আমরা ভালো নেই 

  • 05 November, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 903 view(s)
  • লিখেছেন : সুনীতা দত্ত
বাইরেটা দেখে কারো বোঝার উপায় নেই আমরা ভালো নেই। আমাদের না বলা কষ্টগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভিতরটা খাঁক করে দেয়। আমাদের হাসির আড়ালে একঝাঁক কষ্টগুলো শেয়ার করার মত খুব বিশ্বস্ত কাউকে পাইনা। কিন্তু আমরা হারতে নারাজ। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় নায়ক আমরা নিজেরাই। অ্যাসিড আক্রান্ত আমি হাসপাতালে শুয়ে সেদিন ধারণাও করতে পারিনি আসল লড়াইটা কোথায়!

আমি এবং আমরা কিছু মানুষ আছি যারা চিৎকার করে বলতে পারি না আমরা ভালো নেই, অনেকের মত আমাদের মনেও কষ্ট আছে। আমরা কষ্টের ব্যাখ্যা দিতে জানি না। 

হুম!‌ আমাদের গড়গড়িয়ে চোখের জল গড়িয়েও পড়ে না। বাহ্যিক দিক দেখে কারো বোঝার উপায় নেই আমরা ভালো নেই। আমাদের না বলা কষ্টগুলো ভীষণ জ্বালাচ্ছে, পোড়াচ্ছে, এমনকি ভাবাচ্ছেও— 

হ্যাঁ, সত্যিই আমরা কিছু মানুষ নীরব থাকি, আমাদের হাসির আড়ালের একঝাঁক কষ্টগুলো শেয়ার করার মত খুব বিশস্ত কাউকে পাইনা।

সেই কোন ছোট্ট থেকে দেখছি বেঁচে থাকার জন্য দু-‌বেলা দু-‌মুঠো ভাতের জন্য লড়াই— আমার নয়, আমার মায়ের সন্তানদেরকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। তা দেখতে দেখতে বেড়ে উঠতে উঠতে শুরু হয়ে গেল নিজের জীবনের যুদ্ধ, এ লড়াইয়ে জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না, তাই মন থেকে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। 

আমার জীবনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২০১০ সাল থেকে। ক্লাস নাইন পড়ি তখন। ঠিক করে বুঝতাম না জীবনের আসল লক্ষ্যটা কী। শুধু মনে হত মায়ের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। 
কখনো বুঝতে পারিনি এমন লড়াইয়ের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। 

যখন আমার উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয় তখন আমি নিজেও জানতাম না এরকম ভাবে কোনও মানুষের ক্ষতি করা যায়। 
যখন আমি হাসপাতাল শুয়ে আছি তখনও বুঝিনি আমার জীবনে হাসপাতালে লড়াই আসল লড়াই নয়। কী মারাত্মক যন্ত্রণা মনে এবং শরীরে। কিন্তু সবাই যখন বলত সব ঠিক হয়ে যাবে আমিও সেটা বিশ্বাস করতাম। কিন্তু বাস্তবটা যখন সামনে এল তখন বুঝলাম এটা সারা জীবনেও ঠিক হবার নয়। তাই এটাকে মেনে নিয়ে শুরু হল আসল লড়াই।

বাড়ির বাইরে যখন বেরোতাম লোকজন এমন ভাবে আমাকে দেখত আর বলত আমিই যেন এই ঘটনার জন্য দায়ী। সত্যি বলতে তাদেরকে আজ আমি ধন্যবাদ দিতে চাই। আজ যদি তারা এমনভাবে না বলত আমি ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না। হয়ত তাদের জন্য আমার এবং আমার মত আরও সহযোদ্ধারাও এই ভেবে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে আমরা এখনো দিশাহীন। কিন্তু হেরে যেতে চাইনা। জীবন মানে বার বার আশাহত হয়েও আশায় বুক বাধা। ‘‌ভাগ্য’‌ আমাদেরকে শুধু কষ্ট দিয়েছে আর আমরা এইগুলো মেনে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাবার লক্ষ্য মনে করে জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে চলতে শুরু করেছি।

তবে হ্যাঁ, আমাদের পাশে কিছু বন্ধুকে পেয়েছি, কিছু সংগঠনকে পেয়েছি যারা তাদের সাধ্যমত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ‘‌চিৎকার’‌ সংগঠন আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের মনোবল বাড়িয়েছে, আমাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। আমারা চাই এইভাবে আমাদের হাত ধরে যেন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তার পাশাপাশি আমাদের পাশে থাকা বন্ধুদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ আমাদের এই লড়াইয়ে পাশে থেকে একটু ভালবাসা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে। 

এর পাশাপাশি অবিলম্বে দোষীদের কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। 
আর চাই নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী একটা কর্মস্থান। 

আমরা জীবনে অনেক সময় অনেক কাজেই ব্যর্থ হই। অনেকের কাছে নিজের যোগ্যতার অভাবে হেরে যাই। অনেক সময় যোগ্যতা থাকা সত্বেও পরিস্থিতির জন্য হার মানতে বাধ্য হই। কিন্তু আমরা সবাই একটা কথা হয়ত জানি না বা ভুলে যাই সেটা হল আমরা কখনো অন্যের কাছে হেরে যাই না, আমরা হেরে যাই নিজের কাছে। আমরা সবচেয়ে বড় ভুল তখনই করি যখন আমরা অন্যদের  প্রতিযোগী ভাবতে শুরু করি। অথচ আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী আমরা নিজেরাই। কেউ আমাদের কখনো হারাতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি এবং আমরা নিজেরা হার না মানছি।

আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় নায়ক আসলে আমরা নিজেরাই। কারণ নিজেদের জিতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যেমন আমাদের আছে, হেরে যাওয়ার ক্ষমতাও একান্তই আমাদের। আমরা এটা ভুলে যাই  আমাদের জীবনে সাফল্য এনে দেওয়ার মত মানুষ পৃথিবীতে একজনই আছে। আর সেটা আমি এবং আমরা নিজেরাই।

ছবি প্রতীকী

0 Comments

Post Comment