- 28 July, 2021
- 0 Comment(s)
- 932 view(s)
- লিখেছেন : অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
বাংলা সিরিয়ালের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীর একটি পোস্ট ফেসবুকে চোখে পড়ল। অভিনেত্রী তার কয়েক মাসের শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে ছবি দিয়েছেন। লিখেছেন, তিনি গর্বিত যে তার সন্তানকে তিনি নিজের হাতেই মানুষ করছেন। কোনও আয়া নিয়োগ করেননি। হ্যাঁ, অতিমারী একটা কারণ ঠিকই কিন্তু শিশুর জন্মের আগে থেকেই তিনি আর তার স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা কোনও আয়া নিয়োগ করবেন না শিশুর দেখাশোনার জন্য। তিনি নিজেও আপাতত কাজে ফিরবেন না। সন্তানের প্রতিপালন তার কাছে অন্য সবকিছুর থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অভিনেত্রীর স্বামী একজন ব্যস্ত অভিনেতা। ধরে নেওয়া যায়, ইচ্ছে থাকলেও তিনি তার সন্তানকে বেশি সময় দিতে পারেন না। তাদের বাড়িতে শাশুড়ী বা মা বা অন্য কোন আত্মীয়-পরিজন থাকেন কি না অভিনেত্রী সেকথা অবশ্য উল্লেখ করেননি। সম্ভবত সম্পূর্ণ একা হাতেই তিনি তার সন্তানকে প্রতিপালন করছেন।
অভিনেত্রীর এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন একজন লিখেছে যে সন্তানদের নিজের হাতে মানুষ করার চিরাচরিত প্রথাকে যে সব মেয়েরা আজকের দিনেও মান্যতা দেয় তাদের সে পছন্দ করে। ঈশ্বর নারীকে মাতৃত্বের ক্ষমতা দিয়েছেন এবং একজন মা’কে মায়ের মতোই আচরণ করা উচিত। তাকে কখনোই ক্রেশে রেখে বা আয়ার হাতে তুলে দিয়ে ঈশ্বরপ্রদত্ত এই দায়িত্বের অবহেলা করা উচিত নয়। তার নিজের মেয়ের এখন নয় বছর বয়স। সে গর্বিত যে এই বয়স পর্যন্ত তার মেয়ে কখনো মা ছাড়া আর অন্য কারুর হাতের রান্না খায়নি। আরেকজন লিখেছে, সে মা হবার আগে পর্যন্ত করপরেট সেক্টরে উচ্চপদে চাকরি করত কিন্তু সন্তানের জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এবং তার কোনও আফশোষ নেই। বর্তমানে অতিমারীর পরিস্থিতিতে অনেকেই বহিরাগত মানুষদের ঘরের কাজে নিয়োগ করছে না ঠিকই কিন্তু যারা আপত্তি জানাচ্ছে তারা শুধুমাত্র বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলেনি।
অভিনেত্রীর পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য রকম প্রতিক্রিয়াও দেখা গেল। বেশ কয়েকজন লিখেছে যে ইচ্ছে থাকলেও তারা সন্তানকে নিজের হাতে মানুষ করতে পারে না কারণ তারা চাকুরিজীবী। এবং চাকরি, বিশেষত সরকারী চাকরি ছাড়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সরকারী চাকরি পেতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। শুধু তাই নয়, এই চাকরি স্থায়ী, নিরাপদ এবং এর বেতনকাঠামো উন্নত। সুতরাং, সেই চাকরি ছাড়ার কোন অর্থ হয় না। একজন প্রশ্ন করেছে, ‘সিংগল মাদার’ এর পক্ষে কিভাবে সম্ভব কাজকর্ম ছেড়ে বাড়িতে বসে বাচ্চা মানুষ করা? আরেকজন লিখেছে, অভিনেত্রীর স্বামী ভালো রোজগার করেন বলে তিনি কয়েক বছর কাজের জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেই পারেন কিন্তু বেশির ভাগ মহিলাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। আবার একজন লিখেছে, অভিনেত্রীর মতো সবাই যদি কোনও রকম সাহায্য ছাড়াই সন্তানপালন করতে শুরু করে তাহলে গরিব ঘরের মেয়েরা কাজ পাবে কি করে? আরেকজন প্রশ্ন করেছে, মাতৃত্বেই নারীর জীবনের চরম সার্থকতা নাকি?
