- 04 June, 2023
- 0 Comment(s)
- 380 view(s)
- লিখেছেন : অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
‘আকালের সন্ধানে’ মনে পড়ছে আজ। অথবা মন্বন্তরের বেয়াল্লিশ। উদ্বাস্তু হয়ে কোনও জনতাকে যখন চলে আসতে হয়, নিশ্চিত ভাবেই ঘা’টা সবচাইতে বেশি করে পড়ে মেয়েদেরই উপর। মন্বন্তরের সময় আমরা দেখেছি, কিভাবে উজাড় করে গ্রামকে গ্রাম এসে পড়েছিল শহরে। একই সঙ্গে আব্রু, সম্মান ও পরিবার বাঁচাতে গিয়ে স্রোতের মুখে বালির চেয়েও নগণ্য আগলের মতো মেয়েরা ভেসে গিয়েছিল। একই সঙ্গে নারী ও উদ্বাস্তু হওয়া যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ...
৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। অনেক বছর হলো এই দিনটিকে আমরা যথাযথ আড়ম্বরের সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমে পালন করে এসেছি। অবশ্য ফেসবুক বা সমতুল সামাজিক মাধ্যমের বাইরে আমাদের বড় একটা কিছু করার থাকে না। মাইনে অল্প বাড়লে পরেই আমরা ঘরে এয়ারকণ্ডিশন বসাই। গণপরিবহনের চেয়ে ব্যক্তিগত পরিবহণকেই অতীব প্রয়োজনীয় বলে মনে করি। আমরা স্বচ্ছন্দে যে কোনও আলোচনার বাইরে এসে দাঁড়ালে, নিশ্চিত করে নিমেষেরই ভিতর ভুলে যেতে পারি পরিবেশ পরিবর্তনের বিষয়ে। কারণ পরিবেশ পরিবর্তন সরাসরি ভাবে এখনও আমাদের, শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তদের জীবনে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। প্রভাব যা কিছু ফেলেছে ওই আফ্রিকা, অমুক-তমুক, অথবা বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। অন্তত তেমনটাই আমরা বুঝে থাকি। কাজেই ‘আবহাওয়া শরণার্থী’ শব্দটাকে কানে শুনলে পরেও, তার আসল ব্যাপ্তিটাকে আমরা এখনও ধরে উঠতে পারিনি। কিছু তথ্য সাজিয়েই বরং বিষয়টির নান্দীমুখ করি আসুন।
পৃথিবীতে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে পরিবেশ পরিবর্তনের এই প্রকোপকে যদি কোনওভাবে এখনও না আটকানো যায়, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ সারা পৃথিবীতে অন্ততপক্ষে ১২০ কোটি মানুষ ‘আবহাওয়া শরণার্থী’র জায়গায় এসে দাঁড়াবেন। অন্য আরেকটি সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে ২০ কোটি জনসংখ্যার দেশ, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ১ কোটি মানুষ ‘আবহাওয়া শরণার্থী’র জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এমন ‘আবহাওয়া শরণার্থী’র সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কাপ্রকাশ করেছেন এই ধারা বজায় থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে কেবলমাত্র আমাদের দেশেই সাড়ে চার কোটি মানুষ ‘আবহাওয়া শরণার্থী’ হয়ে পড়বেন। এই মুহূর্তে যদি পরিবেশ পরিবর্তনকে আটকানো না যায়, তাহলে ওই একই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে গৃহহীন হবেন আরও অন্তত দুই কোটি মানুষ। উন্নত দেশগুলিরই উন্নয়নের মাশুল গুনছে আজ উন্নয়নশীল অথবা গরীব দেশগুলির মানুষ।
পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে ঘটে যাওয়া প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া মানুষদেরই আজ আমরা ‘আবহাওয়া শরণার্থী’ বলে চিহ্নিত করি। তথ্য আরও বলছে - এই বিপুল সংখ্যক যে উদ্বাস্তু জনতা, তাদেরও মধ্যে ৮০%ই হলো নারী, শিশু অথবা বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষ। তাদের উপরেই আজ প্রকৃতির প্রতিশোধ সবচাইতে বেশি করে নেমে আসতে পেরেছে। মেয়েরা বরাবরেরই উচ্ছিষ্টের জাত। যে কোনও বিপদের সময় পুরুষপুঙ্গবেরা তাদেরকেই আগে ত্যাগ করতে চায়। কাজেই উদ্বাস্তু হয়ে আসার পর শরণার্থী শিবিরগুলিতে কায়িক পরিশ্রম থেকে শুরু করে সবধরণের শোষণেরই শিকার হতে হয় তাদের। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল অথবা গরীব দেশগুলির একেকটি বিবরণ তুলে ধরলে পরেই চিত্রটা খানিক পরিষ্কার হয়ে যাবে।
যেমন ধরা যাক পেরুর এসমারেল্ডার কথা। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে উন্নয়ন মানেই প্রথম বিশ্বের বাতিল হয়ে যাওয়া সমস্ত শিল্পের উদযাপন। কাজেই এসমারেল্ডাদের কৃষিজমির আশেপাশে বেখাপ্পা গম্বুজের আকারে ক্রমশই গজিয়ে উঠতে পেরেছে বিষাক্ত সমস্ত কারখানা, যাদের বর্জ্য রাসায়নিক তাদের সেই জমিকে দিয়েছে অনুর্বর করে। এছাড়াও পরিবেশের খামখেয়ালিপনায় বদলে গিয়েছে আবহাওয়ার উষ্ণতার ধরণ, বৃষ্টির সময়কাল। সবমিলিয়ে ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে গেলে আগের চেয়েও অনেকখানি বেশি করে সময় দিতে হয় এসমারেল্ডাদের। গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে হয় জলের প্রয়োজনে। এহবাহ্য যে, এই সমস্ত ক্ষেত্রে গ্রামের মেয়েদেরকেই পাঠানো হয় বেশি। বাকিটুকুকে বিশদে ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখছি না। পুরুষের কদর্য হাত যে প্রসারিত সমস্ত জায়গাতেই।
‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে কৃষিকাজ-জনিত শ্রমের ক্ষেত্রে মোট শ্রমিকসংখ্যার ৪০%ই নারী। অঙ্কের হিসেব কষলে পরে এও দেখা যাচ্ছে, সেই মেয়েমানুষেরাই এই তথ্য অনুসারে সারা পৃথিবীর ৬০%-৮০% খাদ্যের উৎপাদক। এই হিসেবের পরেও, তাদেরই উপর পুরুষপ্রজাতির অত্যাচার সবচাইতে বেশি করে নেমে আসতে পেরেছে।
মার্চ ২০১৬, ইন্দোনেশিয়াতে নিজের পরিবারকে ফোন করে ডলফিনা (৩০) জানিয়েছিল, সে বাড়ি আসতে চায়। ‘কর্মসূত্রে’ ডলফিনাকে থাকতে হতো মালয়েশিয়ায়, উপকূলবর্তী ক্লাং শহরে। ডলফিনা সেই ১৯ লক্ষ অবৈধ শরণার্থীদের একজন, যারা কিনা পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে। পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে ইন্দোনেশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিকাজ ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সেই থেকেই মানুষপাচার চক্রেরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং কাজ পাইয়ে দেবার নাম করে ডলফিনার মতো মেয়েদের, মানুষদের, ঠাঁই হচ্ছে সীমান্তপারের কোথাও। মার্চ মাসের সেই ফোনের পর, এপ্রিলেই ডলফিনার নিথর দেহ কফিনবন্দি হয়ে এসে পৌঁছয় ইন্দোনেশিয়ায়। সঙ্গে একটি মালয়েশিয় ডেথ সার্টিফিকেট। সৎকারের সময় ডলফিনার পরিজনেরা দেখেন, তার মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন। গলা থেকে পেট হয়ে যৌনাঙ্গ অবধি টাটকা সেলাইয়ের দাগ। মানুষপাচার থেকে কখন যেন বেআইনি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারচক্রেরও শিকার হয়ে পড়েছে ডলফিনাদের মতো একেকজন। শেষ অবধি পরিবারের কপালে জুটেছে কফিনবন্দি অবয়ব, কখনও বা জোটেনি তাও। আবহাওয়া শরণার্থীদের এমনই ভবিষ্যৎ।
সোমালিয়া বলতেই আমাদের মনে পড়ে জলদস্যু অথবা ‘ক্যাপ্টেন ফিলিপস’এর হলিউডি উপাখ্যান। বাস্তবে কিন্তু সেই অঞ্চল, ভয়াবহ খরার কারণে গত পাঁচ বছর ধরে চরম দুর্ভিক্ষের শিকার। ২০২২এরই হিসেব অনুসারে সোমালিয়াতে মারা গিয়েছেন অন্ততপক্ষে ৪৩,০০০ মানুষ। যদিও এই বছরেরই মার্চ মাসে আবার প্রবল বৃষ্টির কারণে অভাবনীয় বন্যার কবলে পড়েছে সোমালিয়া। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অন্ততপক্ষে সাড়ে চার লক্ষ মানুষ, দুলক্ষ মানুষ এই বন্যার কারণে নতুন করে উদ্বাস্তু হয়েছেন। আবহাওয়া পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই হলো তার এই খামখেয়ালি মনোভাব। কেবল চরম থেকে চরমতম অবস্থার মধ্যেই জলবায়ুর যাতায়াত এখন। এই পরিস্থিতিতে পড়তে চেয়েছিলাম দাদাব শরণার্থী শিবিরের খবর। খরা ও দুর্ভিক্ষপ্রবণ সোমালিয়ায় ১৯৯১ সাল থেকেই এই শরণার্থী শিবিরটির অস্তিত্ব রয়েছে। বিজ্ঞানীদের মতে, এরপরেও সারা পৃথিবীর তুলনায় আগামী বছরগুলিতে পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া ও এমন সমস্ত গরীব আফ্রিকান দেশগুলিতেই একশো গুণেরও বেশি হয়ে পড়তে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে দাদাব ক্যাম্পের মহিলারা নরকের চেয়েও খারাপ কোনও কিছুতে দিনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
এই মুহূর্তে অনাহারক্লিষ্ট সোমালিয়ায় গর্ভবতী মেয়েদের সংখ্যা ৩,৮০,০০০এর কাছাকাছি। অবিলম্বে জীবনদায়ী চিকিৎসা ও খাবার প্রয়োজন তাদের। হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চলে সব মিলিয়ে ১৫ লক্ষ শিশু এই মুহূর্তে স্কুলের পড়াশোনাকে বিদায় জানিয়েছে। সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষের কারণে এই সংখ্যাটি আরও কয়েক লক্ষ বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন। শরণার্থী শিবিরগুলিতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মেয়েদের উপর অত্যাচার। বাড়ছে বাল্যবিবাহের ঘটনা। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব অনুসারে ২০২২এর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে সোমালিয়ায় মেয়েদের উপর তাদের ঘনিষ্ঠ ভাবে পরিচিত ও নিকটস্থ মানুষদের তরফে অত্যাচারের ঘটনা ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল অবধি দাদাব শরণার্থী শিবিরে চালানো সমীক্ষা বলছে, সেখানকার ৪৭% মহিলাই কোনও না কোনও সময়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের মানুষদের তরফে অত্যাচারিত হয়েছেন। ৩৯% শতাংশ মেয়েদের অভিযোগ, ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বাইরে অন্য পুরুষেরাও তাদের উপরে অত্যাচার করেছে।
চাইলে এমন তথ্যের পরে তথ্য এখানে সাজিয়ে যেতে পারি। শরীর অসুস্থ বোধ হয়। সংখ্যা বস্তুটিকে তখন মানবতার নিকৃষ্টতম আবিষ্কার বলে বোধ হতে থাকে। একদিকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে পরিবেশের ধ্বংসসাধনে আমরা উৎসুক। তারই কারণে, এই যে মুদ্রার ওপিঠ, তারও সম্পর্কে আমরা আদতে চূড়ান্ত অজ্ঞানতার পরিচয় দিয়ে চলেছি। পরিবেশ দিবসের প্রতিজ্ঞা কেবল যে চারাগাছ রোপণেই শেষ হয়ে যেতে পারে না। প্রতিটি ফেসবুক-আলাপেই শেষ হয়ে যেতে পারে না, এই বোধটুকুও আমাদের মধ্যে আসেনি।
আজ প্রতিটি হ্যাশট্যাগ উচ্চারণেরও সময় আমরা যেন এই নিবন্ধে উল্লেখ করে আসা সমস্ত সংখ্যাকেই আমাদের দুঃস্বপ্নে অনুভব করি। যন্ত্রণায় উপনীত হয়ে যেন বা অনুভব করি, একই সঙ্গে নারী ও উদ্বাস্তু হওয়ার সেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার উপাখ্যান ...
সূত্রঃ
[১]https://www.weforum.org/agenda/2021/06/climate-refugees-the-world-s-forgotten-victims/
[২]https://www.ohchr.org/en/stories/2022/07/climate-change-exacerbates-violence-against-women-and-girls
[৩]https://ejfoundation.org/news-media/sacrifice-loss-and-resilience-women-of-dadaab-refugee-camp-2
[৪]https://qz.com/1490598/indonesias-climate-refugees-are-forced-into-deadly-migrant-trafficking
0 Comments
Post Comment