- 02 May, 2023
- 0 Comment(s)
- 921 view(s)
- লিখেছেন : আফরোজা খাতুন
আখতার মহল সৈয়দা খাতুন বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার এক ধনী পরিবারে ১৯০১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। নোয়াখালির সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯১৩ সালে তাঁর বিয়ে হয়। শিক্ষানুরাগী এই মেয়ে গোপনে লেখালেখি করেছেন শ্বশুরবাড়িতে। কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই লেখাগুলো ট্রাঙ্কে তালাবন্ধ করে রেখে দিতেন। একবার নজরুল ইসলাম তাঁর শ্বশুরবাড়ি আসেন। আখতার মহলের দেওর জানতেন তাঁর বৌদি লেখালেখি করেন। তিনি তাঁকে অনুরোধ জানান নজরুল ইসলামকে স্বাগত জানিয়ে একটা কবিতা লিখে দিতে। আখতার মহল দেওরের অনুরোধে কবিতা লেখেন। সেই কবিতা পড়ে নজরুল ইসলাম বুঝতে পারেন তাঁর লেখার চর্চা রয়েছে। নজরুল ইসলামের প্রেরণায় আখতার মহলের ‘নিয়ন্ত্রিতা’ (নওরোজ, ১৩৩৪), ও ‘মরণবরণ’ (সওগাত, ১৩৩৬) প্রকাশিত হয়। তবে গ্রন্থ প্রকাশের পথ তত সুগম ছিল না। জমিদার বাড়ির বধূর লেখা বাইরে প্রকাশ হোক এটা শ্বশুরবাড়ির মানুষ চাননি।
এই জ্ঞানপিপাসু, শিক্ষানুরাগী মহিলার বিবাহিত জীবন তাই সুখের ছিল না। লেখা দুটোর মধ্যেই তার স্পষ্ট প্রভাব। ‘নিয়ন্ত্রিতা’ ও ‘মরণবরণ’-কে কোনো সমালোচক উপন্যাস বলেছেন। কারো মতে বড় গল্প। দুটো কাহিনির দুই মুখ্য নায়িকা বাংলা পড়তে গিয়ে কীভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে আখতার মহল তাঁর নারী হৃদয়ের গভীর মমতা দিয়ে তা বিবৃত করেছেন। দুই নায়িকার মধ্য দিয়ে লেখকের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার হৃদয় যন্ত্রণা প্রকাশ হয়েছে।
‘নিয়ন্ত্রিতা’র নায়িকা আয়েশা এক বছর বয়সে মাকে হারায়। বিমাতার ভালবাসা থেকেও সে বঞ্চিত। তার সঙ্গী ছিল ছেঁড়া পাঠ্যপুস্তক। বইয়ের প্রতি তার অত্যধিক অনুরাগের জন্য সকলেই উপহাস করত। আয়েশা কারো ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভ্রূক্ষেপ না করে, অসীম আগ্রহে বই পড়েছে। বাংলা বই পড়ার ওপর এত নিষ্ঠা দেখে পরিবারের লোক ধরেই নিয়েছিল আয়েশা একটি ‘অসৎ’ মেয়ে হিসেবে গড়ে উঠবে। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতেও বাংলা বই পড়া নিয়ে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। আয়েশার স্বামী ওমর আলী, আবদুল কাদেরকে অভিযোগ করে তার বই পড়া নিয়ে। কারণ ওমর আলীর মা মেয়ে মানুষের হাতে বাংলা গল্পের বই দেখতে পছন্দ করে না। তাই মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রী আয়েশাকে শাসন করে ওমর আলী। অথচ এই ওমর আলীকে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না আয়েশার। সে ভালবাসত তার ফুফাতো ভাই আনোয়ার হোসেনকে। কিন্তু আয়েশার পিতা লতিফ সাহেব মেয়ের বিয়ে ঠিক করল জমিদারের উচ্ছৃঙ্খল পুত্র ওমর আলীর সঙ্গে। আয়েশা ঠিক করেছিল সে বিয়েতে কবুল জবাব (সম্মতি) দেবে না। তার অসম্মতিতেও বিয়ে আটকালো না। অভিভাবকের বলপ্রয়োগে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হল। বিয়ের পর তাকে কাঁদতে দেখে স্বামী ওমর আলী লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়ে বলল, ‘তবে রে অসতী! হারামজাদী! আমার সঙ্গে বিবাহ হওয়াতে কান্না!’১ আখতার মহল সৈয়দা খাতুনের ‘নিয়ন্ত্রিতা’র কাহিনিতে বিশ শতকের প্রথম দিকের বাংলার সমাজবাস্তবতা প্রতিফলিত।