অর্থাৎ একজন কর্মরতা নারী সন্তানের মা হলে তার কি কর্তব্য সেই বিষয়ে নানান মতামত পাওয়া গেল।
১। তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরো সময়টা সন্তানের জন্য দেওয়া ইচিত। নিজের হাতে, কোন ধরনের ‘পেড হেল্প’ এর সাহায্য ছাড়া, তার সন্তান লালনপালন করা উচিত। ক্রেশে দেওয়া বা আয়ার সাহায্যে মানুষ করাটা সন্তানকে অবহেলার নামান্তর। কর্মজগতে কয়েক বছর পরে ফেরা যেতে পারে কিন্তু সন্তান জন্মের অব্যবহিত পরে নৈব নৈব চ।
৪। চাকরি থেকে উপার্জন সংসার চালানোর জন্য জরুরি। তাই সন্তান লালনপালনের উদ্দেশ্যে চাকরি ছাড়ার ইচ্ছে থাকলেও ছাড়াটা সহজ নয়। সরকারি চাকরি ছাড়ার প্রশ্ন ওঠে না।
৫। একক মাতৃত্বের ক্ষেত্রে চাকরি করাটা আবশ্যক। কর্মজগত থেকে সরে আসার কোনও অবকাশ নেই।
৫। আয়াদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া উচিত।
৬। মাতৃত্ব জীবনের পরম সার্থকতার বিষয় নয়।
শেষের বক্তব্যগুলি সামান্য কয়েকজনের। সংখ্যাগরিষ্ঠ মহিলা অভিনেত্রীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছে অথবা চাকরি ছাড়ার ক্ষেত্রে নিরুপায়তার কথা জানিয়েছে।
যে কথাগুলো উঠে আসেনি সেটা হল নিদেনপক্ষে সরকারি ক্ষেত্রে এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মহিলা কর্মীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং child care leave (সন্তানের আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ৭৩০ দিনের ছুটি) পেয়ে থাকে। বহু কর্পরেট অফিসে ক্রেশ, নিজের পছন্দমতো কাজের সময় নির্বাচন করার সুযোগ (flexible working hours), ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ ( work from Home) থাকে। যেকথা উঠে আসেনি সেটা হল সন্তানের পিতারও ভূমিকা থাকে সন্তানপালনে। বোঝা যাচ্ছে আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত কর্মরত মেয়েরা মনে করে সন্তানপালন মায়ের একক দায়িত্ব। রাষ্ট্রও যে তাই মনে করে তার প্রমাণ চাইল্ড কেয়ার লিভ শুধু মহিলা কর্মীরাই পায় (অবশ্য সম্প্রতি single parent পুরুষদের child care leave দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে)। দ্বিতীয়ত, মেয়েদের আত্মনির্ভর হওয়াটা যে জরুরি বা মেয়েদের ঘরে বাইরে কোনও এক সন্তুষ্টিদায়ক কাজ বা সৃজনশীলতার ক্ষেত্র থাকতে পারে এবং মাতৃত্বর সঙ্গে তার যে কোন সংঘাত নেই এই কথাটি আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বহু মহিলা ভাবতে পারে না। তাছাড়া সন্তান জন্ম দেওয়ার পর মায়েরও বিশ্রাম প্রয়োজন, ঘুম এবং পুষ্টিকর খাদ্য প্রয়োজন। শিশুকে স্তন্যপান করালে এগুলো আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আমি মেয়ে হবার পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। আমার মেয়ের বাবা বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতো, মলমূত্র পরিষ্কার করত, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোলে নিয়ে বসে থাকত। আমার দেখাশোনা করার জন্য প্রথম থেকেই একজন আয়াদিদি ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি অপরিসীম ক্লান্তির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করতাম। যে কয় মাস ছুটিতে ছিলাম তখনও। অবশ্য আমার শরীর স্বাস্থ্য কখনোই মজবুত ছিল না। ধরে নিচ্ছি অন্য মায়েরা ক্লান্ত হয় না, রাতের পর রাত না ঘুমিয়েও তারা দিব্যি থাকতে পারে। তবু বুঝতে পারি না, কেন তারা মনে করে তাদের দশভুজা হয়ে সব কিছু একা হাতে সামলাতে হবে, কেন কাজ করার জন্য সে গর্বিত বোধ করবে, কেন তারা সন্তানের পিতাকে সমস্ত দায়িত্ব পালন থেকে অব্যহতি দিতে চায়, কেন কর্মজগতের আহ্বানকে অবজ্ঞা করতে হবে, কেন কর্মজগতের প্রতি দায়বদ্ধতাকে পেছনের সিটে বসিয়ে দিতে হবে, কেন চাকরির কারণে সন্তানকে আয়ার হাতে তুলে দিলে নিদারুণ অপরাধবোধে ভুগতে হবে। কেন চাকরি ছাড়তে না পারার জন্য আক্ষেপ করতে হবে। মাতৃত্বেই যেন নারী জীবনের পরম সার্থকতা। মাতৃত্বপ্রাপ্তি হলে জীবনের আর সব কিছু যেন নগণ্য, তুচ্ছ হয়ে যায়, নিদেনপক্ষে তুচ্ছ হয়ে যাওয়া উচিত। মনে পড়ে, আরেক অভিনেত্রী যখন তার শিশুসন্তানকে বাড়িতে রেখে তার স্বামীর সঙ্গে ভোটের প্রচারে নেমে করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন তিনি নেটমাধ্যমে সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। কেমন মা তিনি? সন্তানকে ফেলে রেখে বাইরে রাজকার্য উদ্ধার করতে যাওয়ার দরকার কি? আজকের দিনে দাঁড়িয়েও যে সমাজের এক বড় অংশ মহিলাদের চিন্তাভাবনা ঘোরতর পিতৃতান্ত্রিক খাতে বয়ে চলে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মাতৃত্বকে মহিমান্বিত করা যে মেয়েদের খাপের মধ্যে এঁটে রাখারই এক পিতৃতান্ত্রিক কৌশল তা বহু মেয়ে বুঝতে পারে না। তারা নিজেরা আদর্শ মা হয়ে ওঠার মরীয়া চেষ্টা করে এবং অন্যদের ওপর সেই আদর্শ চাপিয়ে দেয়। মেয়েরা যারা মা হতে পারেনি বা মা হতে চায় না অথবা যারা সন্তানপালন ও কর্মজীবনকে সমান গুরুত্ব দেয় তারা যেন নারীত্বের আদর্শ থেকে বিচ্যুত। মহীয়সী মায়েরা তাদের মধ্যে একটা অপরাধবোধ গেঁথে দেয়। এইভাবে তারা পিতৃতন্ত্রের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। পিতৃতন্ত্রের hegemony কে আরো জোরদার করে। যতই আমরা মেয়েদের স্বনির্ভরতার কথা বলি না কেন, তার অন্তর্লীন শক্তির পরিপূর্ণ বিকাশের কথা বলি না কেন, আত্মপ্রতিষ্ঠার কথা বলি না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর মন, মননে এখনো পিতৃতন্ত্রের খুঁটি বাঁধা। সে খুঁটি উপড়ে ফেলা খুব সহজ নয়।
একা হাতে সন্তানকে মানুষ করব – এই আস্ফালন অনেক সময় সন্তানের যন্ত্রণারও কারণ হয়ে ওঠে। সন্তানের শৈশব পেরিয়ে গেলেও মায়ের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয় না। মা তার জীবনের সব সিদ্ধান্তগুলো তার হয়ে নিতে চায়। বিয়ের পর বিবাহিত সন্তানের জীবনে অহেতুক মাথা ঘামায়। আমাদের যাদের সন্তান সাবালক হয়ে গেছে তারা বুঝি সন্তানরাও একটা বয়সের পর মা-বাবার থেকে দূরে থাকতে চায়, তাদের নিজস্ব একটা জগত কামনা করে। কিন্তু বহু মা চায়, তার সন্তান সারা জীবন তার আঁচলেই বাঁধা থাকুক। কারণ সন্তানের ওপর তার অধিকারই হয়ে ওঠে তার অস্তিত্বের একমাত্র যৌক্তিকতা। জীবনের আর সব ক্ষেত্র থেকে সে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে আদর্শ ‘মা’ হবার তাড়নায়। তার রান্নাও যে কখনও তার সন্তানের বিস্বাদ লাগতে পারে, তার সন্তানও যে তার স্নেহের শৃংখলে শ্বাসরুদ্ধ বোধ করতে পারে সে যখন বুঝতে পারে তখন হয়তো বড্ড দেরি হয়ে গেছে। গভীর এক শূন্যতাবোধে আক্রান্ত হয় সে।
শেষে বলি, আমি নিজে মন্দ মা। আমার মেয়েকে তিন বছর বয়স পর্যন্ত স্তন্যপান করিয়েছি ঠিকই, কিন্তু প্রথম থেকেই আয়াদিদির সাহায্য ছাড়া আমার চলেনি। আমি বাচ্চাকে ঠিক মতো দুধ খাওয়াতে পারতাম না, দুধের বাটি হাত থেকে পড়ে যেত। যদি ও পড়ে যায় এই ভয়ে কোলে তুলতে ভয় পেতাম। সন্তান হবার তিন মাস পরে কাজে ফিরে গেছি, বলাই বাহুল্য আয়ার হাতে বাচ্চাকে তুলে দিয়ে। ওর এক বছর বয়সের পর থেকে আমার গবেষণার জন্য লাইব্রেরি যাওয়া শুরু করেছি। অফ ডে-র দিনেও বেরিয়ে পড়তাম লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে। একবার রাতে মেয়েকে একা ঘরে শুইয়ে আমি কোথাও উঠে গেছিলাম। মেয়ে কি কারণে ভয় পেয়ে উঠে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমার শাশুড়ি বলেছিলেন, আমি কেমন মা? বাচ্চা ছেড়ে উঠে যাই? যে কয়েক বছর ছিলেন আমার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছেন আমি খুব মন্দ মা। উনি মেয়েকে চুল আঁচড়ে দিতেন, জামা-জুতো পরিয়ে দিতেন। অথচ মেয়ে তখন পারত সবই। আমি প্রতিবাদ করতাম, বলতাম মেয়েকে স্বাবলম্বী হতে দিন। তাই আমি হয়ে যেতাম খারাপ মা। মেয়ে একটু বড় হবার পর ওকে ছেড়ে সেমিনার কনফেরেন্সের যোগদান করার উদ্দেশ্যে একা একাই বিদেশ-বিভুঁইয়ে গেছি। কিছুদিন আগে একা ঘুরে এলাম দার্জিলিং। মেয়ে যেতে চায়নি সঙ্গে। কখনো সখনো আমি রান্না ঘরে ঢুকে মেয়ের পছন্দের কিছু রাঁধি ঠিকই কিন্তু মেয়ে ছোটবেলা থেকেই বহিরাগতের হাতের রান্নাই বেশি খায়। মেয়ের বাবাও মেয়েকে রান্না করে খাওয়ায়। তবে বাইরের মোমো আর বিরিয়ানি খেতে মেয়ে আরো ভালবাসে। একট বয়সের পর মেয়ে নিজেই পড়াশোনা করেছে। বেশি মাথা ঘামাইনি। আমি নিজের কাজে ব্যস্ত থেকেছি। মেয়েও মাথা ঘামানোটা পছন্দ করেনি। ভবিষ্যতে কি হবে জানি না, তবে আমার মেয়ে যদি কোনোদিন মা হয়, আমি জানি আমার মতোই মন্দ মা-ই হবে। আমার মতো মন্দ মা কে দেখেই ও বড় হয়েছে যে!
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক
ছবি : সংগৃহীত
0 Comments
Post Comment