- 17 February, 2021
- 0 Comment(s)
- 1222 view(s)
- লিখেছেন : দেবযানী বসু সেন
রূপকথার গল্প শেষ হয় এইভাবে যে, অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা পেলেন রাজপুত্র এবং রাজা সুখী। এভাবেই রাজপুত্রের বীরগাথার সাফল্য রচিত হয়। শুনডি আর হাল্লার রাজার তো সমস্যাই ছিল না গুপি আর বাঘাকে জামাই করতে, কারণ তাঁদের মণিমালা আর মুক্তমালা একটি করেই সন্তান। তাই জামাইরা শ্বশুরবাড়ির স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করবেনই।
রাজার গল্প ছেড়ে সাধারণ জীবনের দিকে নজর দিলে আমরা দেখতে পাব মধ্যযুগীয় সাহিত্যে সামাজিক হাস্য-পরিহাসের মধ্যে ঘরজামাই প্রথা ছিল অন্যতম। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম বিবাহ-পরবর্তী হরগৌরীর সংসার জীবনের বর্ণনায় জানান বাপের কাছ থেকে পার্বতী বিবাহের সময় জমি যৌতুক পান আর স্বামী-সন্তানসহ হিমালয়গৃহে থেকে যান। কিছুদিন পরেই মা মেনকার সঙ্গে তাঁর বিরোধ-বিসংবাদ শুরু হয়। সপরিবারে কৈলাস যাত্রা করলেন গৌরী। অর্থাৎ বিয়ের পর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে। কন্যা যদি ধনী হন, তাহলেও। না হলে মান থাকে না মেয়ের।
দীনবন্ধু মিত্র যখন ‘জামাই বারিক’ প্রহসন লিখেছেন, তখন অভিজাত সমাজে আলোড়ন পড়ে গেল এই ভেবে যে, এই প্রহসনে এক বিখ্যাত বাড়ির অন্দরের কোন্দল বেআব্রু হয়ে গেল। সেই বিশিষ্ট বাড়ির বড়ো জামাই ছিলেন ঘরজামাই। শিক্ষিত সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে থাকতেন এবং দক্ষতার সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি দেখাশোনা করতেন। মহর্ষি জীবিত থাকাকালীনই এই জামাই মারা যান। এরপর মহর্ষি তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথকে জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথও এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন ।
কন্যার বিবাহ হোক বা না-হোক, বাবা মার সম্পত্তির অধিকার তার বর্তাবে কি না--এর উত্তর দিতে আদালতকে অনেকবার বয়ান (statement) পরিবর্তন করতে হয়েছে। সেই ১৯৫৬ থেকেই এই প্রশ্নের মীমাংসা করতে হিমশিম খাচ্ছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। হয়তো কন্যারা এই অধিকারের বাস্তবায়ন সম্পর্কে নিজেরাই কিছুটা উদাসীন। এর কারণ সম্ভবত সূক্ষ্ম আত্মাভিমান। স্বামী-সন্তানবতী নারীরা পিতামাতার সম্পত্তির ভাগীদার হবার মধ্যে মনে করেন হীনমন্যতার পরিচয় দেওয়া হয়। কেউ-বা মনে করেন, ভাইদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে সম্পত্তির অধিকারকে কেন্দ্র করে।
চাকুরিরত কন্যা অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার ছাড়তে পারেন। কোনো পিতার পুত্রদের মধ্যে কোনো একজন বা একাধিক জন সম্পত্তির অধিকার ছেড়েছেন এমন নজির আছে নিশ্চয়ই। কিন্ত ভাই বোন সকলেই তাঁদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তির সম-অধিকারী, এমন ভাবার মন ও মতের মানুষ তখনও কম ছিলেন, আজও কম আছেন।
আরও একটা অমীমাংসিত পর্ব আছে। সামাজিক বিবাহরীতিতে সালংকারা কন্যাদান অভিভাবকদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। বরপক্ষের দাবি থাকলে তো বটেই (বরের বাবার খাঁই মেটাতে গিয়ে অনেক মেয়ের বাবাই রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প 'দেনাপাওনা'-র নিরুপমার পিতার অবস্থায় পৌঁছে যান), না-থাকলেও কন্যার ইচ্ছাপূরণ করতে এবং নিজেদের সামাজিক মান্যতা বজায় রাখার তাগিদে তাঁরা মেয়েদের বিয়ের জন্য যে খরচ করেন, ছেলেদের বিয়ের সময় তেমন করা হয় না বেশিরভাগ পরিবারে।
তাহলে পিতামাতার অবস্থানে কন্যার সমান ভাগ থাকলে তাঁরা তো বেশি লাভবান হবেন। বিশেষত মায়ের অলংকারগুলি পুত্রবধূর অপেক্ষা মেয়েদের প্রাপ্তি বেশি হয়, এটা কোন্ ভারতবাসী অস্বীকার করবেন! এখনও ভারতবর্ষের চাকরিশূন্য মেয়েরা তো বটেই, চাকুরিরতারাও ভাবতে শেখেননি শাড়ি, গহনা বা আসবাবে সজ্জিত হয়ে পতিগৃহে পৌঁছে গেলেই নিষ্কণ্টক দাম্পত্য জীবন লাভ করা সম্ভব হয় না।
উলটপুরাণও আছে। একাধিক কন্যার পিতা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাঁর যে মেয়ে বা ছেলে তাঁর অমনোনীত জামাই বা বধূ যদি পছন্দ করে তো সেক্ষেত্রে সে তাঁর সম্পত্তি পাবার অনুপযুক্ত। আবার মনে করা যাক পৌরাণিক দক্ষযজ্ঞ ও তা পণ্ড হবার কারণ। ভৃগুমুণির যজ্ঞে শ্বশুর দক্ষকে দেখে মহাদেব প্রণত হননি। এই রাগে দক্ষ একটি যজ্ঞের আয়োজন করলেন, যেখানে তিনি বড়ো জামাই বিভূতিভূষণকে নিমন্ত্রণ করলেন না। সতী লোকমুখে খবর পেলেন পিতার বাড়িতে বিরাট গেট টুগেদার (যজ্ঞ)। শিবের সঙ্গে কলহ-বিবাদ করে দশমহাবিদ্যা রূপ ধারণ করে ভয় দেখান ও বাপের বাড়ি চলে যান। বাবার যজ্ঞস্থলে গিয়ে দেখেন সেখানে শিব ভিন্ন অন্য জামাইরা সম্মানের সঙ্গে আমন্ত্রিত। এটা দেখে তিনি যখন দক্ষের কাছে জবাবদিহি চাইছেন, তখন অসন্তুষ্ট দক্ষ জানান, “বিধবা যখন হইবি তখন আসিবি দক্ষ পুরে”।
আবার একটু মঙ্গলকাব্যের অঙ্গনে বিচরণ করা যাক। ‘রূপসী বাংলা’-র কবি জীবনানন্দ দাশ বেহুলার স্বর্গলোকে নাচ দেখানোর মধ্যে তরুণীর অপমান লক্ষ করলেন, ‘বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদে ছিল পায়ে'। হ্যাঁ, সদ্য বিবাহিত বেহুলার দুরূহ যাত্রা ভয় লাগায়, মায়ায় জড়িয়ে রাখে। কিন্তু নিজের ভাগ্যকে জয় করার এই উদ্যোগের মধ্যে ছিল আর এক গোঁ। বেহুলা বাবার বাড়িতে ফিরবে না। কারণ ‘দুরক্ষরা বাণী’ সে সহ্য করতে পারবে না।
১১ অগস্ট ২০২০ সুপ্রিম কোর্ট রায় শোনাল :
A daughter is a daughter for life whether she is single, married, divorced or widowed and has equal rights to inherit ancestral property.
কাহিনির শুরু ৬৪ বছর আগে (Hindu Succession Act 1956 declares )
Any property possessed by a female Hindu, whether acquired before or after the commencement of this Act shall be held by her as full owner thereof and not as a limited owner. This makes women absolute owners of their properties.
এই রায় আইন হতে কাটল আরও ৪৯ বছর। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে একটি সংশোধনী সমেত বলা হল : একজন পুরুষ যতটা পূর্বপুরুষের সম্পত্তির অধিকার পায়, ঠিক ততটাই অধিকার থাকবে একজন নারীর তার পূর্বপুরুষের অর্জিত সম্পত্তির উপর ।
"Despite the enactment of such legislation, instances prevail where women have not been made aware of their rights. The urgent need is to communicate to the people the importance and significance of laws so that the future of rights and liberties become richer”
ভারতবর্ষের মহামান্য বিচার ব্যবস্থার বাইরে রইল তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। পার্সি, ইংরেজ আর মুসলিম সম্প্রদায়ের জনগণ। এর মধ্যে প্রথম দুই সম্প্রদায়ের জন্য ছিল আছে Indian Succession Act 1925 section 31, 49। ইংরেজের আর পার্সি সম্প্রদায়ের জন্য sections 50 আর 56। দুই ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত।
Muslim Personal Law (Shariat) Application Act 1937, নারীদের নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কিছু স্বাধীন অধিকার দিয়েছে। কী সেই স্বাধীন অধিকার? The right to have marriage legally dissolved by mubarat, talaq, khula and right to inherit property"। কিন্ত মুসলিম পার্সোনাল ল উত্তরাধিকার আইনে পুত্র সন্তানের অর্ধেক ভাগ কন্যা সন্তান পেয়ে থাকেন। ভারতবর্ষের বাইরের দেশগুলিতে আইনের পরিবর্তন এলেও ভারতবর্ষে ১৯২৫-এর ধারা অব্যাহত রয়েছে ।
শোনো বন্ধু শোনো জগতের ইতিকথা। আইন কাজে প্রয়োগ করার সদিচ্ছা প্রায় সময়েই নজরে পড়ে না। তারপর মামলার সাহায্যে আইন প্রয়োগ করতে কেটে যায় বহু সময়। তাই এই আইন সব জট খুলে দিল (দুনিয়ার কোন্ আইন তা পারে) এমন বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্ত এই পদক্ষেপ ভারতীয় মেয়েদের দায়িত্বশীল হতে শেখাবে। নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ভূমি তৈরি করবে। মেয়েরা জানবে তারা কেবল দুহিতা নয়, দায়িত্বের ভাগ নিতে হবে তাদের। হাতে বিবাহকালীন যৌতুক লাভ করা থেকে মনকে মুক্ত করে মুক্ত দৃষ্টির অধিকারী হতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সাহায্যে। অভিভাবকদেরও ভাবনার পরিসরে পরিবর্তন আনতে হবে। কন্যার বিবাহ দিতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খরচের ভার বাড়ানোর প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। রোকেয়ার কথা স্মরণ করি : "কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।" (স্ত্রী জাতির অবনতি)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প 'দিদি' (চৈত্র ১৩০১)। শশী অনেকদিন পর্যন্ত বাবা মার একটি সন্তান ছিল। স্বামীর সঙ্গে সুখী দাম্পত্য ছিল। সন্তানাদিসহ ষোলো বছর নিরঙ্কুশ জীবন কাটানোর পর তাল কাটল। শশীর একটি ভাই হল। জয়গোপাল এই নবজাতকের আগমনকে ভালো মনে নিল না। শশীকে সন্তানসহ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে চা বাগানে চাকরি করতে গেল।
বাবা মার স্নেহের ভাগীদারকে শশীও প্রথমে ভালো মনে নেয়নি। কিন্ত মা মারা যাবার পর অসহায় শিশুটি তাকে এতই অবলম্বন করল যে তাকে ভালো না বেসে শশী পারল না। নিজের ছেলেদের থেকেও বেশি যত্ন করত। ইতিমধ্যে বাবা মারা গেলেন। সম্পত্তির সিকি ভাগ শশীকে লিখে দিলেন। অর্থাৎ বারোআনা পাবে ওই শিশু। শশীর স্বামীর এ ভাগ পছন্দ হল না। সে বেনামে পুরোটাই হাত করতে চাইলো। শশী তখন সাহেবের কাছে উপস্থিত হয়ে ভাই নীলমণির সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করল। সে বুঝল জয়গোপাল এই বালকটিকে বাঁচতে দেবে না। সাহেবের হাতে ভাইয়ের দায়িত্ব অর্পণ করল। কিছুদিন পরেই শশী মারা গেল। বোঝা গেল স্বামী জয়গোপাল স্ত্রীকে বাঁচতে দিল না। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর সাহসের মূল্য তাকে দিতে হল ।
এই জয়গোপালরা কোনো দিন নিশ্চিহ্ন হবে না। তাই আইন রক্ষকদের সাহায্যের হাত বাড়ানোর প্রয়োজন। উইল করলে তবেই মেয়েদের পূর্বপুরুষের সম্পত্তির অধিকার আসত। উইল করা অভিভাবকদের ইচ্ছাধীন ছিল। সেখান থেকে অনেক পথ পার হয়ে আজ যে আইন ঘোষিত হল, তা নিশ্চিত মেয়েমানুষ থেকে মানুষ যাত্রার পথটি প্রশস্ত করল। তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে মেয়েদের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রটিকে উর্বর করে তোলার দায়িত্ব বেড়ে গেল ।
পুনঃপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২৭ আগস্ট ২০২০
ছবি : প্রতীকী
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
0 Comments
Post Comment