আখতার মহলের আধুনিক শিক্ষার প্রতি আকুতি ও প্রতিবন্ধকতার ছবি আরও স্পষ্ট রূপ পেয়েছে ‘মরণবরণ’-এ। এর কাহিনিতে যে দুটি নারী চরিত্র রয়েছে হোসেনারা ও লায়লী, তারা খ্রিস্টান শিক্ষিকার কাছে লেখাপড়া করে। কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন, ‘নব্যসভ্যতা-শ্রোতে কাঠ-মোল্লাদের কদর মূর্খ গ্রামবাসীও মানিতে চাহে না; হাদিসের প্রকৃত তথ্য জানিতে আজ সকলেই আকুল— সকলেই আজ স্বচক্ষে হাদিস দেখিতে— শুধু দেখিতে নহে— কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক তাহারও সন্ধ্যান চাহে।’২ মুসলিম নারীদের সামাজিক অবস্থানে ব্যথিত আখতার মহল হয়ত চেয়েছিলেন নব্য শিক্ষার আলোয় মুসলিম নারীর ব্যক্তিত্ব ও প্রতিবাদ গড়ে উঠুক। তাঁর দুই কাহিনির নায়িকাই পড়াশোনা করার জন্য হৃদয়হীন বিধি ব্যবস্থার কবলে পড়ে দুঃসহ গালিগালাজের শিকার হয়েছে। হোসেনারার নানিশাশুড়ি বাংলা পড়ার জন্য তাকে গালাগাল দেয় এই ভাষায়, ‘লেখাপড়া শিখলে কি মানুষ এমন বাজারী মাগী হয়ে পড়ে। সাধে কি মৌলবীরা মুসলমান মেয়েদের বাংলা শিখতে দিতে মানা করেন।’৩ ‘ স্ত্রীজাতির অবনতি’-তে রোকেয়া দুঃখ করে বলেছেন, সমাজ পড়াশোনা না জানা মেয়েদের দোষ অম্লান বদনে ক্ষমা করে। অন্যদিকে লেখাপড়া জানা মেয়েরা দোষ না করলেও কোনও কল্পিত দোষ শতগুণ বাড়িয়ে সেই বেচারির শিক্ষার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। আর সমাজের রক্ষণশীলরা সমস্বরে ‘স্ত্রী শিক্ষাকে’ নমস্কার করতে থাকে।
আখতার মহল ‘নিয়ন্ত্রিতা’ ও ‘মরণবরণ’-এর কাহিনিতে তৎকালীন মুসলিম সমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার রূপকে ফুটিয়ে তুলেছেন বলেই ধরা যায়। তিনি ‘নারীর অভিযোগ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘নারী সম্বন্ধে লিখিতে গেলে মনে এত বেদনা আসিয়া পুঞ্জীভূত হয়, যা প্রকাশের ভাষা নাই আমার।’৪ সামান্য কয়েকজন মুসলিম মহিলা সেই সময় শিক্ষা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলেও তাঁদের দ্বারা সাধারণ মুসলিম নারীসমাজ আলোড়িত হয়নি। তাই আখতার মহলের প্রতিবাদী উচ্চারণ, ‘আমি কহিতে চাই পঙ্কে পরিপূর্ণা বিশাল সাগররূপিণী মূর্খ জ্ঞানহারা বাকশক্তিহীনা বঙ্গের মুসলিম নারীর বিরাট অভিযোগ।’৫
‘মরণবরণ’-এর কাহিনির নায়িকা হোসেনারা শ্যামাঙ্গিনী। তার বিয়ে ঠিক হয় চাচাতো ভাই আজিজের সঙ্গে। আজিজের মা ছেলের পড়ার খরচ তুলবে বলে বড়লোকের মেয়ে হোসেনারার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে। আজিজের মায়ের ইচ্ছে পড়ার খরচ শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে ছেলে লেখাপড়া শিখুক ও সম্পদশালী হোক। কিন্তু আজিজ ভালবাসত লায়লীকে। লায়লীর পিতা দরিদ্র। তার কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই সেটা আজিজের মা বুঝেছিল। হোসেনারাকে বিয়ে করার মত আজিজের নেই দেখে তার মা পরামর্শ দেয়, ‘তুই পুরুষ ছেলে, তোর চিন্তা কি? একটি ছেড়ে পাঁচটি বিয়ে করলে ঠেকায় কে? আর সে কালো বউ পছন্দ না হয় একটা কিছু দোষ দেখিয়ে পরে ‘তালাক’ দিয়ে দিলেই বালাই যাবে।’৬ আজিজের পিতাও যখন ছেলের অমতে বিয়ে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত, তখন তাকেও আজিজের মা বুঝিয়ে বলে, সে তো ছেলে, বউ পছন্দ না হয় আবার বিয়ে করবে। আখতার মহল সৈয়দা খাতুন এই কাহিনির মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় আইনের ফাঁক গলে বাণিজ্য করার প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়েছেন পাঠককে।
পণ নেওয়া ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। অথচ ক্রমশ সেটা সামাজিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আজিজের মায়ের মতো কেউ ধর্মীয় বিধানকে নিজের ব্যাখ্যায় এনে দাঁড় করাতে পারে যতক্ষণ না শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। পাকিস্তানে ১৯৬১ সালে তাই মুসলিম পারিবারিক আইন পাশ হয়। মৌখিক তালাক বা ইচ্ছেমতো বহুবিবাহ সেখানে বন্ধ। বিবাহবিচ্ছেদ নিতে হয় আইনের মাধ্যমে। যা এখন বাংলাদেশেও চালু। ইচ্ছেমতো তালাক দিলে বা বহুবিবাহ করলে সেখানে জেল ও জরিমানা হয়। স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিকদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে তৈরি হয়েছে মুসলিম পারিবারিক আইন। ভারতের অধিকার আন্দোলনের কর্মীরাও পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব মুক্ত মুসলিম পারিবারিক আইন গঠনের দাবি তুলেছে।
আখতার মহল সৈয়দা খাতুন। বিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বের এক সম্ভাবনাময় লেখকের, সমাজের বিরুদ্ধে চাবুক চালানো কলম অকালেই থেমে যায়। ১৯২৮ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র:
১। আখতার মহল সৈয়দা খাতুন : নিয়ন্ত্রিতা, প্রকাশিকা রায়হানা বেগম, ৩০ ইন্দিরা রোড, ঢাকা-১৫, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯, পৃ. ১৪
২। আখতার মহল সৈয়দা খাতুন : মরণবরণ, (গ্রন্থ- নিয়ন্ত্রিতা) প্রকাশিকা রায়হানা বেগম, ৩০ ইন্দিরা রোড, ঢাকা-১৫, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯, পৃ. ৫৭
৩। আখতার মহল সৈয়দা খাতুন : মরণবরণ, ঐ, পৃ. ৮৭
৪। আখতার মহল সৈয়দা খাতুন : নারীর অভিযোগ, (গ্রন্থ-নিয়ন্ত্রিতা), ঐ, পৃ. ৯৪
৫। নারীর অভিযোগ, ঐ, পৃ. ৯৪
৬। মরণবরণ, ঐ, পৃ.৬৫
পুনঃপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশ ১জানুয়ারি ২০২১
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment