বিবাহিত নারী (২৪)

  • 14 April, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 341 view(s)
  • লিখেছেন : চন্দন আঢ্য
মহিলারা, সাধারণত, স্বামীর আধিপত্যকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করলেও স্বামীকে ‘ধরে রাখতে’ চান। নিজের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেন। আর বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তিনি লড়াই করেন ‘পরিস্থিতি’ রক্ষা করার জন্য যা তাকে নির্ভরশীলতার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই দ্বৈত খেলাটি খেলা কঠিন। আর এই খেলাই আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে উদ্‌বেগ এবং স্নায়বিক দৌর্বল্যের অবস্থাকে--যার মধ্যে অনেক মহিলাই তাঁদের জীবন কাটান।

মহিলারা পছন্দ করেন যে, পুরুষরা এমন কেউ হবেন না যাঁর আত্মদর্শন আছে, বরং তাঁরা হবেন নিষ্ক্রিয় একটি শারীরিক অবয়ব। অস্তিত্বের বিরুদ্ধে মহিলারা নিশ্চিত করেন জীবনকে, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে নিশ্চিত করেন মাংসল মূল্যবোধকে। পুরুষালি উদ্যোগ বা প্রকল্পের প্রতি মহিলারা স্বেচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করেন পাসকালের হাস্যরসাত্মক মনোভাব। এটাও তাঁরা ভাবেন যে, “পুরুষদের সমস্ত দুর্ভাগ্যই আসে একটি জিনিস থেকে, সেটি হল কীভাবে একটি ঘরে বিশ্রাম করতে হয় তা না-জানা”। স্বেচ্ছায় পুরুষদের তাঁরা ঘরে বন্দি করে রাখবেন, পারিবারিক জীবনকে উপকৃত করে না এমন যে-কোনো কার্যকলাপই মহিলাদের বিদ্বেষকে উসকে দেয়। বার্নার্ড প্যালিসির স্ত্রী রাগান্বিত হন যখন তাঁর স্বামী আসবাবপত্র পুড়িয়ে দেন একটি নতুন এনামেল উদ্ভাবনের জন্য যেটি ছাড়া পৃথিবী এতদিন ভালোভাবেই চলে গেছে। শ্রীমতী রাসিন তাঁর স্বামীকে আগ্রহী করে তোলেন বাগানের গুজবেরিগুলির প্রতি। স্বামীর লেখা ট্র্যাজেডি পড়তে তিনি অস্বীকার করেন। ‘বৈবাহিক ইতিহাস’ গ্রন্থে জুয়ানদো নিজেকে প্রায়শই উত্তেজিতভাবে প্রকাশ করেছেন কারণ তাঁর সাহিত্যকর্মকে কেবলমাত্র বস্তুগত লাভের উৎস হিসাবেই বিবেচনা করার ওপরেই জোর দিয়েছিলেন এলিস।

আমি তাঁকে বললাম : আমার শেষ গল্পটি আজ সকালেই প্রকাশিত হয়েছে। বিদ্রুপকারী হতে চাইলেন না তিনি। সত্যি বলতে, শুধুমাত্র যা তাকে প্রভাবিত করে, তাই ধরেই তিনি উত্তর দেন : ভালোই হবে, অন্ততপক্ষে তিনশো ফ্রাঙ্ক বেশি এই মাসেতে পাওয়া যাবে।

এমনও হয় যে এই দ্বন্দ্বগুলি আরও তীব্র হতে হতে সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানো পর্যন্ত চলে যায়। কিন্তু মহিলারা, সাধারণত, স্বামীর আধিপত্যকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করলেও স্বামীকে ‘ধরে রাখতে’ চান। নিজের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেন। আর বাকি পৃথিবীর সঙ্গে তিনি লড়াই করেন ‘পরিস্থিতি’ রক্ষা করার জন্য যা তাকে নির্ভরশীলতার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই দ্বৈত খেলাটি খেলা কঠিন।আর এই খেলাই আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করে উদ্‌বেগ এবং স্নায়বিক দৌর্বল্যের অবস্থাকে--যার মধ্যে অনেক মহিলাই তাঁদের জীবন কাটান। স্টেকেল একটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ দেন :

শ্রীমতী জে. তে. যিনি কখনোই কামোত্তেজনা অনুভব করেননি, তিনি একজন বেশ সংস্কৃতিবান লোককে বিয়ে করেন। স্বামীর শ্রেষ্ঠত্বকে তিনি সহ্য করতে পারতেন না এবং স্বামী যে-বিষয়ে দক্ষ সেই বিষয়ে পড়াশোনা করে  তিনি স্বামীর সমকক্ষ হতে চান। ব্যাপারটি যেহেতু খুবই কষ্টের ছিল, তাই বাগ্‌দানের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁর পড়াশোনা ছেড়ে দেন। ভদ্রলোক বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এবং তাঁর অনেক ছাত্রীই তাঁর পেছনে ছুটতো। স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই হাস্যকর অর্চনায় অংশগ্রহণ করবেন না। সাংসারিক ব্যাপারে স্ত্রী ছিলেন অসংবেদনশীল এবং সেইরকমই রয়ে যান। কেবল তখনই হস্তমৈথুনের সাহায্যে স্ত্রীর অর্গাজম হত যখন তৃপ্ত স্বামী তাঁকে ছেড়ে দিতেন এবং স্বামীকে তিনি বিষয়টি বর্ণনা করতেন। আদর করে তাঁর মধ্যে স্বামীর উত্তেজনা জাগানোর প্রচেষ্টাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতেন ... শীঘ্রই স্বামীর কাজকে তিনি উপহাস করতে এবং ছোটো করতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেননি “এই হাবাগবা ছাত্রীগুলি কেন স্বামীর পেছনে দৌড়োচ্ছে। এই মহান ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবনের নেপথ্য-মঞ্চ তিনি জানতেন”। তাঁদের প্রতিদিনের ঝগড়ার মধ্যে এইরকম বাক্যবন্ধ আসতো : “হিজিবিজি লেখার মাধ্যমে আমার ওপর এটা তুমি চাপিয়ে দিতে পারো না”। অথবা: “তুমি মনে করো তুমি আমার সঙ্গে যা খুশি তাই করতে পারো কারণ তুমি একজন ভাড়াটে-লেখক”। স্বামী তাঁর ছাত্রীদের আরও বেশি করে যত্ন নিতে থাকেন। স্ত্রী নিজেকে ঘিরে নেন যুবক ছেলেদের দ্বারা। অন্য মহিলার প্রেমে স্বামীর পড়ার আগে পর্যন্ত স্ত্রী এভাবেই বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে যেতে থাকেন। স্ত্রী সর্বদা তাঁর স্বামীর এইসব ছোটো যোগাযোগকে সহ্য করে এসেছেন এবং এমনকি স্বামীর পরিত্যক্ত কিছু হতচ্ছাড়া ‘গোবেচারা’-দের সঙ্গে বন্ধুত্বও পাতিয়ে এসেছেন ... কিন্তু তারপর তিনি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেছিলেন এবং তরুণদের মধ্যে প্রথম আগমনকারীর কাছেই কোনো অর্গাজম ছাড়াই নিজেকে অর্পণ করেছিলেন। স্বামীর কাছে তিনি স্বীকার করেন যে, স্বামীর সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন। স্বামীও কোনো সমস্যা ছাড়াই বিষয়টি মেনে নেন। তাঁরা চুপচাপ আলাদা হতে পারতেন ... বিবাহ-বিচ্ছেদকে  স্ত্রী প্রত্যাখ্যান করেন। সেখানে ছিল একটি বিশাল ব্যাখ্যা এবং সমন্বয়সাধন ... স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং সেই প্রথম তীব্র অর্গাজম অনুভব করেন ..

আমরা দেখতে পাই যে, স্বামীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়ও স্বামীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা কখনও তিনি বিবেচনা পর্যন্ত করেননি।

‘স্বামী ধরা’ একটি শিল্প। তাঁকে ‘ধরে রাখা’-ও একটি পেশা। এর জন্য বেশ দক্ষতা লাগে। একজন বদমেজাজী অল্পবয়সি মহিলাকে একজন বোন বলেছিলেন : “সাবধান, মার্সেলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা রাগ প্রকাশ করলে তুমি তোমার অবস্থান হারিয়ে ফেলবে”। পুরস্কার এক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ : বস্তুগত এবং নৈতিক নিরাপত্তা, নিজের একটি ঘর, স্ত্রীর মর্যাদা, প্রেম এবং আনন্দের জন্য কম-বেশি একটি সফল বিকল্প। মহিলাটি দ্রুতই শিখে যান যে, তাঁর ইরোটিক আকর্ষণ তাঁর সবথেকে দুর্বল অস্ত্র। অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে তা নষ্ট হয়ে যায়। হায়! পৃথিবীতে আরও অন্যান্য কাঙ্ক্ষিত রমণীও আছেন। তাই তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান আকর্ষণীয় এবং মনোরম থাকতে। প্রায়শই তিনি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন তাঁকে কামোত্তেজনার দিকে ঠেলে দেওয়া গর্ব এবং কামুক উদ্দীপনার দ্বারা স্বামীকে তিনি সন্তুষ্ট করবেন এবং বেঁধে রাখবেন এই ধারণার মধ্যে। স্ত্রী তখনও নির্ভর করে থাকেন অভ্যাসের শক্তির ওপর নির্ভর করেন। নির্ভর করেন একটি মনোরম গৃহে স্বামী যে আকর্ষণ খুঁজে পান তার ওপর। নির্ভর করেন ভালো ভালো খাবারের প্রতি স্বামীর রুচি, বাচ্চাদের প্রতি স্বামীর কোমলতার ওপর। স্বামীকে ‘সম্মানিত’ করার জন্য নিজের বিনোদন বা পোশাক-পরিচ্ছদের দ্বারা নিজেকেই তিনি ব্যবহার করেন। নিজের পরামর্শ এবং ক্ষমতার দ্বারা তিনি চান স্বামীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে। স্ত্রী এই কাজ যতটা করতে পারেন, ততটাই তিনি নিজেকে অপরিহার্য করে তোলেন হয় সামাজিক সাফল্য বা নিজের কাজের দ্বারা। যদিও, সর্বোপরি, গোটা ঐতিহ্যই স্ত্রীদের শেখায় কীভাবে ‘পুরুষকে পাকড়াও করতে হয়’। স্ত্রীদের আবিষ্কার করতে হবে স্বামীর দুর্বলতা এবং সেই দুর্বলতাগুলির স্তবগান করতে হবে। দক্ষতার সঙ্গেই স্ত্রীদের চাটুকারিতা এবং অবজ্ঞা, নমনীয়তা এবং প্রতিরোধ, সতর্কতা এবং প্রশ্রয়দানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। শেষোক্ত মিশ্রণটি বিশেষভাবে সূক্ষ্ম। স্বামীকে খুব বেশি বা খুব কম স্বাধীনতা দেওয়া উচিত নয়। খুব আত্মতৃপ্ত হয়ে স্ত্রী দেখেন স্বামী তাঁকে এড়িয়ে যাচ্ছেন : অর্থ এবং প্রেমময় উদ্দীপনা যা স্বামী অন্য মহিলাদের সঙ্গে ব্যয় করেন, তা তাঁকে হতাশ করে। এই ঝুঁকিও স্ত্রীর থাকে যে স্বামীর কোনো উপপত্নী স্বামীর ওপর এতটা ক্ষমতা করলো যাতে সে বিবাহবিচ্ছেদ পেতে পারে বা অন্ততপক্ষে প্রথম স্থান অধিকার করতে পারে। এখন স্ত্রী যদি স্বামীকে তাঁর সমস্ত দুঃসাহসিক কাজ করতে নিষেধ করেন, স্বামীকে তাঁর নজরদারি এবং চাহিদার দ্বারা দাবিয়ে রাখেন, তাহলে স্বামীকে তিনি তাঁর নিজেরই গুরুতর শত্রু করে তুলতে পারেন। আসল ব্যাপার হল সুবিবেচনার সঙ্গে ছাড় দিতে জানা। স্বামী যদি ‘চুক্তিপত্রে কয়েকবার ছুরিও চালান’ তাহলেও চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে। কিন্তু অন্যান্য মুহূর্তে চোখ বড়ো করে খোলা রাখতে হবে। নির্দিষ্ট করে বললে, বিবাহিত মহিলারা অবিশ্বাস করেন অল্পবয়সি মেয়েদের--যারা, তাঁর মতে খুবই খুশি হবে, তাঁর ‘অবস্থান’ কেড়ে নিতে।

লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

ছবি : সংগৃহীত

0 Comments

Post Comment