- 04 December, 2024
- 0 Comment(s)
- 61 view(s)
- লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
নিশুতি রাত। আকাশে এখনো চাঁদ দেখা দেয়নি। যে কয়েকটি তারা উঁকি মারছিল তারাও এখন ঘন একটা মেঘের চাদরের তলায় প্রবেশ করে মুখ লুকিয়েছে। উত্তর কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত একটা রাজপথ। সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি, দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমল সবকিছু এখন নিকষ কালো আঁধারে ডুবে আছে। চওড়া রাস্তাকে দুভাগ করে দিয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলি থেকে কেবল নীরবে সাদা আলো ঝরে পড়ছে। হঠাৎ একটি গাড়ি হুস শব্দ করে যেন প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। ঠিক তখনই দূরে কোথাও একটা রাত্রির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে কুকুর ডেকে উঠলো। কুকুরের ডাকটি মিলিয়ে যেতেই আবার সব নিঝুম। মনে হল যেন গোটা শহরটা নিঃশ্বাসবায়ু সংবরণ করে অভূতপূর্ব কিছু একটা ঘটিত হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এবার ওদের আসার সময় হয়েছে। নৈঃশব্দের বুক চিরে ক্রমে অতল থেকে উঠে এল একটি সমবেত নারীকন্ঠের আর্তনাদ। তারপর ধীরে ধীরে যেন মাটির তলা থেকে উঠে এল নারীর অবয়বধারী অসংখ্য ছায়ামূর্তি। আজ রাতে তারা একে একে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে। তাদের অনেকেরই হাতে জ্বলছে মশাল। হাজার হাজার ছায়ামূর্তির সেই মিছিল মুহূর্তের মধ্যে ভরিয়ে দিল কলকাতার পথঘাট। তাদের বহুযুগ সঞ্চিত হাহাকার আজকে সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা দৈত্যের হুংকারের রূপ নিয়েছে। তাদের বুকের আগুন মশাল হয়ে জ্বলে উঠেছে। সেই মশালের আগুনের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে নিদ্রিত শহরের আনাচে কানাচে। ছড়িয়ে পড়া সেই স্ফুলিঙ্গগুলি মোমবাতির দীপ্ত শিখাতে পরিণত হয়ে অন্ধকার অলিগলি থেকে বেরিয়ে এসে ভিড় বাড়াচ্ছে সেই ছায়ামূর্তিদের মিছিলে। মিছিলে অনেকেরই হাতে রয়েছে প্ল্যাকার্ড এবং তাতে লাল কালিতে লেখা আছে, ‘আর্জি নয় দাবি কর’। ছায়ামূর্তিগুলি পথে চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল। তাদের মধ্যে থেকে অনেকগুলি ছায়া বেরিয়ে এসে পলকের মধ্যে একে অপরের হাত ধরে রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তৈরি করে ফেললো এক বিশাল ছায়াবন্ধন। এবার তাদের মধ্যে থেকে অনেকে মিলে হাতে হাত ধরে রাস্তার মধ্যে একটা বড় বৃত্ত রচনা করে ফেললো। তারা উচ্চস্বরে গান গেয়ে এবং হাততালিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো। সেই বৃত্তের মধ্যে থেকে অনেকে আবার রঙ, তুলি নিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। পিচে বাঁধানো ধূলিধূসরিত তিলোত্তমার রাজপথই হয়ে উঠলো তাদের ক্যানভাস। এরপর সেই ছায়াদের বন্ধন ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো। রাতের অন্ধকার যত জমাট বাঁধতে থাকলো তাদের উত্তেজনা ততই বেড়ে চললো। আজ এই ছায়ামূর্তিদের পায়ের চাপে নিদ্রিত শহরের বুকেও কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য এনারা কেউই মৃত বা অস্তিত্বহীন কোনো বিভীষিকা নয়। তারা প্রত্যেকেই জ্বলজ্যান্ত এক একজন নারী। বিশাল এই মিছিলের মধ্যে সকল বয়সের নারীদের সমাবেশ ঘটেছে। এরা সকলেই কোনো না কোনো না সময়, কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, অবহেলিত। আজ তারা নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দিতে পায়ের তলা থেকে উঠে এসেছে মাটির ওপরে। এদের মধ্যে আমি আজ কেবল একজন নারীর কথাই সবিস্তারে বলবো। যাকে কেন্দ্র করে আমার এই গল্পের অবতারণা সবার আগে তার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া যাক। তার নাম ভূষণা। বর্তমানে সে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে। এখন শেষ রাত। সারাদিন কাজের পর বেলাশেষে নিশ্চিন্ত পাখির মত নীড়ে ফিরে যাওয়ার সুখ তার কপালে নেই। এখন সে একটা নরক থেকে পালিয়ে এসেছে। একটা পিশাচের কবল থেকে বাঁচার জন্য সে আজ এই মিছিলে যোগ দিয়েছে। তাই এখন এত রাতেও তার শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই। সে এতদিন ধরে ঠিক এমন একটা মিছিলই তো খুঁজে চলছিল। যে মিছিলে হেঁটে সে তার ওপর চলতে থাকা ধারাবাহিক অকথ্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রাণ খুলে গর্জে উঠতে পারে, বিচারের দাবি তুলতে পারে। অনেকদিন ধরে তার বুকের মধ্যে জমে থাকা সমস্ত রাগ, কান্না, অভিমান মিলেমিশে স্লোগান তুলে গর্জন করছে।
ভূষণার ইতিহাসটা এখানে পাঠককে একটু সংক্ষেপে জানানো প্রয়োজন। বছর দুই আগে ভূষণার বাবা অকস্মাৎ ব্রেন স্ট্রোকে দেহ রাখার পর ভূষণার মা অন্তরে ও বাইরে উভয় দিক থেকেই ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তখন তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে বড়ই নিরাপত্তার অভাব অনুভব করতেন। ভূষণার বোন তার চেয়ে বয়সে সাত বছরের ছোটো। মা তাই ভূষণাকে তড়িঘড়ি পাত্রস্থ করেন। ভূষণার এই বিয়েতে কোনো মত ছিল না। সে চাকুরিজীবি নিজের মত করে বাঁচার ক্ষমতা তার তৈরি হয়েছে। কিন্তু ভূষণা মাকে বিব্রত করতে চায়নি বলে এই বিয়েটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। সে ভেবেছিল পরিস্থিতি একবার অনুকূল হলেই এই অপ্রিয় সম্পর্কের ফাঁস গলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তা সবসময় সত্যি হয় না। ভূষণা বিয়ের দু’মাস পর থেকে ক্রমে বুঝতে পারে, যে ফাঁসটি তার গলায় চেপে বসেছে তা বড়ই যন্ত্রণাদায়ক। বিয়ের আগে মা খুব একটা বেশি খোঁজখবর না নিয়েই দক্ষিণ কলকাতা নিবাসী বেদ নামক এক সৎপাত্রের সঙ্গে ভূষণার বিবাহ দেন। বেদ একটা কর্পোরেট সংস্থায় চাকরি করে। মাইনে বেশ ভালই। বেদের বাড়িতে থাকেন তার মা, বাবা আর এক অবিবাহিত দিদি কালিন্দী। কালিন্দী ছিল বেদের থেকে বছর তিনেকের বড়। বিয়ে করে এই বাড়িতে প্রথম আসার পর ভূষণার মনে হয়েছিল এঁরা সকলেই বড় অমায়িক। তবে বেদকে তার কেমন ছন্নছাড়া বলেই মনে হয়েছিল। বেদ তার সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না, নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্যও কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে না। ভূষণা এই বাড়িতে নিজের জন্য একটা আলাদা শোবার ঘরের ব্যবস্থা করে নিয়েছে তবে এতে শ্বশুরবাড়ির কেউই কোনো আপত্তি তোলেনি। ভূষণা যতবারই বেদের সঙ্গে ডিভোর্সের ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছে ততবারই বেদ বিষয়টাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। বিয়ের দু’মাস কেটে যাওয়ার পর ভূষণা আবিষ্কার করে যে প্রতিরাত্রেই বেদ মদের নেশায় হালকা আচ্ছন্ন থাকে। ভূষণার এই ব্যাপারটা পছন্দ না হলেও সে বিশেষ আমল দিত না। সে মনে মনে ভাবতো আর তো মাত্র কয়েকটা দিন তারপরেই সে অন্যত্র চলে যাবে। ভূষণা এরই মধ্যে শহরতলিতে একটা ফ্ল্যাটের সন্ধান পেয়ে সেখানে নিজে পাকাপাকি ভাবে উঠে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে। ফ্ল্যাটটা কেনার জন্য সে প্রতিমাসে মাইনের থেকে একটা অংশ আলাদা করে সঞ্চয় করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই ক’দিনে আরও একটি ব্যাপার ভূষণার বিবাহিত জীবনে তার অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে তা হল কালিন্দীর সঙ্গে বেদের সম্পর্ক। প্রথম দিকে ভূষণা কিছু বুঝতে না পারলেও পরে বেদ ও কালিন্দীর পরস্পরের প্রতি চাহনি, স্পর্শ, হাবভাব সবকিছু ধীরে ধীরে ভূষণার মনে একটা সন্দেহের বীজ রোপন করে দেয়। শ্বশুর শাশুড়িকে এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে দেখে ভূষণাও বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলো। কিন্তু দিন যত এগোতে লাগলো ভূষণার এই সন্দেহ ততই গাঢ়তর হতে থাকলো। এর পাশাপাশি আরও একটি ব্যাপার বেশ কিছুদিন ধরে ভূষণাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সে এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকে লক্ষ করেছে যে এই পরিবারে তাকে কেন্দ্র করে কখনো কোনো ঝগড়া, অশান্তি, মনোমালিন্য কিংবা হুল্লোড় বা ভালোবাসা কিছুই নেই। এই এতটা অস্বাভাবিক শান্তি ভূষণার কাছে যথেষ্ট সন্দেহজনক বলে মনে হয়। এরা সকলেই তার সামনে নির্বিকার থাকতে চায়। ভূষণার বারবার মনে হচ্ছিল কোথাও কিছু একটা যেন ঠিক নেই। সবকিছুই কেমন খাপছাড়া। এমনটাতো হওয়ার কথা নয়। আজ পর্যন্ত ভূষণার কোনো ইচ্ছা বা অনুরোধে এরা আপত্তি করেনি। ভূষণা এদের মুখ দেখে মনের ভাব পড়ে ফেলতেও ব্যর্থ হয়েছে। তাই সে যতক্ষণ এই বাড়িতে নিঃশ্বাস ফেলতো ততক্ষণ তার প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয়কে সজাগ রাখতো। ক্রমে একটি বিষয় তার নজর এড়িয়ে যেতে পারলো না। তা হল বেদের সঙ্গে কালিন্দীর অসামাজিক যৌন সম্পর্ক। ভূষণা তার সন্দেহটাকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আরও বেশি করে ওদের ওপর নজর রাখতে আরম্ভ করলো। কিন্তু সন্দেহটা তার মন থেকে মুছে যাওয়ার বদলে আরও ঘনীভূত হয়ে বিশ্বাসে পরিণত হল। ভূষণা নিজের মনকে প্রশ্ন করলো, ‘বেদ কি তবে পারভার্ট?’ কিন্তু মন বারবার একই উত্তর দিতে থাকলো, হ্যাঁ, কারণ এই সম্পর্ক শুধুমাত্র দিদি ও ভাইয়ের স্নেহের সম্পর্ক নয় তার চেয়েও জটিল পারস্পরিক যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্তির সম্পর্ক। নিজের চোখকে কখনোই অবিশ্বাস করা যায় না। ভূষণা লক্ষ করেছে কালিন্দীর ঘরের উল্টোদিকে ছাদে ওঠার সিঁড়ির তলার অন্ধকারে যদি কেউ ঘাপটি মেরে বসে থাকে তবে তাকে কেউ দেখতে না পেলেও সে কালিন্দীর ঘরের ভেতরটা পুরোপুরি স্পষ্ট দেখতে পায়। ভূষণা গতরাত্রে সেই অন্ধকারে মিশে কালিন্দীর ঘরের বন্ধ দরজার পাশে একটি আধখোলা জানলা আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকা পাতলা পর্দায় ঘরের ভিতরকার হালকা নীল আলোর পটে বেদ ও কালিন্দীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছায়া প্রত্যক্ষ করেছে। বেদের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও অস্বস্তিতে ভূষণার মন বিষিয়ে ওঠে। তার এখন এই বাড়িতে থাকতে আর একটুও ইচ্ছা করেনা। এখন তার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। তার শ্বশুর শাশুড়ি এই সমস্ত ব্যাপারটা জেনে বুঝেই অমন নির্বিকার থাকেন।
ভূষণার ব্যবহারে কয়েকদিন ধরে যে রুক্ষতা ঝরে পড়ছে তা বেদ এবং তার পরিবারের প্রত্যেকেই অনুভব করেছিল। একদিন বেদ রাতের খাওয়া শেষ করেই ভূষণার ঘরে ঢুকে তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলো। ভূষণা এর কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ভূষণাকে নিরুত্তর দেখে প্রথমে বেদের ভীষণ রাগ হল। তার কপালের দুই প্রান্তের শিরা দুটো দপ করে ফুলে উঠলো। তারপর সে আবার নিজেকে শান্ত করে একটা অস্বস্তিকর ঘিনঘিনে হাসি হেসে বললো, ‘ওহ, তার মানে তুমি আমার আর দিদির ব্যাপারটা সব জেনে গেছো?’ ভূষণা আবারও কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু ভূষণা তখনো পর্যন্ত জানতো না যে সেদিন সেই মুহূর্ত থেকেই তার চরম দুর্ভাগ্যের সূচনা ঘটতে চলেছে। ভূষণার নীরবতা এবার বেদের ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটালো। প্রবল আক্রোশে প্রথমে সে শব্দ করে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। ভূষণা চকিতে বিছানার ওপর উঠে বসেছিল। বেদ এরপর নিজের পাজামার দড়ি ঢিলা করতে করতে বললো, ‘আজ তুমি চরম শাস্তি পাবে।’ এই বলে ভূষণাকে আক্রমণ প্রতিহত করার কোনো সুযোগ না দিয়ে বেদ তার ওপর ক্ষিপ্র বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো। তারপর তাদের পরিবারের লজ্জাজনক গোপন রহস্য জেনে ফেলার অপরাধে বেদ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ভূষণার নাইট স্যুট ছিঁড়ে যা করলো তাকে এককথায় ধর্ষণ বলে।
সেই রাতের ঘটনার পর দুটো দিন আর কিচ্ছু হয়নি। ঐ দু’দিন ভূষণা ঘরের বাইরে বেরোতে পারেনি। ঘরের একটা কোণায় পড়ে থেকে সে কেবল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। তারপর একসময় চোখ থেকে সব জল ঝরে গিয়ে তা কেবল একটা শুকনো খালে পরিণত হয়েছে। ভূষণা প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নেওয়ার পর তার মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন প্রবল হয়ে জ্বলে উঠলো। সে সাহায্যের আশায় মাকে ফোন করে তার ওপর হওয়া এই অনাচারের বিস্তৃত বিবরণ জানালো। সব শুনে মা বললেন, ‘দেখ, এসব তোদের মধ্যেকার ব্যাপার তোরাই সামলে নে। আমাকে আর এসবের মধ্যে জড়াস না, সেটা ঠিক নয়।’ ভূষণার মনটা একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেল। নিজেকে তার বড় অসহায় মনে হল। কিন্তু চোখ ফেটে আর জল বেরোলো না চোখটা জ্বালা করে উঠলো কেবল। দুদিন পর কাজে যাওয়ার জন্য আবার রাস্তায় বেরোলো। সে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা আলোর দিশা দেখতে পেয়েছে। তার মনে পড়লো এইসময় হয়তো তার কষ্টটা কেবলমাত্র দুজন বুঝতে পারবে- শর্মিষ্ঠা আর অজয়। তারা ভূষণার স্কুলের বন্ধু ছিল। ওরা দুজনেই খুব হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল আর নির্ভরযোগ্য বন্ধু। ভূষণা সুখে দুঃখে মনের সব কথা চিরকাল ওদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। এই একবছর আগে ওরা একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে। ভূষণা ব্যাঙ্কে যাওয়ার পথে একটা নির্মীয়মান বহুতলের নীচে নিরিবিলি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ওদের ফোন করে পুরো ব্যাপারটা জানালো। ওরা সবটা গম্ভীর ভাবে শোনার পর ভূষণাকে অবাক করে দিয়ে শর্মিষ্ঠা হো হো করে হেসে উঠে বললো, ‘আরে এতে এত দুঃখ পাওয়ার কী আছে? তোর বর তোকে ভালোবাসছে, এতো আনন্দের কথা। এসব কথা আবার ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সবাইকে বলে বেড়ায় নাকি কেউ? ধুর।’ ভূষণা ফোন কেটে দিয়েছিল। সে বুঝতে পারে না কেউ কেন তার কথা বুঝতে চাইছে না? এখন সে কার কাছে যাবে? সবার কথা শুনে তার নিজেকে পাগল মনে হচ্ছিল। অথচ সারাদিন সারারাত একই দুঃস্বপ্ন তার মাথার মধ্যে অনবরত পাক খাচ্ছে। ভূষণা এখন আর কোনো কাজে মন বসাতে পারেনা। এখানেই শেষ নয় সেই রাতের পর বেদ তাকে আরও বেশ কয়েকবার ধর্ষণ করেছে। বারবার ভূষণার উষ্ণ, কোমল, নগ্ন শরীরটা একটা পিশাচের থাবার তলায় চাপা পড়ে ছটফট করে উঠেছে। এখন ভূষণার কাছে কিছুই আর আগের মত স্বাভাবিক নেই। তার সমস্ত প্রিয় মানুষগুলোর মুখ যেন হঠাৎই বদলে গেছে। গোটা সমাজটা তার কাছে যেন মোটা কাঁচের দেওয়ালে তৈরি একটা কারাগার। ঐ কাঁচের দেওয়ালগুলিতে তার বদ্ধ আত্মা বারংবার ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছে। ভূষণার নিজেকে শুধুমাত্র একটা চলন্ত শব বলে মনে হয়। প্রতিদিন সে আগের মতই সকালে কাজে বেরোয় কিন্তু আগের মত সে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসার তাগিদ অনুভব করে না। ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার সময় প্রায়ই সে বাগবাজারে গঙ্গার ঘাটে অন্ধকারের মধ্যে সিঁড়ির ওপর অনেকক্ষণ চুপচাপ একা বসে থাকে। গঙ্গার সান্ধ্য শীতল হাওয়ায় সে মরণাপন্ন মানুষের মত হা করে বুক ভরে শ্বাস নিতে চায়। ভূষণার অন্তরটা এক নারকীয় যন্ত্রণায় আকপাক করে ওঠে। শান্ত গঙ্গা বক্ষের ওপর ঝুঁকে পড়া ঘন কালো মেঘের মধ্যে তার মৌন হাহাকার বিলীন হয়ে যায় কিন্তু কিছুই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে না। এ কেমন পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছে ভূষণা? তার পীড়াকে সে সকলের কাছে যে ভাষায় প্রকাশ করতে চাইছে সেই ভাষা কারোরই বোধগম্য হয়নি। আসলে মেয়েদের এই যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করার মত কোনো ভাষা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি। এই কারণেই হয়তো ভারতীয় সংবিধানের দন্ডবিধিতেও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বলে কোনো অপরাধের উল্লেখ নেই। আজ ভূষণার জন্য কোথাও আশ্রয় নেই। এমন কোনো অস্ত্র সে খুঁজে পায়নি যা দিয়ে এই নারীমাংসলোভী পিশাচটাকে আঘাত করতে পারে। গঙ্গার ঘাটে সন্ধ্যের ভিড়টা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ভূষণার মনে হচ্ছে তার চারপাশের এই জমাট বাঁধা অন্ধকার তাকে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে দেবে না। এই অন্ধকার তার সমস্ত অস্তিত্ব ও চেতনাকে গ্রাস করে ফেলতে চায়। ভূষণা ফোনে সময় দেখলো রাত নটা বাজে। ভূষণা দেখলো চারপাশটা বেশ নির্জন। এখন সে যদি গঙ্গায় ঝাঁপ দেয় তাহলে প্রথমে কেউ হয়তো খেয়াল করতে পারবে না। ভূষণা সাঁতার জানেনা। যতক্ষণে লোকজন হৈ হৈ করে তাকে উদ্ধার করতে আসবে ততক্ষণে সে তলিয়ে গিয়ে মরে যেতে পারবে না? এমন সময় ভূষণা খেয়াল করলো ফোনে ফেসবুক থেকে পর পর অনেকগুলো নোটিফিকেশন ঢুকছে। সে দেখলো ফেসবুক আর হোয়াটসআপ ভরে উঠেছে একটা লাল রঙের পোস্টারে। তাতে রয়েছে মেয়েদের রাত দখলের ডাক। ভূষণার চোখদুটো অন্ধকারের মধ্যেও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কি মজা! আজ রাতে পিশাচটা আর তাকে ধরতে পারবে না। আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে সে ছুট লাগালো কলেজস্ট্রিটের উদ্দেশ্যে।
সেই থেকেই শুরু হল ভূষণার নিরন্তর পথ চলা। ভূষণা এখন সারাদিন ধরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে চোখ রাখে। কোথায় কখন মেয়েরা রাত দখলে পথে নামছে তা জেনে রাখে। তারপর দিনের আলো নিভে গেলে, ব্যাঙ্কের কাজ শেষ হলেই সোজা ছুটে চলে যায় মিছিলে যোগ দিতে। সেই মিছিল যেখানেই হোক, যতদূরেই হোক। ভূষণা চায় রোজ রোজ এমন মিছিল বেরোক, যতদিন না পর্যন্ত এই দ্রোহের আগুনে সমস্ত নারীমাংসলোলুপ পিশাচগুলো জ্বলে পুড়ে ছারখার না হয়ে যায়। এখন ভূষণা প্রত্যেকদিন রাতভোর জুড়ে তার মত আরও অনেকের সঙ্গে পথে হেঁটে রাতের শহরকে শাসন করে বেড়ায় আর নিজের বুকের আগুন ছড়িয়ে দেয় শহরের প্রতিটি কোণে। ভূষণা আবার হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, আই ওয়ান্ট জাস্টিস।’
লেখক : শিক্ষার্থী, গল্পকার
ছবি সৌজন্য ইন্টারনেট : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment