‌বাংলাদেশের হিন্দু পারিবারিক আইন  ও  সংস্কারের দাবিতে নাগরিক আন্দোলন

  • 05 June, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 850 view(s)
  • লিখেছেন : মালেকা বেগম
ব্রিটিশ শাসনের সময় উনিশ শতকে ভারতবর্ষে বা উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মের ‘পারিবারিক বা পার্সোনাল ল’-এর কোনো সংস্কার হয়নি। পাকিস্তানে মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার ও লিখিত আইন করার আন্দোলন ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়। ১৯৬১ সালের পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের নারী আন্দোলন দাবি জানাচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনে পূর্ণ সংস্কার করে সংবিধানের সঙ্গে পূর্ণ সংগতি রেখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় একটি আইন। 

বাংলাদেশের সংবিধানে সব ধর্মের নাগরিকদের সম-অধিকার রয়েছে। তবে পারিবারিক আইন বিষয়ে ‘ব্যক্তি আইন’ বা সব সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মীয় বিধান অনুসারে চলার বিধান সংবিধানে আছে। ফলে সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের যেমন ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’ আছে, তেমনি খ্রিস্টান সম্প্রদায়, হিন্দু সম্প্রদায়, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন নিজ নিজ ধর্মীয় বিধান অনুসারে পারিবারিক আইন চালু আছে। এই একই বিধান ভারতবর্ষেও প্রচলিত আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ‘পার্সনাল ল’ বিষয়ে ভারত ও বাংলাদেশ কোনো সংস্কার করতে সম্মত নয়। 

উল্লেখযোগ্য যে ‘পার্সোনাল ল’-এর নেতিবাচক আঘাত-সংঘাত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু উভয় সম্প্রদায়ের নারীর জীবনেই শতভাগ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনের সময় উনিশ শতকে ভারতবর্ষে বা উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মের পারিবারিক আইন বিধি বিষয়ে কোনো সংস্কার হয়নি। ইংরেজ সরকার ‘পার্সোনাল ল’ বিষয়ে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সময়ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের প্রধান দৃষ্টি ছিল নারীর জীবনে ‘পারিবারিক বা পার্সোনাল ল’-এর মর্মান্তিক নির্যাতন ও বৈষম্য বন্ধ করার ক্ষেত্রে। ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ থেকে ভারতবর্ষে হিন্দু আইন সংস্কারের ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয় এবং ১৯৫৫ সালে পূর্ণাঙ্গ হিন্দু পারিবারিক আইন প্রণীত হয় এবং পরবর্তীকালে আরও প্রগতিশীল সংস্কার করা হয়। তবে ভারতের মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইন সংস্কার বিষয়ে ভারত সরকার নিশ্চুপ রয়েছে। 

পাকিস্তানে মুসলিম পারিবারিক আইন সংস্কার ও লিখিত আইন করার আন্দোলন ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিলেন নারী আন্দোলনের নেতৃত্ব। ১৯৬১ সালে লিখিত পারিবারিক আইনে কিছুটা সংস্কার করা হয়। ১৯৭৪ সালে মুসলিম বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রার আইন হয়েছে। কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইনটিতেও ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’-এর হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে। ১৯৬১ সালের পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের নারী আন্দোলন দাবি জানাচ্ছে মুসলিম পারিবারিক আইনে পূর্ণ সংস্কার করে সংবিধানের সঙ্গে পূর্ণ সংগতি রেখে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় একটি আইন। একই সঙ্গে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইনের সংস্কার করে সংবিধানের বিধি-বিধানের সঙ্গে সমন্বিত করা হোক। 

সেই লক্ষ্যেই বাংলাদেশের নারী, এনজিও, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ‘নাগরিক উদ্যোগ’ থেকে ‘হিন্দু পারিবারিক আইন’ সংস্কার করার দাবি জানানো হয়েছে। বিয়ে, বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে লিখিত বিধান তৈরির দাবি বাংলাদেশের ব্যাপক হিন্দু নারী সমাজ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। বিতর্ক চলছে হিন্দুধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নারী ও নাগরিক উদ্যোগের নারী-পুরুষ প্রগতিবাদীদের। 

সম্প্রতি নাগরিক উদ্যোগ থেকে একটি প্রস্তাবিত ‘হিন্দু বিবাহ আইন-২০১১ (খসড়া)’—বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রীর কাছে অর্পণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বলেছে, ‘হিন্দু বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে “ঐচ্ছিক আইন” করা যাবে। বাধ্যবাধকতা থাকবে না।’ 
নাগরিক উদ্যোগের খসড়া প্রস্তাবিত আইনটি এরূপ: 

হিন্দু বিবাহ আইন-২০১১ (খসড়া)

খসড়া হিন্দু বিবাহ আইন প্রণয়নের জন্য গঠিত নাগরিক উদ্যোগ যে খসড়া আইনটি তৈরি করেছে, তার বিশেষ দিকগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:‌

হিন্দু বিবাহের শর্তাবলি—

১)    নিম্নযুক্ত শর্তাবলি পূরণ সাপেক্ষে একজন হিন্দু নারী ও একজন হিন্দু পুরুষের মধ্যে বিবাহ সম্পন্ন হইতে পারিবে: 

ক.    বিবাহের সময় বর ও কনে মানসিকভাবে আইনসংগত সম্মতি প্রদানে সক্ষম হইবেন এবং তাহাদের পূর্ণ সম্মতি থাকিতে হইবে; 

খ.    বিবাহে কনের বয়স অন্যূন ১৮ বছর ও বরের বয়স অন্যূন ২১ বছর হইতে হইবে; 

গ.    বিবাহটি অবশ্যই এই আইন অনুসারে নিবন্ধন করিতে হইবে। 

২)     বিবাহে ধর্মীয় প্রথা, নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন করা যাইবে। 

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধীকরণ কি করতেই হবে?

১.    সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলায় একজন হিন্দু বিবাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগ প্রদান করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষ অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং বর পক্ষের দুইজন সাক্ষী ও কনে পক্ষের দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে এবং বর ও কনের সাক্ষ্য গ্রহণপূর্বক বিবাহ নিবন্ধন করিবেন। বিবাহ রেজিস্ট্রার বর পক্ষের অথবা কনে পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্ধারিত ফর্মে বিবাহের সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন; 

২.    বিবাহ সম্পন্ন হইবার দিন হইতে ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই বিবাহ নিবন্ধন করিতে হইবে। কোনো অনিবার্য কারণে নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন না করিতে পারিলে ৩০০ টাকা বিলম্ব ফিসহ পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধন করা যাইবে। বিবাহ নিবন্ধনের দায়িত্ব উভয় পক্ষের। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো পক্ষ বিবাহ নিবন্ধন করিতে অনীহা প্রকাশ করিলে সংক্ষুব্ধ পক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নিবন্ধনের আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন অথবা তজ্জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন;

৩.    বর পক্ষ ও কনে পক্ষ কোনোরূপ ধর্মীয় নিয়মাদি ও সামাজিক উৎসবাদি পালন ব্যতীত সরাসরি বিবাহ রেজিস্ট্রারের অফিসে বিবাহ নিবন্ধন করিতে পারিবেন; 

৪.    হিন্দু বিবাহ আইন-২০১১ পাস হইবার পূর্বে সম্পাদিত সকল বিবাহও পক্ষদ্বয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই আইন পাস হইবার পর যে কোনো সময় নিবন্ধন করা যাইবে। 

বিয়ের শর্ত ভঙ্গ করলে দণ্ড কি?

বিবাহের যে কোনো পক্ষ ৪ ধারার (খ) উপধারার শর্ত ভঙ্গ করিলে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯’ (২১ নম্বর আইন) অনুযায়ী এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হইবেন।

বিবাহবিচ্ছেদের কারণ

এই আইন প্রবর্তিত হইবার পূর্বে অথবা পরে সম্পাদিত যে কোনো বিবাহের স্বামী অথবা স্ত্রী নিম্নলিখিত যে কোনো এক অথবা একাধিক কারণে আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ-এর জন্য আবেদন করিতে পারিবেন:

১.    স্বামী অথবা স্ত্রী যদি একজন অন্যজনের উপর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন করিয়া থাকেন;

২.    স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করিয়া থাকেন;

৩.     স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন এবং চিকিৎসা করানোর পরও যদি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকিয়া থাকে;

৪.     স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি সংক্রামক কোনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া থাকেন যা চিকিৎসা দ্বারা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ হয় অথবা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নাই বলিয়া চিকিৎসক সনদ প্রদান করেন;

৫.     স্বামী স্ত্রীকে যদি একাধিকক্রমে দুই বছর যাবৎ ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন;

৬.     অত্র আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে পৃথকভাবে বসবাসকালীন সময় স্বামী যদি স্ত্রীকে ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন;

৭.     অত্র আইনের ১১ ধারার প্রযোজ্য বিশেষ ক্ষেত্র ব্যতীত স্বামী যদি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া থাকেন;

৮.     স্বামী অথবা স্ত্রী যদি দুই বছর যাবৎ নিরুদ্দেশ থাকেন;

৯.     স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোনো একজন কোনো অপরাধে জড়িত থাকার কারণে ৭ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হইলে;

১০.     স্বামী অথবা স্ত্রী যদি একজন অন্যজনকে অপরাধমূলক কাজ করিতে বাধ্য করিয়া থাকেন;

১১.     স্বামী বিবাহের সময় যদি পুরুষত্বহীন থাকেন এবং তাহা আবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বহাল থাকে; তবে শর্ত থাকে যে, স্ত্রী গর্ভবতী থাকিলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকরী হইবে না।
 
উভয় পক্ষের সম্মতিতে বিবাহবিচ্ছেদ হলে—

১.     এই আইনে বর্ণিত বিধান মতে বিবাহের উভয় পক্ষ (স্বামী-স্ত্রী) একমত হইয়া বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য পারিবারিক আদালতে আবেদন দাখিল করিতে পারিবেন। বিবাহটি বর্তমান আইন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্বে বা পরে যখনই সম্পন্ন হউক না কেন স্বামী-স্ত্রী এই ভিত্তিতে আবেদন করিতে পারিবেন যে, তাহারা গত ছয় মাস ধরিয়া পৃথকভাবে বসবাস করিতেছেন, তাহাদের একসাথে বসবাস করা সম্ভব হইবে না এবং তাহারা আপোসে উভয় পক্ষ এই বিষয় একমত পোষণ করেন যে তাহাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটা আবশ্যক; 

২.     আদালত আবেদন পাওয়ার পর উভয়পক্ষের মতামতের ওপর ভিত্তি করিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করিবেন।
 
বিবাহিতা হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণের অধিকার আছে কি?

১৯৪৬ সালের ‘বিবাহিতা হিন্দু মহিলাদের পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণের অধিকার আইন’ (১৯ নম্বর আইন) অনুযায়ী আদালতের আদেশের মাধ্যমে হিন্দু নারীদের পৃথকভাবে বসবাস করার অধিকার এই আইনের কোনো বিধান দ্বারা বারিত হইবে না। 

বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ কখন পুনর্বিবাহ করিতে পারিবেন—

কোনো ডিক্রি মূলে বিবাহবিচ্ছেদের আদেশ জারি হইবার পর যখন কোনো পক্ষই উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের না করিয়া থাকেন অথবা আপিল দায়ের করিলেও আপিল খারিজ হইয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে যে কোনো পক্ষ উক্ত চূড়ান্ত রায় ঘোষণার ৯০ দিন অতিক্রান্ত হইবার পর এই আইনের বিধানাবলি পালন সাপেক্ষে উভয় পক্ষ নিজেদের মধ্যে অথবা তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইতে পারিবেন। 
বহুবিবাহ চলবে কি?

এই আইন প্রবর্তিত হইবার পর একজন হিন্দু নারী ও একজন হিন্দু পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি কোনো হিন্দু পুরুষ এক বা একাধিকবার অন্য কোনো নারীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করিয়া থাকেন তাহা হইলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন অথবা অন্যূন দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এবং দণ্ডিত হইবার পর দণ্ডিত পুরুষের স্ত্রীর বিবাহে কোনো বাধা থাকিবে না। 

প্রতিপক্ষের প্রতিকার প্রার্থনার অধিকার— 

যে কোনো বিবাহবিচ্ছেদের মামলায় বাদী যে সকল কারণে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা দায়ের করিয়াছেন তাহা যদি প্রমাণিত না হইয়া থাকে, মামলাটি যথাযথভাবে খারিজ হইয়া যাইবে। তবে, আদালত যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হইয়া থাকেন যে বাদী অসৎ উদ্দেশ্যে ও প্রতিপক্ষকে হয়রানি করিবার উদ্দেশ্যে আদালতে এই অভিযোগ আনয়ন করিয়াছেন এবং বাদী নিজেই এই আইনের ৮(১)(২)(১০) ধারার যে কোনো এক বা একাধিক অভিযোগে অভিযুক্ত, তাহা এই আইন অনুযায়ী প্রতিপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রতিপক্ষের অনুকূলে যেই রূপ প্রযোজ্য সেই রূপ প্রতিকারের আদেশ প্রদান করিতে পারিবেন। 

মামলা চলাকালীন ভরণপোষণের কী হবে? 

এই আইনানুযায়ী পরিচালিত কোনো মামলা, যেখানে আদালতের নিকট এইরূপ প্রতীয়মান হয়, স্ত্রীর অবস্থা এরূপ যে তাহার নিজের জীবনধারণের জন্য কোনো স্বাধীন উপযুক্ত আয় নেই, তখন স্ত্রীর আবেদনক্রমে প্রতিপক্ষের নিজস্ব আয় বিবেচনামতে আদালত প্রতিপক্ষকে দরখাস্তকারীর/ আবেদনকারীর পক্ষে মামলা চলাকালীন তাহার ভরণপোষণ, যেইরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করিবেন, সেইরূপ প্রদান করিবার জন্য আদেশ প্রদান করিতে পারেন। 

সন্তানের ভরণপোষণ কে বহন করবে?

বর্তমানে বলবৎ পারিবারিক আইন অনুযায়ী আদালত প্রতিপক্ষকে সন্তানের ভরণপোষণ প্রদানের আদেশ প্রদান করিবেন। 

সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের দায়িত্ব কার হবে? 

আদালত কতৃর্ক ১৮৯০ সালের অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন (৮ নম্বর আইন) অনুযায়ী সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব নির্ধারণ করা হইবে। 

সম্পত্তির বন্দোবস্তকরণ কিরূপ হবে? 

এই আইনানুযায়ী যে কোনো বিচার কার্যধারায় আদালত ডিক্রিতে সেইরূপ যে কোনো ব্যবস্থা রাখিতে পারেন, যেটিকে আদালত উপযুক্ত বিবেচনা করিবেন, এবং যেইগুলো বিবাহের সময় বা বিবাহ সম্পর্কিত বা বিবাহকালীন সময় এবং যেইগুলো স্বামী ও স্ত্রী কতৃর্ক একত্রে বসবাসকালীন অর্জিত অথবা দখলীকৃত সম্পত্তি বা স্থায়ী আমানত বলিয়া প্রমাণিত হইবে। 
তবে শর্ত থাকে যে, স্ত্রীধন যেহেতু স্ত্রীর একক সম্পত্তি বা স্থায়ী আমানত, উক্তরূপ সম্পত্তি বা আমানত এইক্ষেত্রে ভাগ বা বণ্টনযোগ্য হইবে না। 

কোন আদালতে দরখাস্ত/আবেদন দাখিল করা যাইবে?

এই আইনের অধীনে বিচারের এখতিয়ার ও প্রক্রিয়া পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫-এ বর্ণিত বিধান অনুসারে সম্পন্ন হইবে। 
তবে, উক্ত আইনের ১১ ধারার ক্ষেত্রে আদালত বলিতে ‘জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত’ ও ‘চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত’ বুঝাইবে। 

ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল—

এই আইনের অধীন প্রদত্ত কোনো ডিক্রি বা আদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ কোনো পক্ষ পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে বর্ণিত বিধান অনুসারে আপিল দায়ের করিতে পারিবেন।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদে ‘হিন্দু বিবাহ আইন’ এখনো অনুমোদিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রণীত হয়েছে ‘বিবাহিতা হিন্দু নারীর পৃথক বাসস্থান ও ভরণপোষণ আইন, ১৯৪৬’, ‘হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন ১৮৫৬’, ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯’ (এই আইনটি সব ধর্মাবলম্বী নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য)। এই সব আইন সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করা হয়নি এবং আইন প্রয়োগের কোনো ইতিবাচক ব্যবস্থাও দেশে নেই। 

হিন্দু নারী সমাজের বঞ্চনা, বৈষম্য, নির্যাতনের শত শত ঘটনা নাগরিক উদ্যোগের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সরাসরি সাক্ষাৎকার, আলোচনা ও পত্রপত্রিকা থেকে। বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ-রেজিস্ট্রেশন ও বিবাহবিচ্ছেদের আইন না থাকায় নারী ও পুরুষনির্বিশেষে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে পুরুষ স্বামী বহুবিবাহ করতে পারে, কিন্তু স্ত্রী তা পারে না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সারা জীবন একাকী স্বামী পরিত্যক্ত অবস্থায় সন্তানাদি নিয়ে অনাহারে কষ্টে থাকতে হয়।

বিয়ের আইনগত প্রমাণ না থাকায় নারীকে পরিত্যক্ত থাকতে হয়। বিচ্ছেদের আইন না থাকায় স্বামীর ভরণপোষণ না পেলেও, স্বামী দায়িত্ব পালন না করলেও স্ত্রী স্বামীকে বিচ্ছেদ ( Divorce) দিতে পারে না। ১৯৮০ সাল থেকে ‘বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ’ হিন্দু আইন সংস্কার করার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। বর্তমানে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এবং সহযোগী বহু সংগঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশের যশোর, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, গাজীপুর, বরগুনা, ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, চট্টগ্রাম, নড়াইল ও গোপালগঞ্জে তিন হাজার ১১০ জন নারী ও পরিবারের অন্যদের বিষয়ে জরিপ করে ২১০টি ঘটনা বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যে, হিন্দু আইনের বিধান না থাকায় নারীরা নির্যাতিত জীবন যাপন করছেন। সারা দেশের ৭৫ হাজার হিন্দু নারী-পুরুষের স্বাক্ষরসহ প্রতিবেদনে দাবি জানানো হয়েছে, হিন্দু পারিবারিক আইনের বিয়ে রেজিস্ট্রি ও বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রি করতে হবে। হিন্দু-বৌদ্ধ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় এই আন্দোলন অব্যাহত আছে। 

হিন্দু আইনে বিবাহ ও বিচ্ছেদ রেজিস্ট্রি বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে মুষ্টিমেয় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বিরোধিতা থাকায় এবং সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় বিধানে হস্তক্ষেপ না করার রাষ্ট্রীয় নীতি থাকায় হিন্দু নারীদের মানবাধিকার চরমভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। ২০১২ সালের মানবাধিকার দিবসের অন্যান্য কর্মসূচি ও আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু পারিবারিক আইন সংস্কার ও নারীর জন্য সুসহ করার বিষয়টি প্রাধ্যান্য পেয়েছে।‌

লেখক : অধ্যাপক (Central Womens University. Chair Person, Sociology and Gender Studies. Dhaka, Bangladesh) প্রথিতযশা প্রাবন্ধিক  

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment