সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পিতৃচোখে মেয়েরা (পর্ব-২)

  • 25 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 367 view(s)
  • লিখেছেন : তামান্না
অন্ধকারাবৃত এই সময়ে রমরমিয়ে চলছে নারীবিদ্বেষ মূলক- ট্রোলিং, সাইবার বুলিং, কদাকার মিম, অর্ধশিক্ষিত ইউটিউবারদের কদর্য ভিডিও। চাইলেই আমরা সামাজিক মাধ্যমে একজন নারীর চরিত্র তুলে গালি দিতে পারি না, স্রোতে গা ভাসিয়ে, হেলিয়ে, দুলিয়ে ভুলে ভরা এক দুনিয়া গড়তে পারি না। সমাজের সব শ্রেণির  নারীদের প্রতিনিয়ত সন্তর্পণে চরিত্রের শংসাপত্র নিয়ে, দুরু দুরু বুকে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না; সব দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের কানে তুলো, পিঠে কুলো বেঁধে আগামীতে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে!

আধেয় বিশ্লেষণ (Concept Analysis Methodology ) পদ্ধতিটি গণযোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। মূলত পাঁচ  প্রকারের আধেয়  রয়েছে –

 ক) লিখিত পাঠ্য (বই)

খ) মৌখিক পাঠ্য (বক্তৃতা)

গ) দৃশ্যমান পাঠ্য (ছবি)

ঘ) শ্রুতি ও দৃশ্যমান পাঠ্য (সিনেমা)

ঙ) হাইপার টেক্সট  (সামাজিক মাধ্যম) (তথ্যসূত্র : http://www.contentanalysis.org)

 

আমাদের আলোচনায় সামাজিক মাধ্যমে ( হাইপার টেক্সট) নারীদের উদ্দেশ্যে নেতিবাচক মন্তব্যর আধেয়কে পাঠ্য হিসাবে ধরা হয়েছে। সুতপার খুনের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। এই ভিডিওর নিচে মন্তব্য বিভাগ দেখে শিহরণ জেগেছিল।  ফেসবুক অনলাইন সংবাদপত্রের মন্তব্য বিভাগ, সুতপার নিজস্ব ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে ভুরিভুরি জঘন্য মন্তব্য দেখে সত্যিই মনে হয়েছিল, এ কোন সমাজ! সবাই হাতপা ছুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে 'মোরা থোড়াই কেয়ার করি, এই আমাদের মনের মত তরী' গেয়ে। আমাদের আলোচনায় আমরা দেখে নেব সেই সকল 'তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম' মন্তব্যগুলি। ফেসবুকের অনলাইন সংবাদ পত্রে দেখছি-

বহরমপুর ছাত্রী খুনের ঘটনায় যেসব বুদ্ধিজীবীরা মোমবাতি মিছিল করেছেন আর নারী সুরক্ষার প্রশ্ন তুলছেন তাদের উদ্দেশ্যে কটা প্রশ্ন আছে-

১) নারীদের অসুরক্ষার পেছনে আসল কারণ কী? মেয়েদের অপর্যাপ্ত স্বাধীনতা, নাকি নারী স্বাধীনতা-সুরক্ষা-প্রগতিশীলতার নামে একতরফা আইনের সুযোগ করে দিয়ে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতার পথে ঠেলে দেওয়া ?

 

২) ছেলেটা মেয়েটাকে কুপিয়ে খুন করলো, সে ঠিক কোন পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা ঘটালো ? কেনো সে এরকম একটা চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলো, যখন সে নিশ্চয়ই জানে যে খুনের শাস্তি কী!

 

৩) এটাকে খুন বলবেন না প্রতিহিংসার বশে বাধ্য হয়ে আইন হতে তুলে নেওয়া বলবেন ?

 

৪) এত স্বামী সন্তান শিশু খুন হচ্ছে (মহিলারা যেসব নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে) সেগুলোর বিরুদ্ধে কটা মোমবাতি মিছিল বার করেছেন ??  (তথ্যসূত্র: আজতক বাংলা ) পুরুষের মন্তব্য।

 

দেহকে ছুরি দিয়ে কোপানো সবাই দেখলেন, ছেলেটার মনটাকে যে মেয়েটা কুপিয়েছে মাসের পর মাস, ছেলেটার মনের রক্তক্ষরণ দেখা যায়নি তাই সে আজ সবার চোখে ক্রিমিনাল... যার হৃদয়  খুন হয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন, মৃতহৃদয় নিয়ে সে আজ  থেকে কারাগারে থাকবে… (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা) নারীর মন্তব্য।

 

সুতপা চৌধুরীর ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলের মন্তব্য-

নিজের ভুলের মাশুল দিতে হল, মেয়েটি যথেষ্ট খারাপ ছিল। (নারীর মন্তব্য)

 

নিজে ছেলে হয়ে যা বুঝি, ছেলেটা হয়তো খুব কষ্টে ছিল।হয়তো ছেলেটা জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে ছিল। কাউকে খুন করা যেমন অপরাধ, কারো মন ভাঙ্গা সেই অপরাধ। হয়তো মেয়েটা চলে গেলো ছেলেটারও তো একটা জীবন শেষ করে দিল। ছেলেটার মনের কথা কেউ না বুঝুক আমি ঠিক বুঝেছি। (পুরুষের মন্তব্য)

 

ইউটিউব ভিডিওর মন্তব্য-

ছেলেটা একদম ঠিক কাজ করেছে। কারণ মেয়েটি ছেলেটিকে ধোকা দিয়ে, ছেলেটিকে খুন করেছে। (তথ্যসূত্র :News 18 Bangla) পুরুষের মন্তব্য

 

মেয়েটার একসাথে অনেক সম্পর্ক ছিল। (তথ্যসূত্র: ABP ANANDA) নারীর মন্তব্য

 

উপরিউক্ত মন্তব্যগুলি কে আলোচ্য আলোচনায় আধেয় হিসেবে ধরেছি।  মূলত আধেয় বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা, যাঁরা মন্তব্য করেছেন সেই ব্যক্তির মানসিকতা, রুচি,পারিবারিক ও বিদ্যায়তনিক শিক্ষা, আচরণের  একটা সম্যক ধারণা পেয়ে থাকি। খুব মনযোগ দিয়ে উপরের মন্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, অপরাধীকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভাবে আমাদের সমাজের তথাকথিত শিক্ষিত দাদা ও দিদিরা সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁদের মনে দরদে উথলে উঠেছে। ছেলেটির কষ্টে তাঁরা ব্যথাতুর ! মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রশ্নমালা সাজাচ্ছেন। নারীবিদ্বেষ, পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব সামাজিক মাধ্যমের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। বিকৃত রুচির মানুষের মন্তব্যে সমর্থনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সুতপার ছবি দেখে অনেকে তাঁর চরিত্র কত খারাপ বলে ইনিয়েবিনিয়ে, ফেনিয়ে সংবাদ পত্রের মন্তব্য  বাক্স ভরিয়ে তুলেছেন। মজার  বিষয়, এই মন্তব্যকারীদের মধ্যে সিংহভাগ নারী রয়েছেন! উনাদের কে বা কাহারা চরিত্র বিশ্লেষণের মত মহৎ দায়িত্ব দিয়েছেন, কে জানে বাপু!

 

সামাজিক মাধ্যমে অসংবেদনশীল মন্তব্যকারীদের উদ্দ্যেশ্যে, সমাজবিজ্ঞানী সাদেকা হালিম বলেছেন- "এক্ষেত্রে অসচেতনতা, মানসিক বিকৃতি এবং কট্টর পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কাজ করে।"

এছাড়া তিনি যে তথ্য  দিয়েছেন- "সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজেই যা ইচ্ছা লেখা যায়। যেটা অন্য কোথাও সম্ভব না। যারা এ ধরনের মন্তব্য করে তারা নারীকে মানুষ হিসেবে দেখে না, নারী যে বয়সের হোক সে ভোগের বস্তু। মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি তাদের কোন সম্মানবোধ নেই!" (তথ্যসূত্র :  BBC  NEWS বাংলা, ২৩/০৮/২০) সাদেকা হালিমের সুচিন্তিত  গুরুত্বপূর্ণ মতামত থেকে আমাদের সমাজের পিতৃতান্ত্রিক পুরুষ ও পিতৃতান্ত্রিক নারীদের  মানসিক অবস্থান সম্পর্কে অতি উপাদেয়, বিহ্বল মানসিকতার পরিচয় মেলে। হাটেঘাটেমাঠে সর্বত্র আজকাল এদের রমরমা। মেয়েটি আত্মহত্যা করিলো, শুনলুম সে নাকি আবার লিভইন করিতো, চরিত্র খারাপ, ভাল না। মরে গেছে, ভাল হয়েছে। ঐ মেয়েটির হাত কেটে নিলে? নির্ঘাত পরকীয়া ছিল। চরিত্রের দোষ!  নির্লজ্জ বেহায়া মেয়েটি বেবিবাম্প নিয়ে ছবি পোস্ট করল! চরিত্র খারাপ। অভিনেত্রী বিয়ে না করে মা হয়ে গেল, দেশ রসাতলে গেল। চরিত্র গেল, জাত গেল। চারিদিকে কেবল গেল গেল রব! পাড়ার চণ্ডীমণ্ডপের ঠাকুরদারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের শাগরেদগণ - মোক্ষদা, ঠানদি, রাঙা দিদা, পদী পিসি, সুরজি মাসি, লতা কাকি, সেজ জ্যেঠি সবাই আছেন সামাজিক মাধ্যমে! তাঁরাও আজকাল হাতে কলমে সতী ও চরিত্রবতী হবার সহজ পাঠ পড়াচ্ছেন। কী মজা,  দুধে, তুলসীতে ধোয়া চরিত্র নিয়ে কী করিব, কোথায় যাব কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াব, আহা আহা হা!

 

অন্ধকারাবৃত এই সময়ে রমরমিয়ে চলছে নারীবিদ্বেষ মূলক- ট্রোলিং, সাইবার বুলিং, কদাকার মিম, অর্ধশিক্ষিত ইউটিউবারদের কদর্য ভিডিও।  আমরা একবার ভেবে দেখিনা, মন চাইলে আমরা সামাজিক মাধ্যমে একজন নারীর চরিত্র তুলে গালি দিতে পারি না, অন্যায়কে সমর্থন করতে পারি না, স্রোতে গা ভাসিয়ে, হেলিয়ে, দুলিয়ে ভুলে ভরা এক দুনিয়া গড়তে পারি না। সমাজের সব শ্রেণির  নারীদের প্রতিনিয়ত সন্তর্পণে চরিত্রের শংসাপত্র নিয়ে, পা টিপে টিপে, দুরু দুরু বুকে ভীরু সেজে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব না; ফলত সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের কানে তুলো, পিঠে কুলো বেঁধে আগামীতে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হবে!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment