্রচারের লাইম লাইটে আসবে তত আলোকবৃত্তের বাইরের এক পৃথিবী অন্ধকার থেকে কৃষ্ণকলিদের ‘বাঁচাও! বাঁচাও!” আর্তনাদও বাড়বে, ত্রিবর্ণ রঞ্জিত বলিউডি গানের আজাদি পালনে মত্ত আমরা সেসব শুনতে পাব না— এই যা!

ওদিকে আঁধারে নিরালায় একান্তে বসে কোনও মেয়ে রবিঠাকুরের কাছে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে ছদ্মনামে ‘মিম’ বানাবে — ‘চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ, নিম্ন যেথা শির/স্বদেশ বুকে প্রতিষ্ঠিত বাধার প্রাচীর।’

আর বুড়ো স্বাধীনতার চোখ ঝাপ্সা হবে দুঃখে, রাগে, লজ্জায়, গ্লানিতে, অক্ষমতার ক্ষোভে। আমরা ভাবব ‘ও তো নিছক ছানি পড়েছে। ‘মহোৎসবের’ রোশনাই নিশ্চয় সব ঢেকে দেবে!’

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment