আমাজন বাঁচানোর ডাক – সামনের সারিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জনজাতির মহিলারাই

  • 26 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 515 view(s)
  • লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
আরেক সংগঠক তাতিয়ানা এসপিনোজার কথায়, “আমরা যখনই কোনও এলাকায় গাছ কাটতে আসা শ্রমিক অথবা সেই শ্রমিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা সুপারভাইজরদের সঙ্গে কথা বলতে যাই, মেয়ে হবার কারণে তারা আমাদের রীতিমতো অগ্রাহ্য করে। কথার উত্তর দেওয়া অবধি প্রয়োজন মনে করে না।” তাতিয়ানা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “সেই সময় মনে হয় পাশে একজন পুরুষের সামান্য উপস্থিতিটুকুই আজও কিভাবে একেকটি ঘটনাকে সম্পূর্ণ প্রভাবিত করে চলে, দেখলে অবাক হতে হয়।”

দোল পেরোল, পেরোল বসন্ত-উৎসব। লাদাখে সোনম ওয়াংচুকের অনশনও পেরোল ২১ দিন। স্বভাবতই ‘মেইনস্ট্রিম মিডিয়া’ তো দূরে থাক, সাধারণ মানুষের সচেতনতাতেও সেই ঘটনার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ল না। কিছুদিন আগেই যারা বিশ্ব জল দিবসের বিষয়ে গুরুগম্ভীর বক্তব্য ‘নামিয়েছে’, আজ তাদেরই একেকজনকে পুলসাইড পার্টিতে দেখা গেল, অথবা নিদেনপক্ষে রঙগোলা চৌবাচ্চায়। আন্দোলন অথবা স্টেটাস নামানো একদিনের বিষয়। বেঁচে থাক সনাতন উৎসব, মানুষে-মানুষে কি একদিনও একটু হুজ্জতি করবে না?

 

লাদাখ বোধ করি আমাদের পরদেশি-প্রতিবেশী দেশ। আমরা সেখানে ৩৭০ ধারা বিলোপের পরবর্তীতে জমি কিনতে ও ফেসবুক-ইনস্টাতে রিল তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে, শীতে-ও-গ্রীষ্মে, শেরপা অথবা ট্যুর গাইড-সহযোগে পাড়ি জমিয়ে থাকি। এখনকার কিছু বেঁড়ে বুদ্ধিজীবী মানুষ, সোনম ওয়াংচুক বলে ‘অনশনকারী প্রতিবাদী’ যে একজন সাদাচুল লাদাখির ছবি এক্স-হ্যাণ্ডলে অথবা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় লাগাতার শেয়ার করে চলেছে, তারা সবকজনাই আদতে বিদেশি পাউণ্ড-ডলারে পুষ্ট পাশ্চাত্য গুপ্তচর। আসল সোনমকে দেখতে হুবহু বলিউডের আমির খানের মতো। আমরা যারা ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখেছি আমাদের সক্কলেরই সেই সত্য জানা আছে। পাশ্চাত্য ‘ইডিয়ট’গুলো আমাদেরই ‘ইডিয়ট’ ঠাউরেছে বোধহয়!

 

কি ভাগ্যি আমাজনের জনজাতি মহিলারা আমাদের মতো এতখানি আলোকপ্রাপ্তা নন। কাজেই অনেক আগে থাকতেই আমাজনের চিরহরিৎ বর্ষাঅরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে তাঁরা সামনের সারিতে এগিয়ে এসেছেন। জনজাতি বলতে এখানে অরণ্যচারী আদিম অধিবাসীদের কথাই বলা হচ্ছে।

 

মারানহাও, ব্রেজিল, দক্ষিণ আমেরিকা। পৃথিবীর পরিবেশের ক্ষেত্রে আমাজন অববাহিকার চিরসবুজ অরণ্যের অবস্থান যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তা বোধ করি আর নতুন করে কারোকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। তদুপরি, একাধিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, বাজার অর্থনীতি ও বৃহৎ পুঁজিবাদী শিল্পগোষ্ঠীগুলির নিরবিচ্ছিন্ন আক্রমণ, এবং সবশেষে বেশ কিছু বছর ধরে জেয়ার বলসেনারো’র কার্যত একনায়কতন্ত্রী শাসন – আমাজন অরণ্যের অস্তিত্বকেই চরম সংকটের মুখে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে। এরই মধ্যে কিন্তু, বলসেনারো’র অনেক আগে থেকেই অরণ্যচারী আদিবাসী মানুষ, বিশেষত সেখানকার মহিলারা এই আসন্ন সংকটের গুরুত্বকে অনুধাবন করতে পেরে সেই অরণ্য সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন। যাঁদের কারণেই পরিস্থিতি যতখানিও খারাপ হওয়া উচিত ছিল, ততখানি হয়ে উঠতে পারেনি।

 

মারানহাও, ব্রেজিল, দক্ষিণ আমেরিকা। এই অঞ্চলে অরণ্যচারী গুয়াজাজারা আদিবাসীদের বাস। ৫০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে এই জনজাতি গোষ্ঠী তাঁদের চারণক্ষেত্র আমাজন-অরণ্যকে বাঁচিয়ে রেখে চলেছেন। কিন্তু নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশক থেকেই, এই কাজে এক লক্ষণীয় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি জনজাতির মহিলারাও আরও সক্রিয় ভাবে এই অরণ্য সংরক্ষণের কাজে এগিয়ে এসেছেণ। এমনকি অরণ্য পাহারার জন্য ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গিয়ে গোষ্ঠীর পুরুষেরা যেমন নজরদারি চালাতেন, এখন এমন অজস্র মহিলা-গোষ্ঠীও নিজেদের মতো করে এই নজরদারির কাজে শামিল হয়েছেন। উল্লেখ্য যে, এমন নজরদারি চালানোর কাজেই কিন্তু সবচেয়ে বেশী করে বিপদের আশঙ্কা থাকে। চোরাশিকারিদের হাতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণের ঘটনাও এই কাজে অত্যন্ত স্বাভাবিক এক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও, এমনই এক গোষ্ঠীর মুখ্য-সংগঠক, পলা গুয়াজাজারার কথায়, “আমরা মায়ের মতোই এই অরণ্যকে রক্ষা করব।” ২০১৮তে এই পলা’রই এক সতীর্থ চোরাশিকারিদের হামলায় প্রাণ হারান।

 

অরণ্য সংরক্ষণে নজরদারির পাশাপাশি এই মহিলারা প্রতিবেশী এলাকাগুলিতে গিয়ে আরও বেশী সংখ্যায় মানুষকে সচেতন করার কাজ চালান। সেখানকার মহিলাদের অরণ্য সংরক্ষণের এমন কাজে সরাসরি অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে এই মারানহাও এলাকাতে যেখানে প্রায় ২০০০ হেক্টরেরও বেশী এলাকার অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছিল, ২০১৮ সালে মহিলাদের এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হতে না হতেই সেই বছরে নতুন করে ধ্বংসপ্রাপ্ত অরণ্যের পরিমাণ মাত্র ৬৩ হেক্টরের কোঠায় নেমে আসে। গুয়াজাজারা আদিবাসীদের লক্ষ্য মারানহাও অঞ্চলের মোট ১৬টি জনজাতি গোষ্ঠীর প্রত্যেকটিকেই এই আন্দোলনে শামিল করা। তথ্য দিয়ে গুয়াজাজারা অথবা মারানহাওয়ের অধিবাসীরা জানাচ্ছেন, নতুন সহস্রাব্দের শুরু থেকে আজ অবধি মারানহাওয়ের ২৫% অরণ্য অঞ্চল ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই অবস্থায় মারানহাওয়ের অরণ্য সংরক্ষণের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সকলের এগিয়ে আসা উচিত। সেই কাজেই মারানহাওয়ের মেয়েরা অগ্রণী ভূমিকা নিতে আগ্রহী এখন।

 

অরণ্য-সংরক্ষণ অথবা এমন সমতুল নীতি-নির্ধারণকারী বিষয়ে মেয়েদের সরাসরি অংশগ্রহণ, সেই সমস্ত সিদ্ধান্তের প্রয়োগ অথবা বাস্তব-রূপায়ণের ক্ষেত্রেও অধিকতর সহায়তা করে। বিভিন্ন স্বীকৃত গবেষণা তো বটেই, এমনকি মারানহাও অঞ্চলের অরণ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ২০১৬ ও ২০১৮ সালের দুইটি ভিন্ন তথ্যও কিন্তু এই বক্তব্যকে সরাসরি সমর্থন জানায়। অথচ, এর পরবর্তীতেও, তথ্য বলছে সারা পৃথিবীতে নারীর নেতৃত্বে এমন পরিবেশ-সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারক আন্দোলনগুলির ক্ষেত্রে, এমন সমস্ত আন্দোলনের জন্য বরাদ্দ হওয়া মোট অনুদানের মাত্র ১% বরাদ্দ হয়ে থাকে। অর্থাৎ কিনা খাতায়-কলমে অর্ধেক আকাশের অঙ্ক থাকলেও, পরিবেশ আন্দোলনের অনুদানের ক্ষেত্রেও পুরুষ-শাসিত সংস্থাগুলির কপালেই অনুদানের ৯৯% বরাদ্দ হয়। বৈষম্য বললেও এই ঘটনাকেই নেহাতই লঘু করা হবে বোধহয়।

 

যদিও মেয়েদের বোধকরি এত সহজেও পরাস্ত করা চলে না। একদিকে ব্রেজিলের মারানহাও। অন্যদিকে পেরুর বিস্তীর্ণ মারানন নদী-অববাহিকা অঞ্চল। সেখানকার কুকামা-কুকামিরিয়া জনজাতি গোষ্ঠীর নেত্রী এমা তাপুলিমা একদৃষ্টিতে নদীতে জল খেতে আসা মার্মোসেট বাঁদরদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, “ওরা জানে এই অরণ্য সংরক্ষিত, এখানে ওদের কেউ আক্রমণ করবে না।” বেসরকারি উদ্যোগে পেরুদেশীয় আমাজন অববাহিকা অঞ্চলেও শুরু হয়েছে অরণ্য-সংরক্ষণের কাজ। কিন্তু সেখানেও যে পুরুষতন্ত্রেরই প্রকট উপস্থিতি। তাপুলিমা তাঁর অঞ্চলের সংরক্ষিত অরণ্যের নাম দিয়েছেন, ‘ইওয়িরাতি’, তাঁদের ভাষায় এই শব্দের অর্থ ‘গাছ’। তাপুলিমাই পেরুদেশীয় আমাজন অঞ্চলের প্রথম মহিলা, যিনি তাঁর কর্মভূমি লোরেতো এলাকার প্রশাসক পদেও নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও এই তথ্যের বিপরীতে, এও সত্যি – পেরুদেশীয় আমাজনের জনজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে মাত্র ৪% গোষ্ঠীরই নেতৃত্বে কোনও নারীর স্থান রয়েছে।

 

এমনই আরেক সংগঠক তাতিয়ানা এসপিনোজার কথায়, “আমরা যখনই কোনও এলাকায় গাছ কাটতে আসা শ্রমিক অথবা সেই শ্রমিক গোষ্ঠীর নেতৃত্বে থাকা সুপারভাইজরদের সঙ্গে কথা বলতে যাই, মেয়ে হবার কারণে তারা আমাদের রীতিমতো অগ্রাহ্য করে। কথার উত্তর দেওয়া অবধি প্রয়োজন মনে করে না।” তাতিয়ানা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, “সেই সময় মনে হয় পাশে একজন পুরুষের সামান্য উপস্থিতিটুকুই আজও কিভাবে একেকটি ঘটনাকে সম্পূর্ণ প্রভাবিত করে চলে, দেখলে অবাক হতে হয়।”

 

তবুও পলা, এমা অথবা তাতিয়ানাদের মতো মানুষেরা আছেন বলেই এখনও এই পৃথিবীতে সবুজের স্বপ্ন দেখা চলে। বাস্তুতন্ত্র, পরিবেশ, জলবায়ু, অথবা জীববৈচিত্র্যের মতো বিষয়গুলিকে নিয়ে আশান্বিত হওয়া যায়। মেয়েদের লড়াই ক্রমশ মানুষের হয়ে ওঠে। পুরুষকে ছাপিয়ে প্রকৃতিরই সেখানে সদর্থক জয়ের বার্তা ঘোষিত।

 

“You cannot get through a single day without having an impact on the world around you. What you do makes a difference, and you have to decide what kind of difference you want to make.”

Jane Goodall, Conservationist

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার 

ছবি : সংগৃহীত 

 

0 Comments

Post Comment