সোভিয়েত মহিলা : তাঁর দেশের একজন পূর্ণ এবং সমান নাগরিক

  • 15 September, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 284 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
সোভিয়েত মহিলাদের ওপর সেই দেশের রাষ্ট্রের ভরসা, বিশ্বাস এবং চিন্তাকে ন্যায়সংগতভাবে মর্যাদা প্রদান করেছেন সেই দেশের মহিলারা। যুদ্ধের আগে শান্তিপূর্ণ সৃজনশীল শ্রমে, নাৎসি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের সময় এবং বর্তমানে নতুন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মোতাবেক পাহাড়প্রমাণ কাজ সম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সোভিয়েত নারীরা উচ্চমাত্রার বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। শিল্পের যে-সব শাখায় নারীশ্রমের প্রাধান্য রয়েছে, সেই শাখাগুলিই পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে।

এটি একটি সুপরিচিত সত্য যে, রাষ্ট্রের সক্রিয় গঠনকার্যে মহিলাদের অংশগ্রহণ করানোর ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতিক্রমী সাফল্য অর্জন করেছে। সাধারণভাবে স্বীকৃত এই সত্য নিয়ে আমাদের শত্রুরাও বিতর্ক করেন না। সোভিয়েত ইউনিয়নের একজন নারী তাঁর দেশের একজন পূর্ণ এবং (পুরুষের) সমান নাগরিক। সৃজনশীল কার্যকলাপের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করার জন্য আমাদের রাষ্ট্র একজন নারীর মা হিসাবে সন্তান লালন-পালন করার প্রাকৃতিক বাধ্যবাধকতা এবং বাড়ির কর্ত্রী হওয়া--এই দুই বিষয়ের সমস্ত প্রয়োজনীয় শর্ত একইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে।

গোড়া থেকেই সোভিয়েত আইন স্বীকৃতি দিয়েছে--মাতৃত্ব কোনো ব্যক্তিগত বিষয় নয়। বরং তা হল সক্রিয় এবং সমানাধিকারপ্রাপ্ত মহিলা নাগরিকের একটি সামাজিক কর্তব্য। এই প্রস্তাবটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্তও রয়েছে। মাতৃত্বের কোনো ক্ষতি না করে মহিলা শ্রমিকদের কীভাবে যে-কোনো ক্ষেত্রেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করানো যায়-- এই অন্যতম একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সোভিয়েত ইউনিয়ন।

পাবলিক ক্যান্টিন, কিন্ডারগার্টেন সংস্থা, তরুণ অগ্রগামী ক্যাম্প, খেলার মাঠ, ক্রেশ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রভূত মনোযোগ প্রদান করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি, যেমনটা লেনিন লিখেছিলেন, নারীমুক্তির অনুশীলনকে সহজতর করে এবং পুরুষের তুলনায় নারীর ন্যূন অধিকারভোগের বিষয়টি হ্রাস করার ব্যাপারেও বর্তমানে সক্ষম। সাত হাজারের বেশি নারী ও শিশুদের জন্য পরামর্শ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে ইউএসএসআর-এ, যার অর্ধেক গ্রামীণ এলাকায়। ২০ হাজারেরও বেশি ক্রেশ নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, জা়র শাসনের রাশিয়াতে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কেবল ১৯টি ক্রেশ ও ২৫টি কিন্ডারগার্টেনের অস্তিত্ব ছিল। আর এই ক্রেশ আর কিন্ডারগার্টেনগুলি কিন্তু রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিপালিত হত না, হত জনহিতকর সংগঠনগুলি দ্বারা।

মায়েদের সাহায্য করার উপকরণের সরবরাহ সোভিয়েত রাষ্ট্র বাড়িয়েই চলেছে। সন্তান জন্মের আগে ও পরে মহিলারা ভাতা এবং সবেতন ছুটি পান। ছুটি থেকে কাজে যোগ দেওয়া পর্যন্ত কাজের জায়গায় তাঁদের পদ তাঁদের জন্যই বহাল থাকে।

