সন্দেহ

  • 26 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 40 view(s)
  • লিখেছেন : শতরূপা সিংহ
এখন তার নিজেকে বেশ হালকা মনে হল। হোমশিখা আবার বললো, ‘তোমার ওপর এখন আর আমার কোনো রাগ নেই।’ সিদ্ধার্থের ছলছল করে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল কালো মেঘ সরে গিয়ে শরতের নির্মল আকাশের প্রতিবিম্ব যেন ঐ চোখে পড়েছে। হোমশিখার মন আনন্দে নেচে উঠলো, এক বিরাট প্রাপ্তির আনন্দে।

নিউজ এনিটাইম খবরের চ্যানেলের অফিসে তেতলার একটা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে হোমশিখা বেরিয়ে এসেই দেখলো তার ঘরের দরজার সামনে সহকর্মীদের একটি ছোটোখাটো রকমের ভিড় জমে রয়েছে। বাতানুকূল যন্ত্রের সংস্পর্শ থেকে সদ্য বেরিয়ে আসার পরেও হোমশিখার প্রশস্ত কপালে, নাকের দুপাশে এবং গাঢ় গোলাপি রঞ্জকে রঞ্জিত পাতলা ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। সংশয়পূর্ণ দৃষ্টি মেলে হোমশিখা একবার তার প্রায় সমবয়স্ক সহকর্মীদের মুখের দিকে চাইলো তারপরেই তাদের ফেটে পড়া উল্লাস দেখে হোমশিখার মনটা আত্মতুষ্টিতে ভরে উঠলো। সে ছোটো একটা নিঃশ্বাস ফেলে সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বললো, ‘কি নিউজটা কেমন কভার করলাম?’ রণিতা কাছে সরে এসে হোমশিখার ডান হাতটা নিজের দুটো হাতের তালুর মধ্যে চেপে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, ‘কনগ্র্যাচুলেশনস, দুর্দান্ত হয়েছে। কিন্তু তোর হাত যে একেবারে বরফের মত ঠান্ডা।’ হোমশিখা নিজের হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো, ‘ও কিছু না, একটু টেনশনে ছিলাম তাই।’ অমিত বললো, ‘সত্যিই তোর মত এত সুন্দর নিজের ফিলিংসকে কাজে লাগিয়ে নিউজ কভারেজ কেউ করতে পারেনা। দেখবি বস ঠিক খুশি হবেন।’ নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জানার পর হোমশিখার মধ্যে অহংকারের সঞ্চার হল। মানুষের অন্তত একটা বিষয়ে অহংকার থাকা খুব প্রয়োজন না হলে গোটা জীবনটাই অর্থহীন। সাংবাদিকের এই পেশাটাই হোমশিখার একমাত্র অহংকারের কারণ। তার কভার করা নিউজ শোনার জন্য লাখে লাখে মানুষ টিভির সামনে অপেক্ষা করে বসে থাকে। আর সত্যি কথা বলতে কি ওদের খবরের চ্যানেলের দর্শক সংখ্যা প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার মূল কারণ হল সাংবাদিক হোমশিখা দে। কিন্তু মানুষের প্রশংসা প্রাপ্তির পথ কোনোদিনের জন্যই নিষ্কন্টক নয়। হোমশিখার এই ধারাবাহিক উন্নতিও তার সহকর্মীদের মধ্যে অনেকের কাছেই কাম্য নয়। অমিতের কথাটা শেষ হতেই জানকী বললো, ‘অ্যাকচুয়ালি খবরটাই ভীষণ সেনসিটিভ ছিল, তাই ওকে আর নিজের থেকে বিশেষ কিছু রঙ চড়াতে লাগেনি।’ হোমশিখা জানকীর বক্তব্য যেন শুনেও শুনলো না। সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত তখন পৌনে দুটো। সঙ্গে সঙ্গে হোমশিখার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে দেখলো তার সহকর্মীরা তাকে নিয়ে এমন ভাবে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে যে তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচতে পারলেই যেন ওদের এই উল্লাসের একটা সুখদায়ক পরিসমাপ্তি সম্ভব হয়। হোমশিখার খুব ইচ্ছা করছিল ওদের এই উল্লাসটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগ করতে কিন্তু তার পক্ষে তা এই মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। হোমশিখা নিজের বাসনার টুঁটি চেপে ধরে বললো, ‘কত রাত হয়েছে দেখেছিস, আমাকে তো বাড়ি ফিরতে হবে নাকি? সুরেন্দ্র, তুই বাকি নিউজগুলো কভার কর। আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করতে পারবো না। কাল আবার সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, ওকে।’ কথাগুলো বলতে বলতে হোমশিখা লিফটের দিকে দৌড়ে গেল। অমিতও হোমশিখার সঙ্গেই লিফটে উঠে পড়লো। লিফটে চেপে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামতে নামতে অমিত হোমশিখাকে বললো, ‘ এত রাতে তুই কোনো গাড়ি পাবি নাকি? তার চেয়ে বরং চল আমি তোকে ড্রাইভ করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসছি।’ হোমশিখা আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘আরে, আজকের রাতটাতো অন্যরকম। এত মেয়েরা রাস্তায় মিছিল করে বেরিয়েছে কোনো না কোনো ট্যাক্সি বা ক্যাব ঠিক পেয়ে যাবো।’ হোমশিখা মেইন রোডে উঠে দেখলো রাস্তায় এদিকে ওদিকে অনেক মহিলা পুরুষের সমাগম হয়েছে। অন্যদিন রাত দশটা বাজলেই একদম শুনশান হয়ে যাওয়া এই রাস্তাটা দিয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরতে হোমশিখার গা ছমছম করে। কিন্তু আজকের রাতের চেহারা একদম আলাদা। আজ আর কোনো ভয় নেই। দূরে ভেসে যাওয়া কলরব শুনে হোমশিখা বুঝলো কিছুক্ষণ আগেই এখান দিয়ে যে মিছিলটা যাচ্ছিল সেটা দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা এই নরনারীবৃন্দও ঐ মিছিলের অঙ্গ হিসাবেই হয়তো এসেছিল কিন্তু তারা আর এগোবে না বলে মিছিল চ্যুত হয়ে এখানেই থিতু হয়েছে। সদ্য মিছিলের হুংকারে কেঁপে ওঠা নৈশ পরিবেশ আবার ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। কেবল অল্পবয়সী কয়েকটি ছেলেমেয়ের গুঞ্জন ছাড়া বাকি সমস্তই নিস্তব্ধ। হোমশিখা ফোনের অ্যাপসে ক্যাবের সন্ধান করেও ব্যর্থ হল। পিছন ফিরে অমিতের গাড়িটাকে এগিয়ে আসতে দেখে সে কিছুক্ষণ সেইদিকে নীরব আবেদনের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। অমিত হোমশিখার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একটু থেমে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে বললো, ‘বলেছিলাম না কোনো গাড়ি পাবি না। সে তোর যতই মিছিল মিটিং থাক না কেন।’ হোমশিখা আরও একবার নিমরাজি হওয়ার ভান করলেও শেষে অমিতের পীড়াপীড়িতে গাড়িতে উঠে পড়লো। অবশ্য হোমশিখা এটাই চাইছিলো যেন অমিত ওকে আর একবার অন্তত লিফট দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করুক। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হোমশিখা অনেকগুলি মিছিল ও জমায়েত প্রত্যক্ষ করলো। আজ রাতে বোধহয় কেউ আর বাড়িতে নেই, সকলেই রাস্তায় নেমে এসে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে, শঙ্খনাদ তুলে উচ্চস্বরে রাতের নীরবতাকে খন্ড বিখন্ড করছে। ভিড় এড়িয়ে বড় রাস্তা ছেড়ে গলিপথ ধরে অমিত হোমশিখাকে যতটা সম্ভব শীঘ্র বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করলো। অমিতই প্রথম মৌনতা ভেঙে কথা বললো, ‘একটা কথা বলবো? আজকাল দেখি নাইট শিফটের কথা শুনলেই তোর মুখ শুকিয়ে যায়, বসের কাছে এই নিয়ে অনেকবার বকাও খেয়েছিস। কিছুদিন আগে তোর এরকম কোনো বাতিক তো ছিল না। ব্যাপার কী, তোর বর মানে সিদ্ধার্থ কি তোকে সন্দেহ করে?’ গাড়ির মধ্যে অন্ধকারে অমিত হোমশিখার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল না। দেখলে বুঝতে পারতো এতক্ষণে সে মোক্ষম প্রশ্নটা করেছে। এই প্রশ্নটা ছুঁড়েই সে যেন এক মুহূর্তে সমস্ত গোপনীয়তার পর্দা সরিয়ে হোমশিখার অন্তরের ক্ষতটাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে চোখের সামনে মেলে ধরেছে। হোমশিখা সামান্য হেসে বললো, ‘না না, তেমন কিছু নয়।’ কিন্তু সে জানে অমিতের এই প্রশ্নটাই বর্তমানে তার জীবনের সকল সুখ হরণ করে নিয়েছে এবং তার কাছে চরম লজ্জার ও অপমানের বিষয় হয়ে উঠেছে। অমিত বলেছিল বটে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে কিন্তু রাস্তার পরিস্থিতি খুব খারাপ থাকার কারনে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়ে গেল। হোমশিখা তার বাড়ির গলির সামনে নেমে দেখলো তখন রাত তিনটে বেজে গেছে। গলির মুখেই একটা ল্যাম্পপোস্ট নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে কানা হয়ে গেছে বহুকাল আগে। হোমশিখা অমিতকে বিদায় জানিয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বেলে সেই সরু অপরিষ্কার কানা গলিতে সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে চললো। আজকের রাত্রে কল্লোলিনী কলকাতা নারীকন্ঠের কলরবে মুখরিত। যেন সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে নারীর হৃদয়ে সঞ্চিত হতে থাকা ক্ষোভ আগ্নেয়গিরির মুখ ফেটে বেরিয়ে আসা লাভার মত এক অভিশাপ হয়ে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। হোমশিখা অনুভব করলো তার হৃৎপিন্ডের স্পন্দনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই কলরব এখনও ধ্বনিত হচ্ছে, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ সে দেখলো আজকে এই মধ্যরাতেও তার পাড়া একেবারে নিঝুম নয়। কয়েকটা বাড়ির জানলার ফাঁক গলে আলো এসে গলিতে আছাড় খেয়ে পড়েছে। সেই বাড়িগুলি থেকে টিভিতে চলা খবরের বেশ জোরালো আওয়াজ ভেসে আসছে। হোমশিখার খুব ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিলো এতদিনে সত্যিই নারী শক্তির জাগরণ ঘটেছে তাই আজ আর কারো চোখে ঘুম নেই। আজ মেয়েদের রাত্রি শাসনের পালা। 

অত্যন্ত সাবধানে যতটা সম্ভব কম শব্দ করে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তালা খুলে হোমশিখা নিজের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। খুট করে ডাইনিং রুমের আলোটা জ্বেলে সন্তর্পনে সে হাত মুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পরিবর্তন করে খেতে বসে গেল। খেতে খেতে হোমশিখা বারংবার শোবার ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। ম্লান একটা নীল আলোর আভা ঘরের ভেতর থেকে দেখা যচ্ছে প্রতিদিনের মত নিশ্চিত কিছু অপ্রিয় কথা শুনতে পাওয়ার কল্পনায় তার কান টনটন করে উঠলো। আজ চারদিন ধরে তার নাইট ডিউটিকে কেন্দ্র করে সিদ্ধার্থের সঙ্গে হোমশিখার ঝামেলা চলছে। বিয়ের পর একবছর কেটে যাওয়ার পরেও এতদিন এই নিয়ে সিদ্ধার্থ কোনো আপত্তি করেনি কিন্তু হঠাৎ যে কেন সে বেঁকে বসেছে তা হোমশিখা বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু তার অত্যন্ত প্রিয় এই চাকরিটা টিঁকিয়ে রাখতে গেলে তাকে নাইট ডিউটি করতেই হবে। সিদ্ধার্থ ওকে সন্দেহ করছে এটা হজম করতে পারেনা হোমশিখা। বিয়ের আগেও সে নিজের মা বাবার থেকে বেশি সিদ্ধার্থকে বিশ্বাস করেছিল। সে ভাবে সিদ্ধার্থ হয়তো মনে করছে যে মাঝরাতে হোমশিখা বাড়ি ফেরার জন্য কোনো গাড়ি না পাওয়ার অজুহাতে অনায়াসে অন্য পুরুষের গাড়িতে চড়ে। সিদ্ধার্থের প্রতি ঘৃণায় ওর সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। রাত্রে ঘরের বাইরে থাকলে খুব অনায়াসে কোনো মেয়ের স্বভাব চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করাটাই এই সমাজের রীতি। এই কথাটাই যেন সিদ্ধার্থ হোমশিখাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছে। খাওয়া শেষ হওয়ার পরেও সিদ্ধার্থ ঝগড়া করতে এল না দেখে হোমশিখা ভাবলো আজকে সিদ্ধার্থ হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। হোমশিখা শোবার ঘরে পা দিতেই সিদ্ধার্থ বিছানার ওপর উসখুস করে উঠে বসলো। হোমশিখা জিজ্ঞেস করলো, ‘তুমি ঘুমাওনি?’ ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখ তুলে সিদ্ধার্থ বললো, ‘আমার রাতের ঘুম তুমি অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছ। কার সঙ্গে ছিলে আজকে?’ সিদ্ধার্থ কখনো চিৎকার বা চেঁচামেচি করে না কিংবা অপশব্দ প্রয়োগ করে না কিন্তু তার সেই অতি নিরীহ কথাগুলোই তীরের ফলার মত ছুটে এসে হোমশিখাকে বিদ্ধ করে। সিদ্ধার্থের কথাগুলো শুনে হোমশিখার কানদুটো লাল হয়ে উঠলো। সে সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘অমিতের সঙ্গে’। সিদ্ধার্থ ‘ও’ বলে পাশ ফিরে আবার শুয়ে পড়লো।

পরের দিন সকালে হোমশিখার ঘুম ভাঙতে বেশ দেরি হল। ঘুম থেকে জেগে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো ক্লান্তি তার সারা শরীরে ছাপ রেখে গেছে। গতরাত্রে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ার ফলে তার চোখের তলা ফুলে উঠেছে। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা না করে সিদ্ধার্থের সঙ্গে সেও তাড়াতাড়ি অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। হোমশিখা মুখের ওপর থেকে যন্ত্রণার সব চিহ্ন ঢেকে ফেলার জন্য ভালো ভাবে মেকআপ করে নিল। অন্যদিকে রাস্তায় নেমে সারা শরীরে সকালের নতুন সূর্যালোক মেখে সিদ্ধার্থের মন থেকেও গতরাত্রের সমস্ত ক্লান্তি একেবারে মুছে গেল। সে অফিসে ঢুকেই দেখলো তার সহকর্মীরা ইতিমধ্যেই গতকালের মেয়েদের রাত দখলের আন্দোলন নিয়ে বেশ জোরালো আলোচনা সভা বসিয়ে দিয়েছে। সিদ্ধার্থ নিজের চেয়ারে বসে ওদের গল্প শুনছিল। শুনতে শুনতে সে ভাবলো এতদিনে এদের আড্ডা জমানোর মত বেশ একটা মুখরোচক ব্যাপার ঘটেছে। সিদ্ধার্থ জানে এরা সবাই অফিসে এসে মেয়েদের অধিকার নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবে, নারীবাদী বিভিন্ন জ্বালাময়ী বক্তৃতায় সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে তুলবে এমনকি পাড়া প্রতিবেশীদের দেখিয়ে মিছিলেও স্লোগান তুলে হাঁটবে কিন্তু অন্যদিকে বাড়ি ফিরে স্বচ্ছন্দে নিজের স্ত্রীর ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনা করবে এবং ভিড় বাসে বা ট্রেনে উঠে কোনো কলেজ পড়ুয়া মেয়ের বুকে কনুই দিয়ে গুঁতো মারবে কিংবা কোমরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করবে। সিদ্ধার্থের এদের ওপর ঘৃণা ধরে গেছে। সে ওদের থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে ভাবনার মধ্যে ডুবিয়ে দিল। গুপ্ত শত্রুর মত একটা সন্দেহ কোথা থেকে তার মনে প্রবেশ করে হোমশিখার প্রতি তার ভালোবাসার গাঢ় রঙকে ফিকে করে দিয়েছে। পাঁচদিন আগে পাশের ফ্ল্যাটের সুদর্শনাদি সিদ্ধার্থকে অফিস থেকে ফেরার সময় ডেকে বলেছিলো, ‘কী ব্যাপার ভাই সিদ্ধার্থ, তোমার বউকে দেখি প্রতিদিন এত রাত করে বাড়ি ফেরে?’ সিদ্ধার্থ হেসে জবাব দিয়েছিলো, ‘আসলে খবরের চ্যানেলে কাজ করে কিনা, কখন কি ডিউটি পড়ে যায় তার ঠিক নেই।’ সুদর্শনাদি মুখ বিকৃত করে বলেছিলো, ‘তাই না আর অন্য কিছু?’ সিদ্ধার্থ ভুরু কুঁচকে প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিলো, ‘মানে?’ সুদর্শনাদি রহস্যময় হাসি হেসে ঘাড় কাত করে বলেছিলো, ‘উত্তেজিত হয়ো না ভাই। আজকালকার মেয়েদের কি আর চোখ বুঁজে বিশ্বাস করা যায়? তাছাড়া আমি একা নই তিনতলার ফ্ল্যাটের সমরেশ কাকুও ঐ একই কথা বলছিলেন। সেদিন বিকেলে ছাদে শুকনো কাপড় তুলতে গিয়ে সমরেশ কাকুর সঙ্গে দেখা হল। তিনি বললেন একদিন মাঝরাতে বাথরুমে যাবার জন্য উঠে ঘুম চোখে জানলা দিয়ে দেখেন একটা অচেনা ছেলের গাড়ি থেকে তোমার বউ হাসতে হাসতে গলির মুখে নামছে। কাকুও বলছিলেন আর এখন আমিও বলছি ভাই বউকে একটু চোখে চোখে রেখো, কেমন?’ সিদ্ধার্থের তখন এইসব কথা শুনে কান মাথা গরম হয়ে উঠেছিল। ঘরে ফিরে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার খুলে সে অনেক্ষণ তার নিচে মাথা পেতে দাঁড়িয়ে রইলো কিন্তু শীতল জলের স্পর্শও তার অন্তরের জ্বালাকে ঠান্ডা করতে পারলো না। সেদিনকেও হোমশিখা সিদ্ধার্থের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়ে রাত দুটোয় বাড়ি ফিরেছিলো। সিদ্ধার্থ নিজের মন থেকে সন্দেহটাকে দূর করে স্বাভাবিক হতে অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হতে পারেনি। হোমশিখাকে দেখলেই সেই সন্দেহ যেন মনের মধ্যে বারবার ঘুমন্ত দৈত্যের মত আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে এবং হোমশিখাকে আঘাত করতে না পারা পর্যন্ত সে শান্ত হতে পারেনা। সিদ্ধার্থের এখন মনে হচ্ছে এই সহকর্মীদের সঙ্গে তার নিজের কোনো পার্থক্য নেই। মনে মনে সে নিজেকে ধিক্কার জানালো। সেদিন আর তার কাজে মন বসলো না। ছুটি হওয়ার আগেই সে অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে আসার জন্য বেরিয়ে পড়লো। ফেরার পথে সে বাসে বসে একটা বড় মিছিলের সম্মুখীন হল। সিদ্ধার্থের মনে হল এই বিপ্লবের আগুনের আঁচ যেন তার অন্তরাত্মাকে পর্যন্ত শুদ্ধ করে দিচ্ছে।

ফ্ল্যাটের দরজার তালা খোলা দেখে সিদ্ধার্থ বুঝতে পারলো যে হোমশিখা তার আগেই বাড়ি ফিরেছে। ঘরে প্রবেশ করে সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে সে কথা জিজ্ঞেস করতে হোমশিখা ভাবলেশহীন মুখে বললো, ‘কাজে জবাব দিয়ে দেব ভাবছি।’ কথাটা বলে হোমশিখা রান্নাঘরে গিয়ে বাসন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ সিদ্ধার্থের মুখ দিয়ে কোনো কথা সরলো না। তারপর আস্তে আস্তে সে বললো, ‘আই অ্যাম সরি, আমি আমার ভুলের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। প্লিজ তুমি জবটা ছেড়ে দিও না। আমি জানি এই কাজটাকে তুমি কতটা ভালোবাসো।’ হোমশিখা চোখে অবিশ্বাস নিয়ে একবার সিদ্ধার্থের দিকে চাইলো তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে নিল। হোমশিখাকে নিরুত্তর দেখে সিদ্ধার্থ আবার বললো, ‘তোমার সুখ্যাতি এখন লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। আমার কলিগরাও যখন তোমার কথা আলোচনা করছিল তখন আমার বুকটা গর্বে ফুলে উঠেছিল। এখন তুমি অনেক মেয়ের অনুপ্রেরণা। আচ্ছা, তুমি বল এই লড়াইটা কি তোমারও নয়, আন্দোলনের এই চরম মুহূর্তে তোমার কি সেখান থেকে সরে আসা উচিৎ?’ হোমশিখা এবার সিদ্ধার্থের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ এই লড়াইটা আমারও। আমি জানি, রাত করে বাড়ি ফিরি বলে শুধু তুমি কেন গোটা পাড়া, গোটা শহর, গোটা রাজ্য, গোটা দেশের লোক আমাকে সন্দেহ করে। আর এই প্রকারের সন্দেহ সচরাচর পুরুষদের প্রতি জন্মায় না। এই কারনে রাতের রাস্তায় কোনো মেয়েকে তার নিজের দায়িত্বে বেরোতে হয়। তখন তার সঙ্গে কোনো অপরাধ হলে সমাজ খুব সহজে তার দায় এড়িয়ে যেতে চায়। যুগ বদলালেও এই আদিম সংস্কারের কোনো বদল নেই।’ হোমশিখা বুঝতে পারলো যে এখন সে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। তার কপাল থেকে ঘামের বিন্দু গাল বেয়ে গড়িয়ে এসে থুতনির নিচে জমা হয়েছে। এখন তার নিজেকে বেশ হালকা মনে হল। হোমশিখা আবার বললো, ‘তোমার ওপর এখন আর আমার কোনো রাগ নেই।’ সিদ্ধার্থের ছলছল করে ওঠা চোখের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল কালো মেঘ সরে গিয়ে শরতের নির্মল আকাশের প্রতিবিম্ব যেন ঐ চোখে পড়েছে। হোমশিখার মন আনন্দে নেচে উঠলো, এক বিরাট প্রাপ্তির আনন্দে।

লেখিকা : গল্পকার, শিক্ষার্থী। 

ছবি : সংগৃহীত। 

0 Comments

Post Comment