- 06 October, 2022
- 0 Comment(s)
- 246 view(s)
- লিখেছেন : মীরা কাজী
বাবা!
বাইরে দাঁড়িয়ে কেন? ভেতরে এস?
ভীতচকিত নিশা দ্রুত পায়ে ভিতরে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।
আজও ঘুম এলো না? এক গ্লাস জল নিশার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে শিশিরবাবু বললেন।
সে আজও এসেছিল। জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে গ্লাসটা হাতে ধরা অবস্থায় বলল নিশা।
নিশা! তোমাকে আগেও বলেছি ওসব তোমার মনের ভুল। সবসময় অভিকে নিয়ে চিন্তা করছ, তাই ওরকম হচ্ছে।
না বাবা! আমার মনের ভুল নয়? আমি সত্যি শুনতে পাই, জানালার বাইরে অভিরূপের মত গলায় আমার নাম ধরে কেউ ডাকে!
তোমার কি খুব ভয় করে? সস্নেহে বললেন শিশিরবাবু।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে নিশা। তারপর ধীরে ধীরে বলল, “ভয় ঠিক নয়, তবে যখন নিশ্চিত জানি মানুষটা আর নাই। কখনও আমার নাম ধরে আর ডাকবে না। তবুও যখন এমন হয়। তখন আমার খুব অস্থির অস্থির লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
কাল থেকে তুমি রাতের খাবার খেয়ে এ ঘরে চলে আসবে। আমি তো জেগেই থাকি। তোমার সঙ্কোচের কোনো কারণ নাই। তুমি বইটই পড়বে, ইচ্ছে হলে গান শুনতে পার। তারপর যখন ঘুম আসবে তখন ঘুমোতে যেও।
কিন্তু মা যদি কিছু —?
আমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলব।
বাবা!
কিছু বলবে? তুমি দাদার কাছে গিয়ে থাকার কথা বলছিলে না?
হ্যাঁ! তো কী হয়েছে?
আমি ওখানে যাব না।
কেন? কোনো অসুবিধা?
বৌদি অসুস্থ। সেই নিয়ে এমনিতেই দাদা ভীষণ টেনশনে থাকে। অভিরূপের মৃত্যুটাও দাদার কাছে একটা বিশাল ধাক্কা। এবার আমি যদি ওখানে গিয়ে থাকি তাহলে —!
আমি কিন্তু তোমাকে সেভাবে বলিনি। তোমার নিজের বাড়ি থাকতে তুমি কেন দাদার বাড়িতে বরাবর থাকতে যাবে? পরিবেশ পাল্টালে অনেক সময় মনের ভার লাঘব হয়। তাই বলেছিলাম। তোমার যেতে মন না চাইলে যেও না।
নিশার ভাল নাম নিশিথীনি। শিশিরবাবুর একমাত্র ছেলে অভিরূপের স্ত্রী। অভিরূপ চলে যাবার পর থেকে হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছল মেয়েটা দিনকেদিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। দিনের বেশিরভাগ সময় সে নিজের ঘরে শুয়েবসে কাটায়। সমস্ত কিছুতেই সে ভুল করে ফেলে— তরকারিতে নুন দিতে, চায়ে চিনি দিতে। তাই ঘরের কোনো কাজে মালবিকা তাকে হাত দিতে দেয় না।
শিশিরবাবু অনেকবার মালবিকাকে বুঝিয়েছেন, সংসারটা নিশার হাতে ছেড়ে দিতে, তাহলে হয়তো আস্তেআস্তে ওর মনের ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে। মালবিকা তাতে রাজি নয়। একমাত্র ছেলের মৃত্য তাকেও ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। অভিরূপের মৃত্যুর সব দায় নিশার ঘাড়ে চাপিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা পেতে চাইছে। শিশিরবাবু সব বোঝেন। শুধু বুঝতে পারেন না এখন তার কী করা উচিৎ। নিশার হয়ে কিছু বললে মালবিকা অশান্তি করে। তাতে করে নিশা আরো বেশি কষ্ট পায়। মেয়েটার জন্য বড় কষ্ট হয় শিশিরবাবুর।
নিজের ঘরে এসে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকল নিশা। সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সে। আজ বলে নয় অভিরূপ মারা যাবার পর থেকেই এমনটা হচ্ছে। রাতে ঘুম আসে না। অভিরূপের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মাঝরাতে মনে হয় অভি্রূপের গলায় কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। তখন সে আর স্থির থাকতে পারে না। এক ছুটে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরে গিয়ে হাজির হয়। প্রথম দু-চার দিন শাশুড়ির ঘরে গিয়েছিল। তার ফল ভাল হয়নি। তিনি উলটে গালমন্দ করেছিলেন নিশাকে।
ছেলেটার মাথাটা তো খেয়েছো? এখন তার নামে উলটোপালটা দোষারোপ করতে মুখে বাধছে না তোমার?
উলটোপালটা নয়। আমি স্পষ্ট শুনলাম, অভিরূপ আমার নাম ধরে ডাকল। দেখতে গেলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না।
ছাড় ওসব পাগলামি। তুমি বলতে চাইছো, অভিরূপ ভূত হয়ে তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে? আমি ওর মা, কই কোনদিন তো কিছু শুনিনি। ঠিক আছে, ভূতের বাড়িতে তোমার থাকার দরকারটাই বা কি? তোমার দাদার কাছে গিয়ে থাকলেই তো হয়।
এ বাড়ি থেকে চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ বলছি। কার টানে এখানে পড়ে থাকবে? তার থেকে নিজের পছন্দ মত কাউকে বিয়ে করে সংসার পাত। আমরাও শান্তি পাই।
এরপর থেকে শাশুড়ির ঘরে যায়না নিশা। এই ঘরে টিকতে না পারলে শ্বশুর মশাইয়ের ঘরে চলে যায়। সেখানেও কি শান্তি আছে? ওঘরে বেশিক্ষণ থাকলে শাশুড়ি আপত্তি করেন।
অভিরূপ যখন ছিল তখন এই শাশুড়িই কত ভালোবাসত নিশাকে। নিজের শাড়িগয়না দিয়ে সাজিয়ে দিত। একমাত্র ননদ অরুনিমাও “বৌদি” “বৌদি” করত। মাঝে মাঝে নিজের বাড়িতে ডেকে নিশার প্রিয় পদ রান্না করে খাওয়াত। হঠাৎ করে কালবৈশাখী ঝড় এসে নিশার জীবন থেকে সোনা রঙের দিনগুলো শুকনো পাতার মত উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল।
সে দিনটা ছিল রবিবার। অভি নিশাকে নিয়ে বেরিয়েছিল। গন্তব্য রবীন্দ্র সরোবর। পৌঁছানোর ঠিক আগে হঠাৎ করে একটা কুকুর বাইকের সামনে চলে এল। কুকুরটাকে বাঁচাতে গিয়ে অভি টাল সামলাতে পারল না। নিশা ছিটকে অনেকটা দূরে গিয়ে পড়ল। তারপর আর কিছু জানে না নিশা। যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে নার্সিং হোমে। নিশার আঘাত মারাত্মক ছিল না। চার দিনের মাথায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়াছিল। পরে নিশা জানতে পেরেছিল অভিরূপের স্পট ডেথ হয়েছে।
বাড়িতে ফিরে নিশা দেখল কিছুই আর আগের মত নাই। শ্বশুরমশাই, শাশুড়ি পাথরের মুর্ত্তির মত বসে আছেন। অরুনিমা তাকে দেখেও না দেখার ভান করল। কাজের বৌ সুমিতা তাকে তার ঘরে পৌঁছে দিল। কাঁদতেও বুঝি ভুলে গেল নিশা।
তারপর নিশা কতবার ভেবেছে, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। পারেনি। এবাড়ি ছেড়ে যাওয়া মানে অভিরূপকে ছেড়ে যাওয়া। অভিরূপ নেই কিন্তু তার রেখে যাওয়া সবকিছু এখানে আছে। তার মধ্যেই কোথাও না কোথাও অভিরূপকে পেয়ে যায় সে। তাই বা কম কি? দাদার কাছে চলে গেলে অভিরূপ কে পুরোপুরি হারাবে সে।
সেদিন খেতে বসে শিশিরবাবু লক্ষ্য করলেন নিশা দু-এক গ্রাস খেয়ে হাত গুটিয়ে বসে আছে। জিজ্ঞা্সা করতে বলল, তার ক্ষিদে নেই। বিকালে শিশিরবাবু মালবিকাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওকে কিছু খেতে দিয়েছ?”
দিতে হবে কেন? ও নিজে নিয়ে খেতে পারে না? ভাত ছেড়ে উঠে পড়ে দেখাতে চাইছে, ও খুব কষ্টে আছে। মিটমিটে শয়তান।
আহ মালবিকা! ও শুনতে পাবে।
পাক!
একটা মেয়ে সারাদিন অভুক্ত থাকল! ও যদি তোমার নিজের মেয়ে হত?
বাজে বকবে না। তোমার আদিখ্যেতা আর আমার সইছে না। সবসময় ওর দিকে ঝোল টেনে কথা বল। তাহলে ওকে নিয়েই থাক। আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। দুম দাম পা ফেলে চলে গেল মালবিকা।
তার কিছু পরেই অরুনিমার ফোন।
বাবা! তুমি মাকে কি সব উলটোপালটা বলেছ? এমন চলতে থাকলে মাকে আমার কাছে এনে রাখব।
কি হয়েছে বলবি তো?
তুমি জান না? বৌদি না খেয়ে উঠে গেছে বলে তুমি মাকে যা নয় তাই বলে হ্যানোস্থা করেছ? দাদা মারা যাবার পর থেকে এমনিতে মা কান্নাকাটি করে। তার উপর তোমাদের অত্যাচারে মানুষটা শেষে পাগল না হয়ে যায়?
অরুনিমার কথা শুনে মর্মাহত হন শিশিরবাবু। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে কুরেকুরে খেতে থাকে। অভির মৃত্যুতে তার কোনো কষ্ট নেই? মালবিকার কষ্টটাই অরুনিমা দেখতে পেল? একেক জনের কষ্ট একেক রকম। শিশিরবাবু, মালবিকার কষ্টের সাথে নিশার কষ্টের তুলনা চলে না। সে পরের বাড়ির মেয়ে বলে তার কষ্টকে খাটো করে দেখা অন্যায়।
প্রায় প্রতিদিনই নিশা অল্প কিছু মুখে দিয়ে উঠে পড়ছে। সেদিনের পর থকে নিশার খাওয়ার ব্যাপারে উচ্চবাচ্চ করেন না শিশিরবাবু। সেদিন নিশা না খেয়ে উঠে পড়লে মালবিকা গজগজ করতে থাকল, “গরীবের অন্ন মহারানির মুখে রুচছে না। যাও না কোন চুলোয় যাবে? কে ধরে রেখেছে?” হঠাৎ কি মনে করে শিশিরবাবু নিশার ফেলে রাখা মাছের ঝোল একটু মুখে দিলেন। একি! এতো নুনে পোড়া? তার বাটিতে তো নুন ঠিকই আছে? তাহলে? কে করেছে এ কাজ? মালবিকা? ছিঃ! ছিঃ! মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়াবার জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মালবিকা? এত নীচে নেমে গেছে? কতদিন এভাবে চলছে কে জানে? দিনের পর দিন মেয়েটা না খেয়ে কাটাচ্ছে। অথচ কাউকে মুখ ফু্টে কিচ্ছু বলেনি। বড় অসহায় লাগে শিশির বাবুর।
বেশ কয়েকদিন নিশা শিশিরবাবুর ঘরে ঢোকেনি। সেদিন রাতে শিশির বাবুর ঘরে এসে বলল, “আপনি রোজ দুপুর বেলায় কোথায় যান? ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়?”
কিছু জরুরি কাজ পড়ে আছে। সেগুলো গুছিয়ে নিতে হচ্ছে।
বাবা! আমাকে একটা কাজ দেখে দিন না?
তুমি কাজ করবে? কি কাজ?
যে কোনো কাজ! এভাবে আপনাদের বোঝা হয়ে কতকাল থাকব?
তুমি আমাদের বোঝা নও সেকথা বলি কোন মুখে? তুমি যে ব্যবহার এ বাড়ি থেকে পাচ্ছ তা যে কোনো ভদ্র পরিবারের পক্ষে অশোভন। তুমি রাগ করতেই পার।
আমার কারো প্রতি কোনো রাগ নেই। মাকেই বা দোষ দিই কি করে? আমার কপাল দোষেই তিনি আজ তার ছেলেকে হারিয়েছেন।
নিশা! তুমি এ কালের শিক্ষিতা মেয়ে। মালবিকা যা ভাবে, তোমার তেমন করে ভাবা সাজে না। এটা একটা দুর্ঘটনা। অকারণ নিজেকে দোষী ভেবে কষ্ট পেও না। যাও্ এবার ঘুমোতে যাও।
এত রাতে এখানে তোমার কি কাজ? হঠাৎ করে ঘরে ঢুকে নিশাকে শিশিরবাবুর ঘরে দেখে গর্জে উঠল মালবিকা।
না মানে ঘুম আসছিল না তাই—
ঘুম আসছিল না বলে শ্বশুরের ঘরে শুতে আসবে? নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ কোথাকার?
কী হচ্ছে মালবিকা? কাকে কী বলছ?
বুড়ো বয়সে তোমার ভীমরতি হয়েছে! রাত দুপুরে ছেলের বিধবার সাথে গল্পগাছা করতে বাধে না তোমার? ছিঃ।
মালবিকা! নিশা আমার কাছে অরুনিমার মত। আমার আর এক মেয়ে। বাপের কাছে মেয়ে আসবে তাতে বাধা কোথায়?
মেয়ে? বুঝিনা কিছু? এত কিছুর পরেও ও কেন এ বাড়িতে পড়ে আছে? কার টানে?
ছিঃ! মালবিকা থামো! শিশিরবাবু ধমকে উঠলেন।
নিশা কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে চলে গেল।
বাড়িটা যেন শ্মশানপুরী। তিনটে প্রাণী কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সেদিনের পর থেকে নিশা তার ঘর থেকে বেরোয় না। শিশিরবাবু সারাদিন বাইরে কাটান। রাতে নিজের ঘরে চুপচাপ বই পড়ে কাটান। খাবার টেবিলে দুজনের খাবার যেমনকার তেমনই পড়ে থাকে।
সেদিন দরজায় মৃদু আঘাতে ধড়মড় করে উঠে বসল নিশা।
নিশা! আমি, দরজা খোলো।
বাবা! আপনি? এত রাতে? শরীর ঠিক আছে তো? শিশিরবাবুর ডাকে দরজা খুলে বলল নিশা।
হ্যাঁ মা! ঠিক আছে। তুমি তৈরি হয়ে নাও। এক জায়গায় যাব।
কোথায় বাবা?
পণ্ডিচেরী।
পণ্ডিচেরী?
হ্যাঁ। সেখানে অরবিন্দ আশ্রমে আমার একটা কাজের ব্যবস্থা করেছি। বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দেব।
আর আমি?
তুমি আপাতত ওখানেই থাকবে। তারপর অন্য কিছু ভাবতে হবে। তোমাকে নতুন একটা জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে আমি যে মরেও শান্তি পাব না!
আমরা কোত্থাও যাব না বাবা!
নিশা! এর পরেও এ বাড়িতে থাকতে তোমার মন চাইছে?
হ্যাঁ! চাইছে। আমি এবার থেকে এখানে নিজের অধিকারে থাকব। অভিরূপের স্ত্রী হিসাবে আমি তার জমানো টাকা এবং এই বাড়ির একটা অংশের মালিক। আমার এক ল ইয়ার বন্ধু শ্রেয়স, তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। অভিরূপের সমস্ত কাগজপত্র তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।
নিশা! আমিও তো ঠিক এটাই ভেবেছি। এখানে তোমার মা ও অরুনিমা অনেক সমস্যা তৈরি করবে। তাই ভেবেছিলাম অন্য কোথাও গিয়ে —।
আমি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি আমার সাথে আছ তো বাবা?
থাকতে তো আমাকে হবেই। হেরে যাওয়া নিশাকে দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার জিতে যাওয়া নিশাকে দেখতে চাই।
বাবা!
আসল লড়াইটা তো তুমি জিতেই গেছ। সেটা ছিল তোমার নিজের সাথে নিজের লড়াই। বাকিটা তোমার বন্ধুর হাতে ছেড়ে দাও। এবার ঘুমিয়ে পড়। শিশিরবাবু নিজের ঘরে দিকে এগিয়ে গেলেন। নিশাকে নিয়ে আর কোনো দুশ্চিন্তা নাই। অনেকদিন পর তিনি একটু নিশ্চন্তে ঘুমোবেন আজ।
0 Comments
Post Comment