বড়ো পরিবার এবং এক-অভিভাবকের পরিবারগুলি তাদের সন্তানের ভরণ-পোষণ ও লালন-পালনের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা পায়। এই ধরনের ভাতা-প্রদানের ক্ষেত্রে ১৯৪৫ সালে রাষ্ট্র দু-হাজার মিলিয়ন রুবেলের চেয়েও বেশি অর্থ খরচ করেছে।কেবল RSFSR[1]-এতেই দশহাজারের বেশি মহিলাকে ‘জননী-নায়িকা’[2]সম্মাননা-উপাধিপ্রদান করা হয়েছে। আর ‘মাতৃত্বের গৌরব’[3] এবং ‘মাতৃত্বের পদক’ সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে এগারোশো হাজার মহিলাকে।

সোভিয়েত মহিলাদের ওপর সেই দেশের রাষ্ট্রের ভরসা, বিশ্বাস এবং চিন্তাকে ন্যায়সংগতভাবে মর্যাদা প্রদান করেছেন সেই দেশের মহিলারা। যুদ্ধের আগে শান্তিপূর্ণ সৃজনশীল শ্রমে, নাৎসি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের সময় এবং বর্তমানে নতুন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মোতাবেক পাহাড়প্রমাণ কাজ সম্পূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সোভিয়েত নারীরা উচ্চমাত্রার বীরত্ব প্রদর্শন করেছেন। শিল্পের যে-সব শাখায় নারীশ্রমের প্রাধান্য রয়েছে, সেই শাখাগুলিই পরিকল্পনা রূপায়ণের ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে। একইভাবে উল্লেখ করার যোগ্য--সোভিয়েত রাষ্ট্রে কৃষাণীদের বিরাট কৃতিত্ব। এই কৃষাণীরাই যুদ্ধের বছরগুলিতে নিজেদের কাঁধে বহন করেছিলেন কৃষিশ্রমের বেশিরভাগ বোঝা। 

আমাদের মহিলারা এখন সেই পেশাগুলি আয়ত্ত করে ফেলেছেন যা দীর্ঘ দিন ধরে পুরুষদের একচেটিয়া হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। যেমন আছেন মহিলা ইঞ্জিন-চালক, মহিলাযন্ত্রী, মহিলা লেদ-মেশিনচালক, মহিলা ফিটার-মিস্ত্রি। সবচেয়ে জটিল যন্ত্রচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বেশ সুশিক্ষিত মহিলাকর্মীরা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের নারীরাবিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও শিল্পকলাকে এগিয়ে নিতে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে কাজ করে চলেছেন। জাতীয়শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় তাঁরা একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন।

৩০ বছর আগে যে-দেশে ২৩০০ হাজার মহিলা কর্মীর মধ্যে ১৩০০ হাজার মহিলা ভৃত্য হিসাবে শহরে কাজ করতেন এবং ৭৫০ হাজার মহিলা গ্রামাঞ্চলে কাজ করতেন খামার-শ্রমিক হিসাবে, যে-দেশে বলতে গেলে কোনো মহিলা ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক প্রায় ছিলেনই না, যে-দেশে শিক্ষক পদে মহিলাদের নিয়োগের সঙ্গে যুক্ত থাকতো তাঁদের মর্যাদার প্রতি অবমাননাকর নানা শর্ত--সেই দেশে এখন ৭৫০ হাজার মহিলা শিক্ষক, ১০০ হাজার মহিলা ডাক্তার, ২৫০ হাজার মহিলা ইঞ্জিনিয়ার। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকই মেয়ে। ৩৩ হাজারের বেশি মহিলা গবেষণাগার এবং গবেষণা-প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। ২৫ হাজার মহিলার রয়েছে বিদ্যায়তনিক খেতাব ও ডিগ্রি। ১৬৬ জন মহিলাকে বিজ্ঞান এবং কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের কৃতিত্বের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-এ ভূষিত করা হয়েছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মহিলারা তাঁদের রাজনৈতিক অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ ঘটাচ্ছেন। ইউএসএসআর-এর সুপ্রিম সোভিয়েতে রয়েছেন ২৭৭ জন মহিলা ডেপুটি, যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার গ্রামীণ, শহুরে, আঞ্চলিক এবং প্রজাতান্ত্রিক বিভিন্ন সংগঠনে নির্বাচিত হয়েছেন ২৫৬ হাজার মহিলা ...

সোভিয়েত ইউনিয়নের নারীদের তাঁদের সরকারের কাছ থেকে কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, মাতৃত্ব সুরক্ষার অধিকার দাবি করার দরকার নেই। রাষ্ট্র নিজেই, সরকার নিজেই নারীদের কাজের দিকে টেনে আনছে। সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। মায়েদের সহায়তা প্রদান করছে, তাঁদের পুরস্কৃত করছে।

নাৎসি হানাদারদের আগ্রাসনের বছরগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নারীরা তাঁদের নিজের চোখে দেখেছিলেন--নাৎসিবাদের প্রতিটি চিহ্ন মুছে না যাওয়া পর্যন্ত নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে অক্লান্ত যুদ্ধ চালানোর প্রয়োজনীয়তা। নতুন যুদ্ধের হুমকি থেকে একমাত্র এটাই পৃথিবীকে রেহাই দেবে।

আজ আমাদের মুখ্য কাজ হল গণতন্ত্র ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম;তীব্র প্রতিক্রিয়া ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে নারীদের বিচ্ছিন্ন করে, তাঁদের ‘খাঁটি নারীত্ব’-এ বন্দি করার চেষ্টা করে নারীবাদী সংগঠনগুলি নারীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই কেবল দুর্বল করে দিতে পারে। গণতন্ত্রের জয়ই একমাত্র পারে নারীর সমতা নিশ্চিত করতে।

আমরা, সোভিয়েত ভূমির নারীরা, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দ্বারা নির্ধারিত পাহাড়প্রমাণ কাজ সম্পাদনের জন্য আমাদের সমস্ত শক্তি সৃজনশীল শ্রমে নিয়োজিত করছি এটা জেনে যে, এই কাজ করার মাধ্যমে বিশ্ব-জুড়ে শান্তির প্রাচীরকে শক্তিশালী করছি--সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ইউনিয়ন।

একইসঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের থেকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে এবং তাদের পরিকল্পনা, অভিপ্রায় ও গণতন্ত্রকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টাকে প্রকাশ করতে হবে।

প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামে, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতা ও শান্তির জন্য লড়াইয়ে গণতন্ত্রের সকল শক্তির সম্মিলিত ঐক্যই আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অস্ত্র।

 

 

[1]রুশসোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ১৫টি সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে জনবহুল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অংশটিই ‘রাশিয়ান ফেডারেশন’ রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

[2] ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে পর্যন্ত ‘Mother Heroine’ উপাধিটি প্রদান করা হত। এটি একটি সম্মান সূচক উপাধি বা শিরোনাম যা বড়ো পরিবারের ভরণ-পোষণ ও লালন-পালনের জন্য মহিলাদের দেওয়া হত। এই সম্মাননা প্রদানের উদ্দেশ্য গর্ভবতী নারীদের, বৃহৎ পরিবারের মায়েদের এবং একলা মায়েদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি।

[3]সোভিয়েতরাশিয়ার একটি নাগরিক সম্মান। বহু সন্তানবতী মায়েদের স্মরণের উদ্দেশ্য ১৯৪৪ সালের ৮ জুলাই থেকে এই সম্মান প্রদান অনুষ্ঠান শুরু হয়। জোসেফ স্টালিন ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তা।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment