- 06 June, 2020
- 0 Comment(s)
- 1029 view(s)
- লিখেছেন : সৌমেন দত্ত
গত দু'সপ্তাহে দুটি ঘটনা ভারতীয় সুন্দরবনে জনজীবনের সর্বনাশ করল। ২০ মে সাঁঝবেলায় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় আমপান হিঙ্গলগঞ্জ থেকে সাগরদ্বীপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াল। দু:স্বপ্নের ঘোর কাটতে না কাটতে ভাঙা বাঁধের হাঁটু-কাদায় পরিযায়ী শ্রমিকরা এসে দাঁড়াল। চোখের সামনে পুকুরে মরা মাছ, ভাঙা ঘরে আকাশের চাঁদোয়া, ধানখেতে ছলাৎ ছলাৎ লোনা জল। এ কেমন ঘরে ফেরা!
বোধহয় তখনও আয়লা হানার মাসপূর্তি হয়নি। সুন্দরবনের সিংহদুয়ার গদখালিতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছি। নানা দ্বীপ থেকে একের পর এক নৌকা এসে ভিড়ছে। হাতে ব্যাগ, পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে দলে দলে জোয়ান ছেলে লাফ দিয়ে পারঘাটে নামছে। বেশ অবাক হয়েছিলাম। দুর্দিনে ভিটে, সংসার ফেলে কোথায় চলল? মহামারীর কালে উত্তরটা পেলাম। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, দিল্লি, রাজস্থান গত এক দশক ভাটির পোলাদের অস্থায়ী ঠিকানা ছিল। আয়লার পর বানভাসি সুন্দরবন জীবিকার আশ্বাস দিতে পারেনি। জল জঙ্গল ছেঁচে মাসে পাঁচ-ছ'হাজারের বেশি রোজগারের সুযোগ নেই। এই মওকায় ঠিকাদারের এজেন্ট এসে বার্তা দিয়েছিল, "ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়। মাসে পনের-কুড়ি হাজারের গ্যারান্টি।" পরিবারে সু-পবনের আশায় এতদিন ১০ বাই ১০ ফুট ঘরে গাদাগাদি করে থেকে তারা এক থালায় ভাত খেয়েছে। অসময়ে পরস্পরের কাঁধে ভরসার হাত রেখেছে। কে জানত, শিয়রে এমন নরক-চুম্বী অনিশ্চয়তা !
রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রত্যাগত পরিযায়ী সাড়ে আট লক্ষ। জেলাওয়াড়ি তালিকা হাতে পাইনি। নানা মহলের ধারণা, ৪৫ লক্ষ মানুষের ব-দ্বীপে সংখ্যাটা ১০ হাজার হবেই। শুনছি, আরও আসছে। আপত্তি করার কিছু নেই। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে, তার হক। প্রতি পাঁচটি পরিবারের অন্তত একজন অন্যত্র কাজ জুটিয়ে রাজ্যে বেকারির ভার কমিয়েছিল। এটাই তো অনেক। মুশকিল হল, "করোনা" ত্রাস 'কাবাব মে হাড্ডি' হয়েছে। ঘর ফিরতিদের ঘর আছে বা নেই। নিজের ঘরে করোনা লেজুর নিয়ে ঢুকছে কিনা তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। পরিণামে পরিযায়ীদের সম্পর্কে ভীতির আবহ ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। যেখানে সম্ভব প্রশাসন কোরেন্টাইন শিবিরে রেখেছে। তারপর থেকে পানীয় জল, খাবার, শৌচাগার, স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে ক্ষোভ প্রতিদিনের খবর। যাদের ফেরাতে রাজ্য সরকার তৎপর ছিল, স্থানীয় প্রশাসনের এই উদাসীনতা তাদের প্রাপ্য ছিল? প্রশ্ন উঠবেই, করোনা পরীক্ষা কেন অগ্রাধিকার পাবে না? ঢালাও লালারস ও অন্যান্য পরীক্ষা না হলে উপসর্গহীন অসুস্থরা অজ্ঞাতে ভাইরাস ছড়াবে। সুন্দরবনে করোনা বল্গাহীন মহামারী হয়ে উঠবে।
গত তিন মাসের লকডাউনে চাষবাস, মাছ ধরা, মধু সংগ্রহের কাজ প্রায় বন্ধ ছিল। ঘরে ঘরে চাল বাড়ন্ত। মারণ ঝড় মাথা গোঁজার ঠাঁই কেড়ে নিয়েছে। পরিযায়ীরা করোনা আগমনীতেই শুনেছিল "পাততাড়ি গোটানোর সময় হয়েছে।" বেঁচে থাকার বিকল্প পথ হিসেবে মাটি, জল, জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমপান এসে প্রাণে মারেনি, পেটে মেরেছে। মধুর মরসুম শেষ হয়ে এলেও গত এক মাসে চার জোয়ান বনে বাঘের শিকার হয়েছে।
আর একটা জরুরি কথা। চাল চিঁড়ে পানীয় জলের পাউচ প্রায় সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ত্রাণের মেনু। প্যাকেটে নতুন কিছু সামগ্রী সংযোজন করার সময় হয়েছে। জলজ প্রাণী, গাছ, খেতের ফসল পচে গ্রামে দুর্গন্ধ ম ম করছে। অদূরে অনাহূত আন্ত্রিকের পদধ্বনি। প্রত্যন্ত দ্বীপে এখনই জল শোধনের ওষুধ, ব্লিচিং পাউডার, চুন, ও আর এস, চিকিৎসার ওষুধ, মাস্ক, হাত ধোয়ার সাবান না পৌঁছলে মাতলায় লাশ ভাসবে। করোনা এবং আন্ত্রিক হানা ঠেকাতে ব-দ্বীপে চিকিৎসা শিবির এই মুহূর্তে ভীষণ ভীষণ জরুরি। ইতিমধ্যে কিছু তরুণ জেলা ও মহকুমা শাসকের তৎপরতা সরকারি পরিষেবা সম্পর্কে আস্থা জাগিয়েছে। দু'পক্ষ হাত মিলিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোলে দুর্গত মানুষগুলো বাঁচার অক্সিজেন পাবেন।
দুটি ছবিই সুন্দরবনের রাঙাবেলিয়ার জটিরামপুরের। ছবি তুলেছেন ধ্রুব মন্ডল।
লেখক: সাংবাদিক
0 Comments
Post Comment